‘There are only hints and guesses,
Hints followed by guesses…’—T S Eliot (“The Dry Salvages”, Four Quartets)

‘আমি নৈঃশব্দ্য আর অন্ধকারকে শব্দে বদলে নিই’, লিখেছিলেন চির-ব্যতিক্রমী কবি র‍্যাঁবো। 

আমরা লক্ষ করব পঞ্চাশের মুখর কবিদের মধ্যে কেউ কেউ ভাষার ভেতর ভিন্নতর এক পরিসর খুঁজেছেন, খুঁজেছেন নৈঃশব্দ্যের শব্দ, যেমন শঙ্খ ঘোষ, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত বা আলোক সরকারযা তাঁদের উচ্চারণকে স্বতন্ত্র করেছে, কবিতার অন্দরে জ্বালিয়ে দিয়েছে এক নিভৃত আলো।

শঙ্খের কবিতাশরীর থেকে সেই আলো কখনও নেভে নি। ‘দিনগুলি রাতগুলি’ (১৯৫৬), ‘নিহিত পাতালছায়া’ (১৯৬৭) পার হয়ে ‘সীমান্তবিহীন দেশে দেশে’ (২০২০) পর্যন্ত এই অব্যক্ত তাঁকে জীবনরহস্যের কেন্দ্রে প্রোথিত করেছে। অলোকরঞ্জনের উজ্জ্বল বিভার পাশে শঙ্খের নম্র লতাগুল্মময় স্বগতকথন তাঁর শ্লেষাক্ত জনপ্রিয় কবিতাগুলির চেয়ে দীর্ঘতর এক অনুরণন রেখে যায় পাঠকমনে।     

নিজের মতো করে জীবনকে খুঁজতে গিয়ে এই নিরাবয়বকে ঘিরে ঘিরে তাঁর চলন। যেন নিরন্তর খুঁজেছেন ‘শব্দমধ্যগত সেই অবাচ্যতা’। প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য মিলে তাঁর কবিতার এই সাংগীতিক ধর্মকে না অনুধাবন করলে তাঁকে হয়তো বোঝাই হল না পুরোপুরি। তা যে শুধু ‘পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ’ (১৯৮০), ‘গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছ’ (১৯৯৪) বা ‘শবের উপরে শামিয়ানা’ (১৯৯৬) গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত ‘জলেভাসা খড়কুটো’-তেই সীমাবদ্ধ, তা তো নয়। তাঁর অধিকাংশ কাব্যগ্রন্থে তৈরি হতে থাকে এক অনুরণন। কবিতার আগে পরের সাদা স্পেস ধরে রাখে সাংগীতিক প্রতিধ্বনিময় এক নীরবতা। ‘নিঃশব্দের তর্জনী’(১৯৭১)বইতে ‘নির্মনা নিরনুভব শব্দপ্রয়োগের বহুলতা’-র বাইরে যে ‘নিঃশব্দ অনায়াস নিবিড় আয়তনের কবিতা’-র কথা বলেছেন তিনি, তা যে তাঁর আপন কথা।

মৌন জানে শুধু মানুষেরই বুক, দুয়ের মধ্যে সম্পর্কেই আছে মৌনেরই বীজ, যেমন জানতেন কীয়ের্কেগার্ড। সেই বীজ ফিরে পেতে চায় শুধু যাপনের নির্যাস। যাপন, যাপন। আছি, আমি আছি— এই ধ্বনি যখন শোনা যায় প্রশ্বাসের আবর্তে, কেবল তখনই দলবাঁধা সব শব্দ ধাবিত হয়ে চলে যেতে চায় শেষহীন নীরবতার দিকে। (“নিঃশব্দের তর্জনী”, প্রবন্ধটির রচনাসাল: ১৯৬৬)

আমরা শঙ্খ ঘোষের রবীন্দ্রমগ্নতার কথা জানি, কিন্তু একবারও কি ভেবে দেখেছি রবীন্দ্রনাথ থেকে তাঁর আকণ্ঠ প্রাপ্তির কথা? ‘কবিতা-পরিচয়’-এ আবু সয়ীদ আইয়ুবের তোলা তর্কের উত্তরে তিনি লিখেছিলেন: ‘আমারও হাত যদি ছেড়ে দেন রবীন্দ্রনাথ তবে সেই মুহূর্তে ছিন্ন হয়ে যাবে আমার সমস্ত অস্তির বোধ।’

শঙ্খের কবিতাশরীর থেকে সেই আলো কখনও নেভে নি। ‘দিনগুলি রাতগুলি’ (১৯৫৬), ‘নিহিত পাতালছায়া’ (১৯৬৭) পার হয়ে ‘সীমান্তবিহীন দেশে দেশে’ (২০২০) পর্যন্ত এই অব্যক্ত তাঁকে জীবনরহস্যের কেন্দ্রে প্রোথিত করেছে।

‘অপঘাতী মিথ্যা বাণিজ্যের’ থেকে দূরে দাঁড়িয়ে এই সাংগীতিক সমগ্রতার ভাবনা নিশ্চয়ই রবীন্দ্রনাথের সবচেয়ে বড় শিক্ষা, যা শঙ্খ ঘোষ ছাড়া কোনও উত্তরাধিকারী তেমন করে গ্রহণ করতে চাননিতাঁর ভাবনায়, এখানেই হতে পারে কবিতার মুক্তি। আঁদ্রে জিদকে লেখা পল ভালেরির চিঠি মনে পড়ে যাচ্ছে তাঁর: এক পৃষ্ঠা লেখা কি কখনওই এক স্বরলিপির মহিমায় পৌঁছতে পারে? তিনি লিখছেন, 

সংগীতের মতো হওয়া আর সংগীত হওয়া এক কথা নয়। শব্দ যে তার চারপাশের জড়ত্ব নিয়েই এগোতে চায় সত্যের দিকে, এই তো তার গৌরব। একথা ঠিক যে, ‘কবির শব্দ যেখানে থামে, আলোর সেখানে শুরু’। কিন্তু কবির শিল্পই তো এই যে তিনি পারেন শব্দকে এই আলোর তটভূমি পর্যন্ত পৌঁছে দিতেশব্দের পারম্পর্য নতুন করে গাঁথা হয়ে যায়, তারই মধ্যে রণিত হয় নিঃশব্দ সংগীত…। 

(“শব্দ থেকে পালানো”, রচনাসাল: ১৯৭০, ‘নিঃশব্দের তর্জনী’)

জলের মতো ঘুরে ঘুরে একা কথা কওয়া রচনাটি শেষ করছেন এই কথা বলে:

নিঃশব্দ মানে শব্দ থেকে পালানো নয়, শব্দকে ইথারমণ্ডিত করে তোলা মাত্র, অভ্যস্ত শব্দসম্পর্কের আলস্য ভেঙে দিয়ে তার মধ্যে সত্যের প্রবাহ নিয়ে আসা। কবিরই সেই কাজ। (ঐ)

‘শব্দ আর সত্য’ (১৯৮১) বইটির কথা মনে পড়বে আমাদের, অথবা ‘নিঃশব্দের তর্জনী’ বইয়ে ‘শব্দের প্রদীপ শিখা’ (রচনাকাল: ১৯৬২) প্রবন্ধটির কথা। অক্ষরের স্নায়ুতে এই অব্যক্ত নৈঃশব্দ্যের কথা উঠল শঙ্খ ঘোষের অনুবাদে টি. এস. এলিয়টের শেষ কাব্যগ্রন্থ ‘ফোর কোয়ার্ট্রেটস’-এর তৃতীয় কবিতা ‘দ্য ড্রাই স্যালওয়েজেস’ পড়তে পড়তে। ১৯৬২ সালে যখন অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের সঙ্গে ‘সপ্তসিন্ধু দশদিগন্ত’ সম্পাদনা করলেন তিনি, তখনই সেই সংকলনে এই দীর্ঘ কবিতাটি ছিল। মনে রাখতে হবে, তখন শঙ্খ ঘোষের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘নিহিত পাতালছায়া’(১৯৬৬, রচনাকাল ১৯৬০-১৯৬৬)-র কবিতাগুলি রচিত হচ্ছে। 

সেই সংকলনের জন্য জার্মান থেকে ক্লাউস গ্রোট, স্টেফান গেয়র্গে, কার্ল ক্রাউস, গেয়র্গ হাইম, বের্টোল্ট ব্রেশট, স্পেনীয় থেকে আন্তোনিও মাচাদো, নিকোলাস গিয়েন, পাবলো নেরুদা, আর্তুর প্লাজা’র একটি করে অনুবাদের পাশাপাশি ইংরেজি থেকে এলিয়টের দীর্ঘ কবিতাটিও ছিল। প্রশ্ন হচ্ছে, এলিয়টের প্রথম বা দ্বিতীয় পর্যায়ের কবিতা না বেছে শেষ খ্রিস্টিয় পর্যায়ের কবিতা নির্বাচন করলেন কেন তিনি? পরে ভারবি প্রকাশিত তাঁর ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ (১৯৭০) ও অনুবাদ কবিতার বই ‘বহুল দেবতা বহু স্বর’(১৯৮৫)-এও এলিয়টের বিখ্যাত কবিতাটি অন্তর্ভুক্ত হয়। 

আরও পড়ুন: চিন্ময় গুহর কলমে: ফরাসি কবিতায় প্রেম

নিকোলাস গ্যিয়েন-এর এগারোটি কবিতা (‘চিড়িয়াখানা ও অন্যান্য কবিতা’ নামে এক সময় যা গ্রন্থবদ্ধ হয়েছিল), তেলেগু কবি চেরাবাণ্ডা রাজুর আটটি, বের্টোল্ট ব্রেশট-এর চোদ্দোটি, জাক প্রেভের ও জুসেপ্পে উনগারেত্তির পাঁচটি করে কবিতা বাদে অন্য অনেকের (যেমন হিমেনেস, ডিলান টমাস, গুন্টের গ্রাস, এমে সেজের, পাবলো নেরুদা, স্টেফান গেয়র্গে, গেয়ররগ হাইম, আনা আখমাতোভা) একটি বা দুটি নমুনা ছিল ‘বহুল দেবতা বহু স্বর’-এর নতুন সংস্করণে (১৯৯৭)এর মধ্যে পাউল সেলান-এর ‘মৃত্যরাগিণী’ (জার্মানে ‘টোডেসফুগে’) কবিতাটি অনুবাদ  এলিয়ট ও ইকবালএর সঙ্গে তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ অনুবাদ মনে হয়েছে আমার। প্রথম কয়েকটি পংক্তি:

‘Schwarze Milch der Fruehe wir trinken sie abends / wir trinken sie mittags und morgens wir trinken sie nachts / wir trinken und trinken

এইভাবে অনুবাদ করেছিলেন শঙ্খ ঘোষ:

সকালবেলা কয়লাকালো দুধ আমরা খেয়ে নিই সূর্যাস্তে
খেয়ে নিই দুপুরবেলায় খেয়ে নিই রাত্রে
খেয়ে নিই সব খেয়ে নিই
আমরা কবর খুঁড়ব স্বর্গলোকে ওখানে ভিড় নেই একেবারে…

আমাদের বিশেষ করে আবিষ্ট করে শেষ দুটি পংক্তি

‘dein goldenes Haar Margarete
Dein aschenes Haar Sulamith’:

তোমার সোনালি চুল মার্গারেট
তোমার ধূসর চুল সুলেমিট।

বুঝতে অসুবিধে হয় না নিজের সমাজচেতনা আর প্রেমকে এইভাবে অনুবাদের মাধ্যমে সম্প্রসারিত করে নিচ্ছেন শঙ্খ ঘোষ।

এবার আমার মূল প্রতিপাদ্যে, অর্থাৎ ইকবালকে বাদ দিলে ওঁর দীর্ঘতম অনুবাদ কবিতাটিতে ফিরে আসি। কেন তিনি নির্বাচন করলেন এলিয়টের কাটা কাটা পংক্তির বিস্ফোরক, ‘আধুনিক’ ভাঙাচোরা কবিতাকে এড়িয়ে গিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রকাশিত তাঁর শেষ কাব্যগ্রন্থের ওই সজল তৃতীয় কবিতা? এলিয়টের কাব্যে নৈঃশব্দ্যের ব্যঞ্জনা তাঁর কবিতার মূল সুর, মনে করেছেন স্বয়ং ডেনিস ডনগি তাঁর ‘ফোর কোয়ার্ট্রেটস’ বিষয়ক পুনর্পাঠে।

He was a man of words who loved silence. Indeed, in his greatest poems the words are one part sound and three parts silence, the silence in which he pondered, felt and remembered. If we ask the source of his words, the answer is easy; they came from the other side of silence…

‘Words, after speech, reach into the silence.’ 

The heart of Eliot’s poetry is in that silence…And the object is a new and deeper silence, a silence of longer memory and deeper scruple.  

(T S Eliot’s ‘Quartets’: A New Reading)

অক্ষরের স্নায়ুতে এই অব্যক্ত নৈঃশব্দ্যের কথা উঠল শঙ্খ ঘোষের অনুবাদে টি. এস. এলিয়টের শেষ কাব্যগ্রন্থ ‘ফোর কোয়ার্ট্রেটস’-এর তৃতীয় কবিতা ‘দ্য ড্রাই স্যালওয়েজেস’ পড়তে পড়তে। ১৯৬২ সালে যখন অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের সঙ্গে ‘সপ্তসিন্ধু দশদিগন্ত’ সম্পাদনা করলেন তিনি, তখনই সেই সংকলনে এই দীর্ঘ কবিতাটি ছিল।

দান্তের ‘দিভিনা কম্মেদিয়া’ (১৩২০)-র মতো, নরকাগ্নি পেরিয়ে, আশা-নিরাশার ভয়ংকর দোলাচল পার হয়ে এলিয়ট যখন ইঙ্গ-ক্যাথলিকবাদে ধর্মান্তরের (১৯২৭) পর এক দিব্যবিভান্বিত দিশা খুঁজে পেলেন, তাঁর ধাক্কা দেওয়া ছুরির ফলার মতো প্রভাবশালী ভাষার জায়গায় আস্তে আস্তে স্থান করে নিল ১৯৩৫ সালের জুন মাসে ক্যান্টারবেরি খ্রিস্টীয় উৎসবে মঞ্চস্থ ‘মার্ডার ইন দ্য ক্যাথিড্রাল’-এর দীর্ঘ পঙক্তি দিয়ে সাজানো এক সুসংহত নিরবচ্ছিন্ন স্তোত্রময়তা: In search of the still pointভালেরি-নন্দিত সাংগীতিক শুদ্ধতার কাছে পৌঁছনো যদি কবিতার অন্বিষ্ট হয়, এলিয়টের ‘রক’ কোরাসগুলি, পূর্বোল্লিখিত কাব্যনাটকটি এবং এই চারটি মহাকবিতা এক মন্ত্রময়তার দিকে প্রবাহিত করে আমাদের, যার মূল বার্তা: ‘Humility is endless.’  

ছ’বছর ধরে প্রকাশিত ওই চারটি কবিতা গ্রন্থাকারে একসঙ্গে প্রকাশিত হয় ১৯৪৩ সালে। সময়ের প্রবাহ, সময়োত্তর, পার্থিব অভিজ্ঞতার যন্ত্রণা ও ঈশ্বরের সঙ্গে মানুষের অন্তঃসম্পর্ক নিয়ে এই চতুর্ভুজ মহাকবিতার সাংগীতিক কাঠামো নির্মিত। শঙ্খ-অনূদিত তৃতীয় কবিতাটি ১৯৪০ সালের শেষে ইংল্যান্ডে বিমান আক্রমণের সময় রচিত হয়। এলিয়টের ছেলেবেলার স্মৃতি এবং জলের প্রতিচ্ছবি কবিতাটিকে সজল ও শান্ত করে রাখে।

‘The river is within us, the sea is all about us.’

তাঁর কবিতায় জলের ব্যবহারের কথা নিজেই উল্লেখ করেছেন শঙ্খ ঘোষ। ‘যখন পৃথিবী বরফ হয়ে আছে’, শঙ্খ ঘোষ নৈঃশব্দ্যের মতো জলের কাছে বারবার ফিরে যেতে চেয়েছেন, যা তাঁর কবিতাকে ঘূর্ণিপাকের মতো জড়িয়ে থাকে। আমাদের মনে পড়বে ‘জল কি তোমার কোনো ব্যথা বোঝে?’ বা ‘দুই প্রান্ত থেকে ফিরে আমাদের দেখা হলো  ভূমধ্যসাগরে’-র মতো গহন সব পঙক্তি। যখন এলিয়টের (তিনি তখনও বেঁচে, মৃত্যু হবে তিনি চার বছর পর ১৯৬৫ সালে) কবিতাটি অনুবাদ করছেন, তখন নির্মীয়মান ‘নিহিত পাতালছায়া’-য় এমন সব উল্লেখ ছিল জলপ্রতীকের: ‘পা-ডোবানো অলস জল, এখন আমায় মনে পড়ে?’ (‘অলস জল’), ‘বুড়িরা জটলা করে/আগুনের পাড়ায়/দু-ধারে আঁধার জল/পাতাল নাড়ায়। (‘বুড়িরা জটলা করে’) অথবা ‘খেয়ে যা, খেয়ে যা, খা/ দেয়ালের মধ্য খুঁড়ে জল।/ বাহিরে ভরসা ছিল এতকাল শাদা/কোথা ঠেকে নীলাভ গরল–/দেয়ালের মধ্যবুকে জল। (‘পোকা’)

তাহলে কি ছোটবেলায় পাবনার পাকশীতে দেখা পদ্মার সেই স্মৃতিই শঙ্খ ঘোষকে (যেমন এলিয়টকে মিসিসিপি) টেনে আনল ‘দ্য ড্রাই স্যালওয়েজেস’-এর দিকে, যা আসলে ম্যাসাচুটেসসের অ্যান অন্তরীপের উত্তরপূর্ব বেলাতটে ‘লে ত্রোয়া সোভাজ’ নামে পাথরের সারি? সেখানকার সেই বাঙ্ময় নৈঃশব্দ্য যা তাঁর শব্দকে ‘ইথারমণ্ডিত’ করে তুলবে? অনুবাদের বইটির ভূমিকায় লিখছেন তিনি: ‘এবার আর হিমেনেথ নয়, ‘দি(য)ড্রাই স্যালওয়েজেস’ থেকে উঠে এল বইয়ের পরিচয়। এলিয়টের ওই কবিতাটিতে সমুদ্রের ছিল বহুস্বর: Many gods and many voices! দেশদেশান্তরের যুগযুগান্তরের কবিদের স্বরই তো আমাদের কাছে কখনও কখনও হয়ে ওঠে সেই সমুদ্র, সেই মহাসময়!’ 

‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’ (১৯২২; যা বোদল্যের-এর ‘লে ফ্ল্যর দ্যু মাল’-এর পঞ্চাঙ্ক কাঠামোকে স্মরণ করায়) এবং ‘ফোর কোয়ার্টেটস’-এর বাকি তিনটি কবিতার মতো পাঁচ ভাগে সুবিন্যস্ত সূক্ষ্ম সাংগীতিক বিন্যাসের মতো ‘দ্য ড্রাই স্যালওয়েজেস’- ও পঞ্চভুজএলিয়টের ‘I do not know much about gods; but I think that the river / Is a strong brown god—sullen, untamed and intractable’ তিরিশ বছরের তরুণ শঙ্খের হাতে হয়ে উঠছে ‘দেবতার কথা আমি জানি না বিশেষ; শুধু যেন মনে হয় এই/নদী এক সমর্থ ধূমল দেব, অনম্য, অনাব্য, ক্রোধী’। এই ‘শক্তিশালী বাদামি দেবতা’ অবশ্য মিসিসিপি। আমরা নিঃশব্দে দেখি এলিয়ট-শঙ্খের জ্যা-সংযোগে শঙ্খের কবিতার লতাগুল্ম হয়ে উঠছে ঘনবদ্ধ ও সংহত, যেন সুধিন্দ্রীয় স্থাপত্য, যা সাংগীতিক, অর্ধস্ফুট, দীপময়।

 

আরও পড়ুন: অবন্তিকা পালের কলমে: ইলোকরঞ্জনের ঈশ্বর: দ্বন্দ্বে, বিশ্বাসে, কবিতায়

না, ‘অল্প বয়সের চপলতায়’ (“কতটুকু এলিয়ট”, ‘ঐতিহ্যের বিস্তার’, ১৯৮৯)নয়, যেমন অনেক পরে বিষ্ণু দে সম্পর্কিত এক প্রবন্ধের টীকায় লিখেছেন শঙ্খ ঘোষ, এর পেছনে ছিল গভীর অনুধ্যান। 

    নদী আমাদেরই মধ্যে, সমুদ্র সবার চার দিকে;
    সমুদ্র ভূমিরও প্রান্ত, স্পর্শ করে যায়
    গ্রানিটের স্তর আর তটের উপরে দেয় ছুঁড়ে
    বিচিত্র প্রাক্তন যত সৃষ্টির ইঙ্গিত:
    হাঙর, কাঁকড়ার খোল, প্রকাণ্ড তিমির শিরদাঁড়া;
    অথবা নিথর জলে সবার অস্থির চোখে
    ধরা পড়ে সমুদ্রের জলজ উদ্ভিদ, প্রাণীকুল।
    ছুঁড়ে দেয় আমাদের হৃত রত্নগুলি রত্নাকর
    ছেঁড়া জাল, ভাঙা দাঁড়, বিধ্বস্ত বল্লম আর
    ভিনদেশী মৃতদের জীর্ণ বাস। সমুদ্রের বহু স্বর,
    বহুল দেবতা, বহু স্বর।
              বুনো গোলাপের বুকে লবণশীকর,
     কুয়াশা-উথাল ঝাউশাখা।
            সমুদ্রগর্জন আর
     সমুদ্রশ্বসন, এসব বিচিত্র স্বর প্রায়
     একত্র পুঞ্জিত শোনা যায়… 

আরও পড়ুন: মৃদুল দাশগুপ্তের কলমে: বাংলা কবিতায় বিদ্যুতের ঝলক: তুষার রায়

আমরা ‘সাগরের ঠোঁট, আঁধারকণ্ঠ দেবে না যাদের ফিরে,/অথবা যাদের ছুঁতেও পারে না সমুদ্রঘণ্টার/বিরামবিহীন স্তব’ তাদের জন্য নিঃশব্দ প্রার্থনা করি কৃষ্ণ-কথিত ‘সত্য পরিণাম’-এর কথা ভেবে। দান্তে, পাসকাল বা সেন্ট জন অফ দ্য ক্রস-এর হাত ধরে এলিয়ট সেখানে পৌঁছতে পেরেছেন। এলিয়টের এই আলো-আঁধারিতে অস্থির তৃতীয় কবিতাটিকে অসফল ও অমীমাংসিত মনে হয়েছে কোনও কোনও পাশ্চাত্য সমালোচকের। কিন্তু শঙ্খ ঘোষ সেখানে খুঁজে পেয়েছেন অজানা ও অশ্রুতকে: 

    অজানা পাতার বুনো গন্ধ কিংবা শীতের বিদ্যুৎ
    অথবা প্রপাত কিংবা গান
    এমন প্রগাঢ় শোনা যেন-বা অশ্রুত মনে হয়,
    তবুও তুমিই সংগীত যতক্ষণ বিরাজে সংগীত। 
    এসব ইঙ্গিত, অনুমান, ইঙ্গিতের অনুগামী অনুমান।
    আর বাকি সব
    প্রার্থনা, পালন, চিন্তা, কর্ম ও শৃঙ্খলা।
    অর্ধ-অনুমিত এ-সংকেত, অর্ধ-উপলব্ধ উপহার,
    এই তো বিগ্রহ মূর্তিমান!

চারপাশের ‘কলরোলময়, বার্তাবিহীন, অভ্যাসতাড়িত’ শব্দস্রোতের মাঝখানে এই অর্ধ-অনুমিত, সাংকেতিক, অর্ধ-উপলব্ধ ইঙ্গিতময়তাকেই তো কবিতার প্রাণ বলে বুঝতে চেয়েছেন শঙ্খ ঘোষ, যা মিলিয়ে দেবে সময় ও মহাসময়ের সংযোগবিন্দুকে (“The point of intersection of the timeless / With time”)তাঁর মতে, এভাবেই হতে পারে শব্দ ও নৈঃশব্দ্যের নতুন সৃষ্টি। 

পথেই তো এলিয়ট ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’ বা ‘দ্য হলো মেন’-এর দুঃস্বপ্ন কাটিয়ে অবশেষে খুঁজে পাবেন সেই স্থির বিন্দু যা তাঁকে পৌঁছে দেবে গোলাপবাগানের দরজায়।  

এই আশ্চর্য ভাষান্তরে তাই বাকস্পন্দের সুর গেছে মিলে।  

*মূল জার্মানের জন্য কৃতজ্ঞতা: সুব্রত সাহা

পেশায় ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক। লেখক, প্রবন্ধকার ও অনুবাদক হিসেবে খ্যাত। 'ঘুমের দরজা ঠেলে' বইয়ের জন্য পেয়েছেন অ্যাকাডেমি পুরস্কার। ফরাসি ভাষা ও সাহিত্যচর্চায় ওঁর পাণ্ডিত্য সুবিদিত। 'হে অনন্ত নক্ষত্রবীথি', 'গাঢ় শঙ্খের খোঁজে', 'অন্য জলবাতাস অন্য ঢেউ' ওঁর কিছু প্রকাশিত বাংলা বই। ইংরেজি ভাষাতেও লিখেছেন একাধিক বই। বিশিষ্ট ফরাসিবিদ হিসেবে তিনবার ফরাসি সরকারের কাছ থেকে নাইটহুড পেয়েছেন।

3 Responses

  1. শব্দ ভেঙে গেলে পড়ে থাকে অক্ষরেরা,
    অক্ষর থেকে আলো,
    আলোর ভেতরে থাকা প্রতীতির খোঁজে মানুষ যেভাবে
    ঈশ্বরের পাশে গিয়ে বসে –
    সেই ভঙ্গীর পাশে আমাদের হীনমন্যতা রাখা থাকে
    মাণিক্যের মত…

    চিন্ময় গুহ পান্ডিত্যের অভিজ্ঞান, সর্বজনবিদিত। বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর জ্ঞানের ঐশ্বর্যে বিচ্ছুরিত হয়ে উঠেছে চৈতন্যের চরাচর। এখানেও তার ব্যতিক্রম হলনা। প্রখর বিশ্লেষণের আতসে কবির সৃষ্টি যেভাবে আলোচ্য হয়ে উঠেছে, যেভাবে স্তবক থেকে স্তবের সৌরভ চুঁইয়ে আসছে, তা আমাদের বিস্ময়ের সীমানা ছাড়িয়ে যায়। যদিও এই অবধারিতই স্বাভাবিক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *