আজ থেকে অনেক বছর আগের কথা। ১৯৯২ সালের শীতের মরসুম। একদিন আমার গুরু পণ্ডিত মানস চক্রবর্তী তালিম দিচ্ছেন। আমরা সব ছাত্রছাত্রী উন্মুখ হয়ে জেনে নিচ্ছি রাগের অচেনা, অপূর্ব সব রাস্তাঘাট। এমন সময়ে দরজায় এসে দাঁড়ালেন এক ছোটখাটো মানুষ, আপামর বাঙালির চেনামুখ, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। ছোটবড় সবার সন্ধ্যাদি। সঙ্গে শ্যামল গুপ্ত। একটা রাগাশ্রয়ী গানের রেকর্ড বেরবে। চাই নতুন গান। 

গুরুজির প্রবল উৎসাহ চিরকালই নিত্যনতুন রচনায়। সরস্বতী পুজো হোক বা আমাদের সবার প্রোগ্রাম, তাগড়াই সব বন্দিশ, ঠুমরি, পতঝর বা পসর কে গীত। নিজের কনসার্টের শেষ আইটেমের জন্য বড় ঘেরের বাংলা রাগপ্রধান ও ঠুমরি । দুই সেতারি সঞ্জয়দা, কুশলদা যখন শিখছেন তাঁদের জন্য নতুন আঙ্গিকের বন্দিশ, গৎ। সবার আবদার মেটাতে গুরুজির হেঁসেলে এসব হতেই থাকত অনর্গল। কে গাইবে, তার আওয়াজের কী জাত, কত তৈয়ারি ও আন্দাজ সেই বুঝে মালমশলা দেওয়া হত― পাঞ্জাবি হরকত বা করিমী পুকার।

সন্ধ্যাদির যে দীর্ঘ তালিম পাতিয়ালা ঘরানায়, সেই বুঝে মিশ্র বৈরাগী ও যোগ রাগে দুটি গান বানালেন। শুরু হল শেখানো দিন তিনেক ধরে। গুরুজি আবার শেখানোর সময় গুরুমূর্তি ধরতেন, সে খুব কড়া এক মানুষ। আর দেখলাম খ্যাতির শীর্ষে থাকা বয়সে বড় এক শিল্পী কিভাবে আবার ছাত্রী হয়ে গেলেন। অসাধারণ মনোনিবেশ। স্ক্যানিংয়ের খুঁটিনাটি  সঠিকভাবে রপ্ত করার শিক্ষানবিশী এক মন। উনি গান তুলে রেকর্ড করে নিয়ে যেতেন। আমাদের যদিও সে সুযোগ হয়নি কোনদিন। একবার দেখিয়ে দেওয়া টপখেয়াল ফেরার পথে মিনিবাসে বসে রপ্ত করতে করতে আসতাম যাতে এক সপ্তাহ পর ঠিকঠাক শোনাতে পারি। তাতেই যে কী আনন্দ!

কোটালি গায়কী অসম্ভব সূক্ষ্মতায় সমৃদ্ধ। সম্ভবতঃ শাস্ত্রীয় সংগীতের কঠিনতম ধারা। গলায় তুলতে তুলতে, বার বার চেষ্টা করতে করতে, এক সময় চোখে জল সন্ধ্যাদির। বললেন, ভাই মানস, এখন যদি আসি, তোমার ক্লাসে বসতে দেবে? শেষে রেকর্ডিং হয়ে গেল। শুনলাম, ভালোভাবে রেকর্ডিং হয়ে গেছে। তবে গুরুজির মন খুঁতখুঁতে, কোনও একটি জায়গা একদমই গুরুজির পছন্দমতো হয়নি। সেই নিয়ে সন্ধ্যাদিকে পরে ফোনে বললেন। উনি মানলেন না, বললেন তুমি যে রকম দেখিয়েছ সেরকমই গেয়েছি।

sandhya Mukhopadhyay 3
খ্যাতির শীর্ষে থাকা বয়সে বড় এক শিল্পী কিভাবে আবার ছাত্রী হয়ে গেলেন

হঠাৎ পরেরদিন সকালে ফোন এল সন্ধ্যাদির। অত্যন্ত অপরাধী গলা, শেখার সময় রেকর্ড করে নিয়ে যাওয়া গান শুনে বুঝতে পেরেছেন নিজের ভুল। অত বড় মাপের এক শিল্পী, ক্ষমা চাইলেন। আজ যখন বাংলার কোনও বিখ্যাত শিল্পী, বারবার দেখানোর পরও কোনও সুর গলায় তুলতে না পেরে “যা হল ওটাই একটু মানিয়ে নিন, আমার অন্য রেকর্ডিং আছে…” বলে পালান, এটা বুঝতে পারি আমাদের নানাবিধ অবনমনের রাস্তা কত দিকে ছড়িয়ে পড়েছে।

আমাদের এই শাস্ত্রে পরীক্ষার ফলের মান শুধু পরীক্ষার্থী নয়, পরীক্ষকের ক্ষমতার ওপর সমানভাবে নির্ভর। ১৫ বছর বয়সে, ১৯৪৬ সালে গীতশ্রী পরীক্ষায় যাঁদের সামনে পরীক্ষা দিয়ে প্রথম, তাঁরা ছিলেন উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, উস্তাদ মোহাম্মদ দবির খাঁ ও রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর। জাত শিল্পীর হল এক উচ্চমানের মূল্যায়ন। সন্ধ্যাদির শাস্ত্রীয় সংগীতের তালিম দীর্ঘ। শুরুতে প্রায় ছ’বছর আচার্য যামিনী গঙ্গোপাধ্যায়, পরে পণ্ডিত এ টি কানন ও অল্প কিছুদিন সঙ্গীতাচার্য চিন্ময় লাহিড়ীর কাছে। তারপর পাতিয়ালার উস্তাদ বড়ে গুলাম আলি খানের কাছে গান্ডা বন্ধন। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় বলে গেছেন, যে একরকম গানের তালিম গলায় এতগুলো বছর বসানোর পর ওস্তাদের সেই বাজপাখির মতো অত্যাশ্চর্য গতিময় আর তীক্ষ্ণ সপাট তান, মুড়কি, হরকত, তার গায়কী, গানের চরিত্র, স্বরক্ষেপনের নিপুণতা, আর সবকিছুর ওপর সুর লাগানোর এক অন্য তরিকা, সেই গান বোঝার বা রসাস্বাদন এর কান বা বোধ কোনওটাই আট বছর পরেও সঠিক আয়ত্তে আসেনি তাঁর। কিছুটা আন্দাজ তৈরি হয়েছে মাত্র। 

গুরুজি আবার শেখানোর সময় গুরুমূর্তি ধরতেন, সে খুব কড়া এক মানুষ। আর দেখলাম খ্যাতির শীর্ষে থাকা বয়সে বড় এক শিল্পী কিভাবে আবার ছাত্রী হয়ে গেলেন। অসাধারণ মনোনিবেশ। স্ক্যানিংয়ের খুঁটিনাটি  সঠিকভাবে রপ্ত করার শিক্ষানবিশী এক মন। উনি গান তুলে রেকর্ড করে নিয়ে যেতেন। আমাদের যদিও সে সুযোগ হয়নি কোনদিন। একবার দেখিয়ে দেওয়া টপখেয়াল ফেরার পথে মিনিবাসে বসে রপ্ত করতে করতে আসতাম যাতে এক সপ্তাহ পর ঠিকঠাক শোনাতে পারি।

১৯৬৮-তে চলে গেলেন বড়ে গুলাম। শেখা চলতে লাগলো তাঁর পুত্র মুনব্বর আলি খানের কাছে। আমরা এক গুরুভাইয়ের কাছে শুনেছি, মুনব্বরজি যখন বাইরের প্রোগ্রাম সেরে ফিরতেন, কলকাতার সব শাগরেদদের কাছে খবর পৌঁছে যেত। পোস্টকার্ডে পাঠানো হত তাঁর ক্লাসের খবর। হয়তো চার মাস থাকবেন। একটাই রাগের তালিম, একটাই বন্দিশ শেখানো চলবে সারাদিন। যে যেরকম পারবে আসবে যাবে, ক্লাস শুনবে, তুলে নেবে যে যা পারে। সেই মুনাব্বরজির কাছে শেখা চলতে চলতে বড়ে গুলামের গায়কীর সেই অদ্ভুত আন্দাজ অবশেষে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কাছে ধরা দিল। অনেক বছর চলে গেছে তখন সাধনায়।

সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে মিশ্র খামাজে ঠুমরি ‘দেখে বিনা বেচৈন’

এ পাওয়া খুব সহজ কথা নয়। এ রিয়াজ়ের বাইরের চিজ়। জাত শিল্পীর পথ ও স্বপ্ন। যেমন খাঁ সাহেব (ওস্তাদ আলী আকবর খান) পেয়েছিলেন মাইহার ঘরানার আসল সূত্র, যখন বাবা আলাউদ্দিন গত হয়েছেন। বিদেশ থেকে ফিরেছেন মাইহারে বাবার শূন্য ঘরে, আর রেখে যাওয়া অজস্র খাতায়। কিছু খাতা ভরা দীর্ঘ সত্তর বছরের সংগীতচিন্তা, কিছুতে রাগ রাগিনীদের আসা যাওয়ার অজস্র পথ। কিছুতে আলী আকবরের তিরিশ বছরের নানা বাজনার ভুল ধরে ধরে সযত্নে লিখে রেখেছেন। তখন আলী আকবর বিশ্বব্যাপী খ্যাতির মধ্যগগনে। সরোদসম্রাট বলা হয় তাঁকে। তবু আমাদের এই শাস্ত্রে তো শেষ কথা বলে কিছু নেই। তাই খান সাহেবের তখনকার কথা সংক্ষেপে বললে এই দাঁড়ায়: আমি সেদিন আবার নতুন করে সরোদ নিয়ে বসলাম; বোঝার চেষ্টা করলাম স্বর, শ্রুতি, রাগ, লয় এ সব কিছু শেখানোর বাইরে বাবা আসলে আমাকে কী বলতে চেয়েছিলেন। চিন্তার সেই নতুন ভাঙাগড়ায় তখন সদ্য পঞ্চাশোর্ধ আলী আকবরের বাজ বদলে গেল। পরবর্তী সময়ে আমরা সেই অতিপরিণত সরোদ শুনেছি। সে এক অলৌকিক, আত্মস্থ ধ্যান।

সন্ধ্যাদির সত্তরের দশকের খেয়াল আর ঠুমরি শুনে পাওয়া যায় তাঁর গায়কীর পরিণত রূপ। সপ্তপদী তখন দশ বছরে আর “এই পথ যদি না শেষ হয়” চিরকালের জন্য বাঙালির ঘরে ঢুকে পড়েছে। ‘জয়জয়ন্তী’ চলছে মিনার বিজলী ছবিঘরে। পাড়া ও জেলাশহরের অজস্র জলসায় মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, উৎপলা সেন, সনৎ সিংহের পর শেষের আসরে হেমন্ত ও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। একই সময়ে দেখছি সন্ধ্যাদি দেশ ও দেশের বাইরে বহু শাস্ত্রীয় সংগীতের আসরে গাইছেন। অনেক শহরে অল ইন্ডিয়া রেডিওতে গাইছেন, হয়তো এক সেশনে বাংলা গান আর পরের সেশনে খেয়াল। কটকে রেডিওর স্টেশন ডিরেক্টর সৈয়দ মুজতবা আলী স্তম্ভিত হয়ে বলছেন কী করে একটা পাতিয়ালা ঘরের দমদার খেয়াল গেয়ে তারপরেই গলা পাল্টে এক কিশোরীর গলায় “ঘুম ঘুম চাঁদ ঝিকি মিকি তারা” গাওয়া সম্ভব? বাংলা গানের ঘুম ঘুম জলসা থেকে সটান অল বেঙ্গল কনফারেন্স যেখানে রোমান গ্ল্যাডিয়েটরদের মতো বাঘেদের সঙ্গে প্রাণপাত যুদ্ধ। যেখানে গাইছেন আগেপরে ওস্তাদ নিসার হুসেন খান থেকে ওস্তাদ লতাফত হুসেন। 

sandhya Mukhopadhyay 5
সন্ধ্যাদির সত্তর দশকের খেয়াল-ঠুমরি শুনে পাওয়া যায় তাঁর গায়কীর পরিণত রূপ

সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় এই দুটি আলাদা সাঙ্গীতিক ধারা দীর্ঘদিন ধরে রেখেছেন, অন্ততঃ ধরে রাখার তীব্র চেষ্টা করেছেন এটা অনস্বীকার্য। সায়েন্স সিটিতে ২০০৮-এর ক্রিসমাসে মান্না দে-র সঙ্গে সেই বিখ্যাত ডুয়েটের দিনের কথা কলকাতায় অনেকেরই মনে আছে। ওঁর সঙ্গে তার দু-তিনদিন পরে অনেক গল্প হয়েছিল। রিয়াজ, গলার যত্ন, বেশি গান শেখালে গলা আর মাথা দুটোই নষ্ট হয় ইত্যাদি। বললেন উনি নিজের মনোনিবেশ ও অভ্যাসের জন্য অনুষ্ঠানের কয়েকমাস আগে থেকে শুধু সেই ধরনের গানেরই চর্চা করেন। কিন্তু তা যে যথেষ্ট নয়। 

১৯২৫ থেকে ’৬৫ এই সময়ে অনেক বাঙালি খেয়ালিয়া বাংলা গান গেয়েছেন। এর মধ্যে দেখা যাচ্ছে পন্ডিত জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ গোস্বামী, পণ্ডিত ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, আমার দাদাগুরু সংগীতাচার্য তারাপদ চক্রবর্তী এবং পরে অবশ্যই আরো অনেকে। এঁদের গায়কী দেখলে দুয়েকটি ব্যাপার বোঝা যায়। এক হল এই যে, যিনি যত বড় খেয়ালিয়া, তাঁর বেশির ভাগ বাংলা গান ততটাই ছোট খেয়ালের মতো শোনাত। বাংলা রাগাশ্রয়ী গান বলতে এখন আমরা যা বুঝি, তা নয়। আধুনিক গানের মতো তো নয়ই। দাদাগুরুর চল্লিশের দশকের তিন মিনিটের বাংলা গান মানে পুরোদস্তুর কিরানার ছোট খেয়াল (ওঁর গলা তখন ওস্তাদ আবদুল করিম খানের ধাঁচে চলত), সঙ্গে সেই সময়ের বাঘের মতো ক্ষিপ্র সপাট ও বক্রতান, কখনও তাঁর বিখ্যাত হলক তান, বলা হয় যা ঠিকমত নিকাশ করতে না পারলে কণ্ঠ ও ফুসফুসের যৎপরোনাস্তি ক্ষতি হবার সম্ভাবনা। আর এই বঙ্গসন্তানটি ছিলেন দীর্ঘ সাড়ে তিনদশক ধরে একমাত্র সর্বভারতীয় স্তরের খেয়ালিয়া― বাঙালির জাত্যাভিমান, যাকে অনেকে ঠেস দিয়ে ‘বেঙ্গলি এক্সেপশনালিজ়ম’ বলে থাকেন, তাই নিয়ে বড়ে গুলাম আর আমীর খান সাহেবদের সঙ্গে সমানে টক্কর দিয়ে গেছেন আসর থেকে আসরে। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের খ্যাতির এক দু’ দশক আগে বাঙালির ঘরে ঘরে তাঁর সেই সব খেয়ালাঙ্গের গান অতি প্রচলিত ছিল। 

sandhya Mukhopadhyay 1
সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় এই দুটি আলাদা সাঙ্গীতিক ধারা দীর্ঘদিন ধরে বজায় রেখেছেন

আমার দিদিমারা পড়ন্ত বিকেলে দাওয়ায় বা ছাতে বসে শুনেছেন সেই গান। মারফির ভালভ রেডিও বা গ্যারাডের রেকর্ড প্লেয়ারে। তার কুড়ি বছর পর বারোয়ারি বায়োস্কোপ নিয়ে এল উত্তম সুচিত্রা সন্ধ্যা হেমন্তের জুটি আর ধীরে ধীরে বাংলা গান আধুনিক হয়ে গেল। বড় হয়ে গিয়ে উচ্চাঙ্গ সংগীতের হাত মোটামুটি ছেড়ে গেল। দিদিমাদের পরের প্রজন্ম ট্রানজিস্টর রেডিওতে পেয়ে গেল তাকে ঘরে ঘরে। তারপর ’৭৫-এ টিভি। কোনার্ক।  অডিও হল অডিও ভিসুয়াল। ঘুরিয়ে বললে ভিসুয়াল অডিও। আজ তা হয়ে গেছে ইউটিউব। সভ্যতার এই মডার্ন থেকে পোস্ট মডার্ন হবার রাস্তা অনেক কিছুকে সহজ ও সহজলভ্য করছে। কিন্তু খানদানী ফাইন আর্ট বা আর্ট মিউজ়িক না সহজ না সহজলভ্য। এই দ্বিভাজন থেকেই যত টানাপোড়েন। কে কোন রাস্তা নেবেন এবং কে কী পাবেন, তার হিসেবনিকেশ এই পথেরই আশেপাশে হয়ে থাকে। নন্দনতত্ত্ব ও বাজার। বা এখনকার সময়ে, এক উদ্ভট বাজারী নন্দনতত্ব। যেমন ইজ়ি জ্যাজ়। আর আমরা ভারতে বানিয়ে ফেলেছি মেজাজহীন এক বেসুরো চটকদারী রাগসঙ্গীত। আমি তাকে বলি পপ ক্লাসিকাল। 

মানে হল এই, যে হিন্দুস্তানি উচ্চাঙ্গ সংগীতের উচ্চতা ধরে রাখতে গেলে একটা একমুখীনতা লাগে। ভারতে সেই উচ্চতায় এক সময়ে দশজনের বেশি শিল্পী পাওয়া শক্ত। তাঁরা এর বাইরে পা দিতে চান না সংগত কারণে। পা রাখলেও তা থাকে সংক্ষিপ্ত। যে কারণে বড়ে গুলাম সাহেব কোনও সিনেমার গান বা কোনও লঘুসংগীত শোনা পছন্দ করতেন না। সন্ধ্যাদি এক ইন্টারভিউতে তা বলে গেছেন। এটার মধ্যে এলিটিজম আছে সন্দেহ নেই। কিন্তু সঙ্গত কারণেই। দিল্লি দূরদর্শনে সন্ধাদির বেহাগে সবরঙ-এর বন্দিশ ‘অব তো রট লাগি’, সঙ্গে বোলতান, ছুটতান, লয়কারী শুনতে শুনতে মনে হয় সত্তরের দশকে খুব কম মহিলা কণ্ঠশিল্পীর কণ্ঠে এই অনায়াস দক্ষতা। 

তবু খানিকটা হলেও ধীরে ধীরে আধুনিক গানের প্রভাব সন্ধ্যাদির খেয়ালে এসে পড়ে। এর প্রমাণ একটি সাড়ে দশ মিনিটের মালকৌশ। অথবা ছোট পরিসরের কোমল ঋষভ আশাবরী বা রেডিও সংগীত সম্মেলনের হংসধ্বনি। অসাধারণ সুরে। কিন্তু বাঢ়ত বহুক্ষেত্রে বেশ কাঁচা।  দু’ একটি সরগম তান শুনলে বাংলা রাগাশ্রয়ী গান মনে পড়ে। বেশ আগে থাকতে সাজানো গান মনে হয়। এছাড়াও খেয়ালের ক্ষেত্রে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গায়কী, হিন্দুস্তানি খেয়ালের মেজাজ ছেড়ে জায়গায় জায়গায় “ঘুম ঘুম চাঁদ”-এর মিষ্টি মিষ্টি গলার টোন চলে এসেছে, চলে এসেছে কিছু আপস– ম্যানারিজ়ম, ফলসেটো, ভাইব্রাটো, ট্রেমেলো। সমসাময়িক, বড়ে গুলামের অন্য শিষ্যা মীরাদি (মীরা বন্দোপাধ্যায়) যেখানে গাইছেন মালকৌশ, বিষ্ণু দিগম্বর জয়ন্তী সমারোহে, ১৯৬৮, একদম পোক্ত নিকাশ, জাত খেয়ালিয়ার দমদার মেজাজ। 

sandhya Mukhopadhyay 4
সত্তর দশকে খুব কম মহিলা কণ্ঠশিল্পীর কণ্ঠে খেয়ালের এই অনায়াস দক্ষতা ছিল

অথচ খেয়াল ছেড়ে ঠুমরিতে গেলে গল্পটা সম্পূর্ণ আলাদা। ঠুমরি হল লাইট ক্লাসিকাল। খেয়ালের বিশাল দায়িত্ব থেকে মুক্ত হয়ে এখানে সন্ধ্যাদি আধুনিক গান আর উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের দুই পৃথিবীর ভাল চিজ়গুলো দিয়ে সাজিয়েছেন। খামাজ ঠুমরি ‘শ্যাম ঘুঁঘট পট খোলে, দেখে বিনা বেচৈন’ (১৯৭৬ আকাশবাণী সংগীত সম্মেলন), অব না মানত শ্যাম (১৯৭৯, অল ইন্ডিয়া রেডিও) আর পিলু ঠুমরি, ‘কাটে না বিরহ কি রাত’, অল ইন্ডিয়া রেডিওর রেকর্ডিং, খুব উল্লেখযোগ্য কাজ। 

ফিল্মি আর আধুনিক গানের মডুলেশন, ধরা-ছাড়ার পারফেকশন, মাইক্রোফোনের একৌসটিক্স বুঝে তার সঠিক ব্যবহার, তবলার ঠেকা ও লয়ের ফান্দা, সব মিশেছে পুরোনো পাতিয়ালা ঠুমরির তালিমে। অসম্ভব নিপুণতার ছোঁয়া, গুরুর দেখানো পথে খানদানি পাঞ্জাবি হরকত ও পাতিয়ালার সিলসিলা। একই আধুনিক পারফেকশন আমরা দেখি সেই সময়ের মহিলা সরোদিয়া জারিন দারুওয়ালার হাতে, যিনি বহুদিন স্টুডিওতে সেশন মিউজিশিয়ান হিসেবে জিঙ্গল থেকে শুরু করে ফিল্ম মিউজিক সবই করেছেন। 

যিনি যত বড় খেয়ালিয়া, তাঁর বেশির ভাগ বাংলা গান ততটাই ছোট খেয়ালের মতো শোনাত। বাংলা রাগাশ্রয়ী গান বলতে এখন আমরা যা বুঝি, তা নয়। আধুনিক গানের মতো তো নয়ই। দাদাগুরুর চল্লিশের দশকের তিন মিনিটের বাংলা গান মানে পুরোদস্তুর কিরানার ছোট খেয়াল (ওঁর গলা তখন ওস্তাদ আবদুল করিম খানের ধাঁচে চলত), সঙ্গে সেই সময়ের বাঘের মতো ক্ষিপ্র সপাট ও বক্রতান, কখনও তাঁর বিখ্যাত হলক তান, বলা হয় যা ঠিকমত নিকাশ করতে না পারলে কণ্ঠ ও ফুসফুসের যৎপরোনাস্তি ক্ষতি হবার সম্ভাবনা। 

কী করি সজনী, আসে না প্রীতম– বড়ে গুলাম আলী খানের বিখ্যাত ঠুমরিকে বাংলায় সাজিয়েছেন নিখুঁত পাঞ্জাবি ঠুমরির আঙ্গিক ও অসাধারণ হরকতে। গায়কীর বনেদিয়ানা ও নিখুঁত পরিবেশনায় বারবার মুগ্ধ করে সিন্ধু ভৈরবীর এই গানটি। একটি লাইভ কনসার্ট এত নিখুঁত হতে পারে ভাবা যায় না। যদিও তার সপ্তকে তিনি ফলসেটো ব্যবহার করেছেন, তবু সুর ও মুনশিয়ানা কোথাও কমে যায় না। ‘বিজরী চমকে হিয়া কাঁপে’, ১৯৭৯-এ রেকর্ড হওয়া মাঝ খামাজ-এ বাংলা ঠুমরি, অত্যন্ত জনপ্রিয় ও ততোধিক মুনশিয়ানার পরিচায়ক। এ সব থেকে অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে যায় যে মুনাব্বরজিকে বাদ দিলে সেই সময় সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ই বড়ে গুলামের ঠুমরি গায়কীর সঠিক উত্তরাধিকারিণী। আজকেও তাই। সন্ধ্যাদির পর সেই আন্দাজ বাংলায় আর দেখিনি, পণ্ডিত জগদীশ প্রসাদ ছাড়া। একসময় তাঁর ভাইয়া, গুরু মুনাবর আলী খাঁ-এর তত্ত্বাবধানে এই সব বাংলা ঠুমরি তিনি একের পর এক রেকর্ড করেছেন, যা আমাদের এক অনন্য সম্পদ বলে আমি মনে করি। কিন্তু তাজ্জব কাণ্ড, আমরা বাঙালিরাই জানি না সে কথা। হাওয়ায় উড়ছে ভুলভুলাইয়া।

উস্তাদ বড়ে গুলাম আলী খাঁ-র বিখ্যাত ঠুমরি ‘আয়ে না বালম’ বাংলায় গেয়েছিলেন তাঁর শিষ্যা সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়

উত্তর খুঁজতে গিয়ে হাহুতাশ করে লাভ নেই। খেয়াল গানে যেটুকু হারানো, তার বিনিময়ে সন্ধ্যাদি পেয়েছেন সিনেমার গান ও আধুনিক গানে প্রভূত সাফল্য। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় জানতেন একজন শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিল্পীর জাগতিক প্রাপ্তির পরিমাণ সাধারণত নগণ্য। সে ফুলটাইম সংগীতে সেলফ-এমপ্লয়েড। কুড়িবছর গুরুর কাছে শিক্ষাগ্রহণের পরও তার নেই কোনও ডিগ্রি বা পূর্বনির্ধারিত গন্তব্য। তিনি চাকরি করেন না, তাই কেরিয়ারের সিঁড়ি তাঁর নেই। একজন মহিলা শিল্পীর পক্ষে এ কেরিয়ার আরও শক্ত। চারণ কবিদের মতো দেশের বড় বা প্রান্তিক শহর ঘুরে ঘুরে, দিনরাত এক করে গান করে বেড়ানো সহজ নয়, ষাট সত্তরের দশকের নারীবৈষম্য ও প্রাচীনপন্থী পরিবারতন্ত্রের মধ্যে তো নয়ই। সঙ্গে আয়োজকদের আরোপিত অর্থনৈতিক বৈষম্য। পাশাপাশি, শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির বাজারিকরণ, সঙ্গে কর্পোরেট স্পনসর, আর তাদের পেটোয়া মধ্যমানের শিল্পীদের দাপট। সে হিসেবে, সন্ধ্যাদি একটা অন্য রাস্তা বেছে নিয়েছিলেন। সেই মধ্যপন্থার সার্বিক ফল ভালোই হয়েছে বলে আমি মনে করি। যদিও কনফারেন্স সার্কিটে একজন দাপুটে, খানদানি গায়কীর বাঙালি মহিলা কণ্ঠশিল্পী থাকলে আমার একটু দলভারী হত। 

২০০৯ সালে আমাদের সংস্থা ‘পারম্পরিক’ বছরভর সংগীতাচার্য তারাপদ চক্রবর্তী শতবার্ষিকী অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিল। সে এক এলাহী কান্ড। ভারতের সব বড় শিল্পীরা হাজির। সন্ধ্যাদিকে ধরলাম, আপনি সুভেনিরের জন্য লেখা দিন। আগে জানতে চাইলেন আমার গানবাজনা নিয়ে। তারপর মানসভাই কী করছে, কেমন আছে। শেষে বললেন, তারাপদবাবুর মতো সংগীতজ্ঞকে নিয়ে কিছু বলার যোগ্যতা আমার আছে বলে আমি মনে করি না। আমি পারব না, আমায় ছেড়ে দাও। সেদিন ফিরলাম খালি হাতে। মন তবুও ভরে ছিল। আসলে সন্ধ্যা নেমেছে আগেই। আপসহীন, প্রচারবিমুখ স্তম্ভগুলো পড়ে যাচ্ছে একে একে সময়ের অমোঘ নিয়মে । উঠে আসতে হবে আমাদেরই সেই জায়গায়। নইলে আমাদের ছাত্রছাত্রীরা কী ধরে বাঁচবে এখনকার মনুষ্যত্ব উড়িয়ে নেওয়া ঝড়ে?

 

*ছবি ও ভিডিও সৌজন্য: Ruchirapanda.com, Pinterest, Jiyobangla, Youtube

রুচিরা পান্ডা বাংলার কোটালি ঘরানার আজকের মুখ্য প্রতিভূ। একাধারে সঙ্গীতশিল্পী, সঙ্গীতগুরু ও কম্পোজার। পন্ডিত মানস চক্রবর্তীর কাছে দীর্ঘ পঁচিশ বছরের তালিম। দেশ বিদেশের বড় আসর গুলিতে সঙ্গীতাচার্য তারাপদ চক্রবর্তীর তৈরি এই অল্পশ্রুত ঘরানার শাস্ত্রীয় সঙ্গীত পরিবেশন করে আসছেন দুই দশক ধরে। তাঁর ছাত্রছাত্রীরা আসরে উঠে আসছেন একে একে। বিভিন্ন শিল্পমাধ্যম ও সাহিত্যের গবেষণাধর্মী চর্চা করতে ভালোবাসেন। বিখ্যাত রাগসঙ্গীত ও সমাজকল্যাণ সংস্থা পারম্পরিকের প্রতিষ্ঠাতা ও কর্ণধার।

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *