দীনবন্ধু মিত্রের সধবার একাদশী নাটকের প্রধান চরিত্র, নিমচাঁদ, ইংরেজি শিক্ষিত, উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান, কিন্তু মদ্যপায়ী। অন্যদিকে, সে কথায় কথায় শেকসপিয়র, মিল্টন, পোপ-এর লাইন আওড়ায়। এমনকি, মদ খাওয়ার সমর্থনেও সে কবিতার লাইন উদ্ধৃত করতে ছাড়েনা। এছাড়াও গোটা নাটকে ছড়িয়ে আছে শেকসপিয়রের বিভিন্ন নাটকের উদ্ধৃতি, যেমন– ম্যাকবেথ, রোমিয়ো আর জুলিয়েট, হ্যামলেট । মদ্যপায়ী হলেও, নেশার ঘোরে নিমচাঁদ অবশ্য কখনওই কোনও ভুল বা অসংলগ্ন পংক্তি বলে না। বিশেষ করে চোখে পড়ে যখন নিমচাঁদ হেনরি ফিল্ডিং-এর স্বল্প-পরিচিত ও বর্তমানে প্রায় বিস্মৃত দ্য জাস্টিস কট ইন হিজ ওন ট্র্যপ নাটকের লাইন আওড়ে বলে: ‘বাবা, যদি রাইম কত্তে চাও, তবে মদটা ধর’।ফিল্ডিং-এর এই নাটকের উদ্ধৃতি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় সেকালের কেবলমাত্র ইংরেজি চর্চার নয়, ইংরেজি নাট্যচর্চারও পরিব্যপ্তি!

রাইম আর মদের সরাসরি যোগসূত্র না থাকলেও, ইংরেজি শিক্ষা, তথা শেকসপিয়র যে বাঙালির আসক্তির বিষয়, সেটার একটু আধটু নমুনা আমরা দেখে নিই। নীরদচন্দ্র চৌধুরি তাঁর আত্মজীবনীর প্রথম খন্ডে লিখেছেন যে পৃথিবীতে অন্য কোনও দেশ বা জাতির কথা তিনি জানেন না যারা একজন লেখককে এমন করে তাদের সাহিত্যের মূর্তিরূপ ও প্রতীক বানিয়েছে যেমন শেকসপিয়রকে উনিশ শতকের বাঙালি করেছিল! উনিশ শতকে শেকসপিয়র শুধুমাত্র ইংরেজিআনার একমাত্র চিহ্ন ছিল না; শেকসপিয়র ছিল সার্বভৌম মানবতার প্রতীক। শার্লট ব্রোন্তের শার্লে উপন্যাসের নায়ক রবার্ট মূর অর্ধেক ইংরেজ, অর্ধেক বেলজিয়ান; নায়িকা ক্যারোলাইন রবার্টকে বোঝাচ্ছে যে সে পুরোপুরি ইংরেজ হতে পারবে একমাত্র শেকসপিয়র পড়েই। টমাস কার্লাইল তো ঘোষণাই করেছিলেন ‘ভারতীয় সাম্রাজ্য যায় যাক, কিন্তু শেকসপিয়র ছাড়া আমাদের চলবেনা’। শেকসপিয়র হল ‘অবিনশ্বর সাম্রাজ্য’।
নিমচাঁদ রবার্ট নয়, কিন্তু ওই অবিনশ্বর সাম্রাজ্যের সে প্রতীয়মান মুর্তি। ইংরেজি শিক্ষা নিয়ে তাঁর বেশ কিছুটা অহমিকাও আছে — সে ইংরেজি পড়ে, লেখে, বলে, ইংরেজিতে বক্তৃতা দেয়, ভাবে, স্বপ্নও দেখে। নিমচাঁদ ইংরেজি ‘কালেজে’ পড়েনি, ইংরেজি শিখেছে গৌড়মোহন আঢ্যর স্কুলে। যদিও দীনবন্ধু মিত্র নিজে হিন্দু কলেজের ছাত্র ছিলেন, এখানে গৌরমোহন আঢ্যর স্কুলকে বেশী প্রাধান্য কেন দিচ্ছেন, সেই কারণ অন্বেষণে আমরা যাচ্ছি না।

কলকাতায় শেকসপিয়র চর্চার শুরু
কলকাতায়, তথা বাংলায়, শেকসপিয়র চর্চা শুরু আঠার শতকের মাঝামাঝি। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মীদের বিনোদনের জন্য ১৭৫৩-তে ওল্ড প্লেহাউস নামক নাট্যশালা খোলা হয়, কিন্তু তা ছিল ক্ষণস্থায়ী। এখানে মঞ্চস্থ হয়েছিল রিচার্ড তৃতীয় এবং হ্যামলেট। এরপর ১৭৭৫-এ খোলা হয় ক্যলকাটা থিয়েটার।জানা যায় যে ডেভিড গ্যারিক, আঠারো শতকের লন্ডনের বিখ্যাত অভিনেতা, ম্যাসিঙ্ক নামে তাঁর এক সহচরকে কলকাতা পাঠিয়েছিলেন তাঁর প্রবাসী স্বজাতীদের শেকসপিয়র নাট্যিকরণে সহায়তা করতে।
১৮৩১-এ খোলা হয় হিন্দু থিয়েটার, যার মূখ্য উদ্দেশ্য ছিল শেক্সপিয়রের নাটকের অভিনয়করণ। ক্রমে ক্রমে ইংরেজি থিয়েটার, তথা শেকসপিয়র, বাঙালিদের দখলে আসতে শুরু করে। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ১৮৪৮-এর আগস্ট মাসে সাঁ সুসি থিয়েটারে বৈষ্ণবচরণ আঢ্যর ওথেলো-তে সাড়াজাগানো অভিনয়।
১৮১৭ –এ প্রতিষ্ঠিত হিন্দু কলেজ হয়ে ওঠে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র। এর এক দশকেরও পরে, ১৮২৯-এ, গৌরমোহন আঢ্য ওরিয়েন্টাল সেমিনারী প্রতিষ্ঠা করেন। স্বনামধন্য এই স্কুলে পড়ত উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলেরা, যার মধ্যে ছিলেন রবীন্দ্রনাথও। ওরিয়েন্টাল সেমিনারী অবশ্য অন্য ভাবে আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এর আগে প্রতিষ্ঠিত ইংরেজি স্কুলগুলো, যেমন শেরবোর্নস স্কুল, ডেভিড ড্রামন্ডস একাডেমী, ডাফস ইন্সটিটিউট ছিল ইংরেজদের প্রতিষ্ঠান। ওরিয়েন্টাল সেমিনারী প্রথম ইংরেজি স্কুল, যা কোনও বাঙালির প্রতিষ্ঠা করেন। তবে এইসব স্কুলে পাঠ্যসূচির বড় অংশ জুড়ে ছিল শেকসপিয়র। ছাত্র থাকাকালীন ডিরোজিও বা মধুসূদন যথাক্রমে দ্যা মার্চেন্ট অফ ভেনিস আর পঞ্চম হেনরি –তে অভিনয় করে ইংরেজিতে তাঁদের সাবলীল বাগ্মীতার যে পরিচয় দেন, তা সুবিদিত। এই বিদ্যায়তনিক শেকসপিয়র অভিনয়ে ডিরোজিওই প্রথম বাঙালি। তবে রামতনু লাহিড়ী, কৃষ্ণমোহন ব্যানার্জি বা অমৃতলাল রায়ও ছাত্রাবস্থায় শেকসপিয়র অভিনয় করে বেশ প্রশংসা পেয়েছিলেন।
কলকাতায়, তথা বাংলায়, শেকসপিয়র চর্চা শুরু আঠারো শতকের মাঝামাঝি। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কর্মীদের বিনোদনের জন্য ১৭৫৩-তে ওল্ড প্লেহাউস নামক নাট্যশালা খোলা হয়, কিন্তু তা ছিল ক্ষণস্থায়ী। এখানে মঞ্চস্থ হয়েছিল রিচার্ড তৃতীয় এবং হ্যামলেট। এরপর ১৭৭৫-এ খোলা হয় ক্যলকাটা থিয়েটার। জানা যায় যে ডেভিড গ্যারিক, আঠারো শতকের লন্ডনের বিখ্যাত অভিনেতা, ম্যাসিঙ্ক নামে তাঁর এক সহচরকে কলকাতা পাঠিয়েছিলেন তাঁর প্রবাসী স্বজাতীদের শেকসপিয়র নাট্যিকরণে সহায়তা করতে।

দেশী মঞ্চে শেকসপিয়র
সময়ক্রমে আরও নাট্যশালা খোলা হয়, যেমন চৌরঙ্গি থিয়েটার বা সাঁ সুসি, তবে সেগুলোর নির্মাণে দ্বারকানাথ ঠাকুরের মত অভিজাতরা আর্থিক সাহায্য দেন। তবে এইসব থিয়েটার ছিল ইংরেজ দর্শকদের জন্য। এই থিয়েটারগুলোয় ইংল্যান্ড থেকে অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রী অভিনয় করতে আসতেন, যাঁদের মধ্যে এস্থার লীচ উল্লেখযোগ্য। ১৮৩১-এ খোলা হয় হিন্দু থিয়েটার, যার মূখ্য উদ্দেশ্য ছিল শেক্সপিয়রের নাটকের অভিনয়করণ। ক্রমে ক্রমে ইংরেজি থিয়েটার, তথা শেকসপিয়র, বাঙালিদের দখলে আসতে শুরু করে। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ১৮৪৮-এর আগস্ট মাসে সাঁ সুসি থিয়েটারে বৈষ্ণবচরণ আঢ্যর ওথেলো-তে সাড়াজাগানো অভিনয়। বৈষ্ণবচরণের বিপরীতে ডেসডিমোনার ভূমিকায় অভিনয় করেন বিখ্যাত এস্থার লীচের কন্যা মিসেস এন্ডারসন। সম্পূর্ণ ইউরোপীয়দের নিয়ে গঠিত ওই নাট্যদলে বৈষ্ণবচরণ ছিলেন একমাত্র বাঙালি। ক্যলকাটা স্টার পত্রিকা একটু তিজর্কভাবে লিখেছিল ‘the real unpainted nigger Othello’!
কাজেই, শেক্সপিয়রের নেশা বাঙালিকে ভর করেছিল ম্যাকলের ইংরেজি শিক্ষানীতি প্রবর্তনের আগেই। যে আসক্তির কথা আগে বলেছি, সেই আবহের পরিচয় পাই রবীন্দ্রনাথে। জীবনস্মৃতি-তে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন যে তাঁর বাল্যকালে ‘রোমিও-জুলিয়েটের প্রেমোন্মাদনা’, ‘লিয়রের অক্ষম পারিতাপের বিক্ষোভ’, ‘ওথেলোর ঈষার্নলের প্রলয়দাবদাহ’ অক্ষয় চৌধুরীর আবৃত্তিতে ‘তীব্র নেশার ভাব’ জাগাত। কবির বিভিন্ন লেখায় শেক্সপিয়রের অনেক উল্লেখ আছে, আছে প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যের সঙ্গে শেক্সপিয়রের নাটকের তুলনামূলক সমালোচনা। তাঁর নাটকেও যে শেক্সপিয়রের প্রভাব আছে, সেকথাও অনেকে বলেছেন।আমরা এও জানি যে বাল্যকালে রবীন্দ্রনাথ ম্যাকবেথ-এর অনুবাদ করেছিলেন, যার অংশমাত্র এখন পাওয়া যায়।

তবে বাল্যকালে যা ছিল নিছক আসক্তি, জীবনের শেষ প্রান্তে এসে সেই শেকসপিয়রকে কেন্দ্র করে তাঁর নিজের শিল্পতত্বের এক নতুন ভাবনা তুলে ধরলেন। ১৯৪১-এর ‘সাহিত্যের মূল্য’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যে রস এবং রূপের পার্থক্য দেখাতে গিয়ে বলছেন যে গীতিকবিতা সৃষ্টি করে রসের, নাটক করে রূপের। তিনি লিখছেন, ‘সাহিত্যের ভিতর…ভাবের আকূতি অনেক পেয়ে থাকি এবং তা ভুলতেও বেশি সময় লাগে না। কিন্তু সাহিত্যের মধ্যে মানুষের মূর্তি যেখানে উজ্জ্বল রেখায় ফুটে ওঠে সেখানে ভোলবার পথ থাকে না…. সেই কারণে শেক্সপিয়রের লুক্রিস এবং ভিনস অ্যান্ড অ্যাডোনিসের কাব্যের স্বাদ আমাদের মুখে আজ রুচিকর না হতে পারে’। কিন্তু লেডি ম্যাকবেথ অথবা কিং লীয়র অথবা অ্যান্টনি ও ক্লিয়োপেট্রা চিরস্মরনীয়। ‘শেকসপিয়র মানব-চরিত্রের দ্বারোদ্ঘাটন করে দিয়েছেন, সেখানে যুগে যুগে লোকের ভিড় জমা হবে’। এর থেকে আমরা বুঝতে পারি রবীন্দ্রনাথের কাছে শেকসপিয়র কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
বৈষ্ণবচরণের বিপরীতে ডেসডিমোনার ভূমিকায় অভিনয় করেন বিখ্যাত এস্থার লীচের কন্যা মিসেস এন্ডারসন। সম্পূর্ণ ইউরোপীয়দের নিয়ে গঠিত ওই নাট্যদলে বৈষ্ণবচরণ ছিলেন একমাত্র বাঙালি। ক্যলকাটা স্টার পত্রিকা একটু তিজর্কভাবে লিখেছিল ‘the real unpainted nigger Othello’!
১৮৩১-এ খোলা হয় হিন্দু থিয়েটার, যার মূখ্য উদ্দেশ্য ছিল শেকসপিয়রের নাটকের অভিনয়করণ। ক্রমে ক্রমে ইংরেজি থিয়েটার, তথা শেকসপিয়র, বাঙালিদের দখলে আসতে শুরু করে। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ১৮৪৮-এর আগস্ট মাসে সাঁ সুসি থিয়েটারে বৈষ্ণবচরণ আঢ্যর ওথেলো-তে সাড়াজাগানো অভিনয়। বৈষ্ণবচরণের বিপরীতে ডেসডিমোনার ভূমিকায় অভিনয় করেন বিখ্যাত এস্থার লীচের কন্যা মিসেস এন্ডারসন। সম্পূর্ণ ইউরোপীয়দের নিয়ে গঠিত ওই নাট্যদলে বৈষ্ণবচরণ ছিলেন একমাত্র বাঙ্গালি। ক্যলকাটা স্টার পত্রিকা একটু তিজর্কভাবে লিখেছিল ‘the real unpainted nigger Othello’!
এছাড়া, সূচনাপর্ব থেকেই বাংলায় শেকসপিয়রের নাটকই ছিল মূল চর্চার বিষয়, তাঁর সনেটগুচ্ছ বা কবিতা থেকে গেছে আলোচনার বাইরে। রবীন্দ্রনাথের এই তত্ত্ব এর সম্ভব্য কারণে কিছুটা আলোকপাত করলেও করতে পারে।
একথা ঠিকই যে তাঁর নাটকে চরিত্রের বৈচিত্র ও শৌর্য, এবং তাদের বলিষ্ঠ চিত্রায়ণই বাঙ্গালিকে শেকসপিয়ররের প্রতি আকৃষ্ট করেছিল। এর সঙ্গে আমরা যোগ করব তাঁর প্লটের বহুলতা, ভাষার ঔজস্য ও ব্যঞ্জনা, এবং নাটকীয়তা। শেকসপিয়রের নাটকের এইসব বৈশিষ্ট বাংলা সাহিত্যে যথেষ্ট প্রভাবও বিস্তার করেছিল।

নাটক ও নভেল
বঙ্কিমচন্দ্র নিজেই বলেছেন যে কপালকুন্ডলা লেখার সময় উনি ভালো করে শেকসপিয়র পড়েছিলেন, যদিও দুর্গেশনন্দিনী লেখার আগে আইভ্যানহো পড়েন নি। কপালকুন্ডলা-য় বঙ্কিম অনেক পরিচ্ছেদে শেক্সপিয়রের বেশ কয়েকটা নাটকের লাইন এপিগ্রাফ হিসেবে ব্যবহার করেছেন। শকুন্তলা, মিরান্দা ও ডেসডিমনার তুলনামূলক আলোচনার প্রবন্ধে দেখিয়েছেন অন্য দুজনের চাইতে ডেসডিমোনার চরিত্র অনেক বেশি পরিস্ফুট হয়েছে।
বঙ্কিম যে শেকসপিয়র অনেক গভীরভাবে অধ্যয়ন করেছেন তার আরও একটা উল্লেখযোগ্য নিদর্শন পাই রজনী উপন্যাসে। উপন্যাসের তৃতীয় খন্ডে আমরা দেখি যে অমরনাথ ‘সেক্ষপিয়র গেলেরি’ দেখছেন এবং দেখা শেষ হলে খুব ধারালো মন্তব্যও করছেন। অমরনাথের মতে, ‘যাহা বাক্য এবং কার্জ্যদ্বারা চিত্রিত হইয়াছে, তাহা চিত্রফলকে চিত্রিত করিতে চেষ্টা পাওয়া ধৃষ্টতার কাজ। সে চিত্র কখনোই সম্পূর্ণ হইতে পারে না’।… ডেসডিমনার চিত্র দেখাইয়া কহিলেন, ‘আপনি এই চিত্রে ধৈর্জ্য, মাধুর্জ্য, নম্রতা পাইতেছেন, কিন্তু ধৈর্জের সে সাহস কই? নম্রতার সহিত সে সতীত্বের অহংকার কই?… এ নবযুবতীর মূর্তি বটে, কিন্তু ইহাতে জুলিয়েটের নবযৌবনের অদমনীয় চাঞ্চল্য কই’। অমরনাথের মত যে বঙ্কিমেরই মত সেটা বলা বাহুল্য।

জন বয়ডেলের শেকসপিয়র গ্যালারির ছবি১৭৮০-র শেষের দিকে জন বয়ডেল যিনি পরে লন্ডনের মেয়র হয়েছিলেন, কিছু প্রতিষ্ঠিত চিত্রশিল্পীকে শেক্সপিয়রের নাটকের কিছু দৃশ্য আঁকার দায়িত্ব অর্পণ করেন। সেই ছবিগুলোর একটা বিশালাকার ফোলিও সংস্করণ প্রকাশ করেন শেকসপিয়র গ্যলারি নামে। পরবর্তীকালে, সেই ছবিগুলোর খোদাইকরা নকশা থেকে সস্তায় মুদ্রিত ছবির বাণিজ্যিক সংস্করণ বিক্রি হত আলাদাভাবে বা শেক্সপিয়রের গ্রন্থাবলীর সঙ্গে। তখনকার দিনেও শেকসপিয়র গ্যলারি যে খুব জনপ্রিয় ছিল এমন নয়; সম্ভ্রান্ত ক্রেতারাই বয়ডেলের ছবির সংস্করণ কিনতেন। কিন্তু বঙ্কিমের শেকসপিয়র গ্যলারির নিবিড় পাঠ আমাদের দেখিয়ে দেয় তৎকালীন বাঙালি মননশীল ব্যক্তিবর্গের ভাবনা ও কল্পনাকে শেকসপিয়র কতটা আবরিত করেছিল।
শেকসপিয়রের দিশিকরণ
উনিশ শতকের গোড়ার দিক থেকেই বাঙ্গালিরা শেকসপিয়রকে মূলত অনুবাদ, অভিযোজন আর গদ্য-রূপান্তরের মধ্য দিয়ে দিশিকরণ করতে শুরু করে। বাংলায় প্রথম শেক্সপিয়রের নাটক অনুবাদ করেন মঙ্কটন নামক একজন ইংরেজ। তিনি দ্য টেম্পেস্ট অনুবাদ করেন ১৮০৯-এ। কিন্তু উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকেই বাঙালিরা শেকসপিয়রকে স্বাঙ্গীভূত করার প্রক্রিয়ায় অনুপ্রানিত হন। শুরুতে অবশ্য পুর্ণাঙ্গ নাটক বাদ দিয়ে গুরুদাস হাজরা – মুক্তারাম বিদ্যাবাগীশরা চার্লস ও মেরী ল্যাম্ব-এর টেলস ফ্রম শেকসপিয়র –এর কিছু কিছু গল্পের অনুবাদ করেন। তাঁদের উদ্দিষ্ট পাঠক ছিল যারা ইংরেজিতে শেকসপিয়র পড়তে অক্ষম কিন্তু শেক্সপিয়রের গল্পগুলো পড়ে আনন্দ পেতে চায়। প্রায় একই উদ্দেশ্যে বিদ্যাসাগরও দ্যা কমেডি অফ এররস-এর গল্প ভ্রান্তিবিলাস নামে প্রকাশ করেন ১৮৮৪-এ। গতিময়, রোমাঞ্চকর গল্প পাঠকের কাছে তুলে ধরা—এই ছিল আসল উদ্দেশ্য। কিন্তু তার সঙ্গে ছিল বিদেশী সাহিত্যের বৃহৎ জগতের সঙ্গে বাঙালি পাঠকের পরিচয় ঘটিয়ে দেওয়ার বাসনা।

গ্রন্থে ও মঞ্চে শেকসপিয়রের রূপান্তর
১৮৫৩-তে হরচন্দ্র ঘোষ দ্য মার্চেন্ট অফ ভেনিস-এর পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ প্রকাশ করেন ভানুমতিচিত্তাভিলাস নাম দিয়ে। এটাই কোনও বাঙালির করা প্রথম শেকসপিয়রের নাটকের পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ। তবে হরচন্দ্র মোটেই বিশ্বস্ত অনুবাদ করেননি। এই মর্মে আমরা বলতে পারি যে ঠিক এই সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যলিফোর্নিয়ায় সারা স্টার্ক তেহম্যন থিয়েটারে শেক্সপিয়রের অন্যান্য নাটকের সাথে দ্যা মার্চেন্ট অফ ভেনিসও মঞ্চস্থ করছিলেন। মার্কিন দেশের ওয়েস্ট কোস্টে সেই প্রথম শেকসপিয়র মঞ্চে পরিবেশিত হচ্ছিল। সেদিনও আজকের মত বৈদ্যুতনিক ব্যবস্থা থাকলে একটা আন্তঃ-সাংস্কৃতিক সম্পর্ক তৈরি হতে পারত কিনা সেটা নিছকই অনুমান। এই অনুবাদের ভূমিকায় হরচন্দ্র লিখেছেন যে কোন এক বিদেশি বন্ধুর পরামর্শে তিনি চরিত্রের নাম এবং স্থান পরিবর্তন করেছেন ‘এই অনুবাদকে দেশের রুচির অনুগামী করার উদ্দেশ্যে’।
এর থেকে বোঝা যায় যে বেশিরভাগ অনুবাদ বা অভিযোজনই বাঙালি পাঠকের রুচি এবং বোধকে মাথায় রেখে করা হয়েছে। ভানুমতিচিত্তাভিলাস মঞ্চস্থ হয়েছে বলে জানা নেই। আবার গিরিশ ঘোষ তাঁর অনুদিত ম্যাকবেথ-কে , মূলের প্রতি যথাসম্ভব বিশ্বস্ততা রেখেও কোওনরকম সাফল্যের মুখ দেখেননি। চতুর্থ রাত্রেই নাকি পেক্ষাগৃহ ছিল দর্শকশূন্য! এক্ষেত্রে আমরা উল্লেখ করতে পারি উনিশ শতকে মুম্বইতে গনপত রাও-এর মারাঠি ম্যাকবেথ-এর প্রথম প্রযোজনার ঘটনা। দর্শক এতটাই উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল যে তাঁরা লেডি ম্যাকবেথের নিদ্রাচারী (sleep-walking) দৃশ্য পুনরায় দেখার দাবী তোলে। অগত্যা, গনপত রাও নিজে মঞ্চে এসে বলতে বাধ্য হন যে দর্শককে সেই দৃশ্য পুনরায় দেখতে হলে আবার তিন ঘন্টা নাটকটা শুরু থেকে দেখতে হবে। সময় তখন রাত একটা! হেমচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় শেকসপিয়রকে কালিদাসের উপরে স্থান দিয়েছিলেন ‘ভারতের কালিদাস, জগতের তুমি’–তে বন্দিত করে। দ্যা টেম্পেস্ট- এর খোলনলচে বদলে ১৮৬৮-এ নলিনী-বসন্ত নাটক লেখেন, কিন্তু সেই নাটক পঠিত হলেও কোন মঞ্চ-ইতিহাস তার আছে বলে জানা নেই।

অবশ্য শেকসপিয়রের মৌলিক রচনাকে স্বাধীনভাবে রূপান্তরিত / আত্তিকরণ করার প্রথা খোদ ইংল্যান্ডেই শুরু হয় সতের শতকে। উইলিয়াম দাভেনান্ত থেকে শুরু করে নুহাম টেট পর্যন্ত অনেকেই এই কাজ করেছেন। টেট তো কিং লিয়র-কে পুণর্লিখিত করে নাটকটার চরিত্রই বদলে দিয়েছিলেন। ট্র্যাজেডির বদলে এনেছিলেন পুণর্মিলন এবং আনন্দময় সমাপ্তি! বাস্তবিক অর্থে, রঙ্গালয়ে শেকসপিয়রকে খুব সফল্ভাবে মঞ্চস্থ করার ইতিহাস উনিশ শতকের বাংলায় তেমনভাবে নেই। এর মধ্যে ব্যতিক্রম হরিরাজ (১৮৯৭)। হ্যামলেট –এর অভিযোজিত এই সংস্করণে অভিনয় করেন প্রখ্যাত অভিনেতা অমরেন্দ্র দত্ত। হরিরাজের গানের এল পি ও হয়েছিল। এই সফলতায় উৎসাহিত হয়ে অমরেন্দ্র দত্ত আরও কয়েকটা নাটক যেমন- ম্যাকবেথ (১৮৯৯), কমেডি অফ এররস ( কোনটা কে, ১৯০৫), এবং দ্যা মার্চেন্ট অফ ভেনিস ( সওদাগর, ১৯১৫), অমৃতলাল বসুর পরিচালনায় পরিবেশন করেন। তবে এগুলোর কোনওটাই হরিরাজের মত সফল হয়নি।
বাংলা থিয়েটার
বাংলা থিয়েটারে হ্যামলেট ঘুরেফিরে অনেকবারই এসেছে, এখনো আসে। ১৯৭১-এ লেখা ‘ধর্মতলার হ্যামলেট’’ প্রবন্ধে উৎপল দত্ত হ্যামলেট চরিত্রকে দেখেছেন ’৭০-এর র্যডিক্যল, আমূলসংস্কারপন্থী যুবসম্প্রদায়ের মুখপাত্র হিসেবা। শেকসপিয়রের নাটককে বাংলার সমকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতির ভাষ্য করে উপস্থাপিত করার ক্ষেত্রে উৎপল দত্তের অবদান অসামান্য। কেবলমাত্র রাজনৈতিক ভাষ্যই নয়, উৎপল শেক্সপিয়রের নাটককে সাধারণ মানুষের চেতনায় স্থানান্তরিত করেছিলেন যাত্রার মাধ্যমে। প্রসঙ্গত আমরা বলতে পারি রোমিও এবং জুলিয়েট কে যেমন প্রসেনিয়াম মঞ্চে দেখিয়েছেন, তেমনি তাকে যাত্রার ছাঁচে ঢেলে সম্পূর্ণ অন্যভাবে ভুলি নাই প্রিয়া –তে উপস্থাপিত করেন।

উৎপল দত্তের হ্যামলেট একজন বিপ্লবী, এবং তাঁর দৃষ্টিতে শেকসপিয়র হ্যামলেটকে বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে শ্রেনী-সংগ্রামের প্রতীক হিসেবেই চিত্রিত করেছেন। সে অর্থে হ্যামলেট একটা রাজনৈতিক নাটক, এবং আত্ম-নিমগ্ন, দ্বিধাগ্রস্ত ডেনমার্কের রাজপুত্রের বদল আমরা পাচ্ছি র্যডিক্যাল, বিপ্লবী যুবসম্প্রদায়ের প্রতিনিধির প্রতিচ্ছবি ।
১৯৭৩-এর অসিত বসুর কলকাতার হ্যামলেট উৎপল দত্তের রাজনৈতিক রেখাচিত্রের অনুসরণেই লেখা, কিন্তু হ্যামলেট চরিত্রের সাথে অভিমন্যুকেও মিশিয়ে অসিত, অতীত ও বর্তমানের সমকালবর্তীতা বোঝতে চেয়েছেন। ২০০৬-এর ব্রাত্য বসুর হেমলাট বা ২০১১-এর বিভাস চক্রবর্তীর হ্যামলেট কলকাতাকেন্দ্রিক, এবং হ্যামলেট চরিত্রর মধ্য দিয়ে শহরের বিদ্রোহী মেজাজকে ফুটিয়ে তুলেছেন। এককথায়, হ্যামলেট বর্তমান বিক্ষুব্ধ কলকাতার প্রতিক। সম্প্রতিকালের শেক্সপিয়রের অন্যান্য নাটকেরও নতুন প্রযোজনা হয়েছে যেমন কৌশিক সেন অভিনীত ম্যাকবেথ বা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অভিনীত রাজা লিয়র ২০১০ (কিং লিয়র), তবে এই দুই নাটকেই সমকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতির সমালোচনা যথেষ্ঠ প্রখর। রাজা লিয়র, মঞ্চস্থ হয়েছে প্রায় চল্লিশবার, তবে তার কারণ হয়তো সৌমিত্র নিজে।
কিং লিয়র যে বাঙ্গালির কাছে অন্যভাবে গুরুত্বপূর্ণ তার প্রমাণ আমরা পাই সিনেমা থেকে। অপর্ণা সেনের 36 Chowringhee Lane এবং ঋতুপর্ণ ঘোষের The Last Lear শেক্সপিয়রের এই অন্যতম শ্রেষ্ঠ ট্র্যজেডির উপরেই নির্মিত। ঋতুপর্ণের ছবিতে প্রধান চরিত্র অমিতাভ বচ্চন হওয়া সত্তেও তেমন দাগ কাটতে পারেনি, যতটা পেরেছে অপর্ণার ছবি। এছাড়া, অপর্ণার ছবিতে সুপ্তভাবে লুকিয়ে আছে আমাদের দেশে শেকসপিয়র অভিনয়ের এক বিশেষ অধ্যায়। এই ছবির প্রধান চরিত্র ভায়োলেট স্টোনহ্যামের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন জেনিফার কেন্ডল (কাপুর)। উপস্থিত আছেন জেফ্রি কেন্ডলও, ভায়োলেটের ভাই এড্ডির ভূমিকায়।

শেকসপিয়রানা ও সিনেমার শেকসপিয়র
কেন্ডল পরিবারের নাট্যদল শেক্সপিয়রানা ১৯৪০ ও ৫০-এর দশকে সারা ভারতব্যপি শেক্সপিয়রের মূল নাটক অভিনয় করে বেড়াত। এই নাট্যদলের অন্যান্যদের মধ্যে ভারতীয়রাও ছিলেন, যেমন শশী কাপূর এবং উৎপল দত্ত। ১৯৬৫-এ আইভরি-মার্চেন্ট শেকসপিয়রয়ালা নামে কেন্ডল গোষ্ঠিকে নিয়ে একটা সিনেমা করেন। জেফ্রীরা যখন তাঁদের অভিনয় শুরু করেন ততদিনে ইংরেজিতে মূল শেকসপিয়র দেখার উৎসাহে ভাটা পড়ে গেছে। ব্রিটিশ শাসনেরও পতন হয়েছে। শেকসপিয়রয়ালার গভীরে রয়েছে এই হারিয়ে যাওয়ার সুপ্ত বেদনা।
অপর্ণার সিনেমার শুরুতেও আমরা যখন দেখি মিস স্টোনহ্যাম টুয়েলফথ নাইট পড়াচ্ছেন, কিন্তু ছাত্রীরা অমনোযোগী, তখন শেক্সপিয়রানার অপ্রাসঙ্গিকতা এবং এর সঙ্গে স্বাধীন ভারতে শেকসপিয়রের ভাগ্যের পরিণতির খুব সুক্ষ্ম ইঙ্গিত পাই। এই বিষয়টা আরও স্পষ্ট হয় যখন নতুন প্রধানশিক্ষিকা মিস স্টোনহ্যামের বার্ধক্যের কারণে শেকসপিয়রের বদলে ব্যকরণ পড়াতে বলেন। শেকসপিয়র পড়ানোর ভার চলে যায় ভারতীয় এক তরুণীর হাতে। শেকসপিয়রের মনোপলি আর কোনও ইংরেজের হাতে রইল না!

বস্তুত, বামম্পন্থী এক মিছিলের স্লোগানে এডি বিরক্ত হওয়াতে মিস স্টোনহ্যাম তাঁকে স্মরণ করিয়ে দেন যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দিন শেষ হয়ে গেছে। এছাড়াও, কিং লিয়রের যে মূখ্য থিম, বিশ্বাসভঙ্গতা, সেটাও সমকালীন পরিবর্তিত নতুন মূল্যবোধের নিরিখে মূল নাটকের সঙ্গে সমান্তরালভাবে যুক্ত করেছেন অপর্ণা। কিং লিয়রের পটভূমিকয় রয়েছে ব্রিটেন তথা ইউরোপের সামন্ততান্ত্রিক আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা থেকে বাণিজ্যিক পুঁজিবাদে বিবর্তন। ব্যক্তিকেন্দ্রীকতাই এই নতুন ব্যবস্থার মূল মন্ত্র। সম্পর্কের বন্ধন সেখানে অর্থহীন। কর্পোরেট সমরেশ এখন আর উপন্যাস লেখেনা। কর্পোরেট জগতের মায়াজালে সে আচ্ছন্ন। তাই মিস স্টোনহ্যাম আজ অবাঞ্ছিত; তাঁর পরিস্থিতি আজ প্রত্যাখিত রাজা লিয়রের মতো। নতুন ভারত, পুঁজিবাদ, নবপ্রজন্ম, শেকসপিয়র চর্চা, সতের শতকের ইউরোপ—অনেকগুলো সূত্র মিলিত হয়েছে এই ছবিতে। শেষে মিস স্টোনহ্যাম যখন (লিয়রের কথাগুলো) বলছেন ‘Do not mock me’, আমাদের কাছে হয়তো প্রশ্ন এটাই—কে কাকে বিদ্রূপ করছে?
পার্সি থিয়েটার থেকে বলিউড
অবশ্য নাটক থেকে সিনেমায় শেকসপিয়রের উত্তরণ পার্সি থিয়েটার থেকে হিন্দি তথা বলিউড সিনেমায় যেমনভাবে হয়েছিল, বাংলায় তেমনটা হয়নি। এর একটা কারণ হতে পারে যে উনিশ শতকের পার্সি থিয়েটার শেকসপিয়রকে অনেক সফলভাবে মঞ্চস্থ করতে পেরেছিল। বিনোদন আর মুনাফার যুগ্ম লক্ষ্য নিয়ে ১৮৪৬-এ শুরু হওয়া এই থিয়েটারে যুক্ত হয়ে যায় বেশ কয়েকটা ভ্রাম্যমান নাট্যগোষ্ঠী যারা সিংহল, বর্মা, সিঙ্গাপুরে অভিনয় করত। এমনকি ১৮৮৫ খুরশেদ বালিভালার নেতৃত্বে একটা দল ইন্ডিয়ান এ্যন্ড কোলোনিয়াল এগজিবিশনে অংশও নেয়। খুরশেদ বালিভাল শেকসপিয়র অভিনয়ে এতটাই খ্যাতি অর্জন করেছিলেন যে তাঁকে ‘আইভিং অফ ইন্ডিয়া’ আখ্যা দেওয়া হয়েছিল, ভিক্টোরিয়ান যুগের বিখ্যাত শেকসপিয়র অভিনেতা হেনরি আইভিংএর অনুসরণে।
এছাড়াও পার্সি থিয়েটারে ছিলেন আঘা হাশর কাশ্মিরী। কাশ্মিরী যুক্ত ছিলেন মদন থিয়েটারের সঙ্গে। এই মদন থিয়েটার ১৯০২-এ কলকাতায় স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু কাশ্মিরী প্রধান অবদান তাঁর বহুলসংখ্যক শেকসপিয়র অনুবাদ। ১৯১০-এ যখন নিজের নাট্যদল তৈরি করেন, তাঁর নাম দেন ইন্ডিয়ান শেকসপিয়র থিয়েট্রিক্যল কোম্পানি। শেক্সপিয়রের প্রতি এটাই ছিল তাঁর অঙ্গীকার। কাশ্মিরীকে বলা হত শেকসপিয়র-ই- হিন্দ! এর সঙ্গে আমরা যোগ করতে পারি আরও দু-একটা কথা। সোহরব মোদী অভিনীত খুন-কা-খুন-ই হ্যামলেটের প্রথম সশব্দ চলচ্চিত্রায়িত রূপ। মালা সিন্হা, যিনি প্রথম জীবন কাটিয়েছেন কলকাতায়, এক সাক্ষাতকারে বলেছেন যে কিশোর সাউ নির্দেশিত হ্যামলেটে অভিনয় করেই তিনি অভিনয় জীবনে ‘ব্রেক’ পান, যদিও সেই হ্যামলেট সফল হয়নি।

শেকসপিয়রকে ভিত্তি গড়ে ওঠা এই প্রাণবন্ত, জমজমাট পার্সি থিয়েটার দেখে এলফিনস্টোন কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক চার্লস সিসন এতই বিমোহিত হন যে তাঁর এক ভারতীয় সহকর্মীর সাহায্যে তিনি এই থিয়েটার সমীক্ষা করে শেকসপিয়র ইন ইন্ডিয়া নামে একটা পুস্তিকা লেখেন। তাতে তিনি লেখেন, ‘বম্বের জনপ্রিয় নাট্যমঞ্চ অনেকভাবেই ইংল্যান্ডে ট্যুডর মঞ্চের সমান্তরাল; এখানকার শেকসপিয়রের অভিযোজনগুলো প্রমাণ করে যে (নাটকগুলো) এখনও জীবন্ত…[এবং] তাদের পুনর্জন্ম হচ্ছে, যেমন হয়েছিল এলিজাবেথিয় মঞ্চে।‘
দুঃখের বিষয়, প্রাক-স্বাধীন বাংলায় ডি এল রিচার্ডসন বা এইচ এম পার্সিভালদের মত অধ্যাপকেরা প্রেসিডেন্সি কলেজে শেকসপিয়র পড়ানোর এক ঐতিহ্য তৈরি করেছিলেন, যা পরবর্তীকালে বজায় রেখেছিলেন বাঙালি অধ্যাপকেরা। কিন্তু সিসনের মত এঁরা কেউই ক্লাসঘরের বাইরে উঁকি মেরে দেখেননি বৃহৎ পরিসরে বা জনসাধারণ শেকসপিয়রকে কেমনভাবে গ্রহণ করছিল। তবে সারস্বত শেকসপিয়র চর্চায় বাঙালির প্রতিষ্ঠা যথেষ্ঠ গৌরবময়। কলকাতায় বসে শৈলেন্দ্র কুমার সেনের গবেষণার কথা, কিংবা সুকান্ত চৌধুরীর স্বনামধন্য আর্ডেন শেকসপিয়র সিরিজের জন্য নাটক সম্পাদনা করার কথা স্মরণ করে বলাই যায়, বাঙালির শেকসপিয়র চর্চা থেমে নেই।
গ্রন্থঋণ:
পার্সি থিয়েটার সংক্রান্ত কয়েকটা তথ্য পেয়েছি এন্ড্রু ডিক্সনের ওয়ার্ল্ডস এলস্হোয়ার ( ২০১৫) গ্রন্থ থেকে
শীর্ষেন্দু মজুমদার বোলপুর কলেজে ইংরেজির এ্যসোসিয়েট প্রফেসর। আকরগ্রন্থ Yeats and Tagore: Cross-cultural Poetry, Nationalist Politics, Hyphenated Margins and the Ascendancy of the Mind ( Dublin & Palo Alto, 2013)। আগ্রহের বিষয় আইরিশ সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ইতিহাস, ইয়েটস, রবীন্দ্রনাথ, অনুবাদ ও অনুবাদ তত্ব, মুদ্রনের সংস্কৃতি। ট্রিনিটি কলেজ ডাব্লিনে ভিজিটিং রিসার্চ ফেলো ছিলেন ২০১৮-১৯- এ। একাধিক বিদেশী প্রকাশনায় কনসালট্যন্ট রিডার হিসেবে যুক্ত।
তথ্য সমৃদ্ধ লেখা। পড়ে খুশি হলাম।