ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় পর্যাপ্ত জলপাই হয় জানি। কিন্তু বগুড়ান, তোমার নামের শেষে এমন উপাধি কেন আজও আমি জানতে পারিনি! তোমার বিশাল উন্মুক্ত সমুদ্র-বুক আছে ভালবাসা ঢেলে দেবার জন্য। কিন্তু জলপাই কোথায়, কেন, করতে করতে যখন পৌঁছলাম তোমার দেশ পূর্ব মেদিনীপুরে, তখন দুপুর-সূর্য মাথার ওপর সজাগ। একবাক্যে সবাই চেনে বঙ্গোপসাগরের কূলে দিঘা, মন্দারমণি, তাজপুর, শঙ্করপুরের সমুদ্রতট। কিন্তু বগুড়ান, তুমি কেন এত প্রচারবিমুখ বলতে পার? তোমার কোলে সেই একই সাগর। তবু কত প্রশান্তি তার, কী আত্মমগ্নতা!    




কী জানি আদ্যিকালে কোনও ভিনদেশি জাহাজি এখানে এসে তার প্রিয় জলপাই গাছ পুঁতে গিয়েছিলেন হয়তো। তাই কি তোমার নামের ’পরে এমন মিঠে পদবী? 

জানো বগুড়ান, কলকাতা থেকে বাসে আমাদের সময় লাগল মাত্র চারটি ঘণ্টা। জনসমুদ্রের ঢেউ ঝাঁপিয়ে পড়ার আগেই আমরা হাজির হয়েছিলাম জনমানবশূন্য তোমার সাগরতটে। কংক্রিটের জঙ্গল হয়ে ওঠেনি তোমার আশপাশ। সাগরের অতন্দ্র প্রহরায় বৃষ্টিস্নাত ক্যাসুরিনা, ইউক্যালিপটাস, আকাশমণি আর সোনাঝুরিরা অপলক দৃষ্টিতে একে অপরের দিকে চেয়ে।   মালপত্র রেখে মিনিট ছয়েক হেঁটেই আদিগন্ত বেলাভূমি। ভাদ্রের আকাশে গুমোট রোদ্দুর মেঘের আড়াল থেকে উঁকি দেয়, তাই রক্ষে। ভাটার সময় তোমার জল তখন বহুদূরে। শুধু বালি আর বালি। ডাবওয়ালা ডাব দেয় হাতে । সাগরপাড়ে তার চাকা লাগানো অস্থায়ী দোকানে পান, বিড়ি , সিগারেট, লজেন্স, বিস্কুট সাজানো। ফ্লাস্কভর্তি লাল চা। 

সবুজ বগুড়ান গ্রামের রঙচঙে ছাপাশাড়ির ঝি-বউরা এসে জিরেন নেয় গাংপাড়ে। তাদের চেহারার বাঁধুনি খুব। ভেতরের জামার বালাই নেই। থইথই রূপলাবণ্য উপচোয়। গল্পগাছা করে চায়ে চুমুক দিতে দিতে ফস্টিনস্টি করে দোকান-মালিকের সঙ্গে। মাছ ধরার নৌকো পাড়ে বাঁধা। জোয়ার এলে স্বামীরা রওনা দেবে আবার। স্বামীদের হাতেহাতে ঠিকঠাক করে দেয় মাছ ধরার জাল। খেটো ধুতি পরে জেলে জাল রিফু করে, কেউ আপনমনে পাড়ে বসে জাল বুনতেই থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কেউ জাল শুকোতে দেয় বালিতে। মাছমারাদের জীবনযাত্রা এভাবেই চলতে থাকে বগুড়ানে… ধীর, নিরন্তর, মন্দ্র ছন্দে।   

Sea Beaches
বগুড়ানের সমুদ্র কত না-জানা গল্প শোনায়

তৃষাতুর চোখে সমুদ্রসৈকতের সাদা বালির মধ্যে লাল কাঁকড়া দেখতে দেখতেই আমাদের সময় কেটে যেতে থাকে। এগুলো ধরে খাওয়া যায় না। দূর থেকে দেখে মনে হয়, সাদা বালুকাবেলায়  টুকটুকে শিমূল কিংবা কৃষ্ণচূড়া ঝরে পড়েছে। কাছে যেতেই ভিতু কাঁকড়ার দল বালির গর্তে টুক করে ঢুকে পড়ে। ভয়ে তারা তটস্থ। ধরা দিয়েও দেয় না। ছড়িয়ে ছিটিয়ে যত্রতত্র পড়ে থাকা রকমারি শাঁখের পসরায় চোখ রাখি। এগোই বালির পথ ধরে। আঁচল ভরে কুড়িয়ে ফেলি মুঠো মুঠো ঝিনুক, শামুক, শাঁখ। তাদের মধ্যে বাস করা সামুদ্রিক প্রাণিটি ততক্ষণে খোলস ছেড়ে বেরিয়ে গেছে। পড়ে রয়েছে একা নিঃসঙ্গ বাসাটি। 

সমুদ্র কত না-জানা গল্প শোনায়। বগুড়ান জলপাই গ্রামের জেলে পরিবারের সুখদুঃখের কাহিনি। এখানে পিছাবনি নদী সমুদ্রের বুকে সঙ্গমের খুশিতে ভরপুর। সমুদ্রতটে অপেক্ষমান আঁটোসাঁটো গড়নের জেলে বৌটি একদৃষ্টে চেয়ে থাকে ওপারের দিগন্তরেখার দিকে। তার মনের মানুষ কখন ফিরবে মাছ ধরার নৌকো নিয়ে, সেই আশায়। প্রতিদিনের অনিশ্চয়তা আর অভাব সম্বল তার। পরণে সস্তার দশহাতি বেগমপুরী, হাতে শাঁখা-পলা। গায়ের রং রোদে ঝলসে তামাটে। নোনাজলে চকচক করে নোয়াখানি। স্বামী জল থেকে ফিরেই প্রচুর মাছ ধরার খুশিতে আকণ্ঠ হাড়িয়া খেয়ে নেশাতুর চোখে সমুদ্রতীরে বসেই বৌকে জড়িয়ে গলা ছেড়ে ধরবে ভালোবাসার গান। 




হোটেলে ফিরে সেদিন ছিল আমাদের ইলিশ-চিংড়ি উৎসব। কবজি ডুবিয়ে দিঘার মাছ খাওয়ালেন ট্যুর অপারেটর। একটু বিশ্রাম নিয়েই আবার বিকেলের রোদ গায়ে মেখে হাঁটা দিলাম সাগরপাড়ে। তখনও ভাটা । আবারও পেলাম সমুদ্রের ওম। নির্জনতাকে সঙ্গী করে এগিয়ে চলি অনেক দূর। সন্ধের মুখে মনসামন্দিরে পেন্নাম ঠুকে হোটেলের ঘরে বিশ্রাম। রাত আটটায় জোয়ার আসবে । সেদিন আবার প্রতিপদ। ঘুটঘুটে অন্ধকারেই বেরিয়ে পড়ি ফের। নিশুতি অন্ধকারে শব্দ বলতে লম্বা লম্বা সেপাই গাছেদের শনশন শব্দ আর ঝিঁঝিঁদের দাপুটে কনসার্ট। জোয়ারের শব্দ কানে এল। বিকেলে যেখানে দাঁড়িয়ে ঝিনুক কুড়িয়েছিলাম সেখানে তখন জল এসে পায়ের পাতা ছুঁল।

Sea Beaches
নির্জনতাকে সঙ্গী করে এগিয়ে চলি অনেক দূর

 হঠাৎ ঝড় ওঠে সাগরপারে। বালির ওপর পায়ের পাতায় জলের আলপনা মুছে মুছে যায়। হুহু হাওয়ায় বালি ওড়ে। আঁচল ওড়ে। উথালপাথাল হতে হতে ঘরের দিকে ছুটি।  

পরদিন ভোরে সমুদ্রতটে পূবের সূয্যিকে দেখতে গিয়ে দেখি আর এক জেলেনী। জোয়ার আসতেই তার বরকে নির্বিঘ্নে যাত্রা করে দিল দূর সমুদ্রে। কে জানে কখন তার স্বামী নৌকোবোঝাই মাছ নিয়ে ঘরে ফিরবে? আবার যদি ঝড় ওঠে কাল রাতের মতো? জেলেনী কি একা ঘরে বসে টিমটিমে পিদিম জ্বালিয়ে দুরুদুরু বুকে অপেক্ষা করবে সঙ্গীর? ভাবতে ভাবতে পা চালাই। মুঠো মুঠো বিচিত্র শাঁখের পসরা বালুকাবেলা জুড়ে। স্থানীয় মানুষ কুড়িয়ে কুড়িয়ে থকে গেছে। কেউ দেখি মাছ ধরার জাল থেকে মুক্ত করছে পাঁচমেশালি চুনোমাছ। বাজারে বিক্রি হলে শুঁটকি হবে। 




সকালে খাওয়াদাওয়া সেরে আমাদের ঘুরে বেড়ানোর কথা। অলিগলি দিয়ে অটো চলল। সাগরের নোনা হাওয়া আর গ্রামের রাস্তা গিয়ে মিশল পিচঢালা চকচকে রাস্তায়। অটো থামল পুরনো শঙ্কেশ্বর শিবমন্দিরে। স্থানীয় মানুষের বিশ্বাস, চৈত্রমাসে গাজনের সময় সেখানকার কুণ্ড থেকে এক ‘কামনা ঘট’ ওঠে। সেদিন মহা ধুম হয়। শিবদুর্গার পুজো হয় একত্রে। 

ক্যাসুরিনায় ঘেরা বগুড়ান জলপাই গ্রামের কিছু দূরেই বাঁকিপুট সমুদ্রসৈকতের হাতছানি। খুব শান্তির পরিবেশ বাঁকিপুটেও। সেখানে সমুদ্রের জল অবশ্য কংক্রিটে আটকানো। ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে সিমেন্টের সিঁড়িতে। সবুজ গাছের ডাল নুয়ে পড়েছে ওপর থেকে সমুদ্রের গায়ে। ছবির মতো সুন্দর দৃশ্যপট। সবুজ ধানগাছে, ভাদ্রের ভরা জলে থইথই চাষজমি আর অগুন্তি চিংড়ির ভেড়ি গ্রামজুড়ে। মীন ধরে জলে ছেড়ে মিষ্টি জলের বাগদার চাষ হয়। সেটাই মূল জীবিকা সবার। তারপর বঙ্কিমচন্দ্রের স্মৃতিবিজড়িত কপালকুণ্ডলার প্রাচীন মন্দিরটি দেখতে যাওয়া। বঙ্কিমচন্দ্র সে সময় ছিলেন কাঁথির ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। কালীমন্দিরের এক কাপালিককে দেখেই নাকি গল্প ফেঁদেছিলেন নবকুমার ও কপালকুণ্ডলার। বিগ্রহশূন্য সেই মন্দিরে দু’শো বছরের কুলুঙ্গিটি মেরামতির ফলে অক্ষয় আছে। সেখানেই দু’বেলা ফুল দেওয়া হয়। 

Sea Beaches
সাগরের অতন্দ্র প্রহরায় বৃষ্টিস্নাত ক্যাসুরিনা, ইউক্যালিপটাস, আকাশমণি

এবার গন্তব্য দরিয়াপুর লাইটহাউজ়। কেন্দ্রীয় সরকারের দেখভালে সেটি মূলতঃ স্মৃতিসৌধ হিসেবেই সংরক্ষিত। এই সমুদ্রনগরীতে সমুদ্রযাত্রার এককালীন অন্যতম অনুষঙ্গ। এখনকার জিপিএস-এর যুগে অবশ্য ইনি অচল।

 তারপর আবার অটোয় চড়ে বসা। এবার মেছো গন্ধে প্রাণ অস্থির। পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম মৎস্য বন্দর পেটুয়াঘাটে এলাম। ধোবিরা যেমন দড়িতে জামাকাপড় শুকোয়, তেমন সারেসারে মাছেরা শুকোচ্ছে রোদে শুঁটকি হতে। সেই শুঁটকি সরণি পেরিয়েই ঝুপ করে মাছ-বন্দরে নামা হল। থরে থরে ফিশিং ট্রলার বাঁধা পাড়ে। আর পরপর শোওয়ানো বরফের চাঁই। তাদের একে একে তোলা হচ্ছে জাহাজে। মাছ ধরার অনেকদিন পর জাহাজ ফিরবে তীরে। তাই মাছ সংরক্ষণ হবে এই বরফে।




জেলে, মাঝিমাল্লা, স্নান-রাঁধাবাড়া সারছে জাহাজের মধ্যেই। তাদের যাত্রা শুরু হবে দিনক্ষণ দেখে, আবহাওয়ার খবর নিয়ে। পরিবার ফেলে দিনের পর দিন ভাসবে গভীর সমুদ্র থেকে মোহানার দিকে। সঙ্গে থাকবে সাইক্লোন, সুনামির বিধিসম্মত সতর্কীকরণ। তবুও জীবনের ঝুঁকি নিতেই হবে, কারণ তারা মৎস্যজীবী। সমুদ্রে পেতেছে শয্যা। ঝড়কে করেছে মিতে। ওদের দেখে মনে হল, আমরা বাঙালিরা থাকি মাছে-ভাতে। বাজারে গিয়ে দু’দশ টাকা নিয়ে মাছওলার সঙ্গে দরদস্তুর করি। কিন্তু সে মাছ ধরে আনার নেপথ্যে যে সৈনিকের দল, তাদের মঙ্গল, অমঙ্গল, শুভাশুভ কিম্বা গায়ের ক্ষত, ঘামের দাগের খবর রাখি কই?

 

*ছবি সৌজন্য: লেখক, getbengal ও facebook

Indira Mukhopadhyay Author

রসায়নের ছাত্রী ইন্দিরা আদ্যোপান্ত হোমমেকার। তবে গত এক দশকেরও বেশি সময় যাবৎ সাহিত্যচর্চা করছেন নিয়মিত। প্রথম গল্প দেশ পত্রিকায় এহং প্রথম উপন্যাস সানন্দায় প্রকাশিত হয়। বেশ কিছু বইও প্রকাশিত হয়েছে ইতিমধ্যেই। সব নামীদামি পত্রিকা এবং ই-ম্যাগাজিনের নিয়মিত লেখেন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, রম্যরচনা ও প্রবন্ধ।

One Response

  1. অসাধারণ । একটি ভ্রমণ কাহিনীর মধ্যে দিয়ে সেই অঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ,আর্থসামাজিক কাঠামো ,খাওয়া-দাওয়া সবই উঠে এসেছে লেখিকার লেখনীতে। একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ভ্রমণ কাহিনী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *