হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ডের প্রথম বছরেই আমার পরিচয় ঘটে গেল আনন্দবাজার গোষ্ঠীতে আমার চার প্রিয় মানুষের সঙ্গে। এঁদের প্রত্যেকের বেলাতেই কেমন করেই জানি একেকটা বই এসে পড়ল। বলতে গেলে ওই বইগুলিই যেন গড়ে দিল সম্পর্কগুলো। সেই চার প্রিয় মানুষ যথাক্রমে— সহকর্মী সাংবাদিক বিক্রমন নায়ার, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এবং রমাপদ চৌধুরী। আর সেই চার বই? তাহলে সেই গল্পগুলোই শোনাতে হয়। আসুন…
বাহাত্তর সালেই কাগজে একটা খবর চোখে পড়ল আমার আর নায়ারদার। তখন তো নায়ারদার এডিটিং ডেস্কেই আমি; ও চিফ সাব, আমি সাব। কী ডে শিফটে, কী নাইট শিফটে আমাদের দেদার কথাবার্তা আর তর্ক চলে বইপত্র আর সাহিত্য নিয়ে। কামু, সার্ত্র তো আছেনই, এসে পড়েন রিলকে, ইয়েটস, অরওয়েল, পাস্তেরনাক, এলিয়ট, মোরাভিয়া। বাংলা সাহিত্যের প্রসঙ্গ উঠলে অবধারিতভাবে রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দ, তারপর সমরেশ বসু, শক্তি, সুনীল, বিনয়। মনে আছে নায়ারদা ইয়েটস এবং জীবনানন্দকে Kindred spirits বলে বর্ণনা করত। নাটক বলতে নায়ারদা বুঝত শেক্সপিয়ার আর ব্রেশট। আধুনিক কবিদের মধ্যে ওকে মুগ্ধ করত পাবলো নেরুদা।

নাইট শিফটের পর আমাদের বাকি রাত কাটাতে হত অফিসেই— টেবিলজোড়া বিছানায় বিছানায় ঘুম দিয়ে। তবে নায়ার ফর্মে থাকলে ঘুমের দফারফা হতে সময় লাগত না। মার্কসবাদী নায়ারের তখন সারাক্ষণের চর্চা চে গেভারা, প্যারিসের ছাত্রবিপ্লব, মাও জে দং আর চিনের ভবিষ্যৎ এবং সর্বোপরি মার্কসের জীবন ও কাজ নিয়ে যে-কোনও নতুন বই।
তো এই নায়ারের সঙ্গে একদিন ডে শিফটে কাজ করতে গিয়ে টেলিপ্রিন্টারে একটা খবর উঠে এল। সে-বছর সাহিত্যের নোবেল প্রাইজের সম্ভাব্য বিজয়ীদের একটা তালিকা, যাকে বলে শর্ট লিস্ট। অর্থাৎ বাছাই করে করে যে পাঁচ-সাতটা নামে এসে ঠেকেছে কমিটি। যাঁদের একজনের কপালেই আছে সেই বছরের নোবেল।
সেই তালিকার চারজনের নাম আমার ও নায়ারের চেনা। কিন্তু পঞ্চম নামটি সম্পূর্ণ অচেনা। তাঁর বর্ণনায় বলা হয়েছে তিনি আর্জেন্তিনীয় গল্পকার, মান্য হন স্প্যানিস ভাষার এক শ্রেষ্ঠ লেখক হিসেবে। নাম হর্হে লুইস বর্হেস। এই কপি কাগজের জন্য লিখতে লিখতে মন থেকে হারিয়ে গেল বাকি চার নাম, আমাদের দু’জনেরই মগজে পাক খাচ্ছে বর্হেস, বর্হেস, বর্হেস। আর সে-সব তো গুগল সার্চের দিন নয়, লেখকদের জীবনী যা-সব আনন্দবাজারের লাইব্রেরিতে আছে সেও বেশ প্রাচীন ব্যাপার। অতএব অপেক্ষায় থাকতে লাগলাম ১০ অক্টোবর তারিখের জন্য, যেদিন সাহিত্যের নোবেলজয়ীর নাম ঘোষণা হবে।

হলও। কিন্তু নামটা হর্হে লুইস বর্হেসের নয়। যাঁর নাম এল তিনিও বড় ঔপন্যাসিক, পশ্চিম জার্মানির—হাইনরিশ ব্যোল। তাঁর সতীর্থ গুন্টর গ্রাসের ‘দ্য টিন ড্রাম’, ‘ক্যাট অ্যান্ড মাউস’ আমাদের পড়া ছিল, ব্যোলের নাম জানাটুকুই সার। নোবেল পাওয়াতে অচিরে বাজার ছেয়ে গেল ওঁর বইয়ে। সে-সব কিনে কিনে পড়া শুরু হল আমার ও নায়ারের। কিন্তু দু’জনের মনের মধ্যেই একটা মস্ত তেষ্টা— বর্হেস।
দেখতে দেখতে শীত এসে গেল। সেবারে বেজায় শীত। নাইট শিফটে ফের একত্র হলাম আমি ও নায়ারদা। রাতে বিছানায় শুয়ে ওর শুরু হল আমাকে তাতানো—“যদি সকালবেলা আমার মেসে আসো তো এমন একটা কিছু ঘটবে যা তোমার জীবন বদলে দেবে।”
জীবন বদলে দেবে? সে আবার কী?
নায়ারদা বলল, “একটা বই।”
বললাম, “বই? কী বই? কার বই?”
নায়ারদার ফের ধোঁয়াশা, “তার জন্য আমার মেসে আসতে হবে।”
বললাম, “আপনার মেসে তো আকছার যাই। এই বইয়ের জন্য বিশেষ করে কেন?
নায়ারদা শুধু মিটিমিটি হাসল।
৬৯ নং রিপন স্ট্রিটে নায়ারদাদের মেসটা ছিল এক আজব, মজার জায়গা। নায়ারদার ঘরটা ছিল হাজার বইয়ে ঠাসা, ছড়ানো-ছিটোনো কাগজপত্র, কালিকলমে একাকার এক ‘চিন্তার বাজার’। এই চিন্তার বাজার বা মার্কেট অফ থট নামটা দিয়েছিল এক তরুণ জার্মান লেখক যে কিছুদিন এসে থেকেছিল ওই ঘরে। যাবার সময় ছেড়ে গিয়েছিল রিলকের এক কপি ‘ডুইনো এলিজি’ যা হাত ঘুরে আমার কাছে এসে পড়ে।

সেদিন সকালে ট্রামে করে যখন নায়ারের মেসে যাচ্ছি কেবলই শুনি ও বলছে, “জীবনে বেশি বই থাকে না যা তোমার জীবনটাই বদলে দেবে। ক্ল্যাসিক্স-ফ্ল্যাসিক্স তো ঢের আছে, থাকবেও, পড়তেও হবে। কিন্তু এই যেটা গত তিনদিন পড়ে কাহিল হয়ে গেলাম, এ বই নয় বারুদ। মগজ প্রায় বিগড়ে যাবার দশা। শুধু মনে হচ্ছিল তোমার সঙ্গে শেয়ার করে একটু নর্মাল হই। পরেই ভাবলাম, No. You also need this shock. তোমাকে পড়ে পাগল হতে হবে। তাই সবুর করো, মেসে গিয়ে টোস্ট, অমলেট, চা নিয়ে বসি। তারপর…”
অমলেট, টোস্ট চিবোচ্ছি যখন নায়ারদা ওর মাথার বালিশের তলা থেকে আস্তে করে বইটা বার করে ধরল আমার চোখের সামনে। দেখলাম বইয়ের নাম ‘ল্যাবিরিন্থস’, অর্থাৎ গোলকধাঁধা. আর লেখকের নামের জায়গায়— হর্হে লুইস বর্হেস।
ভাবলাম, আরেহ, এই তো সেই লেখক যাঁর হদিশ পাচ্ছিলাম না আমরা অ্যাদ্দিন! জানতে চাইলাম, “তা, কোথায় পেলেন এটা?” নায়ারদা ফের রহস্য বাড়াল, “সে জেনে তোমার কী কাজ? বইটা নিয়ে বাড়ি যাও আর পড়ো। তারপর কথা হবে। Hurry! Hurry!”

চা শেষ করে বই নিয়ে ছুটে বেরিয়ে এসেছিলাম। মা চা আর লুচি দিতে তাই মুখে দিতে দিতে পড়া শুরু করেছিলাম। আর Oh my God! প্রায় প্রতিটি গল্পে যেন এক নতুন জগৎ, নতুন মহাবিশ্ব, নতুন বাস্তব, নতুন নিয়তি! এমন জাদুকরী ভাষা ও বয়ন যে একই পাতা বার বার পড়ছি। আর গল্পের যে কী বুনোট! অনেক কাহিনিই গোয়েন্দা কাহিনি, যে-গোয়েন্দা কাহিনির সূত্র সুরি। বন্দুক, রক্তের দাগ, পদচ্ছাপ নয়, সব সূত্রই কোনও না কোনও ইতিহাস, তত্ত্ব ও আইডিয়া। কেবল এই জন্মেরই নয়, পূর্বজন্মেরও বৃত্তান্ত। সর্বোপরি সত্তা, অর্থাৎ identity. আমি কে? কেন? এসব প্রশ্নও ঘুরেফিরে আসছে। যেমন গল্পের বইয়ের মধ্যে ছড়ানো কিছু অপূর্ব প্রবন্ধের মধ্যে একটির শিরোনাম ‘বর্হেস অ্যান্ড আই’। অর্থাৎ বর্হেস এবং আমি। যার শেষ বাক্যটি দাঁড়াল: এই যে পাতাটি লেখা হল, তা কে লিখল—বর্হেস না আমি?
‘ল্যাবিরিন্থস’ যে আমাকে কীভাবে তোলপাড় করেছিল তা এই পূর্বকথায় বারবার ঘুরে আসবে। রবীন্দ্রনাথের গীতবিতান, শ্রীম’র কথামৃত, শেক্সপিয়রের ট্র্যাজেডি, কামুর গদ্য, ইয়েটস ও এলিয়টের কবিতার মতো বর্হেসের গল্প, প্রবন্ধ, আত্মকথা আমার জীবনসঙ্গী হল. নায়ারদার কথা সত্যি হল: আমার জীবনটা অজস্র বদলে গেল। ‘জীবন থেকে জীবনে’র আগামী কোনও পর্বে সেকথা ফিরে আসবে। আপাতত শক্তি, সুনীল, রমাপদ চৌধুরী প্রসঙ্গে যাব, আর সেই সম্পর্কে যে তিনটি বই প্রসঙ্গ হয়ে উঠেছিল সেই কথায়…
(চলবে)
*ছবি সৌজন্য: Wikipedia, Picryl.
*পরের পর্ব প্রকাশ পাবে ১৯ জুলাই, ২০২৩
শংকরলাল ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট, কলকাতায়। ইংরেজি সাহিত্যে স্বর্ণপদক পাওয়া ছাত্র শংকরলাল সাংবাদিকতার পাঠ নিতে যান প্যারিসে। তৎপরে কালি-কলমের জীবনে প্রবেশ। সাংবাদিকতা করেছেন আনন্দবাজার গোষ্ঠীতে। লিখেছেন একশো ত্রিশের ওপর বই। গল্প উপন্যাস ছাড়াও রবিশংকরের আত্মজীবনী 'রাগ অনুরাগ', বিলায়েৎ খানের স্মৃতিকথা 'কোমল গান্ধার', হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিমালা 'আমার গানের স্বরলিপি'-র সহলেখক। অনুবাদ করেছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা থেকে সত্যজিৎ রায়ের চিত্রনাট্য পর্যন্ত।
অনেক শুভেচ্ছা । খুব ভালো লাগছে ।