রাত্রিবেলা টিভিতে খবর দেখতে দেখতে খাওয়া আমার বহুদিনের অভ্যাস। হঠাৎ বজ্রপাতের মতো খবরটা ভেসে এল। শাঁওলিদি চলে গেছে। এত আকস্মিক, এত অভাবিত, যে খানিকক্ষণ কথা বলতে পারিনি। ওর সম্পর্কে কোনও খবরই তো আর কানে আসত না। অসুস্থ ছিল বলে আবছাভাবে শুনেছিলাম, কিন্তু সে অসুস্থতা যে প্রাণঘাতী হতে পারে, তা মনের কোণাতেও আসেনি। এখন একে একে খবর আসছে। নিউমোনিয়ায় ভুগছিল। বেশ কিছুদিন আগেই নাকি ইচ্ছাপত্র তৈরি করে রেখেছিল। সবথেকে বড় কথা, ডাক্তার বলেছিল, বাইপাস সার্জারি করাতে, শাঁওলিদি পাত্তা দেয়নি। মৃত্যুকে স্বীকার করে নেবার একটা ছবি উঠে আসছে না এর ভেতর থেকে? কোথাও কি বিদায় চাইছিল ভেতরে ভেতরে? কিন্তু এ সব অনুমানের আর কোনও মানে নেই।

আমি যে শাঁওলি মিত্রকে চিনতাম, সে আজকের এই পাকা চুলের অসম্ভব আভিজাত্যময় বয়স্কা শাঁওলি মিত্র নন। আমার তখন আঠারো উনিশ, তার মানে শাঁওলিদি তখন পাঁচিশ-ছাব্বিশ। বহুরূপী পর্বেই ওর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল, পরে পঞ্চম বৈদিক পর্ব এবং তার পরের পর্ব থেকে আস্তে আস্তে সে যোগাযোগ ছিন্ন হতে থাকে। বেশ, তাকে চিনতে না-পারার একটা গল্প দিয়ে শুরু করি আজকের এই স্মৃতিকথা। তখন ক্লাস এইটে পড়ি। ঠাকুমার কাছ থেকে এক টাকা আদায় করে অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসের দোতলায় বসে দেখছি বহুরূপীর ‘বাকি ইতিহাস’। 

Shaoli Mitra with Sambhu Mitra
বাবা শম্ভু মিত্রের সঙ্গে শাঁওলি মিত্র

ওই তো তৃপ্তি মিত্র, বাসন্তীর চরিত্রে অভিনয় করছেন। বাসন্তী তার লেখা একটা গল্প পড়তে শুরু করে মঞ্চে, কয়েক পলকের জন্যে অন্ধকার হয়ে যায়, কড়া নাড়ার শব্দে আলো ফুটলে বেণী দোলানো যে যুবতী ছুটে এসে দরজা খোলে, সে তো নিশ্চয় শাঁওলি মিত্র। পরে জেনেছি, না, অবিশ্বাস্য দ্রুততায় বাসন্তীর বেশ, রূপসজ্জা পরিবর্তন করে আচরণ পালটে যিনি মঞ্চে ঢুকতেন তিনি তৃপ্তি মিত্রই, শাঁওলি নন। এই হল চিনতে না-পারার গল্প। পিঠোপিঠি বলতে ইচ্ছে করছে, শাঁওলিদির আমাকে চেনা কিন্তু ভয়ের থেকে। সে গল্পটাও শুনতে মজা লাগবে আপনাদের। শুনুন তবে।

ততদিনে খানিকটা পোক্ত হয়ে গেছি। তৃপ্তি মিত্রকে শাঁওলিদি বলে ভুল করার বয়েস আর নেই। কলেজে পড়ছি, অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন ঘোষের সূত্রে বহুরূপীতে ঢোকার পাসপোর্ট জোগাড় হয়েছে। প্রথম দিন অ্যাকেডেমিতে যেতে হবে দুপুর তিনটের সময়। হ্যাঁ, তখন মোটামুটি তিনটে থেকেই মঞ্চ বানানোর কাজ শুরু হত, এবং কাজটা করতে হত মুখ্যত আমাদের, দলের ছেলেদের। সাহায্য করবার জন্যে একজন আধজন থাকত শুধু। আজকের শহুরে থিয়েটারের ছেলেমেয়েরা কি এসব ভাবতেও পারবে? গেট দিয়ে ঢুকেছি, হঠাৎ সামনে দেখি শাঁওলি মিত্র। ধীর পায়ে হেঁটে যাচ্ছে। যাব? গিয়ে আলাপ করব? সাহস হচ্ছে না তো। যাব কি যাব না ভাবতে ভাবতে পেছনে পেছনে হাঁটছি। শুনশান দুপুর। একবার শুধু দেখলাম, সে ভীত চোখে আমার দিকে ফিরে দেখল। তারপর হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল, আমি হাঁটার গতি কমিয়ে দিলাম। আমি যে দুবৃত্ত নই, মতলববাজ ছোকরা নই, সে কথা তো মহিলাকে বোঝানো দরকার।

মৃত্যুর পরে বয়েস জানা গেল শাঁওলিদির, আমার চেয়ে বছর আষ্টেকের বড় ছিল। শম্ভু মিত্র তো অনেক দূরের মানুষ, তাঁর সঙ্গে জানবার জন্যে কথা বলা যায়, সে ব্যাপারে তাঁর উদার আমন্ত্রণ। তৃপ্তি মিত্র খানিকটা বাড়ির মা-মাসিদের মতো সহজ। কিন্তু দিদি বলতে যেটা বোঝায়, সেটা হয়ে উঠেছিল শাঁওলিদি। দিদি, কিন্তু যে কোনও রকম ফক্কুড়ি করবার মতো দিদি নয়। আমাদের সমবয়সীদের একটা দল ছিল, রমাপ্রসাদ বণিক ছিল তাদের পাণ্ডা। সে অবশ্য বহুদিন ধরে আছে, তার সঙ্গে মিত্র পরিবারের সম্পর্ক প্রায় পারিবারিক। 

Shaoli Mitra
শাঁওলিদি আমাকে একটা মেরুন সোয়েটার বুনে দিয়েছিলেন

তার বাইরে, আমার সম্পর্কে হয়তো একটা বাড়তি ভালবাসা ছিল শাঁওলিদির। এলোমেলো টুকরো টুকরো কিছু কথা মনে পড়ছে। যেমন, আমাকে একটা সোয়েটার বুনে দিয়েছিল। মেরুন রঙের সোয়েটার, হাফ হাতা, বেশ অন্য রকমের ডিজাইন। সেটা আমার খুব প্রিয় ছিল, প্রায় গায়ের চামড়া করে ফেলেছিলাম পরে পরে। তার পর একদিন হঠাৎ সে কোথায় হারিয়ে গেল, নাকি ছিঁড়েই গেল– খেয়াল করিনি। আজকে লিখতে বসে সেই মেরুন সোয়েটারের কথা মনে পড়ে বুকের মধ্যে হায় হায় করে উঠছে।

শাঁওলিদির সঙ্গে প্রথম বড় চরিত্রে, মলাট চরিত্রেই বলা চলে, অভিনয় ‘পাখি’ বলে একটি ছোট নাটকে। তৃপ্তি মিত্রের নির্দেশনায়। আমি শাঁওলিদির চেয়ে বয়েসে বেশ অনেকটাই ছোট, একেবারেই নতুন। তা সত্ত্বেও যে আমাকে অমন একটা চরিত্রে বাছা হয়েছিল, তার দু’তিনটে কারণ থাকতে পারে বলে মনে হয়। এক তো, আমার দিকে নজর পড়েছিল বড়দের, এই ছেলেটাকে দিয়ে চেষ্টা করা যেতে পারে ,এমন একটা ধারণা তৈরি হয়েছিল কোথাও। সেক্ষেত্রে একটা ছোট নাটক, যার অভিনয় পূর্ণাঙ্গ নাটকের মতো অত বেশি হবে না বলেই মনে করা যায়, সেখানে পরীক্ষা করিয়ে নেওয়াই ভাল। 

Shaoli Mitra
শাঁওলিদি যখন চিনেছি তখন সে পঁচিশ-ছাব্বিশ, আমি আঠারো-উনিশ হব

‘পাখি’-তে আমি যে খুব দারুণ অভিনয় করতে পেরেছিলাম এমনটা নয়, তখন আমার মধ্যে শম্ভু মিত্রকে নকল করার প্রবল প্রবণতা কাজ করত। বহুদিন পর্যন্ত সেই অভিশাপ আমাকে তাড়া করে বেড়িয়েছে। কিন্তু এই নাটকে আমি, যাকে ‘অর্ডিনারি স্পিচ’ বলে, সেই সাধারণ স্বাভাবিক কথোপকথনের ভাষায় অভিনয়ের একটা জায়গা পেলাম। পাশে ছিল শাঁওলিদি। এমন অনেক সময় হয়েছে, দুপুর থেকে মহলা। তৃপ্তি মিত্র আসবেন একটু দেরি করে বিকেলের দিকে। আমি, শাঁওলিদি, রমাপ্রসাদ আর রানি মিত্র চারজনে মহলা দিচ্ছি। মঞ্চে কেমনভাবে অনায়াস হতে হয়, কেমন করে সাধারণ কথাবার্তাকে সহজ করে বলতে হয়, হাঁটতে চলতে হয়, তার একটা শিক্ষা ভেতরে ভেতরে চারিয়ে যাচ্ছিল।

এইখানে একটা গল্প বলব, গল্পটা সেই সময়ের পক্ষে করুণ, কিন্তু আজকে তো মজার স্মৃতিই হয়ে গেছে। স্টেজ রিহার্সালের সময়, শাঁওলিদির হাত ভাঙল। বাঁ হাত। হাতে ব্যান্ডেজ। অভিনয়ের দিন ব্যান্ডেজ খুলে অভিনয় করছে, বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে। একটা জায়গায় আমি সপ্রেমে তার হাত ধরব, দু’জনে মিলে অনেক ভালবাসা মাখানো কথা আছে। বহুরূপীর মঞ্চে এত বড় চরিত্রে একেবারে আনকোরা, তার ওপর প্রথম অভিনয়ের উত্তেজনা, বয়েসটাও মনে রাখবেন। হাত যে ভাঙা সে কথা মনেই নেই। আমি যেমনটা হওয়ার কথা, তার হাত চেপে ধরে অভিনয় করছি। পরে শাওলীদি বলেছিল, আমার তো মনে হচ্ছিল স্টেজে অজ্ঞান হয়ে যাব, ভাঙা হাতের ওপর অমন চাপ! খুব বকুনি খেয়েছিলাম বড়দের কাছে, কিন্তু একটা ছাড়ও ছিল কোথাও। সব বকুনির ভেত থেকে বেরিয়ে আসা একটা ক্ষমা, সেই মন বুঝতে পারার থেকে যা উৎসারিত হয়।

কিন্তু এইসব ব্যক্তিগত কথা আর কত বলব। এতদিন একসঙ্গে ছিলাম, অনন্ত স্মৃতির ভাণ্ডার জমে আছে মনের ভেতরে। বরং ওর সম্পর্কে আমার দুটো বিশ্লেষণের কথা বলি। সম্ভবত বাবা মায়ের কাছ থেকেই সে পেয়েছিল, থিয়েটারের প্রতি অমোঘ ভালবাসা এবং সে ভালবাসার সঙ্গে গভীর দায়িত্ববোধ মেশানো থাকত। মহলার মধ্যে কখনো নিজেকে আলগা দিয়েছে, এমনটা দেখিনি। নাটকের মধ্যে যখন থাকত, নাটকের মধ্যেই থাকত। ছিলেজোড়া তীরের মতো, উদ্যত, উদগ্রীব। সে যে শুধু মঞ্চনাটকের বেলায় তাই নয়, আমি শাঁওলিদির সঙ্গে বহু বহু রেডিও নাটক করেছি, সেখানেও। এমনিতে তো খুব হাসিখুশি, খুব হৈচৈ মজা পেছনে লাগার স্বভাব, কিন্তু কাজের মধ্যে ঢুকলে একেবারে সর্বস্ব দিয়ে তাতে ডুবে যাওয়া।

আমার সম্পর্কে হয়তো একটা বাড়তি ভালবাসা ছিল শাঁওলিদির। এলোমেলো টুকরো টুকরো কিছু কথা মনে পড়ছে। যেমন, আমাকে একটা সোয়েটার বুনে দিয়েছিল। মেরুন রঙের সোয়েটার, হাফ হাতা, বেশ অন্য রকমের ডিজাইন। সেটা আমার খুব প্রিয় ছিল, প্রায় গায়ের চামড়া করে ফেলেছিলাম পরে পরে। তার পর একদিন হঠাৎ সে কোথায় হারিয়ে গেল, নাকি ছিঁড়েই গেল– খেয়াল করিনি। 

আর একটা ছিল, প্রখর নীতিবোধ। এক ধরনের শুচিতার মনোভাব ছিল তার। সভ্যতার নিরিখে যাকে অশালীন বলে, তেমন কোনও আচরণ, কোনও কথা সহ্য করতে পারত না। শ্রাবন্তী মজুমদারের স্টুডিওতে একবার রেকর্ডিং চলার সময় একজন প্রবীণ অভিনেতা, খানিকটা দুষ্টুমি করেই সামনে একটা খারাপ কথা বলেছিলেন। পলকে শাঁওলিদির মুখটা কঠোর হয়ে গেল। দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরে নিজেকে সামলাল, তারপর নিজের চরিত্রে ডুবে গেল। পরে শুনেছিলাম, ‘লিভিং সাউন্ড’ ছেড়ে দিতে চেয়েছিল, অনেক সাধ্য সাধনা করে সেই সিদ্ধান্ত থেকে ফেরানো হয়। 

এই নীতিবোধের একটা প্রভাব ওর ব্যক্তিজীবনে তো বটেই, নাটক বাছাইয়ের সময়, এবং নিজে যে চরিত্রে অভিনয় করবে তা নির্বাচনের সময়েও হয়তো কাজ করত বলে আমার ধারণা। তার ফলে হয়ত ওর নাটক একটু ডায়ডাকটিক হয়ে পড়ে, হয়তো বা কখনও একটু একপেশে। আমার ধারণা, সেই প্রখর নীতিবোধের জায়গা থেকেই সে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছিল। পরে বোধহয় সেখান থেকে বেরিয়েই এসেছিল, বাইরে থেকে যতটুকু বুঝেছি, তবে এ নিয়ে কথা বলবার মতো ঘনিষ্ঠতা তখন তার সঙ্গে আমার আর ছিল না। আরও পরে, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় একটি রেপার্টরিতে তার নির্দেশনায় চাঁদ বণিকের পালা হবার কথা ছিল। সেখান থেকেও যে সরে এসেছিল, উড়ো কথায় জেনেছি, তার কারণও তার অনমনীয় নীতিবোধ।

Shaoli Mitra in Naathavati-Anaathavat
নাথবতী অনাথবৎ নাটকে শাঁওলিদি

কেমন অভিনেত্রী ছিলেন শাঁওলী মিত্র? চারপাশে এখন প্রশংসার বান ডেকেছে, সেটাই স্বাভাবিক। ‘নাথবতী অনাথবৎ’ বা ‘কথা অমৃতসমান’-এর ওই অভিনয়কে কেই বা অস্বীকার করবে। আমার কিন্তু একটা অন্য কথা মনে হয়। শম্ভু মিত্র বলতেন, প্রতি দশ বছর অন্তর মানুষের কথা বলার ধরন বদলায়। পাঁচের দশক থেকে বাংলা থিয়েটারের অভিনয়রীতিতে দুটি ঘরানা রাজত্ব করেছে। এক, শম্ভু মিত্র অনুসারী বহুরূপীর অভিনয়রীতি, আর একটি উৎপল দত্ত অনুসারী এলটিজি পিএলটির অভিনয়রীতি। শাঁওলীদি যখন পঞ্চম বৈদিকে নাটক করছে, নাথবতী কথা অমৃতসমান অথবা তার পরবর্তী নাটকগুলো, তখন বাংলা থিয়েটারের অভিনয়রীতি বদলে গেছে অনেকটা, বহুরূপী ঘরানা তার জোর হারিয়ে ফেলেছে। তার মধ্যে দাঁড়িয়েও অন্তত মহাভারতকেন্দ্রিক দুটি নাটকে যে শাঁওলিদি আপামর জনসাধারণকে মুগ্ধ করে দিতে পেরেছিল, তাতে তার অপরিমেয় ক্ষমতা প্রমাণিত হয়। তার চলে যাওয়া সম্ভবত এই ঘরানারও অবসান ঘটাল।

 

*ছবি সৌজন্য: Wikipedia, Hindustan Times bangla, Asianet News Bangla

সৌমিত্র বসুর জন্ম কলকাতায়। শিক্ষা, গবেষণা ও অধ্যাপনা বাংলা সাহিত্যে। পরবর্তীতে নাটক নিয়ে পড়িয়েছেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়েও। ভারতীয় নাট্য আকাদেমির সাধারণ পরিষদ ও পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমির সদস্যও ছিলেন। নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, কবি। অন্তর্মুখ নাট্যদলের সভাপতি, নির্দেশক ও প্রধান অভিনেতা তিনি। তাঁর নাট্যচর্চার শুরু বহুরূপীতে। তৃপ্তি মিত্র এবং কুমার রায়ের নির্দেশনায় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছেন। নাটক লেখার জন্য পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমি পুরস্কার-সহ বহু সম্মাননা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *