নিমাইবাবু,আমার ধারণা ছিলো, সত্যজিতের সিনেমার কোনো একজন অভিনেতা। স্কুলে পড়ি তখন। সবে সোনার কেল্লা দেখেছি। প্রথম দিকে একজন ফোটোগ্রাফারকে দেখা গেছে, যাকে মুকুল বলেছে যে ছবি তোলার সময় তার হাসি পাচ্ছে না। উনিই নিমাই ঘোষ, মেজদা বলে দিয়েছিল। ওঁর চেহারা, পোশাক, সাধারণ টিপিকাল বাঙালিদের মতোই, সত্যজিতের স্কেচ থেকে উঠে আসা। আর একটা কারণ, ভবানীপুরে আমাদের পাড়ায় জ্যোতিষবাবুর বিখ্যাত ষ্টুডিও ‘ইমেজ’এ উনি নিয়মিত আসতেন। ফিল্ম প্রসেস, প্রিন্ট করতে,আড্ডা মারতে। যেমন আসতেন সত্যজিতের অনেক বন্ধুরা, পরিচিতজনেরা । সেই বয়েসে আমি সত্যজিৎকে চিনতাম ফেলুদা শঙ্কুর জন্য, অপুর সংসার, দেবী বা নায়ক-এর জন্য নয়। তাই সিনেমার স্টিল ছবি তোলার  লোকের গুরুত্ব না বোঝারই কথা। শুধু এটুকু শুনেছিলাম, উনি মানিকবাবুর পেটোয়া লোক, থাকেন কাছেই, পূর্ণ সিনেমার পাশের গলিতে। ব্যস, এই অবধি।

পরে আমার নিজের ছবি তোলার শখ হওয়ায় আমিও ওই ইমেজে যেতাম। ওঁকে দেখতে পেলে একটা সম্ভ্রমপূর্ণ দূরত্ব রাখতাম, কারণটা উনি নন, সত্যজিৎ। যদিও, কাউন্টারের ওপর পড়ে থাকা ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট প্রিন্টগুলো আড়চোখে দেখে নেওয়ার চেষ্টা করতাম। খবর রাখতাম কোন ছবির শুটিং চলছে, তাই স্টিল হলেও, তার প্রিভিউ দেখার লোভ সামলানো শক্ত ছিল।

সারা দুনিয়া যখন আতঙ্কে নিস্তেজ, রাস্তাঘাট ফাঁকা, ঠিক এই সময় চলে গেলেন নিমাইবাবু, ক’দিন আগেই। সুযোগ দিলেন না ভাইরাসকে কাছে ঘেঁষতে। অনেকগুলো  জরুরি কাজ সেরেই গেলেন। নিজের কাজগুলো দিয়ে গেলেন যথাস্থানে, যেখানে যথোপযুক্ত সম্মান ও দক্ষতায় তা সংরক্ষিত হবে। আক্ষেপ করতে শুনেছি, চাপা গলায়, ‘আমার এতো নেগেটিভ, আমি তো আর চিরকাল থাকব না। এখানে তো কেউ নিল না।’ বেরিয়েছে একধিক বই। প্রত্যেকটি সুমুদ্রিত কফিটেবল ছবির অ্যালবাম। আগেই দেখেছি ‘সত্যজিৎ অ্যাট সেভেন্টি’। হেনরি কার্টিয়ের ব্রেসর মুখবন্ধ। শুটিং চলাকালীন, কাজের সময়, হাল্কা মুডে, বাড়িতে বিভিন্ন মেজাজে গ্রেট মাস্টারের এমন ছবি আর কারুর কাছে দেখিনি। সবই ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট। প্রকাশিত হয়েছে  দিল্লি আর্ট গ্যালারি থেকে বেরনো বিশাল বই, একই বিষয়, আরও অনেক ছবি। “রে” নিয়ে গুগল সার্চ করলে নিমাইবাবুর ছবিই বেরবে বেশি, বলাই বাহুল্য। সত্যজিতের ছবি বলতে বিদেশিদের কিছু কাজ আছে। দেশের নামী লোক বলতে রঘু রাই, রঘুবীর সিং, তারাপদ ব্যানার্জি। খুব বেশি নয় কিন্তু।

কেন? এ নিয়ে অনেক গল্প চালু আছে। নিমাইবাবু তো কাউকে ঢুকতেই দিতেন না, এটা সবচেয়ে জনপ্রিয় থিওরি। হতে পারে। কিন্তু সেটা তখনই সম্ভব যখন বিগ বস-এর সায় থাকবে। সায় থাকার কারণ? আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম এক বার। পাড়ার ছেলে, একটু ছবি তোলে, মুখ চেনা। স্পর্শকাতর প্রশ্নটি করার চান্স নিয়েছিলাম ওই কথা ভেবে। যদিও অনেক বেশি বয়েস থেকে ওঁকে দেখছি, চেঁচামেচি করতে শুনিনি কখনও, আস্তে আস্তে কথা বলেন। বলেছিলেন “মানিকদা আমাকে খুবই স্নেহ করতেন, সেই প্রথম থেকেই, সেই গুপীবাঘা।”

নাটক নিয়ে ভাল কাজ আছে ওঁর, উত্তমকুমারকে নিয়ে ছবির বইও। দিল্লি আর্ট গ্যালারি থেকে বেরিয়েছে কলকাতার ওপর বেশ ওজনদার বই। কচ্ছ অঞ্চলে কাজ করেছেন আদিবাসী সংস্কৃতি নিয়ে। হয়তো আছে আরও অনেক কিছুই। সম্ভবনা আছে অদূর ভবিষ্যতে দেখতে পাওয়ার। নিমাই ঘোষের পুত্র হলেন সাত্যকি ঘোষ, বিজ্ঞাপন জগতের নামী আলোকচিত্রশিল্পী, বহুকাল মুম্বাইতে রয়েছেন। সাধারণ মানুষ নিমাইবাবুকে সত্যজিতের নিকটতম ক্যামেরা দ্রষ্টা হিসেবেই জানে। দেশে বিদেশে ওঁর ছবির প্রদর্শনী হয়েছে অজস্র। পাবলিশড ছবি অগুন্তি । এই মুহূর্তে চলছে দুর্দান্ত আর একটি প্রদর্শনী, ‘ঘরে বাইরে’র মধ্যে, কলকাতায়, ওল্ড কারেন্সি বিল্ডিঙে। সুবিশাল এক কক্ষে, নিমাই ঘোষের সত্যজিৎ। আগে না দেখা রঙিন ছবিও আছে। কিছু দিন আগেই বলছিলেন, নতুন ছবি দেখবে এ বার।

শেষ কয়েক বছর লাফিয়ে দাপিয়ে ছবি তুলতেন না, বয়েস, অবধারিত অসুস্থতার কারণে। এর মধ্যেই একটা জরুরি কাজ হয়ে গেছে। তৈরি হয়েছে তথ্যচিত্র, বো ভ্যান ডার ভের্ফের করা, সত্যজিতের সঙ্গে ওঁর জীবন নিয়ে। প্রথম দিকে এখানে শোনা যায় নিমাইবাবুর কণ্ঠ, “আমি আর ওই বাড়িতে যেতে চাই না। কোথায়, কখন বসবেন, কী করবেন, আলোটা দিনের কোন সময়ে, কোথায় পড়বে, এমনকী, সারা বছর বাইরে কোন ফুল কখন ফুটবে সেটা আমার নখদর্পণে ছিল।” চলাফেরা করতেন ধীরে ধীরে, ছবির প্রদর্শনীতে উপস্থিত হতে দেখেছি বহু বার। নিজের ছবির সময় ও ঘরানার ব্যাপারে যথেষ্ট সনাতনপন্থী হলেও সমকালীন চিত্রভাবনায় বিরাগভাজন বলে মনে হয়নি। একটি ব্যাপারে একচুল নড়তে দেখিনি ওনাকে। ধরে রইলেন  ফিল্মকে, কিছুতেই ডিজিটালের স্বাচ্ছন্দকে চৌকাঠ পেরোতে দিলেন না।

সকালের দিকে ময়দানে হাঁটতে যেতেন, তারপর এলগিন রোড, হরিশ মুখার্জি রোডের মোড়ে গুরুদ্বারের পাশে চায়ের দোকানে একটু আড্ডা। দেখা হওয়ায় জিজ্ঞেস করেছিলাম ফিল্ম নিয়ে। ডিজিটাল কত সুবিধের, ফিল্মের এখন ভয়ঙ্কর দাম এই সব বলার চেষ্টা করলাম। এতটুকু রেগে গেলেন না। শান্তভাবেই বললেন “ফিল্ম, ক্যামেরা  জোগাড় করার কষ্ট আগেও ছিল, এখনো আছে। এর মধ্যেই কাজ করেছি আমরা। কাজটা বরাবরই শক্ত ছিল। ছিল বলেই করতে ভাল লাগতো। ফিল্মে মেজাজটা একেবারেই আলাদা। এখনকার সুবিধেগুলো নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই।” সত্যজিৎ বেঁচে থাকলে, আবার গুগাবাবা তৈরি হলে, আধুনিক প্রযুক্তিকে কাজে লাগাতেন এমন ধারণা হয়তো ভুল নয়। তখন নিমাইবাবুর রক্ষণশীলতা অক্ষুন্ন থাকতো কি না আজ বলা অসম্ভব। দুজনেই চলে গেছেন যাবতীয় প্রশ্নোত্তরের অনেক উর্দ্ধে। এই মুহূর্তে এক জন তাঁর  জীবনভরের দায়িত্ব পালন করে চলেছেন  কি না, তা-ও আমরা জানি না।

আদতে অভিনয়ের লোক, একটা ফিক্সড লেন্স ক্যানন ক্যামেরা এসে পড়ে হঠাৎই। বন্ধু রবি ঘোষ সত্যজিতের শুটিংয়ে ব্যস্ত, নিজেদের রিহার্সাল বন্ধ। কোথায় শুটিং? বর্ধমানের কাছে। চলে গেলেন নিমাই ঘোষ বিখ্যাত লোকের শুটিং দেখতে। লোকেশনে পৌঁছে দেখলেন, রিহার্সাল চলছে বাঁশ বাগানে। একটা মানুষের ঘোরাফেরা, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ বেশ ভালো লেগে গেলো। দুম করে তুলে ফেললেন কিছু ছবি।পরে সেই ছবি পৌঁছয় সত্যজিতের হাতে। এরপর কী হল আমরা সবাই জানি। অজস্র লেখা, সাক্ষাৎকার, ভিডিও রয়েছে হাতের নাগালে, দেখে নেওয়া যেতে পারে।

নিমাই ঘোষের ছোট বাড়িতে ঢুকলেই চোখে পড়বে দেয়ালভরা তাক, তলায় ড্রয়ার। এতেই আছে যাবতীয় নেগেটিভ। হলুদ কোডাকের বাক্সে অজস্র প্রিন্ট। কোথাও আলাদা করে লেখা নেই কিছু, অর্থাৎ এই বিশাল চিত্রভাণ্ডারের কোনো ক্যাটালগ বা ইনডেক্স নেই। সত্যজিতের ছবির প্রয়োজনে সারা দুনিয়া থেকেই ডাক আসে ওঁর কাছে। ‘কোন ছবি কোথায় আছে জানেন? খুঁজে পান কী করে?’  মাথার  দিকে আঙ্গুল তুলে বলেন “মেমরি”।

নিমাই ঘোষের সম্মানের পাশাপাশি সমালোচনাও কম নয়, অন্তত কলকাতা শহরে। সত্যজিৎ না থাকলে কি আর উনি ‘উনি’ হতে পারতেন? যেহেতু মানিক রায়ের ছত্রছায়ার সিংভাগের দখলদার, অন্যরা সেই অর্থে বঞ্চিত, হয়তো, তাই আক্ষেপ অস্বাভাবিক নয়। প্রয়োজন নেই, তবুও এর উত্তর খুঁজতে চাইলে একটা কথা মনে হয়। এক জন অত্যন্ত বুদ্ধিমান, প্রতিভাবান বাঙালি আইকন একটি মাত্র মানুষকে অকারণে এতখানি জায়গা ছেড়ে রাখেননি।এক জন গ্রেট সম্পর্কে অনেক কথা বলা হয়, লেখা হয়। এরপরেও থেকে যায় অনেকখানি ফাঁক। কথার সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে একমাত্র ছবি ফিরিয়ে আনতে পারে একটি মিসিং লিংক, তার নাম, মেজাজ। মুহূর্ত। এখানেই ওঁর সার্থকতা। জহুরী চিনে নিয়েছিলেন সঠিক রতন।  নিমাই ঘোষের কাছেই শুনেছি, ছবি তোলার এক্সক্লুসিভ স্বাধীনতা পেলেও ছবিকে ব্যবহারের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সতর্কতার  প্রয়োজন পড়ত। ওঁর নেগেটিভের ওয়ালেট দেখেছিলাম এক বার। ভেতরে ফিল্ম।  বাইরে ট্রেসিং পেপারের ওপর রঙিন মার্কিং করা আছে রায়-ঘোষের নিজস্ব কোড-এ। কোনওটির মানে, এটি লবি স্টিল হতে পারে, এটি ইন্টারভিউয়ের সঙ্গে যেতে পারে অথবা এটি ম্যাগাজিনের লেখার সঙ্গে। পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে এই নির্দেশ পালন করে গেছেন ফটোগ্রাফে জীবনস্মৃতি লিখে রাখা মানুষটি। নিমাই ঘোষের কাজের সার্থকতা যদি বিচার করতেই হয়, তা হলে মাত্র দুই শটে সেটি সম্ভব। একনিষ্ঠ অবিচলতা।

শুভময় মিত্র আদতে ক্যামেরার লোক, কিন্তু ছবিও আঁকেন। লিখতে বললে একটু লেখেন। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে অনেকরকম খামখেয়ালিপনায় সময় নষ্ট করে মূল কাজে গাফিলতির অভিযোগে দুষ্ট হন। বাড়িতে ওয়াইন তৈরি করা, মিনিয়েচার রেলগাড়ি নিয়ে খেলা করা, বিজাতীয় খাদ্য নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করা ওঁর বাতিক। একদা পাহাড়ে, সমুদ্রে, যত্রতত্র ঘুরে বেড়াতেন। এখন দৌড় বোলপুর পর্যন্ত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *