দুনিয়া তখনও বন্দি হয়নি সাড়ে ছ’ইঞ্চি এলইডি খাঁচায়। চোখ চাইলে দেখা যেত গাছ, ফুল, পাখি। মুদলে বাতাসের ফিশফাশ, শুকনো পাতার সরসর, হৃদয়ের লাবডুব। 

নাহ। টাইম মেশিন টেশিনের দরকার নেই। মাত্রই একুশ বছর আগেকার কথা। মোবাইল-বিহীন দুনিয়া। কী? ভাবা যায় না তো আজকাল আর? এক ক্লিকে খাবার আসছে তো এক ক্লিকে বাজার। চলচ্ছবি যাচ্ছে কলকাতা থেকে কামচাটকা, বারুইপুর থেকে বস্টন! সাড়ে ছ’ ইঞ্চিতে জীবনের যাবতীয় রূপরসবর্ণগন্ধ নিয়ে মেতে থাকা নিত্যদিন। একদিন অচানক… ঠ্যাঙের উপর ঠ্যাঙ তুলে শুয়ে শুয়ে ফেসবুকের দেয়াল থেকে দেয়ালে লম্ফ মারতে গিয়ে দেখা সেই বেরঙিন দুনিয়ার সঙ্গে। সূর্যের একুশ পরিক্রমণ পূর্বের সেই সব দিন! 

ক্যাটকেটে নিয়ন কমলা রঙের সোয়েটশার্ট পরা রাহুল। তাতে লেখা গ্যাপ। গলায় রুপোলি চেন। তাতে লেখা ‘কুল’…! দুই নায়িকা। লাল রঙের ঢোলা ডাংরি আর ছোট্ট ব্লান্টকাট চুলে ম্যাচিং বান্দানা পরে বাস্কেটবল কোর্টে দাপিয়ে বেড়ানো অঞ্জলি। সুপার সেক্সি গেরুয়া শর্ট ড্রেস আর হাইহিলে লন্ডন থেকে স্বপ্ননগরীর মাটিতে নেমে আসা টিনা। পৃথিবীতে ফ্রেন্ডশিপ ডে বলে যে একটা পদার্থ আছে, সেই দিনেই যে বন্ধু বা বান্ধবীর হাতে বেঁধে দেওয়া যায় রঙিন ফ্রেন্ডশিপ ব্যান্ড, এমনকি সেই অছিলায় যথেচ্ছ ফ্লার্ট করার সুযোগও মিলে যায়, শিখলুম। মাত্র বছর একুশ আগে। 

আমি তখন নবম শ্রেণি। শাড়ি নই, স্কার্টেই আছি। তবু পনেরো বছরের কাঁচা হৃদয়ে লাল-কমলা-সোনালি-রুপোলি রঙ ধরবে না, তা তো আর হয় না! ধরেওছিল। রাহুল-অঞ্জলি-টিনার ক্যাটকেটে গ্যাদ্গ্যাদে কৌটো খোলা এশিয়ান পেন্টস! এখন পনেরোর হৃদয় কেমন হয়? জানা নেই। তাদের হাতে আছে সাড়ে ছ’ইঞ্চির ভগবান, হও সবে আগুয়ান, হবে জয়! হয়েও চলেছে চর্মচক্ষে দেখতে পাই। আমরা কিন্তু ছিলুম বেফিকরে হেরোর দল। পর্দার রাহুল-অঞ্জলি-টিনার ত্রিকোণ দেখে হাত-পা অবশ হয়ে আসা কেবলুশের ঝাড়। আমার ছেলেমেয়ে কি জীবনেও দেখবে এসব? বলবে, “ম্যাগে, কীসব দেখতে তোমরা! দেখে আবার কাঁদতে? এই নাকি তোমাদের আইকনিক ছবি?” তখন বোধহয় স্মিতহাস্যে লজ্জা লজ্জা মুখ করব। বলব “আচ্ছা বেশ তোরা দেখিস না।“ কিন্তু নিজেরা দেখব অবরে সবরে। হরষে-বিষাদে চায়ের কাপটি হাতে যখন একলা হব, একা একাই হাসব, কাঁদব আর ফিরে যাব সেই পঞ্চদশীর পূর্ণিমা হয়ে উঠতে চাওয়ার দিনগুলোতে। একুশ বছর পিছোতে টাইম মেশিন লাগে নাকি? লাগে স্রেফ যতীন-ললিতের গিটারের কয়েকটা টুং – “কোই মিল গেয়া/ মিল হি গেয়া!”

একুশ বছরে দুনিয়া এধার থেকে ওধার। ৯০’স চাইল্ড বলে আলাদা এক রোম্যান্টিকতার জন্ম হয়েছে। তাকে নিয়ে খিল্লি খোরাকও কম হচ্ছে না। ইউটিউবেই মিলবে মজাদার শর্ট ফিল্ম, একুশ বছর পরে কী হাল রাহুল-টিনা-অঞ্জলির? নির্দেশক রাঘব সুব্বু ছবির নাম দিয়েছেন, কুছ কুছ সোচা হ্যায়! অর্থাৎ কিনা একুশ বছর আগেকার সেই চরম অবাস্তব অপরিণত অলীক ছবিকে এনে ফেলেছেন আজকের পরিণত বাস্তবে। ছোট্ট অঞ্জলি বড় হয়ে গেছে। বড় অঞ্জলি মধ্যবয়স্কা। তার লাল বাঁধনি প্রিন্টের সেই কিংবদন্তী ওড়না এখন ন্যাতা। কলেজগার্ল অঞ্জলি জন্মদিনের সন্ধে কাটাবে বাইরে! বড় অঞ্জলির নিষেধের জবাবে বলে, “আমার ভাবনা আমিই ভাবব। সারাজীবন কী তোমার মত ব্রো-জোনড হয়ে কাটাব নাকি? আট বছর বয়সে কিউপিড সেজে শিমলা অবধি ছুটে গেছিলাম। নিজের ভালোমন্দ আমি বেশ বুঝি। তুমি বরং কাজের কাজ কিছু দ্যাখো দেখি! বাবার চক্করে তো কলেজের পড়াটাও শেষ করলে না! করো না এখন? নাচ-গানের এত শখ ছিল, তাই নিয়েই নয় করলে কিছু?” সজল নেত্রে প্রাচীনা অঞ্জলি বলে ওঠে, “অপনি মম কি বাত সুন বেটি!” নবীনা অবলীলায় বলে দেয়, “মম নেহি মা, স্টেপ মম!” শেষে অবশ্য মিঠে খুনসুটি স্টাইলেই প্রাচীনা-নবীনার সন্ধি হয়ে যায় এবং তারা মনে করিয়ে দেয় এ এক আইকনিক ছবির স্পুফ মাত্র! 

দেখতে দেখতে মোবাইল হাতে ধরা প্রাচীনার মুখে হাসি, চোখে জল। সবই তো ঠিক বলছে এরা! সত্যিই তো, ছবিজুড়ে কেবল নাচাগানা আর ডায়লগবাজি! তোতলা নায়কের একঘেয়ে অতি-অভিনয়। মেকি দৃশ্য, মেকি সংলাপ, পচা ক্লাইম্যাক্স, বাপের বিয়ে দেওয়া বেড়ে পাকা ছানা… এই নিয়ে এত আদিখ্যেতা আমাদের? কেন? 

এই কেন-তে এসেই আটকে যায় সব বাস্তবতা। যুক্তিজাল ছিঁড়ে পড়ে সুখস্মৃতির ভারে। বৃষ্টির রাতে লাল শাড়ি পরা অঞ্জলি আর কালো শার্ট পরা রাহুল যখন চুপচুপে ভিজে হাত ধরে নাচ করে আর কোথা হইতে আকাশে-বাতাসে বাজিয়া উঠে পিয়ানোয় সেই আইকনিক সুর… তখনই প্রাচীনার পাঁজরের অন্দরে যে হিল্লোল, অপাঙ্গে যে লাজুক চাহনি, অধরে যে মুচকি হাসি… তার কারণ কী? আরও একবার নবম শ্রেণির সেই কচি বালিকাটিকে ফিরে দেখার সাধ? নাকি নবম শ্রেণির সেই অপূর্ণ প্রেমের উথাল পাথালের দিকে চেয়ে চোখের কোণটা লুকিয়ে আলতো করে মুছে ফেলার বাড়াবাড়ি? নাকি হারিয়ে যাওয়া বন্ধু আর হলেও-হতে-পারা প্রেমিকের দেওয়া শস্তা কানের দুল আচমকা খুঁজে পেয়ে হুশ করে বেরিয়ে আসা দীর্ঘশ্বাস? ব্যাখ্যা দেওয়া মুশকিল। নামুমকিনও বোধহয়। তাই না? মর্মব্যবচ্ছেদ বড় কঠিন ঠাঁই! কখনও রবিবাবুতে ফালা ফালা, কখনও বা কর্ণ জোহরে! হেথায় নিষেধ নাই রে দাদা, নাই রে বাঁধন নাই রে বাধা, হেথায় রঙিন আকাশতলে, স্বপনদোলা হাওয়ায় দোলে!

একুশ বছর কাটল। কেউ কথা রাখল, কেউ রাখল না। ছবিটা তবু পুরনো হল না। গানগুলোও শোনা হয় না আজ প্রায় দু’দশক। তবু কথাগুলো মুখস্থ এখনও। চোখ বুজে সংলাপ শুনে বলে দিতে পারি দৃশ্য। রাহুল-অঞ্জলি-টিনার তখন কোন রঙের সাজ। পরের সংলাপ কী। চোখ খোলার দরকারই বা কী? চক্ষু মুদেই বেশ দেখতে পাই সামার ক্যাম্পের কাঠের সাঁকোর ওপর দিয়ে রাহুলের দৌড়, ট্রেনের দরজায় সাদা সালোয়ার কামিজে চোখভর্তি জল নিয়ে অঞ্জলি, ওম জয় জগদীশ গান গেয়ে উদ্ধত রাহুলের থোঁতা মুখ ভোঁতা করে বেরিয়ে যাওয়া টিনার কোমরের দুলুনি! আরও অজস্র অসংখ্য আপাত-আজগুবি দৃশ্যের অবতারণায় দোলন খেপির স্বপনদোলা ক্যাটকেটে রামধনু রঙ হয়ে ধরা দেয় স্মৃতিপটে। ব্যাকড্রপে পুরনো প্রেমিকের নীল চোখ… চোখ বুজেই বলে ফেলি, কুছ কুছ হোতা হ্যায়, তুম নেহি সমঝোগে! 

লিখতে শিখেই লুক থ্রু! লিখতে লিখতেই বড় হওয়া। লিখতে লিখতেই বুড়ো। গান ভালবেসে গান আর ত্বকের যত্ন মোটে নিতে পারেন না। আলুভাতে আর ডেভিলড ক্র্যাব বাঁচার রসদ। বাংলা বই, বাংলা গান আর মিঠাপাত্তি পান ছাড়া জীবন আলুনিসম বোধ হয়। ঝর্ণাকলম, ফ্রিজ ম্যাগনেট আর বেডস্যুইচ – এ তিনের লোভ ভয়ঙ্কর!!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *