কখন যে পিছনের সিটে গা এলিয়ে চোখটা লেগে  গিয়েছিল খেয়ালই করিনি। আমি মোটেই ভোরে বিছানা ছাড়ার পাত্র নই। তার উপর সাজ়ের মিঠে সুর আর গাড়ির জানলা দিয়ে বয়ে আসা সকালের হাওয়ায় আর ঘুমটা আটকাতে পারিনি। লিনের জি-পি-এস বলছে আমরা মিনিট তিনেক হল ই-৮০-তে উঠেছি। তুরস্কের ভূমি রুক্ষ। গাছপালা তেমন একটা নেই বললেই চলে। দু’ধারে মূলত শুকনো ঝুরঝুরে মাটি। তার মধ্যেই এদিকে ওদিকে একটু আধটু ঝোপঝাড়। ইস্তানবুল শহরের ইউরোপের দিকটায় বেশ কিছু পাইন গোছের গাছগাছালি দেখতে পাওয়া যায়। শহরের একেবারে পূর্বদিকে, মানে আমাদের ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসেও তেমন গাছ রয়েছে বেশ কয়েকটা।

মজার ব্যাপার হল, ই-৮০ ধরে আরও পূর্ব-তুরস্কের দিকে আমরা যতই এগিয়ে চলেছি, সে গাছের সংখ্যাও ধীরে ধীরে ততই কমছে। আর এখানে ঝোপঝাড়ের মাঝে তেমন গাছ আর চোখে পড়ে না বললেই চলে। রাস্তার দু’ধারের (প্রায় খরা কবলিত) সমতলভূমির গা ঘেষেই এক আধটা টিলার মত উঁচু পাহাড় উঠে গেছে। সেই টিলায় গজানো গাছগুলোর গঠন খানিকটা পাইনের মতন। এমনই অদ্ভুত ভূচিত্রের বুক চিরে ওঠা নামা করেছে বিরাট সর্পিল ই-৮০ মহাসড়ক। আমরা চলেছি! 

E-80 Highway
অদ্ভুত ভূচিত্রের বুক চিরে ওঠা নামা করছে বিরাট সর্পিল ই-৮০ মহাসড়ক

আরও বেশ খানিকটা চলার পরই লিন জানালো ম্যাপ বলছে ডান হাতে মিনিট পনেরো গেলেই পড়বে বোলু শহর। সত্যি বলতে বোলুতে ঢুঁ মারার একটু ইচ্ছে আমার প্রথম থেকেই ছিল। হাইমে-কে কিছু বলবার আগেই দেখি ব্যাটা গাড়ি নিয়ে ঢুকে পড়েছে। বন্ধুরা বোধহয় এভাবেই মনের কথা শুনতে পায়!

বোলু শহরের মাঝামাঝি একটা পার্কের গায়ে গাড়িটা পার্ক করে আমরা এক পেয়ালা করে কফি আর লিনের তৈরি করা চিকেন স্যান্ডুইচ দিয়ে ছোট্ট একটা পিকনিক সেরে নিলাম। বোলু বেশ ছিমছাম শহর। পাহাড়ের গায়ে সাদা সাদা ওসমান বাড়িঘর। আর এদিক ওদিক ছড়িয়ে রয়েছে একগুচ্ছ ওসমানলি মসজিদ। হাইমের জন্য আমার নিজেরই খারাপ লাগছে। একা একা এতক্ষণ গাড়ি চালাচ্ছে, আর আমি পিছনের সিটে নাক ডেকেছি। কিন্তু লাতিনো যুবকের মুখে আমি হাসি ছাড়া একমুহূর্তও অন্য কিছু দেখতে পাই না। ঘণ্টাখানেক বিশ্রাম নিয়ে আমরা আবার বেরিয়ে পড়লাম। এবার সাফ্রানবোলু পর্যন্ত বাকি পথটা আমি সামনে আর লিন পিছনের সিটে।

পেট ভরে প্রাতরাশ সারার ফলে তিনজনের মেজাজই বেশ ভাল, কাজেই এবার আড্ডা জমল। মসৃণ ই-৮০ সড়কের উপর দিয়ে রুক্ষ্ম তুরস্কে বুক চিরে ছুটে চলা আমাদের গাড়ি এই আড্ডার মাঝেই কখন যে কারাবুক শহরে এসে পৌঁছেছে, একেবারে খেয়াল হয়নি। তার মানে আমরা প্রায় আমাদের গন্তব্যের কাছেই এসে পড়েছি। এবার হাইওয়ে ছেড়ে ঐতিহাসিক সেলচুক-অটোম্যান ইতিহাসের কোল ঘেঁষে ধীর গতির চড়াই। মিনিট পনেরো চলার পর আমাদের গাড়ি একটা চৌকোণা চত্বরে এসে থামল। তার একদিকে একটা মসজিদ (অটোম্যান তুর্কিদের তৈরি শহরের প্রমাণ) আর অন্য তিনদিক জুড়ে একরাশ আধুনিক দোকানপাট। 

Silent Alleys
ইতিহাসের অলিগলি ছুঁয়ে

প্রথমে খানিকটা মুষড়ে পড়লেও তিনজনেই সাহস করে এগিয়ে চললাম। চৌকো চত্বর ছেড়ে একটা কামারের দোকানের পাশ দিয়ে খানিকটা এগোতেই শিঁকে ছিড়ল। আমরা এবার যে জায়গাটায় এসে পৌছেছি সেটা একটা পাড়া। খানিকটা আমাদের বাংলার মফসসলের পাড়ার মতোই মেজাজ। বাঁধানো পাথরের রাস্তার দু’দিকে পুরনো বাড়িগুলোর কয়েকটা একতলা আর গুটিকয়েক দোতলা। আমার পড়াশোনায় যদি বিশেষ ভুলভ্রান্তি না থেকে থাকে, তবে টিলার দিকে এগিয়ে গেলে আমরা আরও ভালভাবে তৎকালীন নাগরিকদের শহুরে যাপনের বেশ কিছু নিদর্শন দেখতে পাব।

পাথরের রাস্তা ধরে এগিয়ে চললাম। রাস্তার দু’পাশে মাঝেসাঝেই এক-আধটা একইরকম গলি উঠে গেছে। দু-একটা মোড় ঘুরে আমরা দেখেও এসেছি। শতাব্দী প্রাচীন সাদা-লাল ওসমানলি বাড়িঘরের সবটাই একইরকম রাখা আছে, ভিতরের একটি কেদারাও যেন নেড়ে-চেড়ে দেখা হয়নি। শুধু ,মানুষগুলোই নেই। একটা শহরের বুকে হঠাৎই  যেন একটা ঘুম নেমে এসেছে। যেন এমনই এক দুপুরবেলা, নিজেদেরই মনের খেয়ালে, রান্নাঘরের বাসন, বিছানা গোছানোর কাজ, পাড়ার মোড়ের চায়ের দোকানের আড্ডা, ঝুল বারান্দায় নুয়ে পড়া প্রেম-খুনসুটি ছেড়ে শহরবাসী আচমকা চিরতরে হারিয়ে গেছেন। শতকের পর শতক ধরে এ শহর তার অভিমান আঁকড়ে পড়ে রয়েছে তাঁদেরই অপেক্ষায়।

সেই তো! শহরও তো মানবসান্নিধ্য আশা করে, মানব আলিঙ্গনের চাহিদায় তো উছলে ওঠে তারও চোখ? অথচ কেবল নিজের প্রয়োজনে সামান্য বাধা পড়লেই, মানুষ তার একদা চোখের-মণি নগরের ভালবাসাকে নিমেষে অগ্রাহ্য করতে পারে। হায়রে মানব সভ্যতা!

Safranbolu Market
সেলচুক যুগে তৈরি সাফরানবোলু বাজার

এইসব আকাশ কুসুম ভাবতে ভাবতেই আমরা একটা সরু গলির মতো জায়গায় এসে পড়েছি। গলির দু’পাশে একরাশ সুভেনিয়রের দোকান। সে সব দোকানে যে বিশেষ আকর্ষণীয় কিছু পাওয়া যায় তা নয়; ওই ফ্রিজ-ম্যাগনেট, পোস্টকার্ড এইসব। একটু খবর নিতেই জানা গেল, ১৯০০ সালের প্রথম দশক পর্যন্ত এই রাস্তায় জুতোর কারবারিদের বসতবাড়ি আর কারখানা ছিল। অর্থাৎ এই সেই  বিখ্যাত “ইয়েমেনি“ জুতোর আঁতুড়ঘর। সেই মেজাজটা ধরে রাখতে পুরনো কারখানা আর দোকান ঘরগুলোতেই পর্যটকদের জন্য কিছু আধুনিক জুতোর দোকান বসানো হয়েছে। আমরা আরও এগিয়ে চললাম। খানিকটা এগোতেই বাঁ হাতে মোড় ঘুরে দুটো ছোটোখাটো মসজিদের দেখা পাওয়া গেল।

এই চত্বরের মসজিদগুলো ভিতর বা বাইরের গঠনে ঐতিহাসিক ওসমান মসজিদের মতো হলেও ইস্তানবুলের মসজিদের তুলনায় আজানের জন্য ব্যবহৃত গম্বুজের সংখ্যা এক্ষেত্রে দুইয়ের জায়গায় একটি। মসজিদ থেকে বেরিয়ে আমরা আবার উপরের দিকে উঠতে শুরু করেছি। আশপাশের বাড়িঘরগুলো বেশ খানিকটা পালটে গেছে। পাহাড়ের বেশ খানিকটা উপরে হওয়ায় রাস্তার একদিকে প্রচুর গাছপালা। খাদের মাঝখান দিয়ে ছোট্ট একটা ঝরনা। খাদের গায়ে কাঠের বাড়িঘরের প্রায় মরচে ধরা কাঠামোও চোখে পড়ে।

Osman Mosque
ইজজেত মেহমেদ পাশা মসজিদ

এদিকটায় আসলে আদিম তুর্কোমান উপজাতিদের বসবাস ছিল। পরে ওসমানরা সেই বাড়িগুলকেই ভাইন-ইয়ার্ড, কিচেন-গার্ডেন, গাছগাছালির মাঝে “সামার-হাউস” হিসাবে ব্যবহার করত। এতক্ষণ পর্যন্ত যে জিনিসটা আমায় মুগ্ধ করেছে, তা হল এই ঐতিহাসিক শহরের গঠনে- শহুরে এবং গ্রামীণ, এই দুইয়ের সমান প্রভাব। 

পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে আরও খানিকটা উঠে যেতেই একটা তুলনামূলক সমতলভূমির দেখা পাওয়া গেল। এটা সাফরানবোলুর প্রধান বাজার। এখান থেকে টিলার উপরের পুরনো জায়গাটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এখানেই তৈরি হয় সেলচুক সময়কার সাফরানবলু শহর। সে সময়কার বাড়িঘর এখন আর দৃষ্টিগোচর না হলেও এ জায়গার গঠন প্রমাণ করে যে এ শহর সেলচুকদের হাতেই প্রথম তৈরি হয়।

পর্যটকদের কেনাকাটির জন্যই এই জায়গাটাকে আরও জমজমাট করে ঢেলে সাজিয়েছে তুরস্ক সরকার। বাড়িঘর, দোকানপাটের গঠন একইরকম রয়েছে, বদলেছে কেবল মানুষ আর বদলে গেছে তার পছন্দ। মাত্র ১৫০০ লিরা পিএইচডি স্কলারশিপ পাই। মাসের খরচ, বই কেনার খরচ, এদিক ওদিক বেড়ানোর খরচ সামলে, গাড়ি ভাড়া- হোটেল ভাড়ার ব্যবস্থা করেছি। কাজেই এসব দোকান ও তার পশরা আমার জন্য ব্রাত্য। লিন একটা স্কার্ফ কিনল। দিব্যি দেখতে। আমার চোখ অবশ্য অন্যদিকে। রাস্তার দুধারেই রমরমিয়ে জমে উঠেছে একসে-বড়কর-এক ওসমান রেস্তোরা। তাছাড়া টিলার উপরে একবার উঠতেই হবে। 

Safranbolu city
টিলার চার দিকেই ধরা দিয়েছে মধ্যযুগীয় ক্যারাভান-রুটের সাফরানবোলু শহর

হাইমে আমার মনের কথাটা বুঝেছে। ও বলল, “আমি আর লিন একটা রেস্তোরাঁয় অপেক্ষা করি। তুমি বরং চাইলে টিলার উপর থেকে ঘুরে এস?” অতি উত্তম প্রস্তাব! আমি বেরিয়ে পড়লাম।  বিশেষ কোনওদিকে না তাকিয়ে, প্রায় ঊর্ধ্বশ্বাসে, মিনিট দশেকেই টিলার উপর পৌঁছনো গেল। এই জায়গাটার ব্যাপারে আমার বিশেষ আগ্রহ, তার কারণ এখান থেকেই সাফরানবোলুর অপরূপ প্যানোরমা পাওয়া যায় বলে শুনেছি, এবং গিয়ে বুঝলাম মোটেই ভুল শুনিনি। টিলার চার দিকেই ধরা দিয়েছে মধ্যযুগীয় ক্যারাভান-রুটের সাফরানবোলু শহর।

এ দৃশ্যের মাধ্যমেই, মধ্যযুগীয় প্রাচ্য ইতিহাসের সঙ্গে আমার প্রথম চাক্ষুস আলাপ। এ আরাম-সুখরাজ্যের রাজকুমারী যেন এক অজ্ঞাত ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত সদাগর পুত্রের জন্য তাঁর আচল এলিয়ে রেখেছেন। দু’দণ্ড বিশ্রামের পরই নেমে আসবে চিরবিরহের পালা। রাত পোহালেই সদাগর সাত সমুদ্র তেরো নদীর অভিযানে পাড়ি দেবেন। এই তাঁদের এক লহমার দেখা, এই তাঁদের অন্তহীন সুখস্মৃতির আদর বিনিময়।

মনটা ভার করেই নেমে আসতে হল। আর তো দেখা পাব না। কিছুটা পথ নামতেই রগরগে তুর্কী কাবাবের গন্ধে ইহজগতে ফিরে এলাম। ওহ! এত হাঁটাহাঁটির পর প্রবল খিদে পেয়েছে। হাইমেরা গেল কই? মোড় ঘুরতেই দেখা মিলল; ওইতো! একটা জমজমাট রেস্তোরাঁর বাইরে বাঁধানো রাস্তার উপর ফেনা ওঠা আয়রানে ভরা তিনটি ঠান্ডা পেতলের গেলাস টেবিল আলো করে রয়েছে। আর তাকে ঘিরে বসা গল্পে মশগুল হাইমে আর লিন আমায় দেখেই একরাশ হেসে একটা চেয়ার এগিয়ে দিয়েছে।

Turkish scene Amasra
ফিলিয়োস থেকে দৃষ্টিগোচর কৃষ্ণ সাগরের তীরে আমাসরা শহর

আমি মোটামুটি ঠিক করেই নিয়েছিলাম। হয় “আদানা কেবাপ” খাবো অথবা “জা কেবাপ।” রেস্তোরাঁর মালিক বললেন এ অঞ্চলে আদানাটাই বেশি চলে। বেশ তাই সই। হাইমে নিয়েছে ইস্কেন্দার কেবাপ আর লিন একটা দুরুম। ধোঁয়া ওঠা আদানা আর কনকনে ঠান্ডা আয়রান সহযোগে জমিয়ে লাঞ্চ সেরে মিনিট পনেরোর মধ্যেই উঠে পড়লাম আমরা। নাঃ সত্যিই অনেকটা সময় কেটে গেছে, টেরই পাইনি। এরপর ফিলিয়স হয়ে কৃষ্ণ সাগরের উপকূল ধরে আমাসরা যাব আমরা। ড্রাইভটাও নেহাত কম নয়, সন্ধ্যে হওয়ার আগেই পৌছতে হবে। হাইমে আর লিনকে এগোতে বলে, রাস্তার জন্য প্রয়োজনীয় একটা জলের বোতল কিনতে খাবারের দোকানে ফেরত যেতেই, সেই টিলা পিছনের সাদা-লাল-সাদা স্তব্ধ বাড়িঘর চোখে পড়ল আবার। 

তার চোখে চোখ রেখে মিনিটখানেকের জন্য থমকে দাঁড়াল একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক। নিঃসঙ্গ অভিমানিনী মধ্যযুগীয় যাপনের কাছে আত্মসর্বস্ব মানব সভ্যতার এইটুকু দায়বদ্ধতা তো থেকেই যায়।

 

*ছবি সৌজন্য: লেখক

Rupak bardhan Roy

ড. রূপক বর্ধন রায় GE Healthcare-এ বিজ্ঞানী হিসেবে কর্মরত। ফ্রান্সের নিস শহরে থাকেন। তুরস্কের সাবাঞ্চি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করেছেন। বৈজ্ঞানিক হিসেবে কর্মসূত্রে যাতায়াত বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। লেখালিখির স্বভাব বহুদিনের। মূলত লেখেন বিজ্ঞান, ইতিহাস, ঘোরাঘুরি নিয়েই। এ ছাড়াও গানবাজনা, নোটাফিলি, নিউমিসম্যাটিক্সের মত একাধিক বিষয়ে আগ্রহ অসীম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *