বাড়ির লোকজন মাকে ঘরের মধ্যে কয়েকদিন আটকে রেখেছিলো। আমি ছেড়ে দিয়েছি, কেননা মা যে খালিঘরে ঘুমপাড়ানিয়া গান করত—তা সহ্য করার ক্ষমতা আমার ছিলো না। আমি বাড়ির লোকজনের সঙ্গে রীতিমতো ঝগড়া করে ঘরের তালা ভেঙেছি।
মা আমাকে চুপিচাপ ডেকে নিয়ে একটা নারকেলের নাড়ু দিলো। আর আমার মাথার চুলে বিলি কাটলো কিছুক্ষণ। তারপর দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। সেই থেকে আমার গলায় যেনো একটা আস্ত সমুদ্র আটকে আছে, ‘প্রিয় মৃগেল, ওগো সরপুটি, চিতল, রুই, বোয়াল তোমরা কি জানো তার ছায়া, তোমাদের কানকোর ভাঁজে কি লুকিয়ে নেই তার নিশ্বাস? সে তো গান গাইতো রিমিঝিম, আহা গান, আহা গান…’
বুদ্ বুদ্ ওঠে। আমি এখনো বুদ্ বুদের ভাষা বুঝতে শিখিনি। বুঝি মা ভালোই বুঝতে পারে। ইদানীং আমি জলের ধারে বসে মনে মনে মাছের সঙ্গে কথা বলি। মাছেরা বুঝি জানে, মাছেরা জানে নিশ্চয়!

আমি চা খাচ্ছিলাম ঝুপড়ির সামনে বাহিরে টুলে বসে। চায়ে চুমুক দিতে গিয়ে দেখি কাপের ভিতর ডুবে আছে মেঘের আকাশ। হঠাৎ চমকে পাশ ফিরলাম, ভেজা স্পর্শে। মা আমার কাঁধ ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জামাকাপড় জলে ভেজা। কেমন করে তাকিয়ে আছে! কেমন করে বলি? আমি তার হাত ধরে টেনে আমার সামনে বসালাম, ‘কী হয়েছে, মা?’
‘পেলাম নারে, খোকন।’
‘পাবে, মা।’
‘কখন?’
‘পাবে ঠিক, দেখো।’
‘পাড়ার সব পুকুরে আবারও তো দেখেছি।’
‘কোথাও না কোথাও তো আছে, মা।’
‘সত্যি!’ মা আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। আমার হাত ধরে ঘুমপাড়ানিয়া গান ধরে এই দুপুরশেষে।
‘চলো, বাড়ি যাই। কাল সকালে আমিও তোমার সঙ্গে যাবো।’
মা উঠে দাঁড়ায়। আমাদের দীর্ঘ ছায়ারাও উঠে দাঁড়ায় সঙ্গে।

খুকি মরে যাওয়ার পর মা কেমন যেনো হয়ে যায়। একদিন পাথর হয়ে থাকে। পরদিন খুব ভোর বেলা বেরিয়ে যায়। সন্ধ্যায় তাকে খুঁজে পাওয়া যায় মন্দিরের পাশের পুকুরঘাটে, গুনগুন করে গান করছে, ‘আয় আয়, খুকির চোখে ঘুম আয়…’
খুকি আমাদের পুকুরে ডুবে মারা গেছে। আজ নিয়ে একতিরিশ দিন হলো। মার বিশ্বাস সে মরে যায়নি; জলের ভিতর কোথায় লুকিয়ে আছে, সে জলপরী হয়ে গেছে। আর সেই থেকে মা একটু কাঁদেনি, শুধু পাড়ার পুকুরগুলিতে প্রতিদিন ডুব দিয়ে দিয়ে খুকিকে খুঁজে বেড়ায়।

আমি রাতে ঘুমোতে পারি না বলে সকালে একটু ঘুম যাই। বাইরে, মনে হয় আমাদের উঠানে হৈচৈ। আমার ঘুম ভেঙে গেলো। দেয়ালঘড়িতে সাড়ে এগারোটা বাজে। আজ মা আর আমি বের হওয়ার কথা ছিলো। আমি ওঠে দরজা খুললাম। দরজা খুলেই বিষয়টা স্পষ্ট হলো। বকুলতলার দিঘিতে মা নিষ্প্রাণ জলপরী হয়ে ভেসে উঠেছে। আমি দরজা বন্ধ করলাম আবার। কেউ দরজা ভেঙে ফেললেও আমাকে আজ বের করতে পারবে না ঘর থেকে, ‘ওগো সমুদ্র, আর কতোদিন মাছের কাঁটার মতো আটকে থাকবে আলজিভে?’

কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম মনে নেই। খুব সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙলো। দেখলাম, খুকি আর মা রোদ আর মেঘের জামা পরে আকাশে ওড়ে ওড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর আমি তাদের পাশে পাশে একটি ঘুড়ি উড়াচ্ছি।
মা আর খুকি আসলেই পরী হয়ে গেছে। আমি জানি, আমি জানি, আমি জানি…

কদিন ধরে বাড়ির লোকজন আমাকে বেঁধে রেখেছে। কিন্তু আমাকে তো চেনে না। এর মধ্যেই তিনহাত সিঁদ কেটেছি।
আজ সারাদিন এইখানে রাতের অপেক্ষা করেছি। কিছু খাওয়া হয়নি। অথচ ক্ষিধে নেই। শরীরটা অদ্ভুত রকমের হালকা লাগছে।

এখন আমি পাহাড়ের সব থেকে উঁচুতে দাঁড়িয়ে আছি। ঘনায়মান রাতদুপুর। আকাশে দুইটি চাঁদ জ্বলছে। মা আর খুকি উড়ে আসছে। তাদের মুখের হাসিতে উপচে পড়ছে বেহাগ। আমি তাদের সঙ্গে যাবো।
আমি দুহাত বিস্তারিত করছি ধীরে। আমার দুহাতের হাড়ের ভিতর লুকোনো আছে ডানা। কেউ জানে না, কেউ জানে না, কেউ জানে না…

 

জন্ম বাংলাদেশের কক্সবাজারে, পড়াশোনা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। লেখালেখি আর ছবি আঁকাই মূল কাজ। প্রকাশিত বই-এর সংখ্যা ষোল। জনপ্রিয় বই “পাখি ও পাপ”, “এইখানে বর্ষাকালে বৃষ্টি হয়”, “পুরুষপাখি”, “রাজহাঁস যেভাবে মাছ হয়”। নির্ঝরের সম্পাদিত ছোট কাগজের নাম “মুক্তগদ্য”।

2 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *