এ বড় দুঃসময়। নোভেল করোনা ভাইরাস এসে তা মর্মে মর্মে পশিয়েছে। ভয় গেঁড়ে বসেছে, মৃত্যুভয়। অসহয়তা বোঝা যাচ্ছে অহরহ। মাথায় একগাদা গ্রে-ম্যাটার নিয়েও করোনার বিরুদ্ধে লড়ে তাকে দমিয়ে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। প্রাণপণ এড়িয়ে চলাই একমাত্র উপায় সাব্যস্ত হচ্ছে। শত্রু সর্বশক্তিমান, নতজানু হয়ে তা স্বীকার করে নিতে হচ্ছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ছাড়া পাওয়া পরমাণুর বিষক্রিয়া বা পারমাণবিক অস্ত্র, তারাও মানুষকে এতটা ত্রস্ত করতে পারেনি, যতটা পেরেছে এই মারণ ভাইরাস। পরিবেশ দূষণ, যুদ্ধ, বিপ্লব— কোনও কিছু মানুষকে এইভাবে ঘরবন্দি করতে পারেনি। আবার সত্যিকারের সচেতনও করতে পারেনি। সে দিক থেকে দেখতে গেলে করোনা এক রকম চেতনা জাগিয়েছে, তাও বলা চলে। বাহ্যিক এবং আন্তরিক।
তবে কি মানুষ ভেঙে পড়েছে? একেবারেই নয়। সচেতনতা যেমন চলছে, তেমন চলছে রসবোধের সাপ্লাই। কখনও কখনও তা উচ্চকিতও বটে, যা কিনা ভাইরাসের তীব্রতা লঘু করার দিকে ঠেলে দেয়। কিন্তু আবার সঙ্কটের সময় রসবোধটুকু হারিয়ে গেলে মানুষ তার স্ব-চরিত্র থেকে বিচ্যুত হয়ে যাবে। কারণ জীবন যেমন, ঠিক তেমন ভাবেই তাকে নিতে শেখা মানুষের ধর্ম। হ্যাঁ, নিত্যকার জীবনে তার ব্যত্যয় ঘটে বটে, কিন্তু ওপরের ধুলো সরে গেলে বেসিকটা বেশ বোঝা যায়। বোঝা যায়, মানুষ হেরে যেতে শেখেনি। মনে রাখতে হবে, ভয় পাওয়া আর হেরে গিয়ে আত্মসমর্পণ করা এক কথা নয়। যতই মাত করা ডায়লগ বলুক, ‘জো ডর গয়া ও মর গয়া’। বরং এখন উল্টোটা, যে ভয় পেয়েছে, সে সতর্ক হয়েছে। আর সতর্ক হওয়া সব সময়ই বিচক্ষণতার লক্ষণ। এই বিচক্ষণতার পরিচয় হয়তো সবর্দা মেলে না। কারণ, গা ভাসিয়ে চলাও মানুষের অন্য একটা প্রধান ধর্ম। তাতে ভাবতে কম হয়। আসলে, যে সব প্রাথমিক চরিত্র দিয়ে মানুষ তৈরি, তা রোজকার কর্মব্যস্ত, এন্টারটেনমেন্ট-ব্যস্ত, আলস্য-ব্যস্ত, অকাজ-ব্যস্ত, অজুহাত-ব্যস্ত জীবনের চাপে অনেক নীচের দিকে চলে গেছে। চারপাশ এবং নিজেকে নিয়ে ভাবার অভ্যাসও চলে গিয়েছে।
কিন্তু এই যে এখন নিজের সঙ্গে বাধ্যতামূলক সময় কাটানোর হুইপ জারি করেছে করোনা ভাইরাস, সেই সময়টায় এই সব আস্তরণ সরিয়ে সম্ভবত আসল ‘আমি’টি আত্মপ্রকাশ করার সুযোগ পাবে। কারও ক্ষেত্রে আগে প্রকাশ পাবে, কারও ক্ষেত্রে পরে। কিন্তু পাবে। আর যদি একেবারেই না পায়, তা হলে ধরে নিতে হবে, হয় সে জন চিরআনন্দিত এবং জীবন ও নিজের সম্পর্কে তার কোনও অভিযোগ নেই, অথবা ধরে নিতে হবে তার জ্ঞানবুদ্ধির নিতান্তই অভাব। অন্য সময় হলে বেড়াতে ব্যস্ত থাকা যেত কিংবা হোটেলে খেতে যাওয়া, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডাও মন্দ অপশন ছিল না, কিংবা উদ্দাম প্রেম আর সময় ধরে প্ল্যানিং করে লুকিয়ে পরকীয়া। কিন্তু এখন সে সব শিকেয়। জোর করেই কিছু না-করতে হবে। বাড়ি বসে অফিসের ডিউটি করার পর তো বাকি সময়টায় খবর দেখা ছাড়া কোনও কাজ নেই। অনলাইন প্ল্যাটফর্মও এক সময় ক্লান্তি ধরায়। তা হলে, নষ্ট করার মতো সময়টা পার করেও নিজের হাতে পড়ে থাকবে অঢেল সময়। তখন নিজের সঙ্গে সময় কাটাতেই হবে।
আর নিজের সঙ্গে সময় কাটানোই হল সবচেয়ে বড় ভয়ের। আত্মনিরীক্ষা বিষম বস্তু। কারণ তাতে নিজেকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হয়। বাদী-বিবাদী পক্ষ, এমনকী জজসাহেবও নিজেই বটে। তখন মিথ্যাচার, মনকে স্তোক, নিজের কাছ থেকে পালিয়ে বেড়ানোর জায়গা পাওয়া মুশকিল। নিজেকে ভাল লাগানো মুশকিল। নিজের সব দোষগুলো, সব খামতিগুলো টিভি সিরিয়ালের মতোই চোখের সামনে ঘুরে বেড়ায়, মস্তিষ্কের আর মনের পরতে পরতে ভাসতে থাকে। তখন হয়তো মনে হয়, এ জীবন লইয়া কী করিলাম! এ জীবন লইয়া কী করিব! হওয়ার কথা ছিল কবি, হলাম ব্যাঙ্ক ম্যানেজার। হতে চেয়েছিলাম বোহেমিয়ান, হয়েছি ঘোর গেরস্ত।
আমাদের যেহেতু ক্রমাগত আত্মবীক্ষণের অভ্যেস নেই, তাই নিত্য নিজেকে সংশোধনের প্রশ্নও নেই। কোনও মতে জবরদস্তি সময় পেয়ে যে কাণ্ডটা এখন ঘটছে, নিজের সঙ্গে, স্বামী বা স্ত্রী-এর সঙ্গে যে ঠোকাঠুকি, যে দোষারোপ, যে অশান্তি চলছে, তা আর কিছুই নয়— সারা জীবনের না পাওয়ার এবং নিজের যা কাজ করার ছিল তা না করার সমষ্টি মাত্র। নিয়মিত এই হিসেবনিকেশের স্বভাব নেই বলে এখন সেটা পাহাড়প্রমাণ হয়ে নিজেকেই স্থানবিচ্যুত করছে। নিজের কাছে পুরনো ‘আমি’ কড়া নাড়ছে। পরিবারের সঙ্গে, বইয়ের সঙ্গে, গানের সঙ্গে, ছবির সঙ্গে যত সময় কাটানোর ছিল, তার কিছু হয়তো ফিরে আসছে, আবার প্রচুর তিক্ততাও জমা হচ্ছে। যে তিক্ততাগুলো কেবল এড়িয়ে চলা হয়েছিল এত কাল। এবং সেই এড়িয়ে চলাই হয়তো একটা উপায়ে জীবনে ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা। কিন্তু ভারসাম্য বজায় রাখতে গিয়ে সত্যের উপর ধুলো জমতে দেওয়া কি ভাল? মোটেই নয়। ভারসাম্য নষ্ট হবে বলে ঔচিত্যকে বাদ দেওয়া যায় না, ভারসাম্য বিঘ্নিত হবে বলে সত্যকে প্রশ্ন করা থামানো যায় না।
এই উন্মোচনে ক্ষতি হবে হয়তো কিছু। মানসিক বিষাদ আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলবে। সম্পর্কের টানাপড়েন শুরু হবে। মিথ্যাচার, বিশ্বাসঘাতকতা, অপ্রিয় সত্য, অপারগতা, আরও অনেক কিছু দাঁত-নখ বের করে কামড়ে-খিমচে রক্তাক্ত করবে আত্মাকে। আবার লাভও হবে অনেক। নিজেকে যাচিয়ে নেওয়ার পর যে ফল হাতে থাকবে, সেই অনুযায়ী কাজ করার জন্য বাকি জীবনটা পাওয়া যাবে।
অবশ্য বাকি জীবনের পুরোটাই এই প্রাপ্ত ফলাফল অনুযায়ী চলবে, এ কথা ভাবা বাড়াবাড়ি। কারণ মানুষের গা-ভাসানো, আনন্দিত হয়ে সব ভুলে যাওয়ার ধর্ম এখন শীতঘুমে আছে হয়তো, কিন্তু মরে তো যায়নি। সুতরাং আবার বিস্মৃতি আসবে, আবার ব্যস্ততা আসবে, আবার নিত্য ঘ্যানঘ্যানানি আসবে। তাতে আবার প্রচুর সময় চলে যাবে। তা যাক, কিন্তু এমন জবরদস্তি নিজের কাছে ফিরে যাওয়ার ছুটি আর আসবে না হয়তো। এবং এমন ছুটি যাতে না আসে, সেটাই কাম্যও বটে। কিন্তু এতটা যে পাওয়া গেল, তাই থেকে নিজেকে ঝেড়েমুছে নিয়ে বেশ একটা মনোমত প্রস্তুত হলে ভাল না? কেউ গিটার হাতে তুলে নিক ফের, কেউ ক্ষয়ে যাওয়া সম্পর্ক মেরামত করুক, কেউ নতুন সুর ভাঁজুক, কেউ ভেঙে বেরিয়ে যাক নাম কা বাস্তে সম্পর্ক! নিজের সামনে দাঁড়াক। সে বড় জরুরি।
সঞ্চারী মুখোপাধ্যায় হাসিখুশি, এমনকী যখন সেই মোড-এ থাকেন না, নিজেকে ঠেলে হিঁচড়ে হিহিহোহো’তেই ল্যান্ড করানোর চেষ্টা করেন। জাপটে ভালবাসেন আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, সিরিয়াল, গান, রাস্তায় নেড়িবাচ্চার লটরপটর কান। পড়াশোনার সময় ফিল্ড করেছেন, হাতুড়ি দিয়ে পাথর ভেঙেছেন, গ্রামবাসীদের তাড়া খেয়েছেন, এক বার পাহাড় থেকে অনেকটা হড়কে পড়ে মুচ্ছো গেছিলেন, উঠে দেখেন, কবর! এক বার ম্যানেজমেন্ট কোর্সের অঙ্গ হিসেবে চিন গেছিলেন, রাত্তির দুটোয় সাংহাইয়ের রাস্তায় হারিয়ে গিয়েও কাঁদেননি। ফিউজ সারাতে পারেন, পাখার কার্বন বদলাতে পারেন, কাগজের চোঙ পাকিয়ে গাড়িতে পেট্রল ঢালতে পারেন, চিনেবাদাম ছুড়ে দিয়ে মুখে নিপুণ লুফতে পারেন। ব্যাডমিন্টন খেলার ইচ্ছে খুব, কিন্তু জায়গা ও র্যাকেট নেই। অরোরা বোরিয়ালিস যারা দেখেছে, তাদের একাগ্র ভাবে হিংসে করেন। দেশের বাড়িটা উনি বড় হওয়ার পর ছোট হয়ে গেছে বলে, আর আমির খান এক বার কার্টুন এঁকে দিয়েছিলেন— সে কাগজ হারিয়ে গেছে বলে, জেনুইন কষ্ট পান। এক বার ঈগলের রাজকীয় উড়ান আগাগোড়া খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন।