হাতে কলম আসার আগেই তাঁর জীবনে সুর এসেছিল। প্রথমে বাঁশির রূপে। তারপর কণ্ঠসঙ্গীত ও অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র পরিবেশনের পথ ধরে। অসামান্য মধুর-কণ্ঠী গায়কের পাশাপাশি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় পারদর্শী ছিলেন একাধিক বাদ্যযন্ত্র বাজানােয়। যেমন গেয়েছেন, কীর্তন, বাউল, নিধুবাবুর টপ্পা, রবীন্দ্রসঙ্গীত, দাশরথি রায়ের গান, ভজন, বৈষ্ণব পদাবলী ইত্যাদি; পাশাপাশি বাজিয়েছেন বাঁশি, তবলা, হারমােনিয়াম, বেহালা, এসরাজ, পাখােয়াজ, সেতার।

জন্মগতভাবে সুরের পথ ধরে আপন খেয়ালে শরৎবাবুর জীবনে সঙ্গীত এসেছিল। পরিবেশ ও বন্ধুসঙ্গ অবশ্যই এতে ইন্ধন জুগিয়েছে। শরৎচন্দ্রের জীবনটাই তাে অদ্ভুত। ছােটবেলা থেকেই তাে তার নিদর্শনের শুরু। পরবর্তীকালে, বিরাট জনপ্রিয়তায় ঢাকা পড়ে, ‘অপরাজেয় কথাশিল্পী’ আখ্যা পেলেও, তাঁর এলােমেলাে জীবনযাপনে কোনও ছেদ পড়েনি। নারীর প্রতি সম্ভ্রম ও প্রেম, এক অদ্ভুত অবস্থানে বিরাজ করত তাঁর সত্তায়, তাঁর সাহিত্যে বিভিন্ন নারী-চরিত্র উদ্ভাবনে যা ধরা পড়ে। প্রথম জীবনে সঙ্গীতের পথে যেন প্রেমের এক অজানা পৃথিবীতে ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি। মনের কোনও বিশেষ অবস্থা, পরিবেশ, সঙ্গ ইত্যাদির উপর নির্ভর করত শরৎচন্দ্রের সঙ্গীত-পরিবেশন। অনুরােধ করলেই সবসময় তিনি গাইতেন বা বাজাতেন না। মনে হয় সুরের পথে কিছু পেতে চাইতেন তিনি, যা হয়তাে আসলে অধরা।

জন্ম হুগলির দেবানন্দপুরে হলেও শরৎবাবুর ছােটবেলার বেশিরভাগটাই কেটেছে ভাগলপুরে মামারবাড়িতে। এখানকার আদমপুর অঞ্চলের গাঙ্গুলিবাড়ি ছিল নামকরা শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চার পরিবেশ ভালরকমই ছিল। এ বাড়ির উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় পরবর্তীকালে ‘বিচিত্রা’ পত্রিকার সম্পাদক হন। শরৎচন্দ্রের মামা ছিলেন ইনি। আদমপুরের সঙ্গীত-আবহাওয়াও ছিল যথেষ্ট অনুকূল। এখানকার সুরেন্দ্রনাথ মজুমদার প্রসদ্দু মনােহর ঘরানার একজন ভারতবিখ্যাত শিল্পী। এঁরা ছ’ভাই, প্রত্যেকেই সঙ্গীতে পারদর্শী। এর মধ্যে রাজেন্দ্রনাথের প্রতিভা ছিল সবচেয়ে বেশি। খুব ভাল বেহালা ও বাঁশি বাজাতেন। কিন্তু প্রতিভা সেভাবে প্রকাশিত হতে পারল না, বেহিসেবি জীবনযাপনের জন্যে। শরৎচন্দ্রের তাে এরকম স্বভাব-বাউন্ডুলের সঙ্গেই ঘনিষ্ঠতা হবার কথা। হলও তাই। দিনরাত্রি রাজেন্দ্রনাথের ছায়াসঙ্গী হয়ে, নানারকম অদ্ভুত অভিজ্ঞতা লাভ হল তাঁর। সঙ্গে বাঁশি আর বেহালার প্রাথমিক শিক্ষাও জুটে গেল। এই রাজেন্দ্রনাথ মজুমদারই শরৎ-সাহিত্যের ‘রাজু’ ও ‘ইন্দ্রনাথ’ (শ্রীকান্ত – প্রথমপর্ব)।

Sarat_Chandra_Chattopadhyay
রাজুর সঙ্গে বেপরােয়া দিন কাটানাে শরতের খুব প্রিয় ছিল

রাজুর সঙ্গে বেপরােয়া দিন কাটানাে শরতের খুব প্রিয় ছিল। যাত্রা-কীর্তনের আসরে অনবরত হাজির হয়ে যেতেন তাঁরা। সুযােগ পেলেই সেখানে গানে বা বাজনায় অংশ নিতেন দু’জনে। কীর্তন শরৎকে ভীষণ টানত। একবার রাজুর সঙ্গে মনসুরগঞ্জে গেলেন কালীদাসী বােষ্টমির কীর্তন শুনতে। শুনে তাে শরৎ মােহিত। তিনিও গাইলেন। শরতের মধুর গলার গান শুনে বােষ্টমি যেন একটা টান অনুভব করলেন এই ছেলেটির প্রতি।

মাঝে একবার ভাগলপুর থেকে শরৎকে দেবানন্দপুরে আসতে হয়েছিল। সেখানে স্কুলেও ভর্তি হলেন। দিন কাটানাের পদ্ধতিতে অবশ্য কোনও তফাৎ ঘটল না। ভাগলপুরে গঙ্গা তাে এখানে সরস্বতী। গানছাড়া হলেন না শরৎ। এখানকার বন্ধু কাশীনাথের বােন ধীরুর সঙ্গে খুনসুটি, আপনমনে এধার-ওধার চক্কর কাটা তাে ছিলই; আর ছিল গান-বাজনা। যাত্রার আসরে ধীরুর সঙ্গে হাজির হতেন শরৎচন্দ্র। সুযােগ থাকলেই গান গাওয়া বা ঠেকা দেওয়া। ধীরুর প্রতি মনটাও একটু অন্যরকম হয়েছিল। কীর্তন-পাগল শরৎ একদিন সরস্বতীতে ডিঙি বেয়ে কৃষ্ণপুর গ্রামে রঘুনাথবাবার আখড়ায় কীর্তন শুনতে শুনতে রাত কাবারই করে দিলেন।

এরপর আবার ভাগলপুরে চলে আসা। তখন এক পূর্ব ঘটনার দরুন গাঙ্গুলিবাড়ির সঙ্গে প্রতিবেশী বাঁড়ুজ্যেবাড়ির প্রায় মুখ দেখাদেখি বন্ধ। কিন্তু, দু’বাড়ির ছােটদের আটকানাে যেত না। বিশেষ করে শরৎকে তাে নয়ই। বাঁড়ুজ্যে বাড়িতে প্রায়ই বসত ‘নব-হুল্লোড়’ নামে যাত্রাদলের আসর। শরৎ গান তাে গাইতেনই; উপরন্তু বাজাতেন বাঁশি, বেহালা, তবলা, হারমােনিয়াম। ভাগলপুরের আর্য থিয়েটারের হয়ে এক নারী চরিত্রে মধুর গান-সহ অভিনয় করলেন শরৎচন্দ্র। সবাই মোহিত। এবার, বন্ধু রাজুর সঙ্গে মিলে নতুন থিয়েটার দল তৈরি করে ‘মৃণালিনী’ নাটকে নাম ভূমিকায় অভিনয় করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিলেন। শরৎচন্দ্র বরাবরই ছিলেন শীর্ণ, রােগা চেহারার। কিন্তু গানের গলাটি মিষ্টতায় ভরপুর। ফলে, অল্পবয়সে নারী চরিত্রে তাঁকে ভাল মানাত।

এখানকার আদমপুর ক্লাবের সতীশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে যে থিয়েটার দল তৈরি হয়, শরৎ, রাজু সবাই তাতে অভিনয় করত। শরৎচন্দ্রের কদর ছিল তাঁর সঙ্গীত-কণ্ঠের জন্য। ‘বিল্বমঙ্গল’, ‘জনা’ ইত্যাদি নাটকে শরৎচন্দ্রের অভিনয় মাত করে দিত। আদমপুর ক্লাবের ডাকে কলকাতা থেকে মিনার্ভা থিয়েটারের দল ভাগলপুরে এসে ‘আলিবাবা’ মঞ্চস্থ করে। ‘বাবা মুস্তাফা’র চরিত্রে অভিনয় করেন স্থানীয় ছেলে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।

মাঝে একবার ভাগলপুর থেকে শরৎকে দেবানন্দপুরে আসতে হয়েছিল। সেখানে স্কুলেও ভর্তি হলেন। দিন কাটানাের পদ্ধতিতে অবশ্য কোনও তফাৎ ঘটল না। ভাগলপুরে গঙ্গা তাে এখানে সরস্বতী। গানছাড়া হলেন না শরৎ।

এবার ভাগলপুরে এসে আলাপ হল নীলার সঙ্গে। তার একটি এসরাজ ছিল। শরৎচন্দ্র সেটি চেয়ে নিজের কাছে নিয়ে এলেন। বেশিরভাগ সময় দরজা বন্ধ করে এসরাজ বাজিয়ে চলত শরতের গান গাওয়া। একদিন গাইলেন— ‘মথুরাবাসিনী মধুরহাসিনী..’। কিছুদিন পরে হঠাৎ নীলা মারা গেল কলেরায়। শরতের মনে হল এসরাজের তারগুলাে কে যেন ছিঁড়ে দিল। বুঝতে পারলেন নীলাকে মনে মনে ভালবেসে ফেলেছিলেন।

এদিকে শরৎচন্দ্রের নেতৃত্বে একটি সাহিত্যগােষ্ঠী গড়ে উঠল ভাগলপুরে। লেখালেখি একটু একটু করে শুরু করে দিয়েছিলেন। এই গােষ্ঠীতে একে একে জুটলেন শরৎচন্দ্রের দুই মামা সুরেন্দ্রনাথ ও গিরীন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ ভট্ট, ইন্দুভূষণ ভট্ট, যােগেশ মজুমদার প্রমুখ স্থানীয় সাহিত্যপ্রেমীর দল। বিভূতি ভট্টর বােন নিরুপমা দেবীও (পরবর্তীকালের বিশিষ্ট লেখিকা) ছিলেন এই দলে। সাহিত্যগােষ্ঠীর অন্যতম জমায়েতের জায়গা ছিল একটি গােরস্থানে। এমন স্থান-নির্বাচন শরৎবাবু ছাড়া আর কে-ই বা করতে পারেন! সাহিত্য নিয়ে পাঠ-আলােচনার পাশে এই দলে গান-বাজনাও হত নিয়মিত। শরৎ গভীর রাতে গােরস্থানে গেয়ে উঠতেন— ‘আমি দু’দিন আসিনি/ দু’দিন দেখিনি/ অমনি মুদিলি আঁখি…’। কোনও সময় গাইতেন নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের লেখা কীর্তন— ‘গােকুলে মধু ফুরায়ে গেল/আঁধার আজি কুঞ্জবন …’। এইসব গান শরৎ-কণ্ঠ মারফৎ ভেসে বেড়াত চরাচরে। কখনও বাজাতেন বাঁশি। আধাে ঘুমন্ত অবস্থায় এলাকার অধিকাংশ মানুষ বুঝতে পারতেন এ নির্ঘাত ন্যাড়াচন্দ্রের (শরৎচন্দ্রের ডাকনাম) কীর্তি।

সাঁওতাল পরগনায় সেটলমেন্টের চাকরিতে কিছুদিনের জন্য ঢুকলেন শরৎচন্দ্র। অস্থায়ী তাঁবুতে থাকতে হত। অবসর কাটাতে চুটিয়ে চলত গান-বাজনা। অবশ্যই মুখ্য শিল্পী শরৎচন্দ্র। সেখানকার রাজকুমার প্রায়ই আসতেন এই আড্ডায়। তিনিও ভক্ত হয়ে পড়লেন শরতের গানের। একবার এখানকার এক বড় মজলিসে আনা হল এক বিখ্যাত বাইজিকে। তাবড় কর্তাব্যক্তিরাও এসেছেন। রাজকুমারের পীড়াপীড়িতে শরৎচন্দ্র গাইলেন। বাইজি-সহ সবাই মুগ্ধ। এবার সেই বাইজির বীণা শুনে শরতেরও একই দশা। একটা যােগাযােগ তৈরি হল দু’জনের মধ্যে। একদিন সেই নারী শরৎচন্দ্রকে বললেন যে তিনি শিল্পী, এসব চাকরি-বাকরি তাঁর জন্য নয়। তাঁকে শিল্পের পথেই এগােতে হবে। কী মনে হল— চাকরি ছেড়ে দিলেন শরৎ। 

sarat-chandra-chaterjee
একদিন এক সন্ন্যাসীর সঙ্গে বাড়ি থেকে পালালেন

এরপর একদিন এক সন্ন্যাসীর সঙ্গে বাড়ি থেকে পালালেন। কিন্তু তাও বেশিদিন ভাল লাগল না। একা একা গিয়ে পড়লেন মজফফরপুরে। আশ্রয় মিলল সেখানকার বাঙালি ক্লাবে। কিছুদিনের মধ্যেই শরতের গান-বাজনায় ক্লাব মুখরিত হয়ে উঠল। একদিন শরৎচন্দ্র গলা খুলে গাইছিলেন। পাশের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা নিশানাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। গান কানে যেতে, ছুটে ক্লাবে গিয়ে শরতের সঙ্গে আলাপ জমালেন। সেইদিনই শরৎকে নিয়ে সােজা নিজের বাড়িতে। নিশানাথবাবু নিজে ভাল বেহালা বাজাতেন। এঁদের পুরাে বাড়িটাই গানপাগল। দাদা শিখরনাথ তখনই শরৎচন্দ্রের অল্প গজিয়ে ওঠা, সাহিত্যিক পরিচয়েরও খবর রাখতেন। এঁর স্ত্রী, পরবর্তীকালের বিশিষ্ট লেখিকা অনুরূপা দেবী, আগে থেকেই শরৎচন্দ্রকে চিনতেন। কারণ, তিনি ভাগলপুরের নিরূপমা দেবীর বান্ধবী। সুতরাং, সবদিক থেকেই এই বাড়িতে এক মর্যাদার আসন পেয়েছিলেন শরৎচন্দ্র। গানে গানে চমৎকার দিন কাটছিল।

 

আরও পড়ুন: রাজীব চক্রবর্তীর কলমে: তোমার সুরের ধারা ঝরে

 

কিন্তু, কোনওকালেই শরৎচন্দ্রের এক অবস্থা বেশিদিন পােষায়নি। এবারও তাই। এলাকার মহাদেব সাহু-র সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হল। মদ,গাঁজা অবাধে চলল। বারাঙ্গনাপল্লীতেও যাতায়াত নিয়মিত। অবশ্য, শুধুমাত্র সঙ্গীতের টানে। নিজের গান-বাজনাও অব্যাহত। বরং ক্ষেত্র আরও বেড়ে গেল। বাইজিদের গানের সঙ্গে শরৎচন্দ্রের বাঁশি— সে এক মন্ত্রমুগ্ধ করার মতাে ব্যাপার হত। মহাদেব সাহুকে কিন্তু এককথায় খারাপ লােক বলা যায় না। তাঁর অসম্ভব নেশাসক্তি থাকলেও, তিনি ছিলেন আসলে সুরপাগল। শরতের গানের একজন ভক্ত। কিন্তু, এতকিছু কি সকলে বােঝে? তাই স্বাভাবিকভাবেই শরতের এরকম এলােমেলাে দিনযাপনকে ভাল চোখে দেখলেন না নিশানাথবাবু ও তাঁর বাড়ির লােকেরা। শরৎচন্দ্রকে ভাবতে হল। এরপরেই শুরু হল তার বর্মার (এখন ‘মায়ানমার’) জীবন। সেখানে থাকাকালীন শরৎচন্দ্রের সঙ্গীত দক্ষতার তুঙ্গ প্রকাশ ঘটেছিল।

১৯০২ সালে শরৎচন্দ্র বর্মার রাজধানী রেঙ্গুনে (এখন ইয়াঙ্গন’) যান। প্রথম চাকরি পেলেন রেঙ্গুন থেকে দূরে উত্তর বর্মার পেগুতে পাবলিক ওয়ার্কস অ্যাকাউন্টসে। সেখানকার ডেপুটি এগজামিনার মণীন্দ্রকুমার মিত্র ছিলেন শরৎবাবুর গানের ভীষণ ভক্ত। অচিরেই চাউর হয়ে পড়ল শরৎচন্দ্রের এই গুণপনার কথা। তখন কিন্তু সেখানে তাঁর মূল পরিচয়ই সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে। সাহিত্যিক হিসেবে নয়। একদিন এক সান্ধ্য খানাপিনার আসরে সকলের অনুরােধে শরৎচন্দ্র গাইলেন কীর্তনাঙ্গের রবীন্দ্রসঙ্গীত – “ওহে জীবনবল্লভ/ওহে সাধনদুর্লভ…”। ওখানে উপস্থিত মণীন্দ্র মিত্র বলে উঠলেন, ‘শরৎদা আপনার গলায় নিশ্চয়ই জাদু আছে। কী মিষ্টি গলা আপনার!’ 

মিত্তিরমশাইয়ের চেষ্টায় শরৎচন্দ্র রেঙ্গুনে গিয়ে বেশি মাইনের চাকরিতে ঢুকলেন। সেখানে তাে গানে গানে ভরে উঠল তার জীবন। রেঙ্গুনে একমাত্র বাঙালিদের ক্লাব ‘বেঙ্গল সােশ্যাল ক্লাব’। ক্লাবের ঘরােয়া অনুষ্ঠানে গানবাজনা থাকবেই। প্রথমদিকে শরৎচন্দ্রের সঙ্গীত-দক্ষতার বিষয়ে অনেকেরই সম্যক ধারণা ছিল না। কিছুদিন পরে দেখা গেল, কোনও আসরই সম্পূর্ণ হয়ে উঠছে না, শরৎবাবুর সঙ্গীত ছাড়া। এরকমই এক আসরে তিনি গাইলেন জ্ঞানদাসের পদকীর্তন ‘তােমার গরবে গরবিনী রাই/রূপসী তােমার রূপে…’। যেন মধু ঝরল। সবাই সুরাচ্ছন্ন।

Sarat and Robi
রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে অত্যন্ত ভালবাসতেন শরৎচন্দ্র

শরৎচন্দ্রের প্রিয়তম ছিল কীর্তন। একজন স্বভাব-প্রেমিকের পক্ষে এটাই তাে স্বাভাবিক। শরৎচন্দ্রের কৃষ্ণ-মন ভালবাসার জন্য ছিল সর্বদাই অনুসন্ধানী। অবশ্য তিনি যে শুধুই কীর্তন গাইতেন না, তার প্রমাণ তাে এই নিবন্ধের শুরুর দিকেই আছে। রবীন্দ্রনাথের গান গাইতে অত্যন্ত ভালবাসতেন শরৎচন্দ্র। বারে বারে গেয়েছেন। তাঁর গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীতের মধ্যে যেসব গানের কথা জানা যায়— ‘ওহে জীবনবল্লভ’, জীবনে যত পূজা হল না সারা’, ‘এই করেছ ভালাে, নিঠুর হে’ প্রভৃতি। বিস্ময়ের সঙ্গে একটি প্রশ্ন মনে আসে। এই তিনটির মধ্যে প্রথম গানটি ১৮৯৩ ও পরের দু’টি ১৯১০ সালে লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। অন্যদিকে শরৎচন্দ্র ১৯১৬ সালে বর্মা থেকে ফিরে আর গান করেননি। সুতরাং ধরেই নেওয়া যায়, যা গান তিনি গেয়েছেন সবই তার আগে, যার মধ্যে ওই তিনটি রবীন্দ্রসঙ্গীতও ছিল। 

এখন প্রশ্ন হল, ১৯১৬ সালের আগে, যখন কলকাতার সঙ্গে সেভাবে শরৎচন্দ্রের যােগাযােগই তৈরি হয়নি, তখন দূর-দূরান্তে বসে তিনি, প্রায় সমসময়ে লেখা রবীন্দ্রনাথের গানগুলি সুরসহ পাচ্ছিলেন কীভাবে? রবীন্দ্রসঙ্গীত তাে তখন যত্রতত্র সেভাবে সহজলভ্য ছিল না! শরৎচন্দ্র ১৯১০ সালে বর্মায় থেকেও কী করে প্রায় একই সময়ে সৃষ্ট রবীন্দ্রসঙ্গীতগুলি সেখানে গাইছেন! পাওয়া হয়তাে সম্ভব। কিন্তু তা যে সেইসময় সহজে সম্ভব নয়, বলাই বাহুল্য। শরৎচন্দ্রের প্রতিভা ও সঙ্গীত-আসক্তি— এই দুইয়েরই যােগফল হয়তাে এটা, প্রচলিত ধ্যানধারণায় যা অননুমেয়।

১৯১৬ সালে বর্মা থেকে ফিরে শরৎচন্দ্র নিজেকে সরাসরিভাবে সঙ্গীতজগতের সঙ্গে আর যুক্ত রাখলেন না। এও ধরে নেওয়া যায়, যেহেতু এই সময় থেকেই সাহিত্যরচনায় সম্পূর্ণ মনােনিবেশের শুরু (সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতেও জড়ালেন কিছুদিনের জন্য), রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যােগাযােগও এখন থেকেই শুরু হওয়াটাই স্বাভাবিক। যাঁর গান শরৎচন্দ্র এর কিছুদিন আগেও মনপ্রাণ ঢেলে গাইতেন, কোনওদিন শােনা যায়নি, সেই গানের সৃষ্টিকর্তাকে তিনি কখনও গান শুনিয়েছিলেন বলে। আশ্চর্য! একবারও কি ইচ্ছে হয়নি? কবিও কি জানতেন শরতের এই শিল্পীসত্তার কথা?

যা মনে হয়, সঙ্গীতের বিষয়টি তিনি অন্তরে রাখতেই হয়তাে ভালবাসতেন। উপযুক্ত পরিবেশ ও বিশেষ টান ছাড়া প্রকাশ্যে আনতে চাইতেন না। শরৎচন্দ্র তাঁর গান গাইবার বৈশিষ্ট্যটি কতখানি লুকিয়ে রাখতে চাইতেন, তার জ্বলন্ত প্রমাণ ছিল রেঙ্গুনে কবি নবীনচন্দ্র সেনের সংবর্ধনা সভা। ১৯০৫ সালে রেঙ্গুনের ‘বেঙ্গল সােশ্যাল ক্লাব’ নিয়ে এল কবি নবীনচন্দ্র সেনকে। কবির এই সংবর্ধনা সভায় অভ্যর্থনা সঙ্গীতই গেয়েছিলেন শরৎচন্দ্র ‘এসাে কবিবর এসাে হে/… এসাে সুন্দর, এসাে শােভন/এসাে বঙ্গ হৃদয়ভূষণ/… প্রীতি পুষ্পাঞ্জলি লহ হে…।’ এছাড়াও গাইলেন রবীন্দ্রনাথের গান। তবে সামনে থেকে নয়। সবই মঞ্চের পিছনে পর্দার আড়াল থেকে। নবীন সেন তাে গান শুনে, নিয়ে আসতে বললেন গায়ককে। কিন্তু তিনি তাে ততক্ষণে পগারপার। 

Nabinchandra-Sen
রেঙ্গুনে নবীনচন্দ্র সেনের সংবর্ধনা সভায় অভ্যর্থনা-সঙ্গীত গেয়েছিলেন খোদ শরৎবাবু

সেবার বেশ কয়েকদিন তার ব্যারিস্টার ও সুগায়ক পুত্র নির্মলচন্দ্রকে নিয়ে বর্মায় ছিলেন নবীনচন্দ্র। বারে বারে একে তাকে বলতেন, “ওহে, সে ছােকরাটি কোথায় থাকে হে, রবির গান সে বড়াে চমৎকার গায়।” অবশেষে সুযােগ মিলল। ওই সময় রামকৃষ্ণ সেবক সমিতির উদ্যোগে রেঙ্গুনে এসেছিলেন স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ (ইনি শশী মহারাজ; শ্রীরামকৃষ্ণের বারােজন শিষ্যের অন্যতম)। এঁর সংবর্ধনা সভায় এলেন পুত্র নির্মলচন্দ্র-সহ কবি নবীন সেন। শরৎচন্দ্রও এসেছেন। তাঁকে দেখেই নবীনচন্দ্র বলে উঠলেন, ‘আপনার গান শােনবার আশায় আমি তৃষিত চাতকের মতাে লালায়িত হয়ে আছি।’ শুনে শরৎচন্দ্র বললেন, “আজ আমি গান শােনাতে আসিনি, আপনার পুত্র সুকণ্ঠ নির্মলচন্দ্রের গান শুনতে এসেছি।” আবার নবীনচন্দ্র-শরৎচন্দ্রের সঙ্গে নির্মলচন্দ্রের তুলনা হতে পারে না। এবার মুখ খুললেন স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ। কিছুদিন আগেই যাঁর রেঙ্গুনের রামকৃষ্ণ আশ্রমে শরৎ-কণ্ঠে রামকৃষ্ণ বন্দনা (‘এসাে-সবে মিলে গাই কুতূহলে রামকৃষ্ণ গুণগান…’) শােনার অভিজ্ঞতা হয়েছিল। তিনি বললেন- “আজ এখানে একত্রে নবীনচন্দ্র, নির্মলচন্দ্র ও শরৎচন্দ্রের উদয় হয়েছে বটে, কিন্তু আমি শরৎ সুধাই পান করতে চাই।” 

এরপর আর কথা চলে না। অর্গান বাজিয়ে শরৎচন্দ্র গাইলেন— “আমার রিক্ত শূন্য জীবনে সখা / বাকি কিছু নাই / ও দাও বাঁচিবার মতাে / তার বেশি নাহি চাই…।’ যেন সুরলােক থেকে সঙ্গীত নেমে এল। স্বামীজী স্তব্ধ। উপস্থিত সবাই তন্ময়তায় বিভাের। নীরবতা ভাঙলেন ‘পলাশির যুদ্ধ’-র কবি— ‘আপনার গানের ভাব-উদ্দীপনায় সেই চিরসুন্দরকে মনে করাইয়া দেয়, রেঙ্গুন শহরে এমন রত্ন লুকানাে ছিল জানতাম না। আমি আজ আপনাকে “রেঙ্গুন রত্ন” উপাধি দিলাম।’ 

 

আরও পড়ুন: শ্রীদর্শিনী চক্রবর্তীর কলমে: ক্ষয় নেই সঙ্গীত মার্তণ্ডের

 

শরৎচন্দ্রের সেই অর্থে কোনও তালিম ছিল না। সঙ্গীত বইত রক্তে। পাশাপাশি প্রেমে ভরপুর হৃদয়। এই দুইয়ে মিলে তাঁর সঙ্গীত-কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে আসত ভাবপ্রধান গান। উস্তাদি কসরতের জায়গা সেখানে ছিলই না। সবটাই অনুমান হলেও, মনে হয় শরৎবাবুর রােমান্টিক সত্তা যে গানের জন্ম দিত, তা মেলোডি-নির্ভর ভাবধর্মী। উত্তেজনা সেখানে ছিল না। ছিল তন্ময়তা। গান গাইতে গাইতে তিনি শিহরিত হতে থাকতেন, ঘন ঘন চোখ ভরে উঠত জলে।

পরবর্তীকালে, যখন সঙ্গীত থেকে তিনি অকস্মাৎ সরে গেলেন, তখন নিজের প্রিয় গান শুনতে চাইতেন পছন্দের গায়কদের কাছ থেকে। তার মধ্যে, ভাগলপুরের রাসবিহারী দাসের গলায়, ‘বহুদিন পরে বঁধূয়া আইলে / দেখা না হইত পরান গেলে…’ এবং ‘বলি ও কুব্জার বন্ধু / তােমায় রাধানাথ আর বলব না হে…’ এই কীর্তন দু’টি ছিল তাঁর ভীষণ প্রিয়। কিন্তু, স্থির হয়ে শুনতে পারতেন না। অঝােরে কাঁদতেন। ছটফট করতেন। পুরাে গান না শুনেই সরে যেতেন সেখান থেকে। এরকম, প্রেমিক-মন সঙ্গীতে হাবুডুবু খাবে না তাে কী!

আগে উল্লিখিত গানগুলি বাদে শরৎচন্দ্রকে গাইতে শােনা যেত, ‘কোথা ভবদারা / দুর্গতিহরা’, ‘আমার সাধ না মিটিল’ ইত্যাদি আরও নানা ধরনের গান এবং একাধিক রবীন্দ্রসঙ্গীত। বাজিয়েছেন অনেকরকম বাদ্যযন্ত্র। এরকম একজন সঙ্গীত-দক্ষ মানুষ রেঙ্গুন থেকে ফিরে একেবারে হঠাৎই সরে পড়লেন সঙ্গীতজগৎ থেকে। আত্মনিয়ােগ করলেন সাহিত্যে। কিছুদিনের জন্য জড়ালেন সক্রিয় রাজনীতিতেও। কিন্তু, গান কেন আর তিনি গাইলেন না, এ এক গভীর রহস্য। কারণ খুঁজতে যাওয়া বােকামি। কিন্তু, গান তিনি শুনতেন। ভাগলপুরের রাসবিহারী দাস ছাড়াও দ্বিজেন্দ্রপুত্র দিলীপকুমার রায়ের কাছ থেকে শুনতে চাইতেন বিভিন্ন গান। দিলীপকুমারের গলায় দ্বিজেন্দ্রলালের, ‘ও কে গান গেয়ে গেয়ে চলে যায় / পথে পথে ঐ নদীয়ায় / ও কে নেচে নেচে চলে / মুখে হরি বলে / ঢলে ঢলে / পাগলেরই প্রায়’ গানটি শরৎচন্দ্রকে সত্যিই পাগল করে দিত।

তিনি ঈশ্বর-বিশ্বাসী ছিলেন না। কিন্তু, রাধাকৃষ্ণকে কেন্দ্র করে বৈষ্ণবচিন্তা থেকে উঠে আসা প্রেমের আবেশ, শরৎবাবুকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়েছিল। তাই কীর্তন ছিল তাঁর প্রিয়তম সঙ্গীত। একই কারণে বােধহয় প্রচলিত অর্থে নাস্তিক হয়েও, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের দেওয়া একটি রাধাকৃষ্ণের মূর্তির সামনে ধ্যানস্থ হয়ে অনেকক্ষণ কাটাতেন। চোখ দিয়ে জল পড়ত। ধারে কাছে ফুল-বেলপাতা-ধূপধুনাে জাতীয় পুজো-উপকরণের বালাই ছিল না। রাধাকৃষ্ণ তাঁর কাছে নিছক ঈশ্বরের মূর্তি ছিল না। এক প্রেমের প্রতীক হিসেবেই হয়তাে এই যুগলকে অনুভব করতেন শরৎচন্দ্র। সঙ্গীতের মাধ্যমে এই দুনিয়ায় পৌছবার জন্যই তাঁর প্রিয়তম ছিল কীর্তন।

Sharatchandra
১৯১৬-র পর থেকে শরৎচন্দ্রের কোনও প্রত্যক্ষ সঙ্গীত সংযােগের কথা জানা যায় না

একবার হরিদাস শাস্ত্রীমশাই শরৎচন্দ্রকে জিজ্ঞাসা করেন যে, লােকে যে তাঁর চরিত্র নিয়ে নানা কথা বলে, সে সম্বন্ধে তাঁর নিজের বক্তব্য কী? শরৎবাবুর প্রতিক্রিয়া― “নারীজাতি সম্বন্ধে আমার চরিত্র কোনােকালে উচ্ছঙ্খল ছিল না, এখনও নয়। নেশার চূড়ান্ত করেছি, অনেক অস্থানে কুস্থানে গিয়েছি, কিন্তু তুমি সেসব জায়গায় খবর নিয়ে জানতে পার, তারা সকলেই আমায় শ্রদ্ধা করত।… যাকে ভালােবাসতে পারি নে, তাকে উপভােগ করার লালসা আমার দেহে ওঠেনি কখনও।… বিশ্বকবির গানটা তােমার মনে আছে কী?— “কখনাে, কুপথে যদি / ভ্রমিতে চাহে এ হৃদি / অমনি ও মুখ স্মরি / শরমেতে হই সারা…।’ 

শাস্ত্রীমশাই এর মানে জানতে চাইলে, শরৎবাবু বললেন— “মানেও শুনতে চাও? আচ্ছা শােন। প্রথম যৌবনে আমি একটি মেয়েকে ভালােবেসেছিলাম। ভালােবাসা নিষ্ফল হল। কিন্তু সমস্ত উচ্ছৃঙ্খলতার মধ্যে সে এসে চিরদিন দাঁড়িয়েছে আমার সামনে। সশরীরে যে নয়, তা তােমায় বােঝাতে হবে না বােধ হয়…।’ রবীন্দ্রনাথের ‘তােমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা..’ গানটির শেষ দু’টি লাইন স্মৃতি থেকে বলতে গিয়ে হয়তাে কিছু শব্দের গন্ডগোল করে ফেলেছিলেন শরৎবাবু (ঠিক লাইন, “কখনাে বিপথে যদি / ভ্রমিতে চাহে এ হৃদি / অমনি ও মুখ হেরি / শরমে সে হয় হারা…’)। কিন্তু, এসব সত্ত্বেও এখান থেকে আসলে স্পষ্ট হয় শরৎচন্দ্রের সুরমানসচিত্র।

সঙ্গীত থেকে সক্রিয় যােগাযােগ ছিন্ন করার পর দু’একটি মাত্র ব্যতিক্রমী ঘটনা জানা যায়, যার মধ্যে একটি তাঁর তবলা বাজানো সংক্রান্ত। শোনা যায়, কলকাতার একটি অনুষ্ঠানে তবলচির অভাব পূরণ করেছিলেন শরৎচন্দ্র। আর একবার তার সামতাবেড়ের বাড়িতে এক ঘরােয়া বৈঠকে ওখানে উপস্থিত এক সেতার বাদকের সেতার নিয়ে বাজিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। এগুলাে ছাড়া ১৯১৬-র পর থেকে শরৎচন্দ্রের কোনও প্রত্যক্ষ সঙ্গীত সংযােগের কথা জানা যায় না।

তবে হঠাৎই গান-বাজনার সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পর্কে ছেদ টানলেও, বাংলা নাট্যজগতের সঙ্গে শরৎচন্দ্রের যোগাযোগ বেশ প্রত্যক্ষ ছিল। কারণ, তাঁর একাধিক গল্প নিয়ে নাটক হয়েছে। বিশেষত শিশির ভাদুড়ির সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিল কিছুটা বেশিই। তাঁকে ভরসাও করতেন খুব। ১৯২৭ সালে নাট্যমন্দিরে মঞ্চস্থ হয় শরৎচন্দ্রের ‘দেনাপাওনা’-র নাট্যরূপ ষোড়শী। অসামান্য মঞ্চসফল এই নাটকের পরিচালনা ও অভিনয়ে ছিলেন শিশির ভাদুড়ি। এই নাটকে ভিখারি চরিত্রের একটি গান লিখে দেবার জন্য শরৎচন্দ্র প্রথমে অনুরোধ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথকে। কিন্তু তা বাস্তবায়িত না-হওয়ায় শরৎবাবু নিজেই লেখেন সেই গান- ‘তোর পাওয়ার সময় ছিল যখন/ ওরে অবোধ মন/ মরণখেলার নেশায় মেতে রইলি অচেতন/ তখন ছিল মণি, ছিল মানিক পথের ধারে ধারে/ এখন ডুবল তারা দিনের শেষে বিষম অন্ধকারে।’ 

sisir-bhaduri
শিশির ভাদুড়ির অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন শরৎচন্দ্র

নিজে গান-বাজনা ছেড়ে দিলেও কথা বলতে বলতে গানের লাইনের উল্লেখ, নিয়মিত গান শােনা, সঙ্গীত সংক্রান্ত মূল্যবান মন্তব্য-মতামত— এইসব শরৎচন্দ্রের কাছ থেকে বরাবর পাওয়া গেছে। ১৯২৭ সালে কলকাতা বেতার শুরু হলে, কর্তৃপক্ষ প্রতি বছর শরৎচন্দ্রর জন্মদিনে ‘শরৎ-শর্বরী’ নামে একটি অনুষ্ঠান সম্প্রচার করত। শরৎবাবু কয়েকবার সশরীরে উপস্থিত ছিলেন এই অনুষ্ঠানে। তাঁর একটি নিজস্ব রেডিয়াে সেট ছিল। সামতাবেড়ের বাড়িতে নিয়মিত রেডিয়াে শুনতেন। প্রধান পছন্দ ছিল সঙ্গীত। 

রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে একবার ‘বিচিত্রা’-সম্পাদক উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় (শরৎবাবুর মামা) মন্তব্য করলেন যে, বাণীর জোরালাে উপস্থিতি অনেক ক্ষেত্রে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে মুক্ত পথে সুরের প্রকাশে বাধা দেয় ফলে গান যেন শেকলে বাঁধা পড়ে। শরৎচন্দ্র শুনে বললেন, ‘… তােমরা গানের জানাে কী শুনি। আজীবন যিনি করলেন গানের চর্চা, যাঁর গানের নেই তুলনা, তার সঙ্গে… ভারি অন্যায়, এ কী তােমাদের!… উপীন, তােমরা ভুলে যাচ্ছ যে, বাংলা গানের কথাটাকে অস্বীকার করার উপায় নেই; ওটা কবির কথায় শিল্পীত প্রদীপের মুখে শিখা। সংগীতের ওস্তাদেরা কথাকে আমল না দিয়ে সুরকে বড়াে করেন– এই তাে? কিন্তু কথা তাে বাদ দিতে পারেন না। তােমরা যদি কথা বাদ দিয়ে তেলেনা গাও, দেখবে শ্রাতার সম্পূর্ণ অভাব হয়েছে। ওস্তাদি গানের চরম উদ্দেশ্য হতে পারে সুর, কথা নয়; কিন্তু সেখানেও মুশকিল দাঁড়ায় সুরের কুস্তি নিয়ে। সেটা করা শক্ত হতে পারে; কিন্তু সেখানেও সংগীত শৃঙ্খলিত।… বাংলা গানের নিজের বিশেষত্ব আছে সেটাকে আমি বলব নিজের প্রতিভা। আধুনিক বাংলা গানের আলােচনা করতে বসে তােমাদের বাংলা গানের অতীতটা বাদ দিলে বিচার হয় না, হয় গা-জুরি। বাংলার কীর্তন গান বাদ দিলে বাঙালির থাকে কী? সুর আর কথার আদর্শ সাহচর্য-র কথাই রবিবাবু বলেছেন। তােমাদের বয়স হলে বুঝতে পারবে। এখন পারছ না— তাই তর্ক করছ…’। 

এরকম একজন স্বচ্ছ গভীর সঙ্গীতবােধসম্পন্ন মানুষের হাত দিয়ে কেন শুধুমাত্র ‘ভারতীয় উচ্চ-সংগীত’ (ভারতবর্ষ ১৩৩১ ফাল্গুন) ছাড়া আর সেভাবে একটিও সঙ্গীত বিষয়ক প্রবন্ধ বেরলাে না, তাও যথেষ্ট বিস্ময়কর ও আপশোসের। এসব থেকে পরিষ্কার, হয়তাে প্রকাশ্যে শরৎচন্দ্র সঙ্গীত থেকে দূরে সরে গিয়েছিলেন। কিন্তু অন্তরে নয়। তাঁর শেষ প্রকাশিত উপন্যাস (‘যমুনা’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে লেখা ‘আগামীকাল’ উপন্যাস শেষ করতে পারেননি) ‘শেষ প্রশ্ন’-তে ‘শিবনাথ’ চরিত্র সম্বন্ধে এক জায়গায় শরৎচন্দ্র লিখছেন, “শিবনাথ মদ্যপায়ী মাতাল হওয়ার জন্য কলেজ থেকে বিতাড়িত, বেশ্যালয়েও সে মাঝেমধ্যে যায়, তথাপি সে উঁচুদরের গায়ক, তাই এতগুলি সব গুণ থাকা সত্ত্বেও বড়াে বড়াে মজলিসে তার ডাক পড়ে।” শিবনাথ’ যে শরৎচন্দ্র নিজেই— তা কি আর বলতে হয় ? তার মানে শেষজীবন পর্যন্ত সঙ্গীত তাে তাঁর অন্তরে ছিলই! বিচ্ছিন্নতা কোথায়?

*ছবি সৌজন্য: Wikipedia, Pinterest, Bangaliana.com, Wikimedia commons
*তথ্যঋণ:
১. বিশ্বনাথ দে সম্পাদিত শরৎ স্মৃতি – সাহিত্যম, বৈশাখ ১৩৯৬
২. ছন্নছাড়া মহাপ্রাণ – বিষ্ণু প্রভাকর (অনুবাদ: দেবলীনা বন্দ্যোপাধ্যায় কেজরিওয়াল) – ওরিয়েন্ট লংম্যান, মহালয়া ১৩৮৪
৩. শরৎ রচনাবলী পঞ্চম খণ্ড – শরৎ সাহিত্য সমিতি

Aveek Chottopadhyay Author

জন্ম ১৯৬৫-তে কলকাতায়। বেড়ে ওঠা চন্দননগরে। স্কুল জীবন সেখানেই। কলকাতার সিটি কলেজ থেকে স্নাতক। ছোটো থেকেই খেলাধূলার প্রতি আগ্রহ। গান শেখাও খুব ছোটো থেকেই। তালিম নিয়েছেন রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের কাছেও। দীর্ঘদিন মার্কেটিং পেশায় যুক্ত থাকার পর, গত বারো বছর ধরে পুরোপুরি লেখালেখি, সম্পাদনার কাজে যুক্ত। পুরনো বাংলা গান, সিনেমা, খেলা ইত্যাদি বিষয়ে অজস্র প্রবন্ধ লিখেছেন। আনন্দবাজার পত্রিকা, এই সময়-সহ বহু পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন। সম্পাদিত বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য উত্তমকুমারের "হারিয়ে যাওয়া দিনগুলি মোর", হেমন্ত মুখোপাধ‍্যায়ের "আনন্দধারা", রবি ঘোষের "আপনমনে", মতি নন্দীর "খেলা সংগ্রহ"। লিখেছেন "সংগীতময় সুভাষচন্দ্র" বইটি। সাত বছর কাজ করেছেন "মাতৃশক্তি" ও "জাগ্রত বিবেক" পত্রিকায়। বর্তমানে নিজস্ব লেখালিখি ও সম্পাদনা নিয়ে ব্যস্ত।

2 Responses

  1. শরৎচন্দ্রের গানের কোনো রেকর্ডিং মনে হয় নেই।থাকলে এই প্রজন্ম এক বিরল সংগ্রহের সাক্ষী হতে পারতো। সুন্দর লেখা

  2. শরৎচন্দ্রের সঙ্গীতপ্রিয়তার কথা জানা থাকলেও তিনি নিজে যে এত ভাল গাইয়ে ছিলেন বা বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের পারদর্শী ছিলেন জানা ছিল না।
    কথাশিল্পীর চরিত্রের আর এক দিকের বহু অজানা তথ্য উন্মোচিত হল এই প্রবন্ধে। লেখাটির জন্যে অভীককে অশেষ ধন্যবাদ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *