ফুটফুটে একটা সকালে একটা ছোট্ট খোলস ছেড়ে বেরল এক ছোট্ট প্রজাপতি। তার নাম রোহিনা। রোহিনা বাইরে আসতেই সুয্যিমামা রোহিনার দিকে তাকিয়ে খিলখিল করে হাসল আর রোহিনা খুব খুশি হয়ে গেল।

কিছুক্ষণ বাদে রোহিনা নিজের চারদিকে তাকিয়ে আরও অনেক অনেক প্রজাপতি দেখতে পেল। কিন্তু তাদের সব্বার দু’টো করে ডানা। আবার একটা পাখিও দেখল। পাখিরও দুটো ডানা। একটা বোলতাও ছিল। তারও দুটো ডানা। এ বার রোহিনা নিজের দিকে তাকিয়ে উড়ে যেতে গিয়ে দেখে…সব্বার দুটো ডানা আর রোহিনার তো একটা মোটে ডানা!

তখন রোহিনা দেখল, কারা কারা উড়তে পারে!
যারা উড়তে পারে, তাদের সবারই তো দু’টো ডানা আছে। তাদের কাছে চাইলে একটা ডানা তো রোহিনাকে ওরা দিতেই পারবে, তাই না?
তাই রোহিনা প্রথমে গেল একটা ঘুড়ির কাছে। বলল– ঘুড়িভায়া, ও ঘুড়িভায়া, তুমি তো আকাশে ওড়ো। তোমার নিশ্চয়ই দু’টো ডানা আছে। আমাকে দাও না। আমার মোটে একটা ডানা। কিন্তু ঘুড়ি বলল– কই, আমার তো একটাও ডানা নেই। তুমি বরং প্যাঁচা ঠাম্মির কাছে গিয়ে ডানা চাও। ওই দিকে ওই গাছটায় থাকে প্যাঁচাঠাম্মি।
তখন প্যাঁচাঠাম্মির কাছে গিয়ে রোহিনা বলল– ও প্যাঁচা ঠাম্মি, তুমি তো কী সুন্দর গোলগাল। তোমার দু’-দু’টো ডানা। আমাকে একটা দেবে?
প্যাঁচাঠাম্মি বলল, কে তোমাকে বলেছে গোল হলেই ডানা থাকে আর সেটা ধার দিতে পারে? তুমি তো গোল নও! কিন্তু তাও তো তোমার ডানা আছে! এক কাজ কর, আমার বদলে তুমি বরং এরোপ্লেনের কাছে যাও। ওর দু’টো ডানা। ও তোমাকে একটা দিয়ে দিতেও পারে।
তখন রোহিনা গিয়ে এরোপ্লেনকে বলল– ও এরোপ্লেন দাদা, আমাকে একটা ডানা দেবে?
এরোপ্লেন বলল, মোটেই না! আমি তাহলে উড়ব কী করে? পড়ে যাব যে?

রোহিনার খুব রাগ হল। ও সেখান থেকে চলে গেল। যেতে যেতে যেতে যেতে, রাস্তায় অনেক ব্যাঙের সঙ্গে দেখা। ব্যাঙেরা লাফিয়ে লাফিয়ে যাচ্ছে আর লম্বা জিভ বের করে খাবার খাচ্ছে। তাই দেখে রোহিনা হাততালি দিয়ে বলে উঠল– এইত্তো! প্যাঁচাঠাম্মি ঠিকই বলেছে। আমার একটা ডানা দিয়েই কাজ চলে যাবে।
তখন রোহিনা ওড়ার বদলে লাফিয়ে লাফিয়ে চলতে লাগল আর খাবার খেতে লাগল। কিন্তু তাই না দেখে সব্বাই হাসাহাসি করতে লাগল।
এ মা, একখানা ডানা নিয়ে কেমন লাফিয়ে লাফিয়ে চলছে, কী বিচ্ছিরি…

এবার রোহিনার চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল। কী হবে! সব্বাই তাকে দেখে ঠাট্টা করছে। রোহিনা কেঁদে কেঁদে বলতে লাগল– আমি এখন কার কাছে যাব, কার কাছে গিয়ে একটা ডানা ধার চাইব!
হঠাৎ উপর থেকে কে যেন বলল– তুমি নাও না, আমরা তো অনেকজন আছি!
রোহিনা উপরে তাকিয়ে দেখে পাখি ঠাম্মা! তাই তো! রোহিনা ভাবল, পাখি ঠাম্মার কাছে একটা ডানা চাইলেই হয়! তাই সে তাড়াতাড়ি গিয়ে পাখি ঠাম্মার কাছে ডানা চাইল। পাখি ঠাম্মা বলল– রোহিনা তুমি আমার জন্যে একটা তারা আর একটুখানি সমুদ্রের ঢেউ নিয়ে এস, আমি তোমার একটা ডানাকেই সুন্দর করে সাজিয়ে দেব। দেখবে কী দারুণ লাগে!

তখন রোহিনা আকাশে গিয়ে তারাকে বলল– আমাকে কয়েকটা বাচ্চা তারা দেবে? আমি পিঠের ওপর লাগাব!
তারা বলল– না। চাঁদের মা বুড়ি না বললে আমি একটাও ছোট্ট তারা তোমাকে দিতে পারব না। চাঁদের মা বুড়ি হল আমাদের রানি। রানি মা যা বলবেন, আমাদের তাই শুনতে হবে। আমি খুউউউউউব সরি।
রোহিনা আর কী করে, চাঁদের মা বুড়ির কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল– ও চাঁদের মা বুড়ি, আমি কয়েকটা তারা নিতে পারি?
চাঁদের মা বুড়ি কাঁপা কাঁপা গলায় বলল– নিশ্চয়ই, আমি তো বুড়ি হয়েছি। আমার আর তারা লাগবে না। আসলে হাঁটতে তো পারি না আমি। তাই তারাদের বলি, তোমরা আমাকে সাহায্য করো। ওরা করে বটে। কিন্তু একদিন দেখলাম তারাগুলো বড্ড বেশি হয়ে যাচ্ছে সংখ্যায়! রোজ ১৬৫টা করে জন্মাচ্ছে! আর যে পেরে উঠি না। তুমি নাহয় ক’টা তারা নাও।

রোহিনা খুউউউউব খুশি হল। তারপর সমুদ্রে গিয়ে ঢেউকে বলল– ও ঢেউ, আমার তোমাদের খুব দরকার। একটু ঢেউ দেবে? আমি আমার পাখাকে সুন্দর করব।
কিন্তু ঢেউরা বলল– এমনি এমনি তো দিতে পারব না। সমুদ্রমামা যদি বলে, একমাত্র তাহলেই আমরা তোমাকে ঢেউয়ের কুচি দিতে পারি।
রোহিনা তখন সমুদ্রমামার কাছে গিয়ে বলল– ও সমুদ্রমামা, আমাকে একটু ঢেউ দেবে গো?
সমুদ্রমামা গম্ভীর গলায় গমগম করে কী যে বলল, প্রথমে রোহিনা বুঝতেই পারল না। সে বলল, কী সব বলছ কিছুই তো বুঝতে পারছি না।
তখন সমুদ্রমামা একটু ফিসফিস করে বলল– হ্যাঁ রোহিনা, তুমি ঢেউ নিতেই পার। অনেক ঢেউ আছে আমার। নিয়ে নাও।

তখন রোহিনা খুব খুশি হয়ে তারা আর ঢেউ নিয়ে পাখি ঠাম্মির কাছে গেল। পাখি বলল– এবার তুমি চাঁদের মা বুড়ির কাছে যাও। বলো এগুলো সব তোমার ডানায় আটকে দিতে।

রোহিনা তাই করল। তখন চাঁদের মা বুড়ি সূচ-সুতো দিয়ে রোহিনার একটা ডানায় তারা আর সমুদ্রের ঢেউ সেলাই করে দিল। সেই অপরূপ ডানা দেখে সব্বাই অবাক হয়ে গেল, তাকিয়েই থাকল। কেউ আর রোহিনার লাফিয়ে লাফিয়ে খাবার খাওয়া নিয়ে ঠাট্টা করতে পারল না। আর রোহিনাও মহা আনন্দে বাগানে থাকতে লাগল।

 

* উৎসার বলা গল্পের ভিত্তিতে লিখে দিয়েছেন পল্লবী মজুমদার।

আট বছরের উৎসা ঝলমলে এক গানপাগলা কুচো। নিজের দুনিয়ায় থাকতে আর অগুন্তি আজগুবি প্রশ্ন করে চারপাশে সকলকে ব্যতিব্যস্ত করতে দারুণ ভালোবাসে। কিন্তু তার কিচ্ছুটি খেতে ভালো লাগে না, এই হল মায়ের সমস্যা। কাঁড়ি কাঁড়ি গল্পের বইতেই পেট ভরে যায়। আপাতত ফ্রিডা কাহলো, রোজ়া পার্কস আর হ্যারি পটার নিয়ে ব্যস্ততার চোটে ইস্কুলের পড়াশুনো মাথায়।

4 Responses

  1. আট বছরের উৎসা কে জানাই অনেক আদর। এতো সুন্দর আর মিষ্টি গল্প যে আমরা পড়তে পারলাম এতেই তো এই অসুখের দিনে ভীষণ সুখ পেলাম।
    তুমি আরও লেখো আর অনেক বই পড়ো। অনেক গান শোনাও। কিন্তু না খেলে শক্তি পাবে কি করে? অনেক আশীর্বাদ থাকলো উৎসার জন্য। এই পৃথিবীর ছোটো বাচ্চাদের আর বুড়ো মানুষদের ওর এইরকম সুন্দর লেখা বাঁচিয়ে রাখবে। সমাজকে ভালো দিন না বুঝেই ও দেখালো। এক ঝুরি তারা যেন আমার গায়ে ঝরে পড়ে মনটা ফুরফুরে করে দিলো।উৎসা আর ওর বাবা মা কে অনেক শুভেচ্ছা জানাই।
    অবশ্যই সাথে পল্লবী মজুমদারকে যিনি ঐভাবে সাথ দিয়েছেন।

  2. কি সুন্দর লিখেছে উৎসা। মনে হচ্ছে আমার ছোটবেলার মার মুখে শোনা সেই চাঁদমামা আর তারাদের গল্প আবার নতুন করে কেউ সোনালো আমায়। ছোট্ট উৎসার মিষ্টি গল্প আর ওই আঁকা ছবিটা ফিরিয়ে দিল আমার হারিয়ে যাওয়া ছোটবেলা,আমার মায়ের আদর করে গল্প বলা,বিকেল বেলা য় পাডার মাঠের সবুজ গালিচায় ছুটে ছুটে খেলা করা। এমনি করেই আমাদের ছোটবেলার স্মৃতি গুলোকে আবার নতুন রঙের তুলিতে আঁকতে থাকো মা তুমি উৎসা। আমার অনেক ভালো বাসা ও আদর রইলো তোমার জন্য মাগো ।

  3. অপূর্ব কল্পনার জাল বুনতে বুনতে উৎসা সেই ছোট্টবেলায় নিয়ে গেল আমাকে। এতো আনন্দ হলো তোমার গল্প পড়ে, অনেক অনেক আদর নিও। আরও এরকম গল্প লিখ তুমি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *