মহাকাশ প্রস্তুতি
এরপরের দিনগুলো কাটতে লাগলো যেন পালকের ওপর ভর করে। পদার্থবিদ হিসাবে আমার মূল কাজ ছিল পৃথিবীর ও চাঁদের সমস্ত ডিএনএর নমুনাগুলিকে একত্রিত করা এবং সেগুলিকে এমনভাবে সংরক্ষিত করা যা বছরের পর বছর ধরে সুরক্ষিত থাকে,পৃথিবী ও চাঁদের অস্তিত্ব যেখানে সংকটে, সেখানে হয় এই মহার্ঘ ডিএনএ-র নমুনা গুলোকে আমাদের সৌরজগতের বা তার বাইরের সম্ভাব্য গ্রহে নিয়ে যেতে হবে,তা যদি সম্ভব না হয় তবে অগত্যা সেগুলিকে সুরক্ষিত অবস্থায় মহাকাশে ছড়িয়ে দিতে হবে,যাতে পরবর্তী সময়ে কোনও গ্রহ সেগুলি থেকে নতুন প্রাণ সৃষ্টি করতে পারে।
এই দুটি কাজই বেশ শক্ত,তবে আমার গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল মহাকাশে ডিএনএ সংরক্ষণের উপায় তৈরি করা,কারণ ৩০২০ সালের অনেক আগেই মানুষ বুঝতে পেরেছিল শেষের সেদিন অত্যন্ত ভয়ঙ্কর হতে চলেছে।
আজ দীর্ঘ আট বছর গবেষণা করে আমি এমন একটি বস্তু আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছি যা দিয়ে আগামী দিনে ডিএনএ সংরক্ষণ করা যেতে পারবে,আমার আবিষ্কৃত বস্তুটি ইতিমধ্যেই গ্লোবাল নেচার অরগানাইজেশানে স্বীকৃতি লাভ করেছে।
আজ ইউনিভার্স স্পেস রিসার্চ ইনস্টিটিউটে এর ওপরে বিশদে আলোচনা হবে, এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও গোপনীয়, তাই আজকের আলোচনা সভায় প্রফেসর হেনরি, ইউজিন, আমি,ডঃ লুইস এয়ারক্রাফট ইঞ্জিনিয়র ডঃ পিল্লাই ও প্রফেসর আনো ছাড়া আর কেউ থাকবেন না। সভা শুরুর একটু আগেই আমি হলে এসে পৌঁছালাম,এয়ারটপে নিজের প্রজেক্টের সমস্ত কিছু গুছিয়ে নিচ্ছিলাম।
এয়ারটপ হলো ল্যাপটপের উন্নত পর্যায়। এটির পর্দা যে কোনও মাধ্যম বা কোনও মাধ্যম ছাড়াই দৃশ্যমান হতে পারে, যেন মনে হয় বাতাসে ভেসে থাকা একটা রঙিন আবরণ,সেখানে আঙুল ছুঁইয়ে অনেকটা টাচস্ক্রিন মোবাইলের মতো সব কাজ করা যায়।
আমি হলে একা বসে এয়ারটপের সমস্ত নথিপত্রে শেষ মুহূর্তে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিলাম,হঠাৎ ভারী বুটের শব্দে মুখ তুলে তাকিয়ে দেখি ডঃ আনো আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন।
শরীরের প্রতিটি পেশী যেন পাথর কুঁদে বানানো, প্রশস্ত কপালের নীচে মণিমাণিক্যের মত চকচক করতে থাকা স্বচ্ছ দুটি নীল চোখ এবং তার ওপর অপরাহ্নের সূর্যের আলো পড়ে তৈরি করেছে এক অপূর্ব উজ্জ্বল রং। আমি সেই সুন্দর, সৌম্য চেহারার দিকে বিভোর হয়ে তাকিয়ে রইলাম।
উনি স্মিত হেসে আমাকে বললেন,
-আকাশি শিফন, লম্বা কালো একঢাল চুল মেঘের মতো ছড়ানো, কপালে ছোট্ট টিপ আর চোখে হরিণীর মতো কাজল, গোল নাকের নীচে নিরব অথচ কী বাঙ্ময় ওই দুটো ঠোঁট, নৈঝতা তোমাকে মেঘেদের রাজকন্যা বলে মনে হচ্ছে।
পৃথিবী ও চাঁদের অস্তিত্ব যেখানে সংকটে, সেখানে হয় এই মহার্ঘ ডিএনএ-র নমুনা গুলোকে আমাদের সৌরজগতের বা তার বাইরের সম্ভাব্য গ্রহে নিয়ে যেতে হবে,তা যদি সম্ভব না হয় তবে অগত্যা সেগুলিকে সুরক্ষিত অবস্থায় মহাকাশে ছড়িয়ে দিতে হবে,যাতে পরবর্তী সময়ে কোনও গ্রহ সেগুলি থেকে নতুন প্রাণ সৃষ্টি করতে পারে।
আমি এয়ারটপের স্ক্রিনে চোখ রেখে কেজো গলায় বললাম,
-ওইজন্যই হাউস আমাকে মেঘেদের দেশে পাঠাতে চায়।
আনো সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন
-সবকিছুই জলের সঙ্গে সম্পর্কিত।
আমি এয়ারটপের ওপর থেকে চোখ সরিয়ে ভ্রূতে ভাঁজ ফেলে ওঁর দিকে জিজ্ঞাসু নয়নে তাকালাম।
-আরে একটু অপেক্ষা করো,পরে সব বুঝতে পারবে। আর প্লিজ নৈঋতা, এভাবে ভ্রূভঙ্গিমায় আমার দিকে তাকিও না,তোমার কটাক্ষের কাছে আমি এখনই খুন হতে চাই না ।
আমি লজ্জা পেয়ে বাইরের দিকে তাকালাম। আর ঠিক তখনই ডঃ ইউজিন ও ডঃ হেনরি কন্ফারেন্স হলে প্রবেশ করলেন।
ডঃ ইউজিন আনোর দিকে তাকিয়ে মজা করে বললেন,
-তুমি বেশ সুযোগসন্ধানী তো হে, ঠিক সময় বুঝে চলে এসেছ।
তারপর ওরা তিনজনেই পায়রা ওড়ানো হাসি হেসে উঠলেন,আর আমি মুখে ছদ্ম গাম্ভীর্য এঁটে বসে রইলাম।
ঠিক দুপুর তিনটেতে আমাদের সভা শুরু হলো, ততক্ষণে আমাদের টিমের বাকি দু’জনও চলে এসেছেন ।
আমি আমার বক্তব্য শুরু করলাম।
-শুভদ্বিপ্রহর,বাংলার বিখ্যাত কবি কাজী নজরুল বিধাতার খামখেয়ালি মেজাজকে উদ্দেশ করে লিখেছিলেন
“খেলিছ,এ বিশ্ব লয়ে,বিরাট শিশু আনমনে।”
আমাদের ওপর আগামীদিনে যে দুর্যোগ আসতে চলেছে তাকে ঈশ্বরের খামখেয়ালিপনা ছাড়া অন্য কিছু বলা যায় না।
কিন্তু আমরা মনুষ্য জাতি হিসেবে এই বিশ্বচরাচরকে বাঁচানোর চেষ্টা করবো।
তাই আজ আমরা একত্রিত হয়েছি এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিশন “সেভ দ্য ইউনিভার্স” নিয়ে আলোচনা সভায়। এই প্রজেক্টে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ দুটি বিষয় আছে। একটি হল,সঠিক পদ্ধতিতে ডিএনএ সংরক্ষণ করা আর অন্যটি হল উপযুক্ত পদার্থের আবরণের মধ্যে প্রাণের স্পন্দনকে বছরের পর বছর সুরক্ষিত রাখা।
প্রথম কাজটি ডঃ আনো অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে করবেন বলে আমি আশা রাখি,পরের কাজটি একজন পদার্থবিদের এবং এটি করার জন্য হাউস আমাকে নির্বাচন করেছে।
পদার্থবিদ্যার দীর্ঘদিনের গবেষণার ফল হলো গ্রাফিন,মানুষের চুলের দশ লক্ষ ভাগের এক ভাগ পাতলা, অথচ ষ্টীলের চেয়ে ২০০ গুণ বেশী শক্তিশালী,পৃথিবীর প্রথম দ্বিমাত্রিক পদার্থ যা একই সাথে স্বচ্ছ ও নমনীয়। এতই অভেদ্য যে একটা ছোট্ট হিলিয়াম কণাও যেতে পারবে না একে ভেদ করে। গ্রাফাইট বা ডায়মন্ডের মতো গ্রাফিনও কার্বনের এক রূপভেদ (Allotrope)।গ্রাফিনের একটা স্তরকে আরেকটার উপর বসিয়ে বসিয়ে তৈরি হয় কার্বনের ত্রিমাত্রিক রূপভেদ গ্রাফাইট। গ্রাফিন ষড়ভুজাকৃতির এক দীর্ঘ জালিকা। গ্রাফিনকে বলা হয় পৃথিবীর প্রথম দ্বিমাত্রিক পদার্থ যার পুরুত্ব মাত্র এক পরমাণু (Atom)।
আমরা আবিষ্কার করেছি এই গ্রাফিনেরই একটি অন্য শ্রেণি। এটি বিশেষ ভাবে মহাকাশের জন্যই তৈরি বলতে পারেন। স্পার্ম ও অন্যান্য উপাদানের ডিএনএকে মাইনাস সত্তর ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে সংরক্ষিত করতে পারবে এই গ্রাফিন। এটি সম্পূর্ণভাবে দুর্ভেদ্য এবং একই সঙ্গে তাপ ও বিদ্যুতের অপরিবাহী হওয়ার জন্য এটির মধ্যে জৈবিক উপাদানগুলি খুব ভালোভাবেই সংরক্ষিত থাকবে। এটি দ্বিমাত্রিক হওয়ার কারণে ওজনে ভীষণ হাল্কা,তাই মহাকাশ পাড়ি দিতে কোনও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।গ্রাফিনের এই পুরু অথচ হাল্কা স্তরের গায়ে এঁকে রাখা থাকবে এই ডিএনএ-র নমুনা থেকে প্রাণ সৃষ্টির সম্পূর্ণ পদ্ধতি।
আমরা এই বিশেষ শ্রেণির গ্রাফিনের নাম দিয়েছি “স্পেস গ্রাফিন”। আমার দৃঢ় বিশ্বাস সবকিছু শেষ হয়ে যাওয়ার পরও স্পেস গ্রাফিনের মধ্যে সঞ্চিত থাকবে ভবিষ্যতের বীজ।
শেষ লাইনটা বলতে বলতে আবেগে আমার গলাটা কেঁপে উঠল।
হাউসের সকলে এক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে রইলেন,তারপরই ডঃ আনো করতালি দিতে দিতে উল্লাসিত হয়ে নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন
-প্রফেসর নৈঋতা,তোমার টিম দারুণ কাজ করেছে,এবারও… ইয়ে মানে এবার মনে হয় আমি জীবজগতকে রক্ষা করতে পারব।
প্রফেসর ইউজিন আমায় বলে উঠলেন
-আমি জানতাম তুমি পারবেই।
অশীতিপর প্রফেসরের দিকে তাকিয়ে আমি কান্নাঘন কণ্ঠে বললাম
-আমায় আশির্বাদ করবেন।
মহাকাশচারীদের রোজনামচা
টিমের মধ্যে ডাক্তার লুইসকে বাদ দিয়ে মহাকাশে পাড়ি জমানোর অভিজ্ঞতা আমাদের কারোরই নেই। তাই মাস কয়েক ধরে আমাদের তিনজনকে কঠিন অ্যাস্ট্রোনট ওয়ার্কশপ ও বিশেষ প্রশিক্ষণ নিতে হল। এই কঠিন প্রস্তুতির মধ্যে মানসিক ধৈর্য্য ও বিভিন্ন কঠিন শারীরিক পরীক্ষাও ছিল।
আগে মহাকাশের জন্য ভরহীন অবস্থা পৃথিবীতে তৈরি করার ক্ষেত্রে জলের সাহায্য নেওয়া হতো। অর্থাৎ, জলভর্তি বিশেষ কক্ষে যন্ত্রের সাহায্যে মানুষের শরীরের ঘনত্বের সঙ্গে জলের ঘনত্ব মিলিয়ে দেওয়া হত। এতে মানুষ ডুবে না গিয়ে ভরহীন অবস্থায় ভেসে থাকতে পারত ও মহাকাশে মতো পরিস্থিতি তৈরি করে কৃত্রিমভাবে মানুষকে মহাকাশ যাত্রার জন্য প্রস্তুত করা হতো। কিন্তু বর্তমানে ভার্চুয়াল রিয়েলিটির মাধ্যমে অতি সহজে ও সুচারুভাবে মহাকাশ উপযোগী পরিবেশ তৈরি করে আমরা প্রশিক্ষণ নিচ্ছি। টানা তিনমাসের এই প্রশিক্ষণ শিবিরে এক অবাক করা কান্ড হল,প্রফেসর আনো এই কাজগুলো এমন দক্ষতার সঙ্গে করছেন যেন মনে হচ্ছে এগুলো ওঁর বাঁ হাতের কাজ। এ বিষয়ে ওকে জিজ্ঞেস করলে আমরা আগের মতোই সব গোলমেলে উত্তর পাচ্ছি। কখনও বলছেন, এমনটা আগেও করেছেন তো আবার কখনও স্রেফ মুচকি হেসে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন। সব মিলিয়ে বেশ বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতি।
অবশ্য,প্রফেসর আনোকে নিয়ে বেশি চিন্তা করার অবকাশ আমাদের ছিল না। জুলাইয়ের মধ্যে প্রজেক্টের প্রয়োজনীয় সবকিছু গুছিয়ে নেওয়ার জন্য আমরা দিন রাত এক করে কাজ করছিলাম। পৃথিবীর প্রাণীকূলের অস্তিত্ব রক্ষার যে গুরু দায়িত্ব আমাদের ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে,তা যথাযথ পালন করার জন্য আমরা বদ্ধপরিকর ছিলাম।
বর্তমানে ভার্চুয়াল রিয়েলিটির মাধ্যমে অতি সহজে ও সুচারুভাবে মহাকাশ উপযোগী পরিবেশ তৈরি করে আমরা প্রশিক্ষণ নিচ্ছি। টানা তিনমাসের এই প্রশিক্ষণ শিবিরে এক অবাক করা কান্ড হল, প্রফেসর আনো এই কাজগুলো এমন দক্ষতার সঙ্গে করছেন যেন মনে হচ্ছে এগুলো ওঁর বাঁ হাতের কাজ।
আমাদের মহাকাশ যাত্রার দিন যত এগিয়ে আসছিল আমি ভেতরে ভেতরে প্রচন্ড উত্তেজনা অনুভব করছিলাম। পৃথিবীর অস্তিত্ব সংকট আর তার সঙ্গে চাঁদের বিনাশ মেনে নিতে পারছিলাম না। আমাদের সকলের সর্বজনীন মামা, ছোটো বাচ্চার মাথায় টিপ দিয়ে যাওয়ার জন্য যাকে ডাকতাম,সূর্যের আলোর পর যার আলো নিয়ে পৃথিবীর তাবড় সাহিত্যিকরা রচনা করেছেন অনবদ্য কবিতা বা গদ্য। সেই চাঁদ বা চন্দ্রমাকে আমরা আর কখনও দেখতে পাবো না সেটা কল্পনা করেই মনটা আরও ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ছিল।কিন্তু ভাগ্যে বা ভবিতব্যে যা ঘটতে চলেছে তাকে আর কী করে বদলানো যাবে?
আমাদের মহাকাশযানটি দেখতে অনেকটা ক্যাপসুলের মতো,এটির পেছনদিক আলাদা একটা কম্পার্টমেন্ট আছে,সেটিও স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি মহাকাশযান কিন্তু আকারে আমাদের বর্তমান মহাকাশযানের থেকে ছোট।
মহাকাশ পাড়ি দেওয়ার পর আমাদের প্রাথমিক কাজ হল,চাঁদ থেকে সংগ্রহ করা সমস্ত ডিএনএ গুলিকে গ্রাফিনের দুর্ভেদ্য আস্তরণের মধ্যে সুরক্ষিত রাখা। আমাদের প্রতি ঘন্টায় পৃথিবীতে প্রয়োজনীয় রিপোর্ট পাঠাতে হবে,তার সঙ্গে অবলিটারেশন ৩০২০ ধূমকেতু পৃথিবী ও চাঁদে আছড়ে পড়ার মুহূর্তের সমস্ত ছবি নিখুঁত ভাবে তুলে নিতে হবে। পরবর্তী সময়ে পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ সম্ভবপর হলে তখন আমরা পৃথিবীর পরিস্থিতি বুঝে পৃথিবীতে ফিরে আসব,আর দুর্ভাগ্যক্রমে যদি পৃথিবীর সঙ্গে সমস্ত যোগাযোগ আমাদের বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তখন করতে হবে “প্ল্যান বি”।
এর মধ্যে আমার প্রজেক্টের বাকি সদস্যদের সঙ্গে এয়ার ডিভাইসের মাধ্যমে কনফারেন্স কল করেছি কয়েকবার।ডঃ লুইসের অবস্থা আমার মতোই, উত্তেজনা কমানোর জন্য বেশ কিছুদিন ধরে উনি মেডিটেশন করছেন। উত্তেজিত হয়ে পড়লে মিঃ পিল্লাই ওঁর মাতৃভাষা তামিলে কথা বলতে শুরু করে দেন। শুধুমাত্র ব্যতিক্রম প্রফেসর আনো,এমন স্থিতধী মানুষ আমি দেখিনি। ওঁর সবকিছুই যেন বেশ অন্যরকম।ওঁকে যত দেখছি ততই অবাক হচ্ছি,কোনও একটি পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের সহজাত প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে ওঁর কিছুই মেলে না। মাঝে মাঝে আদ্যপান্ত্য রহস্যে মোড়া এই মানুষটিকে দেখে মনে দ্বন্দ্ব হয় উনি কি পৃথিবীর মানুষ নন?
ক্ল্যাইম্যাক্স
পৃথিবীর হিসাবে আমাদের মহাকাশ পাড়ির আজ চারদিন হয়ে গেল,এখানে দিন রাতের কোনও পার্থক্য বুঝতে পারি না,ভরহীন অবস্থায় থাকতে থাকতে একসময় মনে হয় সময় বুঝি থমকে গেছে এই মহাকাশযানের অশেষ কালো রঙের রহস্যের মোড়কে। মহাকাশ থেকে নীল ও সাদা রঙের পৃথিবীকে দেখতে দেখতে মনে একরকম অদ্ভুত মায়ার জারণ সৃষ্টি হয়। পৃথিবীতে কাটানো সুন্দর মুহূর্তগুলো মনে পড়ে,মহাকাশযানের জানলা দিয়ে পৃথিবীটাকে একটু ছুঁয়ে আদর করতে বড় সাধ হয়।
মহাকাশযানের মধ্যের পরিবর্তিত পরিস্থিতি ও প্রচুর ব্যস্ততার মধ্যেও একদিন লক্ষ করলাম,প্রফেসর আনো গ্রাফিনে মোড়া ডিএনএগুলোর কাছে গিয়ে পরম মমতায় বিড়বিড় করে কিছু বলছেন। কৌতূহল পরবশ হয়ে আমি কাছে গেলাম,উনি তখন আমার দিকে তাকিয়ে উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন,
-শুনে পাচ্ছো? ডঃ? ওরা বলছে? ওরা বাঁচতে চায়,আবার সেই নির্মল পৃথিবীর বাতাসে প্রাণ ভরে শ্বাস নিতে চায়। বৃষ্টিতে ভিজতে চায়,রোদে পুড়তে চায়। ওরা যে আবারও ফিরতে চায়।
ডঃ আনো এমব্রায়োলজিস্টের পাশাপাশি একজন প্রকৃতিবিদ একথা আগেই বলেছি,তাই ওঁর এভাবে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়া খুবই স্বাভাবিক।
আমি ওঁকে কিছু বললাম না। আমরা দু’জন এইভাবেই বেশ কিছুক্ষণ মহাকাশযানের মধ্যে ভেসে রইলাম।
সম্বিত ফিরল মিঃ পিল্লাইয়ের ডাকে।
আমাদের মহাকাশযান সম্বন্ধিত কিছু যান্ত্রিক বিষয়ে আলোচনা করলাম আমরা। আলোচনায় দেখলাম,প্রফেসর আনো অ্যাস্ট্রোনাট ইঞ্জিনিয়ারিং এর বিষয়েও অনেক কিছু জানেন। মিঃ পিল্লাই ওঁকে সেকথা বলাতে উনি রহস্যময়ভাবে হেসে বললেন
“জাহাজ আর উড়োজাহাজে এমন আর কী পার্থক্য”!
যথারীতি ওঁর কথার মর্মার্থ আমরা বাকি মহাকাশচারীরা বুঝতে পারলাম না।
যত দিন এগোতে লাগল আমাদের মধ্যে উত্তেজনা ততই বাড়তে লাগল। শেষ পর্যন্ত সেই বহু প্রতীক্ষিত দিনটি এলো, ৫ই নভেম্বর ৩০২০। ওইদিন পৃথিবীর সময় বেলা দুটো নাগাদ বিধ্বংসী অবলিটারেশন ৩০২০ ধূমকেতু প্রায় ৩২১৯ কিমি প্রতি ঘন্টা বেগে আছড়ে পড়ল চাঁদের ওপর। মিঃ পিল্লাই অসাধারণ দক্ষতার সঙ্গে চূর্ণবিচূর্ণ চাঁদের কিছু ধ্বংসাবশেষ সংগ্রহ করলেন। আমার মনটা ভেঙে পড়ছিল,কঠিন মুখে তবুও শেষ প্রার্থনা করছিলাম যাতে পৃথিবীর ওপর এই মহাপ্রলয়কারী ধূমকেতু বেশী ক্ষয় ক্ষতি না করতে পারে। ডঃ লুইস ও প্রফেসর আনো নিজেদের মধ্যে পরবর্তী করণীয় সম্বন্ধে আলোচনা করছিলেন।
ক্রমশ পৃথিবীর সঙ্গে আমাদের সমস্ত যোগাযোগ ক্ষীণ হতে শুরু হল। মহাকাশযানের মধ্যে আমরা অবাক বিস্ময় ও ভেঙে যাওয়া মন নিয়ে পৃথিবীর ধ্বংস দেখছিলাম।
মানুষের তৈরি পৃথিবীর সমস্ত আশ্চর্য স্থপতিগুলো একে একে তাসের ঘরের মতো ভেঙে গুঁড়িয়ে যেতে দেখলাম। প্রকৃতি যেন আজ পণ করেছে মানুষের মিথ্যা আস্ফালন ও নিজেকে পৃথিবীর সর্বেসর্বা ভাবনাকে সমূলে ধ্বংস করবে। তছনছ করে দেবে মানুষের তৈরি সমস্ত চিন্হকে যা নিয়ে সে একদা গর্ব অনুভব করত।
ক্রমেই পৃথিবীকে ঘিরে কালো হয়ে যাওয়া একরকম ধূসর চাদরের আবরণ সৃষ্টি হল,
পৃথিবীতে অবলিটারেশন ৩০২০ ধূমকেতুর বিধ্বংসী তান্ডব চলতে থাকল।
আমাদের সকলের চোখের জলে ক্রমেই ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল সামনের দৃশ্য,আমরা একে অন্যের হাত ধরে মহাকাশযানের মধ্যে নিরুপায় ভাবে ভেসে রইলাম।
এভাবে কতক্ষণ ছিলাম জানি না,নিরবতা ভেঙে প্রথম কথা শুরু করলেন প্রফেসর আনো।
-আমাদের পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করতে হবে,মিঃ পিল্লাই,আপনাকে আমি এ বিষয়ে সাহায্য করব।
তারপর আমার আর ডঃ লুইসের দিকে তাকিয়ে বললেন,
-তোমরা গ্রাফিনে মোড়া ডিএনএ গুলোকে আরও একবার পরীক্ষা করে নাও।
তারপর নিজের ঠোঁট কামড় ধরে কিছুক্ষণ চিন্তা করে নিয়ে পুনরায় বললেন,
-আমার মনে হয়,আমাদের “প্ল্যান বি” এর দিকে এগোতে হবে।
আমি চমকে গিয়ে ওঁর দিকে তাকালাম,একটা কথা বলতে যাচ্ছিলাম,কিন্তু তার আগেই আমাকে হাতের ইশারায় থামিয়ে দিয়ে উনি বললেন
-ডঃ নৈঋতা,আমি তো তোমাকে আগেই বলেছি,এ কাজ আমি আগেও করেছি,শুধু পার্থক্য হল আগে জল ছিল আর এবারে হল মহাশূন্য।
‘প্ল্যান বি’ অনুযায়ী,পৃথিবী থেকে আমাদের কাছে কোনও রকম সংকেত এসে না পৌঁছলে আমি দুভাগের একভাগ ডিএনএ-র নমুনা নিয়ে সৌরজগতের সীমানায় বাইরে পাড়ি দেব পৌঁছাতে চেষ্টা করব অন্য গ্রহাণুতে, যদি না পৌঁছাতে পারি তবে ডিএনএ-র নমুনাগুলো গ্রাফিনের সুরক্ষিত আবরণের মধ্যেই মহাশূন্যে থেকে যাবে,আমি আশাবাদী তা যদি ঘটে তবুও এই জীবনের স্পন্দনের স্ফুরণ ঘটাবে ভবিষ্যতের কোনও বুদ্ধিমান গ্রহের মানু্ষ। আপনারা সকলে ডিএনএ-র অন্য ভাগ নিয়ে ফিরে যাবেন পৃথিবীতে।
-কিন্তু ডক্টর,আপনি জানেন, এটা কতটা বিপদসংকুল?
আতঙ্কে প্রায় চিৎকার করে উঠলেন ডাক্তার লুইস।
-আর তাছাড়া আমি আরও একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না,আপনি এমন কাজ আগে কবে করেছেন?
ভ্রূতে ভাঁজ ফেলে আমি ওঁকে জিজ্ঞেস করলাম।
উনি আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর কৌতুক করে বললেন,
-নৈঋতা আগেও বলেছি… ওই কটাক্ষ!
ইতিমধ্যে,মিঃ পিল্লাই তামিল মেশানো ইংরেজিতে যা বললেন তার মানে হল,এই মুহূর্তে পৃথিবীতে সঙ্গে আমাদের সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
আমরা জানি এরপর আমাদের কী করতে হবে।
আমাদের মহাকাশযানের পেছনে ছোট কম্পার্টমেন্টের মতো মহাকাশযানটিতে আগে থেকেই সেই ডিএনএ নমুনাগুলো ছিল যেগুলো নিয়ে ডঃ আনো পাড়ি দেবেন সৌরজগতের বাইরে।
আমরা সকলে ওই ছোট মহাকাশযানটির সামনে ভেসে ভেসে চলে এলাম,একে একে আমরা সকলে আনোকে জড়িয়ে ধরে শেষ বিদায় অভিবাদন জানালাম।
আমাকে জড়িয়ে ধরার মুহূর্তে ডঃ আনো আমার কানের কাছে নিজের মুখ নিয়ে গিয়ে খুব ধীরে ধীরে বললেন,
-তোমাদের হিন্দু ধর্মে বাল্মিকী ‘মড়া’ ‘মড়া’ উচ্চারণ করতে করতে রামের সন্ধান পেয়েছিলেন।
তুমিও আমার নাম নিয়ে একটু ভাবতে পারো,সবকিছু বুঝতে পারবে।
আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে অবাক বিস্ময়ে ডঃ আনোর দিকে তাকিয়ে রইলাম। ওঁর সঙ্গে আমাদের কারোরই আর কখনই দেখা হবে না। নিজের কর্মে স্থির,অবিচল,আনন্দপ্রিয় মানুষটি চিরতরে হারিয়ে যাবেন মহাকাশের বিলীন,অশেষ শূন্যতায়।
সেই মুহূর্তে আমি আর কিছু ভাবতে পারছিলাম না। এরকম প্রজেক্টের ক্ষেত্রে আমরা সকলেই জানি পৃথিবীতে সুস্থভাবে ফেরা বেশ শক্ত কখনও কখনও অসম্ভব,আমাদের ট্রেনিং নেওয়ার সময় সেইভাবেই মানসিক প্রস্তুতি নিতে বলা হয়। তবুও মন কিছুতেই মানতে চাইছিল না।এই কয়েকদিনের পরিচয়ে সৌম্য দর্শন প্রকৃতিপ্রেমী মানুষটির জন্য আমার মনের কোথাও আমারই অজান্তে তৈরি হয়ে উঠেছিল ভালোলাগার রেশ।
ডঃ আনো টেক অফ্ করলেন, একসময় ওঁর মহাকাশযানটি ধীরে ধীরে আমাদের দৃষ্টি পথের বাইরে চলে গেল, আমার মনে হল, আর কয়েক ঘন্টা পরে হয়তো ওঁর সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ চিরতরে ছিন্ন হয়ে যাবে। অজান্তেই আমার ভিতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস উঠে এল। আমরা শ্লথ গতিতে আমাদের নির্দিষ্ট স্থানে ফিরে এলাম।
ওঁর শেষ কথাটা ভাবছিলাম,কী বলতে চাইছিলেন আনো? ‘জাহাজ’,’জল’,’আগেও একাজ করেছেন’ শেষের ওই কথাটা ‘নাম উল্টো করে দেখো’,আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। পরপর এত ঘটনা ঘটছে যে আমার মনে হচ্ছে যেন ক্রমশই ভাবার শক্তি আমি হারিয়ে ফেলছি।ডঃ আনোর বলে যাওয়া কথাগুলো কিছুক্ষণ মন দিয়ে ভাববার পর হঠাৎই মাথায় বিদ্যুৎ খেলার মতো ওঁর হেঁয়ালি বুঝতে পারলাম।
আরে,এই কথাটা তো ভীষণ সহজ,আমার এটা বুঝতে এতক্ষণ সময় লাগলো?পরক্ষণেই অবাক হলাম এটা ভেবে যে, কী করে এটা সম্ভব!
আনো শব্দটিকে বার বার উচ্চারণ করলে সেটি উল্টে যে নতুন শব্দ তৈরি হয় তা হল “নোয়া”। হ্যাঁ,প্রফেসর আনোয়ার আলবার্তো ছিলেন আদতে নোয়ার আর্কের সেই নোয়া যার উল্লেখ বাইবেলে রয়েছে।
যিনি অতিপ্লাবনের হাত থেকে পৃথিবীর প্রাণীকূলকে রক্ষা করেছিলেন।
আমার বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষিত মন এর বিরোধিতা করে উঠল,এ তো কোনও ভাবেই সম্ভব নয়।
আমি মহাশূন্যের কালো অনিঃশেষ অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলাম, আলো বিশ্বাস করলে যেমন অন্ধকারকে মেনে নিতে হয়, তেমনই বিজ্ঞান মানলে অসম্ভবকেও মানতে হবে।
এছাড়া,আনোয়ারের বেশ কিছু কান্ডকারখানার আর যে কোনও যুক্তি নেই!
আমি মহাকাশযানের জানলার দিকে ভেসে গেলাম,বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের দোলাচলে ওই গূঢ় রহস্যময় অন্ধকারের মধ্যে নোয়া ও তার আর্ককে খুঁজতে চেষ্টা করলাম,মনে মনে ভাবলাম,উনি কি পারবেন পৃথিবীর জীবকূলকে রক্ষা করতে? আর ঠিক তখনই আমার কানের কাছে কে যেন ফিসফিস করে বলে উঠল
“ডঃ নৈঋতা বাসু,এত দ্বিধা কেন?” ঠিক যেমন করে ডঃ আনোয়ার প্রথম দেখা হওয়ার দিন আমাকে বলেছিলেন।
আমি চমকে গিয়ে চারিপাশে তাকালাম, ততক্ষণে আমাদের মহাকাশযান পুনরায় পৃথিবীর উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেছে।
আমি জানি না পৃথিবীতে আমরা কেমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হব,পৃথিবীর জীবজগতের জন্য ভবিষ্যতে কী অপেক্ষা করে আছে। এই বদলে যাওয়া পৃথিবী আদৌ মনুষ্যবাসের উপযোগী হয়ে উঠবে কিনা তার উত্তর ভবিষ্যত দেবে, কিন্তু আমার স্থির বিশ্বাস, আমাদের চরম অস্তিত্ব সংকটে আমরা আবারও নোয়াকে ফিরে পাব, যার বরাভয় ও নিরাপদ আশ্রয়ে গড়ে উঠবে একটা সুন্দর,নির্মল পৃথিবী।
অনুভা পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। সরকারি চাকরি করেন। লেখালেখি প্যাশন। সানন্দা ব্লগ, শুকতারা, এখন ডুয়ার্স, অপার বাংলা, প্রসাদ-সহ প্রচুর পত্রপত্রিকা, লিটিল ম্যাগাজ়িন, ওয়েবজিন ও সংবাদপত্রে গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, রম্যরচনা প্রকাশ পেয়েছে। সন্ধ্যা ভট্টাচার্য স্মৃতি প্রতিযোগিতায় পুরষ্কার পেয়েছেন ছোটদের জন্য লিখে। কলকাতা আন্তর্জাতিক অণু চলচ্চিত্র উৎসব ২০২০-তে, অমিয়া ভৌমিক স্বর্ণকলম পুরস্কার পেয়েছেন। কলকাতা আন্তর্জাতিক অণু চলচ্চিত্র উৎসব ২০২১-এর বিচারক ও সম্পাদকমণ্ডলীর অন্যতম সদস্য।
অনুভা, তোমার লেখা কল্পবিজ্ঞানের যে গল্প পড়লাম, তার প্লটের অভিনবত্ব আমাকে বিস্মিত করেছে । অনবদ্য, অসাধারণ… কোনও বিশেষণই এ গল্পের নির্মাণ–কুশলতার জন্যে যথেষ্ট নয় । ৩০২০ সালে গল্পের বিস্তার ঘটিয়ে তুমি ঠিক কাজই করেছ। এর মধ্যে জড়িয়ে থাকা ‘ম্যাজিক রিয়েলিজম’ পাঠক যে উপভোগ করবে, তা আমি হলফ করেই বলতে পারি। থাকছে তোমার জন্যে শুভকামনা অফুরান।
অসাধারণ একটি গল্প উপহার দিলেন লেখিকা অনুভা নাথ। তাঁর ভাবনার অভিনবত্বে পাঠক মুগ্ধ হতে বাধ্য। বিজ্ঞান আর সাহিত্যের এমন মেলবন্ধন বড় তৃপ্তি দেয়। লেখিকাকে ধন্যবাদ।