আগের পর্বের লিংক: [পর্ব ১], [পর্ব ২], [পর্ব ৩], [পর্ব ৪], [পর্ব ৫]

বন্ধু। প্রিয় বন্ধু। সেই সতেরো বছর বয়স থেকে বন্ধু তারা। বরের সঙ্গে সে-ও এসেছিল তাদের বাড়িতে। আর যেমন তেমন আসা তো নয়, একেবারে এক কাপড়ে, বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবার পর আসা। কই, দেখে তো তেমনটা বোঝা যাচ্ছিল না! মরাঠি ঢংয়ে শাড়ি পড়া, কপালে বড় টিপ। চোখ দুটো অস্বাভাবিক রকম উজ্জ্বল। 

মেয়েটির বাবা সম্পন্ন মানুষ, নিয়ে যেতে এসেছিলেন মেয়েকে। মাথা গোঁজ করে সে গিয়েছিল। ফিরেও এসেছিল কিছুদিন পর। বরের সঙ্গে একত্রে দলিত ছেলেমেয়েদের পড়ায় সে। সেইজন্যই তো শ্বশুরবাড়িতে সবাই রেগে গেছে, বাড়ি ছেড়ে চলেও যেতে বলেছেন শ্বশুরমশাই। বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছে, কিন্তু পড়ানো বন্ধ করেনি। যাদের পড়ানো নিয়ে এত অশান্তি, সেই মাহার ও মাং দলিতদের পড়ানো চলছেই। 

এইসব গল্প আগে থেকেই শুনেছিল ফতিমা। দাদা, উসমান শেখই বলেছিলেন, সেই কবে ছোটবেলায় বাবা মাকে হারিয়েছে ওরা দুজন, ফতিমার জন্য দাদাই সব। সেই দাদা বললেন,
– ওদের কেউ থাকতে দিচ্ছে না, জানিস?
– আমাদের বাড়িতেই নিয়ে এস না কেন? এত বড় বাড়িতে আমরা তো মাত্র দু’জন?
– নিয়ে আসতেই চাই। তোর কথা ভেবেই ভয় পাই ফতিমা। এমনিতেই এখনও তোর নিকাহ করাইনি বলে, তোকে লেখাপড়া শেখাই বলে, কত লোক নিন্দে করে।
– সে করুক ভাইজান। তুমি ওদের নিয়ে এস। আমার খুব দেখার শখ, ভাব করার শখ।

বোনের কথা ফেলেননি উসমান শেখ। নিন্দা সমালোচনার ঝড় বয়ে গেছিল। মুসলিম হয়ে দলিতদের বাড়িতে নিয়ে আসা? তাদের আশ্রয় দেওয়া? তাদের সঙ্গে ওঠাবসা, খাওয়া দাওয়া? এ তো ধরম ইমান যাওয়ার সামিল! কোনও কথায় কান দেননি উসমান শেখ। জ্যোতিবা-সাবিত্রীকে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসেন। বাড়িতেই দলিতদের স্কুল চালাবারও ব্যবস্থা করে দেন। 

১৮৪৯ সালের কথা। সুতির শাড়ি আর বড় টিপ পরা সাবিত্রীবাঈকে সেই প্রথম দেখে ফতিমা। সতেরো আঠেরো বছরের সাবিত্রী। কিন্তু কী তার ব্যক্তিত্ব, স্বামীর পাশে থেকে কী লড়াই! আর পড়াশুনোও শিখেছে কত। ফতিমারও বয়স ওই সতেরো-আঠেরোই, তাকে পড়াশুনো শেখাবার ব্যবস্থাও করেছেন দাদা। তবু সাবিত্রীকে দেখে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে ফতিমা। এমন বন্ধু না পেলে, তার জীবনই বৃথা। 

Fatima Sheikh Pune
ফতিমা শেখ আর তাঁর দাদা উসমান শেখ আশ্রয় দিলেন একঘরে হওয়া জ্যোতিবা-সাবিত্রীকে

বন্ধু হয়েছিল তারা। প্রাণের বন্ধু। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত। সাবিত্রী-জ্যোতিবার কর্মকাণ্ডে চিরকাল পাশে থেকে সাহায্য করে গেছেন উসমান, ফতিমা। সারাজীবন অবিবাহিত থেকেছেন উসমান, ফতিমাও। তাঁদের যেন একটাই ধর্ম, একটাই ব্রত– জ্যোতিবা সাবিত্রীর দলিত শিক্ষা, মেয়েদের শিক্ষার আন্দোলনকে সফল করা। জ্যোতিবা-সাবিত্রীকে তাও অল্পবিস্তর মনে রেখেছে সমাজ, ইতিহাস। হয়তো মরাঠি জ্যাত্যাভিমান, দলিত মহাত্মা অস্তিত্ব ভুলতে দেয়নি তাদের। কিন্তু উসমান শেখ, ফতিমা শেখ? তাঁদের কথা বলে না কেন কেউ?

অভিজাত মুসলিম পরিবারে জন্ম ফতিমার। খুব অল্প বয়সেই অনাথ, দাদার অভিভাবকত্বে পড়াশুনো, বড় হওয়া। আর তারপর সাবিত্রী বাঈয়ের সংস্পর্শে জীবনের এক বিরাট মানে খুঁজে পাওয়া।

পুণে থেকে আহমেদনগরের মিস মিচেলের নর্মাল স্কুল ও মিস সিন্থিয়া ফারারের টিচিং ইন্সটিটিউট থেকে পড়াশুনো করে ফিরে এলেন সাবিত্রী। পরের বছর বন্ধুকেও জোর করে পাঠালেন একই জায়গায়। সাবিত্রীবাঈয়ের মতোই সসম্মানে উত্তীর্ণ হলেন ফতিমা, দু’টি প্রতিষ্ঠান থেকে পাশ করে ফিরে এলেন পুণেতে এবং যোগ দিলেন সাবিত্রীর মেয়েদের স্কুলের কর্মযজ্ঞে।

Fatima and Savitri
সাবিত্রীর মতো তাঁর বান্ধবী ফতিমাও প্রশিক্ষণ নিলেন শিক্ষিকা হবার

দলিত মেয়েদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে, কীভাবে তাদের বুঝিয়ে স্কুলে নিয়ে আসতেন সাবিত্রী, দেখেছি আমরা। ফতিমার উপর তেমনই ভার পড়ল মুসলিম মেয়েদের নিয়ে আসার। মেয়েদের শিক্ষার, দলিত মেয়েদের শিক্ষার অভিধানে প্রথম নাম যদি হয় সাবিত্রী ফুলে, মুসলিম মেয়েদের শিক্ষার ইতিহাসে সেই নাম ফতিমা শেখের। 

আবারও মনে করে নেওয়া যাক, সময়টা ১৮৫০-৫২। মহারানির শাসন এখনও স্থাপিত হয়নি। মুঘল শাসনের পতনের ১০০ বছরও হয়নি। মুসলিম সম্প্রদায়ের মেয়েদের পর্দাপ্রথা গভীর, গভীরতরভাবে প্রতিষ্ঠিত। ফতিমা শেখের কাজটা সহজ ছিল না। বর্ণহিন্দু সম্প্রদায় ও দলিত মেয়েদের শিক্ষাগ্রহণের ক্ষেত্রে সামাজিক বিধিনিষেধের তারতম্য কতটা গুরুত্বপুর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তা আমরা এর আগে দ্বিতীয় পর্বে আলোচনা করেছি। এই প্রসঙ্গে বৈষ্ণব সম্প্রদায়ভুক্ত মেয়েদের কথাও আলোচিত হয়েছে এটা বোঝাতে যে, পর্দাপ্রথা, বর্ণহিন্দুত্বের কড়াকড়ি না-থাকা কতটা সহায়ক হয়েছিল সেই সম্প্রদায়ের মেয়েদের শিক্ষার উৎসাহে। সাবিত্রীর প্রতিষ্ঠিত মেয়েদের ইস্কুলের লক্ষণীয় সংখ্যার পিছনে ছিল দলিত মেয়েদের মধ্যে পর্দাপ্রথা না থাকা।

ফতিমা কিন্তু সেই সুবিধে পেলেন না। মুসলিম অন্তঃপুরে প্রবেশের অধিকার সহজে পেলেন ঠিকই, কিন্তু খুব কম সংখ্যক ছাত্রী যোগাড় করতে পারলেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতেন, বোঝাতেন মুসলিম মেয়েদের, তাদের বাড়ির লোকেদের। কিন্তু পর্দাপ্রথা, মুঘল সাম্রাজ্যের থেকে যাওয়া অন্তঃপুরের রেওয়াজ অন্তরায় হয়ে দাঁড়াল। তবে থেমে যাননি ফতিমা। সাবিত্রীদের তৈরি স্কুলের মধ্যে বম্বে প্রেসিডেন্সির যে তিনটি স্কুল, তা প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার দায়িত্ব নেন ফতিমা। 

Fatima and Savitri friends
দুই বান্ধবীই নেমে পড়লেন নারীশিক্ষার মহাব্রতে

সাবিত্রীর মতো ফতিমার পরনেও তখন মরাঠি ঢংয়ে পড়া শাড়ি, কপালে গোল টিপটুকুই যা নেই। আর বান্ধবীর মতোই দু’তিনটে শাড়ি অতিরিক্ত নিয়ে বেরোতে হত ফতিমাকেও। কাদা, আবর্জনা তার শাড়িতেও কম পড়ত না। অপরাধ কি কম? সাবিত্রীর কাজে সহায়তা করা, মুসলিম বাড়ির মেয়েদের নারীশিক্ষায় উতসাহিত করা, স্কুল প্রতিষ্ঠা– গুনতি কম নয়।

সাবিত্রী বিধবা মেয়ে ও তাঁদের সন্তানদের জন্য আশ্রম গড়ে তোলেন, সে কথা আগের পর্বেই বিস্তারে আলোচনা হয়েছে। ফতিমা শেখও বন্ধুর মতোই নিজের বাড়িতে গড়ে তুললেন ছাত্রী আবাস। যেসব মেয়েরা পড়তে এসেছে, মুসলিম বা দলিত অথবা অন্য ধর্মের– ফতিমার বাড়িতে আশ্রয় নিতে পারত। পরিবারের চাপে ইচ্ছা থাকলেও পড়াশোনা করতে পারছে না যে মেয়েরা বা পড়াশুনো করছে বলে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে এমন মেয়েদের নিশ্চিন্ত আশ্রয় ছিল ফতিমা শেখের এই ছাত্রী আবাস।

Fatima-Savitri
সাবিত্রীবাঈ ফুলে ও ফতিমা শেখ। সঙ্গে তাঁদের দুই ছাত্রী

ফলে তাঁদের গায়ে যে সমাজ থেকে কাদা, আবর্জনা নিক্ষিপ্ত হবে, এ আর এমনকী?

আজ থেকে দেড়শো বছর আগে দুই বন্ধু, একজন দলিত, একজন মুসলিম, সাহসি নির্বিকার মুখে, প্রতিদিন নামতেন এই ধর্মযুদ্ধে। শুধুমাত্র মেয়েরা পড়াশুনো করবে, দলিত বা মুসলিম এই পরিচয়ে অবহেলিত অত্যাচারিত হবে না, এই আশায়। সমাজের অত্যাচার, অপমান স্পর্শ করত না তাঁদের। আজ দেড়শো বছর পর, দূর কোনও নক্ষত্রলোকে হয়তো হেঁটে চলছেন দুই বন্ধু, মরাঠি ঢংয়ে শাড়ি পরে। নারীদিবস, নারীবর্ষ কয়েক পা এগনো নারীশিক্ষা তাঁদের চোখে পড়ছে কি? 

আগের পর্বের লিংক: [পর্ব ১], [পর্ব ২], [পর্ব ৩], [পর্ব ৪], [পর্ব ৫]
*ছবি সৌজন্য: লেখকের সংগ্রহ, bbc, Wikipedia, theprint.in, Facebook
* তথ্যঋণ:

‘দ্য লাইফ অ্যান্ড টাইমস্‌ অফ ধ্যানজ্যোতি ক্রান্তিজ্যোতি সাবিত্রীবাঈ ফুলে’; আলোক, নূপুর প্রীতি; ২০১৬

‘কাস্ট, কনফ্লিক্ট অ্যান্ড আইডিওলোজিঃ মাহাত্মা জ্যোতিরাও ফুলে অ্যাড লো কাস্ট প্রোটেস্ট ইন্ নাইন্টিন্থ সেঞ্চুরি ওয়েস্টার্ন ইন্ডিয়া’; ও’হানলন, রোজালিন্ড; ২০০২

‘এ টেল অফ টু রিভোল্টস্‌’; গান্ধী, রাজমোহন; ২০০৯

‘কালেক্টেড ওয়ার্কস্‌ অফ্‌ মাহাত্মা জ্যোতিরাও ফুলে’ ভলিউম ১-২, গভর্নমেন্ট অফ মহারাষ্ট্র, ১৯৯১

Isha Dasgupta Author

ঈশা আদতে অর্থনীতির ছাত্রী, শিক্ষিকা ও সমাজকর্মী। বিধাননগর কলেজের স্নাতক ঈশার পড়াশোনা ও শিক্ষকতার ক্ষেত্র ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অফ ম্যাসাচুসেটস, আমহের্স্ট। ছোটবেলা কেটেছে পিতামহী শিক্ষাবিদ মৃণালিনী দাশগুপ্তের ছত্রছায়ায়, অনেক গল্প, গল্পের বইদের সঙ্গে। গল্প বলার ছায়ারা পিছু নিয়েছে তখন থেকেই। ছোটবেলার স্মৃতিদের নিয়ে লেখা 'আমার রাজার বাড়ি' প্রথম প্রকাশিত গদ্যগ্রন্থ। প্রকাশিত হয়েছে 'রাই আমাদের' নামে ছোটদের গল্পের বইও। কবিতার বই 'চাঁদের দেশে আগুন নেই' আর 'রোদের বারান্দা' আছে ঈশার ঝুলিতে। কবিতার জন্য কৃত্তিবাস পুরস্কারও পান। বড়দের গল্প লেখেন অল্পস্বল্প- 'দেশ' পত্রিকা সাক্ষী। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখেন গবেষণামূলক লেখা, যার বিষয় মহিলাদের বিভিন্ন সমস্যা ও তার সামাজিক ঐতিহাসিক স্থানাঙ্ক। মহিলাদের প্রতিবাদের ইতিহাস তুলে আনাই এখন মূল লক্ষ্য ঈশার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *