সামান্থা আর ইউ ওকে?
সামান্থা আর ইউ ওকে?

অ্যালার্ম ঘড়ির মতো বারবার বেজে ওঠে। জানলা দিয়ে একটা মস্ত নিমগাছ দেখা যায়। তার তলায় রাস্তা। সে রাস্তা অফিস যায়, স্কুল যায়, আবার কখন কখনও কোথাও যায় না। 

যেমন সিদ্ধেশ। 

তার এখন নিজের কোনও রাস্তা নেই। একটা ঘর আছে, আর একটা ব্যালনি। সেই ব্যালনিতে বসলে নিমগাছের পাতা ওকে ছুঁয়ে যায়। দাঁড়ালেও ছোঁয় নিশ্চয়। তবে দাঁড়ানো কেমন, জানে না সিদ্ধেশ। তাতে তার কোনও অসুবিধে হয় না। অসুবিধে হতে পারে বলে কত ব্যবস্থা, তার ঘরের কোনও চৌকাঠ নেই। হুইচেয়ার আটকায় না কোত্থাও।

চৌকাঠবিহীন ঘর তার হুইলচেয়ার আটকায় না ঠিকই, কিন্তু সব চলাই কি একরকম? সেসব তো আটকে যায়। তাই বনি পাঠাল সামান্থাকে। বলল আমি তো নেই তোমার কাছে, তাই সামান্থা থাক, ও বুঝবে তোমাকে। প্রাক্তন স্বামীর জন্যে কে এত করে বনির মতো? 




সিদ্ধেশ ব্যাল
নি থেকে দেখল পাশের ক্যান্টিন থেকে একদল লোক খেয়ে বেরচ্ছে। তাদের নীল ইউনিফর্মে নকশা করে লেখা ‘ডিজিপ্যাক। এরা একটা প্যাকেজিং কারখানায় কাজ করে, যাদের কাজ নানান সাইজ়ের জুতোর বাক্স বানানো। সিদ্ধেশ ভাবল, বাক্স বানাতে বানাতে এরাও কি বাক্সের মতো হয়ে যাচ্ছে? এই ক্যান্টিনে এসে খাওয়ার সময়টুকু ওরা সেই চৌকো সত্তা থেকে বেরিয়ে আসে। ওদের তৃপ্ত মুখ দেখে সিদ্ধেশের খুব ইচ্ছে হল ক্যান্টিন থেকে খাবার আনাতে। 

বছর কুড়ি আগে এক মহিলা আর তাঁর স্বামী ক্যান্টিনটা শুরু করেন। মহিলার নাম নমিতা বিশ্বাস। পাড়ার সবাই বলত নমিতাদি। নামই হয়ে গেল নমিতাদির ক্যান্টিন। অপূর্ব রান্নার হাত ছিল নমিতাদির। রান্না তো অনেকেই করে, নমিতাদির ছিল আশ্চর্য এক পরিমিতিবোধ। কম তেলমশলায় সাধারণ পদকেই একটু অন্যরকম করে রেঁধে দিতেন। বিশেষ করে টিফিন আর নিরামিষ রান্নার খ্যাতি ছিল ওঁর। আর দামও খুব কম। অনেকসময়, কারও বাড়িতে হঠা অতিথি এলে কিংবা রাঁধতে ইচ্ছে না হলে নমিতাদির ক্যান্টিন থেকেই আনা হত। কতবার মা পাঠিয়েছে সিদ্ধেশকে। 

দাঁড়ানো কেমন, জানে না সিদ্ধেশ। তাতে তার কোনও অসুবিধে হয় না। অসুবিধে হতে পারে বলে কত ব্যবস্থা, তার ঘরের কোনও চৌকাঠ নেই। হুইচেয়ার আটকায় না কোত্থাও।

এই ব্যালনি থেকে আগে দেখা যেত পুরোটা, এ নিমগাছটা তখন কিশোর ছিল। এখন আর দেখা যায় না। খাবার যতক্ষণ রেডি হত, ততক্ষণ সিদ্ধেশ ভেতরটা দেখত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। লোকের খাওয়ার মধ্যে একটা জীবন্ত ব্যাপার তাকে টানত। আর একটু ঝোল চেয়ে নেওয়া, আর একটা কাঁচালঙ্কা, খাওয়ার শেষে তৃপ্ত হয়ে পাত চাটা— এইসব সে খুব খুঁটিয়ে দেখত। তার নিয়ে যাওয়া টিফিন কেরিয়ারে যখন নমিতাদি খাবারগুলো গুছিয়ে হাতে তুলে দিত, তার সঙ্গে একটা কাগজে আলাদা করে তার জন্যে দিত কোনও না কোনও সদ্য হয়া ভাজা। সে কখনও বেগুনি, কখনও বাদাম দেওয়া মুচমুচে আলুভাজা, এমনকী মাছের ডিমভাজা এক টুকরো। বিকেলের দিকে গেলে ডিমের ডেভিল বা ব্রেড পকোড়া।  সিদ্ধেশের তখনই মনে হত, এখানে যারা খায়, তারা খাওয়া ছাড়াও বাড়তি কিছু পায়। 

তারপর তো সিদ্ধেশ বাইরে চলে গেল পড়তে পড়ল, চাকরি করল, সম্পর্কে ঢুকল, বেরল, তিন-চার বছর অন্তর যখন আসত, তখন এই ক্যান্টিনের দিকে তাকানই হত না। একবার শুধু ভাতের পাতে একটা দারুণ খাবার খেয়ে মাকে বলতে, মা বলেছিল, ‘বুঝতে পারিসনি? কাঁচকলার কোফতা। নমিতাদির ক্যান্টিন থেকে আনিয়েছি। তুই খুব ভালবাসতিস, মনে নেই?’ মনে পড়েনি একেবারেই। কাঁচকলার কোফতা ভালবাসার কথা তো বটেই, এমনকী নমিতাদির মুখটাও মনে পড়েনি।




এখন মনে পড়ছে, জিভ ফিরিয়ে আনছে সমস্ত স্বাদ। সেই স্বা
গুলো পেতে ইচ্ছে করছে আবার। বাদাম দেওয়া মুচমুচে আলুভাজা, ব্রেড পকোড়া, ডিমের ডেভিল, কাঁচকলার কোফতা। মা চলে যাবার পর খান থেকে কিছু খাবার আসেনি। বনি খাবার আনাত, অনেক দেরিতে ওঠার জন্যে ব্রেকফাস্ট খাওয়া হত না, কফি খাওয়ার পর বনি দুপুরের জন্যে বেশি করে পিজা অর্ডার করত, আর রাতে চাইনিজ। সেই সময় ও হিউস্টনে অনেকগুলো সম্পর্ক আর অনেকগুলো চাকরি বদলিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছিল। এসে বহু পুরনো বান্ধবী বনিকে বিয়ে করল। মনে হয়েছিল বনি কলকাতার মেয়ে তো, ওকে নিয়ে  থিতু হতে পারবে। 

লোকের খাওয়ার মধ্যে একটা জীবন্ত ব্যাপার তাকে টানত। আর একটু ঝোল চেয়ে নেওয়া, আর একটা কাঁচালঙ্কা, খাওয়ার শেষে তৃপ্ত হয়ে পাত চাটা— এইসব সে খুব খুঁটিয়ে দেখত। 

কিন্তু  যে সিদ্ধেশ কলকাতা ছেড়ে গিয়েছিল আর যে কলকাতায় ফিরে এল— দু’জন এক মানুষ নয়। এমনিতেই রাস্তায় বেরলে অনেকসময় ও দিক বুঝতে পারত না। এতগুলো ফ্লাইওভার ওর চেনা শহরটাকে বদলে দিয়েছিল। বনিও তো সেই প্রেসিডেন্সির ঘাম চকচকে, মুখে চুল লেপ্টে থাকা মেয়েটা ছিল না। তার প্রথম বিয়েটা ভেঙে গেছে, কলেজে পড়ানো ছেড়ে সে তখন ডকুমেন্টারি ছবি বানায়। বনিকে ধাঁ করে বিয়ে করার পর ওর মনে হল এই বনিকেও ও চেনে না।

তবু খারাপ চলছিল না, কিন্তু হঠা ওর কোমর থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত নার্ভ শুকিয়ে যেতে শুরু করল। আর বনিও একটা ভাল অফার পেল ক্যালিফোর্নিয়ায়, বড় প্রোজেক্ট। কী করতে পারত ও সেটা নেওয়া ছাড়া? 

ও যখন এসেছিল, তখন সিদ্ধেশ একাই। সবে মা চলে গিয়েছে, তার জন্মের শেষ সুতো। একেবারেই বাধাবন্ধহীন সংসার ছিল তাদের। খাওয়া, শোওয়া, বেরনো বা ফেরার কোনও নিয়ম নেই, সাধারণ আর পাঁচটা কাপলের মতো। এটা হয়তো হতে পারত না মা থাকলে। সিদ্ধেশ ভেবেছিল একদিন। ভেবেছিল, মা থাকার কোনও ফ্রিকশন নেই যখন, বিনা আয়াসেই চলবে তাদের গাড়ি, যেমন এখন চলে তার হুইলচেয়ার, চৌকাঠহীন দরজা দিয়ে এ ঘর থেকে ও ঘরে। সিদ্ধেশ ব্যালকনি থেকে ঘরে ফিরবে বলে হুইলচেয়ার ঘোরাতে ঘোরাতে তার ঘরটা দেখতে পেল। চলার কোনও বাধা নেই ঘরে।




মেঝেটা প্রায় পুরো ফাঁকা, শুধু খাট, পড়ার টেবিল আর ছোট একটা ফ্রিজ ছাড়া, দেওয়ালে সেট করা বইয়ের র‍্যাক ট্যাক সব এমন হাইটে যাতে সিদ্ধেশ ইচ্ছে করলেই নিতে পারে। খাট, টেবিল সব হুইলচেয়ার ফ্রেন্ডলি করে বানানো, লাগোয়া টয়লেটও তাই। বনি অবিবেচক নয়, যাওয়ার আগে সব নিখুঁত করে সাজিয়ে দিয়ে গেছে, যাতে সিদ্ধেশের কোনও অসুবিধে না হয়। দু’শিফটে দু’জন আয়া ঠিক করে যেতে চেয়েছিল, সিদ্ধেশ রাজি হয়নি। সকালে আর সন্ধেয় রান্না করে দিয়ে যায় পুষ্প। চা করে ফ্লাস্কে রাখে। তা ছাড়া একটা ইলেকট্রিক কেটলি আছে, কফি মেকার, টুকটাক স্ন্যাক্স মজুত। কেউ এলেও তাকে একা আপ্যায়ন করতে পারে সে। কী হোলে চোখ রেখে সে নিজে গিয়েই খুলতে পারে দরজা।

বাদাম দেওয়া মুচমুচে আলুভাজা, ব্রেড পকোড়া, ডিমের ডেভিল, কাঁচকলার কোফতা। মা চলে যাবার পর খান থেকে কিছু খাবার আসেনি। 

সবই তো পারে সে, তবে? ব্যালকনি থেকে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে হঠাৎ তার মনে হল, দরজায় চৌকাঠ থাকা ভাল, চৌকাঠ থাকলে চলে যাবার আগে বনি একবার থমকে দাঁড়াত। 

বেলা হয়ে গেছে, খেয়ে নিলেই হয়। থরে থরে সাজানো খাবার ক্যাসারোলে। পুষ্প তার মাপ বুঝে গেছে। খুব কমদিনই খাবার তুলতে হয় ফ্রিজে। ঢাকনা খুলে খুলে দেখল সিদ্ধেশ, ঘ্রাণ নিল। ভুনি খিচুড়ি, পটল ভাজা আর পনির। এরকম খেতে ইচ্ছে করছিল আজ। কিন্তু খেতে গিয়ে আর ইচ্ছে করল না। নমিতাদি একটা নিরামিষ লাবড়া করত খিচুড়ির সঙ্গে, মনে পড়ল সেটা।  

মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই আরও একটা চাওয়া তৈরি হল তার মধ্যে। সে সামান্থাকে চাইল। সামান্থা, তার ভরন্ত শরীর, উপচোনো যৌবন নিয়ে স্থির মাধুরীর মতো পড়ে ছিল বিছানায়। চার্জ নিচ্ছিল। কত চার্জ খায় সে সারাদিন? ভাবতেই সিদ্ধেশ হিংস্র হয়ে উঠল। হুইলচেয়ারটা ঠেলে বিছানার কাছে নিয়ে গেল। সামান্থা একদম ধারেই আধশোয়া হয়ে আছে। খাটের লাগোয়া সুইচ বোর্ডে প্লাগ গোঁজা। সামান্থার বাঁ স্তনের ওপর একটা লাল আলো দপদপ করছে। সেখানে দেখাচ্ছে ৬০% চার্জিং। সামান্থা পরে আছে একটা ক্রপড লাল টপ, আর নীল ডেনিম শর্টস। টপের ওপর লেখা ফাকিং মাইন্ড। 




সিদ্ধেশ টপটা খুলবে বলে হাত বাড়াল। তার মধ্যে কে যেন বলে উঠল— পিরিয়ড চলার সময় বনির সঙ্গে মিলিত হয়েছ কি কোনওদিন? সামান্থা তো এখন চার্জে বসানো। এসময়…  সিদ্ধেশ সেই স্বরটাকে পাত্তা না দিয়ে লাল টপটা খুলে ফেলল জোরে। শর্টসটাও। সে জানে এর পর কী হবে। সামান্থা শরীর মোচড়াবে, ওর নাকের পাটা ফুলে উঠবে, ঠোঁট কুঁচকে যাবে, নিপলের রঙ বাদামি থেকে গোলাপি হয়ে যাবে। ও এগিয়ে আসবে সিদ্ধেশের দিকে। 
সিদ্ধেশ রিমোটটা খুঁজল। ওহ শিট! রিমোটটা কোথায়? ওই তো বইটার মধ্যে। ‘আর ইউ জোকিং মিস্টার ফেইনম্যান?’ এটা পড়ছিল কাল থেকে। পড়তে পড়তে ও অনেকবার সামান্থাকে চেয়েছে। সামান্থা তো ক্লান্ত হয় না কখনও। বনির মতো নখরাও করে না। বলে না ‘ছাড়, শরীর ভাল নেই আজ।’ বলে না ‘শরীর ছাড়া কিছুই কি বোঝ না তুমি?’

কী অদ্ভুত! বনিই পাঠিয়েছে সামান্থাকে। ও ছাড়া সিদ্ধেশকে কে আর বুঝবে এত ভাল করে? সিদ্ধেশের আদরে কি বনির নাকের পাটা ফুলে উঠেছে কখনও? নিপলের রঙ বদলেছে? নাভির কাছে তিরতির স্পন্দন? এসবই হয় সামান্থার। কপিবুক ক্রিকেটের মতো। কোন লেভেলের আনন্দ চায় সিদ্ধেশ, তাও সে বলে দিতে পারে রিমোট টিপে। রিমোটটা খুঁজে পেয়ে সিদ্ধেশ লেভেল থ্রি টেপে। আজ তার টপ গিয়ার মস্তি চাই।

পুষ্প তার মাপ বুঝে গেছে। খুব কমদিনই খাবার তুলতে হয় ফ্রিজে। ঢাকনা খুলে খুলে দেখল সিদ্ধেশ, ঘ্রাণ নিল। ভুনি খিচুড়ি, পটল ভাজা আর পনির। এরকম খেতে ইচ্ছে করছিল আজ।

কিন্তু এ কী! কিছুই তো করছে না সামান্থা। যা যা করার কথা তার! তার চিপে কি সঙ্কেত পৌঁছচ্ছে না কোনও? তার নগ্ন শরীর একটা ঠান্ডা লাশের মতো, বনি যেমন শক্ত কাঠ হয়ে পড়ে থাকত তার তলায়। রাগে মাথা ঝাঁঝাঁ করে ওঠে সিদ্ধেশের। সে এখন চাইলেও নমিতাদির হাতের লাবড়া পাবে না, সামান্থার রতিও না! কেন? কেন? ঠাস করে একটা চড় কষিয়ে দেয় সিদ্ধেশ সামান্থার গালে। ওমনি সামান্থা, যন্ত্রমানবী সামান্থা, কামপুত্তলি সামান্থা তাকে ঘুরিয়ে এক চড় মারে। আর বলে ‘আমার কি ইচ্ছে-অনিচ্ছে থাকতে পারে না সিদ্ধেশ, ইচ্ছে-অনিচ্ছে কি থাকতে পারে না আমার?’

ঘুরে ফিরে একই কথা বলেই চলে সামান্থা, যতক্ষণ না সিদ্ধেশ কাঁপাকাঁপা হাতে ওর পিঠের ঢাকনা খুলে  প্রাণভোমরা সিপিইউ-টা বার করে নেয়!

অলঙ্করণ: চিরঞ্জিত্‍ সামন্ত

যাদবপুর বিশববিদ্যালয় থেকে বি.ই‚ এম.টেক । সরকারি মুদ্রণসংস্থায় প্রশাসনিক পদ‚ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিদর্শী অধ্যাপনা তাঁর লেখনীকে বিশেষ স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে।গল্প‚ উপন্যাস, কবিতার পাশাপাশি ছোটদের জন্য কল্পবিজ্ঞান লিখে থাকেন নিয়মিত। প্রকাশিত হয়েছে বহু বই। নামজাদা পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন উত্তর-সম্পাদকীয়। সাম্প্রতিকতম কাব্যগ্রন্থ: 'লাইব্রেরি শার্ট খোলো'।

6 Responses

  1. তৃষ্ণা বসাক এর গল্পটা পড়লাম। টানটান উত্তেজনা আর শব্দের ঠাসবুননি গল্পটা কে এক নিঃশ্বাসে পড়তে অনেকটা বাধ্য করে। গল্পের মধ্যে বিষয় বৈচিত্র্যে নতুনত্ব আছে। শুরুতেই চমক শেষেও চমক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *