পডকাস্ট : শঙ্খ ঘোষ স্মরণে

রচনা ও পাঠ : দীপংকর চক্রবর্তী (সঙ্গে কবি শঙ্খ ঘোষের কণ্ঠে ওনার রচিত চারটি কবিতার কিছু কিছু অংশ বিশেষ)

শঙ্খ ঘোষ স্মরণে:
 
ঊননব্বই বছর বয়েসটাকে নেহাত কম বলা যায় না। কিন্তু শঙ্খ ঘোষের ক্ষেত্রে সেটা কেন যেন মেনেও নেওয়া যায় না। তিনি যে কবি! আলো দেখাতেন! বয়েসের ভারে অসুস্থ, নিজের হাতে লিখতে পারেন না, তাও মুখে বলে গিয়েছেন যা লিখতে চান। পরে কণ্ঠরুদ্ধ হয়ে গিয়েছে, ঠোঁট নেড়ে জানিয়েছেন কী বলতে চান। বামপন্থী চিন্তাধারায় বিশ্বাসী ছিলেন, কিন্তু পার্টি রাজনীতিতে বিশ্বাস করতেন না। অগ্রজ কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় ওঁকে বলেছিলেন, “কমিউনিস্ট পার্টিতে নাম লিখিও না যেন, ওরা পার্টি লাইনের বাইরে তোমাকে লিখতে দেবে না।” শঙ্খ ঘোষ লেখার স্বাধীনতা খোয়াতে চাননি।
বাঙালির জাগ্রত বিবেক বলতে যা বোঝায়, শঙ্খ ঘোষ ছিলেন তাই। কোনও বিশেষ দল বা কোনও বিশেষ রাজনৈতিক মতাদর্শ তাঁকে আচ্ছন্ন করে রাখতে পারেনি। যখনই কোথাও কোনও অন্যায় দেখেছেন, প্রতিবাদ জানিয়েছেন কবিতার মাধ্যমে। এমনকি অনেক বয়সেও প্রতিবাদ মিছিলে হেঁটে তাঁর সমর্থন জানিয়ে রেখেছেন।
 
১৯৫১ সালে খাদ্যের দাবিতে আন্দোলনে কোচবিহারে পুলিশের গুলিতে এক ১৬ বছরের কিশোরীর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। শঙ্খ ঘোষের কলম তখনও কেঁদে উঠেছে– 
‘নিভন্ত এই চুল্লিতে মা একটু আগুন দে, আরেকটুকাল বেঁচেই থাকি, বাঁচার আনন্দে!’ 
আরও অনেক পরে সত্তরের দশকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিয় ছাত্র তিমির বরণ সিংহ নকশাল আন্দোলনে নেমে পুলিশের হাতে মারা যাওয়ার পর শিক্ষক কবি শঙ্খ ঘোষের কবিতায় শোক ঝরে পড়ে-
‘ময়দান ভারী হয়ে নামে কুয়াশায়,
পথে পড়ে আছে, ও কি কৃষ্ণচূড়া? 
নিচু হয়ে বসে হাতে তুলে নিই 
তোমার ছিন্ন শির, তিমির–‘
এই সেদিনও লিখেছেন–
‘এখন আমাদের আর কোনও ভয় নেই। 
এখন আমরা ‘ওরা’ হয়ে গিয়েছি!’ 
তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গোক্তিতে স্পষ্ট বুঝিয়ে দিচ্ছেন, ‘ওরা’ হয়ে যেতে পারলে আর ভয় থাকে না। ‘আমরা’ হতে চাইলেই যত ভয়। 
১৯৯১ সালের মে মাসে বাম শাসনে ভোটের দিনে তাদের পূর্ব প্রতিশ্রুতি মনে করিয়ে দিয়ে ছড়া লিখেছেন.. 
‘হিরের থেকে জিরের দাম
রাজা বাম কি বিধি বাম
বুঝব তিলে তিলে;
কিন্তু রাজা, সোনার বাংলা 
গড়ব বলেছিলে’।।
আবার এখনকার শাসকদল তৃণমূলের বাহুবলীদের মুখে হুমকির সুরে উন্নয়নের কথায় তাঁর কলমে ব্যঙ্গ ঝরে পড়েছিল.. 
‘দেখ খুলে তোর তিন নয়ন,
পথের ধারে খড়্গ ধরে দাঁড়িয়ে আছে উন্নয়ন!’
জন্ম পূর্ববঙ্গে, অধুনা বাংলাদেশের চাঁদপুরে ১৯৩৫ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি। ছোটবেলাতেই অবশ্য এপার বাংলায় চলে আসেন। কিন্তু সেটা সুখস্মৃতি নয়। যেখানে সেখানে ‘বাঙাল’ বলে ব্যঙ্গোক্তি শুনতে হতো। কথায় কথায় ‘রিফিউজি’ বলে খোঁচা। যেন ‘উদ্বাস্তু’ একটা গালি। সব সময় সঙ্কুচিত হয়ে থাকা।- 
শঙ্খ একবার বলেছিলেন, “কলকাতায় আমি পঞ্চাশ বছর ধরে আছি। এই শহরটাকে খুব ভালবাসি। কিন্তু কেন যেন আপন ভাবতে পারি না। মনে হয়, কলকাতা কি আমাকে বহিরাগত ভাবে? এখনও? 
আমার বুকের মধ্যে রয়ে গিয়েছে বাংলাদেশ। এখনও।”
কবি জীবনের স্বীকৃতি হিসেবে পদ্মভূষণ উপাধি থেকে শুরু করে জ্ঞানপীঠ পুরস্কার, সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার, অনেক সম্মান পেয়েছেন তিনি। সঙ্গে পেয়েছেন মানুষের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা। কণ্ঠস্বর ছিল শঙ্খের মতোই জলদমন্দ্র। কথা কম বলা পছন্দ করতেন–
‘এত বেশি কথা বলো কেন? 
চুপ করো, শব্দহীন হও। 
শষ্পমূলে ঘিরে রাখো আদরের সম্পূর্ণ মর্মর.. স্রোতের ভিতরে ঘূর্ণি, ঘূর্ণির ভিতরে স্তব্ধ আয়ু,
লেখো আয়ু লেখো আয়ু, 
চুপ করো, শব্দহীন হও।’ 
স্বল্পবাক কবি শঙ্খ ঘোষ চির নৈঃশব্দের দেশে চলে গিয়েছেন। তার মাত্র আট দিনের মাথায় অনুগামিনী হয়েছেন তাঁর জীবনসঙ্গিনী প্রতিমা–
প্রতিমা ঘোষ নিজেও লেখালেখি করতেন, কিন্তু নিজেকে একটু অন্তরালে রেখে। ছিলেন সহপাঠিনী, পরে সহধর্মিণী। কবির অনুপ্রেরণা।
banglalive logo

বাংলালাইভ একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবপত্রিকা। তবে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে বাংলালাইভ। বহু অনুষ্ঠানে ওয়েব পার্টনার হিসেবে কাজ করে। সেই ভিডিও পাঠক-দর্শকরা দেখতে পান বাংলালাইভের পোর্টালে,ফেসবুক পাতায় বা বাংলালাইভ ইউটিউব চ্যানেলে।

3 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *