হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ডের প্রথম দিনগুলো যেন স্বপ্নের ছিল। কলকাতার সাংবাদিকতার ইতিহাসেরও এক নতুন শুরুই বুঝিবা। ইংরেজিতে দেদার পোক্ত ছেলেরা জার্নালিস্ট হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। স্টেটসম্যান তখন কলকাতার লন্ডন টাইমজ, বাড়িতে বাড়িতে রাখা হয় ছেলেমেয়েরা ভালো ইংরেজি শিখবে বলে। ইংরেজির ব্যাপার-স্যাপার হলে দেখিয়ে দেওয়া হয় স্টেটসম্যান। আর এটাই মস্ত চ্যালেঞ্জ হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ডের তরুণ ম্যানেজিং এডিটর অভীক সরকারের সামনে। শুধু খবরে ও স্টোরিতে নয়, ছবি ডিজাইন ও ইংরেজির স্ট্যান্ডার্ডের একটা class achieve করতে হবে। বিশেষ করে এর ইংরাজিকে super English হতে হবে, এর সংবাদ-কাহিনি বা স্টোরিকে হতে হবে চমকে দেওয়া, ঝাঁ চকচকে, বিলকুল অন্য ঘরানার। আর এসব করার পক্ষে অভীক সরকারের চেয়ে ভালো মগজ তখন গোটা ভারতে নেই।
দামি বিলিতি সুট তো ওঁর পরিধান ছিলই, তবে প্রায়ই গায়ে চড়াতেন সে-সময়ে ফ্যাশনে ওঠা জার্নালিস্ট কম্বিনেশন, যা হল একটু পুরু ফ্যাব্রিকের হাফ স্লিভস শার্ট ও ট্রাউজার। শার্টের বিশেষত্ব দুই বুকে দুটো ঢাকনা দেওয়া পকেট, আর পেটের কাছেও ওরকমই দুটো কাভার্ড পকেট। এই চার পকেটে যে কত কিছু গুঁজে ফেলা যায় তা না দেখলে বিশ্বাস করা সমস্যা। তবে অভীকবাবুর জার্নালিস্ট কম্বিনেশনের সেরা তাসটা ছিল শোল্ডারে, শার্টের হাতার কাঁধের কাছে। দুই হাতার মাথাতেই কলম রাখার পকেট। যা ভরে থাকত কর্তা মশাইয়ের দামি দামি ফাউন্টেন আর ডট পেনে! কাজের কথা বলতে বলতে সড়াক করে একটা পেন বার করে কিছু না কিছু লিখতে শুরু করতেন আর থুতনির ফরাসি স্টাইল দাড়িতে আঙুল বোলাতেন।

অভীকবাবু ওঁর ভাই অরূপের সঙ্গে আমার গানবাজনার আড্ডার খবর রাখতেন। জানতেন ক্রমান্বয়ে বিখ্যাত হতে থাকা তরুণ আমজাদ আলি খাঁ শহরে এলে ওঁর ভাই, সেতারি সুব্রত রায়চৌধুরী ও আমি এককাট্টা হই। আর হয়তো জানতেন যে ক্ল্যাসিকাল গানবাজনায় আমার আরেক নেশা রবিশঙ্কর। তো হঠাৎ একদিন আমায় ডেকে বললেন, “রবিশঙ্কর কলকাতা আসছেন।”
বললাম, “জানি।”
অভীকবাবু বললেন, “রবিশঙ্কর ইজ অলওয়েজ আ গুড কপি। কী বল?”
বললাম, “অবশ্যই।”
সঙ্গে সঙ্গে তরুণ কর্তার ছোট্ট অর্ডার, “লেগে পড়ো।”
তারপরেই ওঁর পাশে মাটিতে রাখা মস্ত একটা টেপ রেকর্ডার দেখিয়ে বললেন, “এই রেকর্ডার ঘরের যেখানে খুশি রেখে চালালে কথা টেপ হয়ে যাবে। তুমি নিয়ে যেতে পারো সেদিন।”
ভয়ভীতিতে সঙ্গে সঙ্গে বললাম, “না, না, আমার টেবল মডেলেই হয়ে যাবে। অত কিছুর দরকার নেই।”
সত্যি বলতে তখন আমার কোনও টেবল মডেল টেপ রেকর্ডারও ছিল না। কাজের দরকারে বন্ধু বাপ্পারটা নিয়ে চালিয়ে দিতাম। আমার সাউন্ড সিস্টেম বলতে একটা ভালো রেকর্ড প্লেয়ার আর বহু লং প্লে, ইপি আর সেভেন্টি এইট আর পি এম। বই আর রেকর্ড কিনে আমার সব টাকা ফতুর হয়ে যায়। আর ইন্টারভিউ চালাই কাগজে-কলমে; এত স্পিডে লিখি যে কারও কোনও কথা মিস করি না।

শীতের সকালে সাদা টুইডের কোট, নতুন সোনালি চশমা, একমাথা ঝাঁকড়া চুল আর কাগজকলম নিয়ে পৌঁছে গেছিলাম গল্ফ ক্লাব রোডের সেই সাবেক স্টাইলের বাড়িতে, সেখানে তখন রবিশঙ্করের দাদা উদয়শঙ্কর থাকতেন। সেবার দাদার সঙ্গে এসে থেকেছিলেন রবিশঙ্কর! আমায় দেখেই বললেন, “বাহ্, এখন তো পাকাপোক্ত জার্নালিস্ট দেখছি।”
ওঁর কথায় একই সঙ্গে অবাক আর খুশি হয়েছিলাম। সেই কবে জুনিয়র স্টেটসম্যানের জন্য ইন্টারভিউ নিতে গিয়েছিলাম, কী রবীন্দ্র সদনে সিংহেন্দ্র মধ্যম বাজিয়ে আসর শেষ করার পর উইঙ্গের আলো-আঁধারিতে প্রণাম করেছিলাম কিংবা শীতের সকালে নিউ এম্পায়ারে ওঁর পরমেশ্বরী শুনে হলের পিছনে বান্ধবীকে নিয়ে গিয়ে গাড়িতে বসা ওঁকে হাত নেড়েছিলাম সবই কি ওঁর মনে আছে! “থাক, থাক” বললেন বটে, তবু প্রণামটা সেরে ফেললাম। আমাকে দেখেই হয়তো আমার সঙ্গে আসা আনন্দবাজারের চিফ ফটোগ্রাফার বিশ্বরঞ্জন রক্ষিতও প্রণাম করলেন শিল্পীকে। পাশে তখন আরও দু’জন দাঁড়িয়ে, আকাশবাণীর জন্য ছোট্ট সাক্ষাৎকার নিতে এসেছেন। কবিতা সিংহ এবং উপেন তরফদার। রেডিয়োর দুই প্রিয়, পরিচিত নাম। কবিতাদিকে আমি বেশ কিছুকাল চিনি সুরবাণীর অ্যাডভাইজার কমিটিতে থাকার দরুণ। ওঁর অনুষ্ঠানে সাক্ষাৎকারও নিয়েছিলাম সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের। কবিতাদি রবিশঙ্করকে বললেন, “রবিশঙ্করবাবু, আমি এই ছেলেটিকে অনেকদিন চিনি। ও জানে যে আপনার ‘পরমেশ্বরী’ শুনে আমার মেয়ের নাম রেখেছি পরমেশ্বরী।”
রবিশঙ্কর হেসে কপালে হাত ছোঁয়ালেন। বললেন, “নামটার মধ্যে বিউটি অ্যান্ড স্পিরিচুয়্যালিটি” আছে। রাগটা ক্রিয়েট করার সময় এই এই দুটো ভাবনাই মাথায় ছিল।” তারপর ওঁর পাশে বেতের আর্মচেয়ারে বসা আমাকে বললেন, “ওঁদের পনেরো মিনিটের রেকর্ডিংটা শেষ করে নিই, তারপর আমরা কথা বলি?”
আমি ক্রমাগত বিস্মিত হচ্ছিলাম বিশ্ববিখ্যাত মানুষটির স্বভাব-বিনয় দেখে। বলতেই হল, “নিশ্চয়ই! নিশ্চয়ই!” রবিশঙ্কর তখন কবিতার দিকে ঘুরে বললেন, “নিন, শুরু করুন।” উপেন তরফদার এগিয়ে এসে মাইক ধরে বললেন, “একটু কিছু বলুন।”
রবিশঙ্কর মুখে একটা সূক্ষ্ম হাসি মেলে ওঁর পরমেশ্বরীর স্বরগুলো উচ্চারণ করে গেলেন। হয়তো তখনই আমি আমার প্রথম উপন্যাসের প্রথম তিনটি বাক্য পেয়ে গিয়েছিলাম—“পায়ের ওপর পা। পরমেশ্বরী। এই ছিল রূপা।”

কবিতাদির কাজ শেষ হতে উনি শিল্পীর কাছে অনুমতি চাইলেন আমাদের সাক্ষাৎকারটা শোনার। বললেন, “আমার কাজ তো হয়ে গেছে। এবার আপনাদের কথা একটু শুনি।” তখন রবিশঙ্কর আমার দিকে চেয়ে বললেন, “কী হে, ইংরেজি কাগজের জার্নালিস্ট, বল তোমার কথা।”
বললাম, “বছরের ন’মাসই তো কাটে আপনার ইউরোপ, আমেরিকায়, মাত্র দু’তিন মাস ভারতে থেকে আর তার মধ্যে দিন কয়েক কলকাতায় এসে অনুভূতিটা কীরকম দাঁড়ায়?”
শুরুতে এমন একটা প্রশ্নে একটু চমকেছিলেন শিল্পী বুঝি বা। চোখ দুটো বন্ধ করে কী একটা ভাবলেন ক’মুহূর্ত। তারপর চোখ খুলে বললেন, “বাড়ি ফেরা। এই যে দাদার সঙ্গে আছি। এও তো ঘরে ফেরা।”
—তাহলে বলছেন কলকাতাই আপনার ঘর?
হাসলেন রবিশঙ্কর। বললেন, “কাশীর বাঙালিটোলাতেই প্রথম ঘর। সেখানেই ছেলেবেলার যা কিছু। তবে বাঙালি তো, ১৯৩৫-এ দাদার সঙ্গে প্রথম কলকাতায় এসে বুঝলাম বাঙালির টিকি কোথায় বাঁধা। এই দেখো না দাদাকে, সারা দেশ-দুনিয়া চষে শেষে জায়গা করলেন কলকাতায়। ওই নাড়ির টান না কী বলে যেন! ভাষা, কল্পনা, স্বপ্ন, দুঃস্বপ্ন, ভাব, ভালবাসা সবই তো গচ্ছিত এখানে। জানো তো আমিও যৌবনে এই শহরের বালিগঞ্জ ফাঁড়িতে ফ্ল্যাট নিয়ে অন্নপূর্ণার সঙ্গে কতদিন কাটিয়ে গেছি। আশু ভাই, মানে আলি আকবরও তো কতকাল থাকল এ শহরে। বাবা আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবও আসতেন এখানে। সারা দেশের গানবাজনার ডেরা তখন এই কলকাতা। এখানেই তো ‘পথের পাঁচালী’ হল। জার্নি শুরু হল মানিকবাবুর। আর ওই ছবিতে আমার সুর আজও কোথায় না কোথায় শুনতে পাই। আমার দাদার কথাই ভাবো না…” রবিশঙ্কর কথা শেষ করার আগেই ওঁর দুই কাঁধের ওপর সযত্নে দুটি হাত চাপা পড়ল পিছন থেকে। আমরা সচকিত হয়ে দেখলাম হাত দুটি ওঁর বড়দাদা উদয়শঙ্করের!

আমরা সবাই উঠে দাঁড়িয়ে ওঁকে প্রণাম জানালাম। উনি স্মিত মুখে ইশারা করলেন বসতে। রবিশঙ্কর পিছনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “দাদা, এরা আমার ইন্টারভিউ নিচ্ছে।” উদয়শঙ্কর কীরকম গর্বিত দাদার সুরে বললেন, “নেবেই তো।” আর বলেই সবাইকে নমস্কার জানিয়ে যেমন নীরব পদক্ষেপে এসেছিলেন তেমনই নিঃশব্দে চলে গেলেন।
রবিশঙ্কর আমাকে বললেন, “তাহলে ইন্টারভিউ শুরু হোক।” অদূর থেকে ফিসফিস করে বলা কবিতাদির কথাটা কানে এল, “ইন্টারভিউ তো শুরু হয়েই গেছে।”
হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ডের রবিবারের আর্টস পেজে সেই ইন্টারভিউয়ের চেহারাটা যা হয়েছিল ভাবা যায় না। আজও চোখের সামনে ভাসে। পাতার দায়িত্বে থাকা সাংবাদিক অরুণ বাগচীকে পরামর্শ দিয়েছিলেন অভীকবাবু। আফশোস একটাই যে দেব-দেব করে সেই পেজ একটা উদয়শঙ্করকে পৌঁছে দিয়ে আসতে পারিনি।

খোঁচাটা যে ভেতরে থেকে গিয়েছিল তা নির্মমভাবে টের পেলাম পাঁচ বছর পর, ১৯৭৭-এ। যখন লন্ডনে রবিশঙ্করের আত্মকথা ‘রাগ-অনুরাগ’ নিয়ে শিল্পীর সঙ্গে কাজ করেছি। হঠাৎ একদিন ফোন এল অভীকবাবুর, “উদয়শঙ্কর আর নেই। রবিবাবুকে দিয়ে একটা স্মরণ লেখাও।”
রবিশঙ্করকে খবরটা দিতে উনি বেশ কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে রইলেন। একটা লেখা লিখতে হবে বলতে বললেন, “তুমি ঘুরে এসো বেলা তিনটে নাগাদ।”
তিনটের সময় যেতে উনি নিজের হাতে লেখা দাদার স্মৃতিচারণা ‘দাদার কথা’ হাতে তুলে দিলেন। আনন্দবাজার অফিসে গিয়ে লন্ডন করেসপন্ডেন্ট অশোক গুপ্তকে সঙ্গে নিয়ে ফ্লিট স্ট্রিটের টেলিগ্রাফ অফিসে পৌঁছে বাংলা লেখাকে রোমান হরফে করে পাঠানো শুরু হল। আমি বাংলা শব্দকে রোমান হরফে বলে যাচ্ছি আর ঝড়ের গতিতে টাইপ করে গেলেন অশোকদা। রাত ন’টায় শেষ হল পাঠানো। কলকাতায় তখন রাত দুটো। পরদিন আনন্দবাজারে লিড হয়ে বেরলো রবিশঙ্করের ‘আমার দাদা’। শুনেছি শহরে বিরাট কৌতূহল ছড়িয়েছিল কী করে এত দ্রুত রচনা এল পণ্ডিতজির।
উদয়শঙ্করের সেই সংবাদ সম্বলিত আনন্দবাজার পত্রিকাটি রবিশঙ্করের কাছে যেদিন নিয়ে গেলাম উনি বহুক্ষণ ধরে সেই জনস্রোতের ছবি দেখলেন। তারপর শান্ত স্বরে বললেন, “কলকাতাই পারে মানুষকে এমন সম্মান দিতে!” আমি চুপ করে ছিলাম, পাঁচ বছর আগে ওঁর দাদাকে ইন্টারভিউয়ের কাগজটা পৌঁছে না দেওয়ার খোঁচাটা ফিরে এল যেন।
আরও কিছুক্ষণ পর কানে এল প্রায় আনমনে বলা কথাটা, “কী বল, মরতে হলে কলকাতাতেই মরা ভাল!”
এর আমি কী উত্তর দেব! নিশ্চুপ থেকে জানলার বাইরে লন্ডনের মেঘলা আকাশ দেখতে থাকলাম।
(চলবে)
ছবি সৌজন্য: Wikipedia, Flickr, Wikimedia Commons.
শংকরলাল ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট, কলকাতায়। ইংরেজি সাহিত্যে স্বর্ণপদক পাওয়া ছাত্র শংকরলাল সাংবাদিকতার পাঠ নিতে যান প্যারিসে। তৎপরে কালি-কলমের জীবনে প্রবেশ। সাংবাদিকতা করেছেন আনন্দবাজার গোষ্ঠীতে। লিখেছেন একশো ত্রিশের ওপর বই। গল্প উপন্যাস ছাড়াও রবিশংকরের আত্মজীবনী 'রাগ অনুরাগ', বিলায়েৎ খানের স্মৃতিকথা 'কোমল গান্ধার', হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিমালা 'আমার গানের স্বরলিপি'-র সহলেখক। অনুবাদ করেছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা থেকে সত্যজিৎ রায়ের চিত্রনাট্য পর্যন্ত।
জানি এ রচনা কতটা interesting আর হৃদয়গ্রাহী হবে । তাই পড়ছি ও পরবর্ত্তী কিস্তির জন্য অপেক্ষা ক’রে আছি ।