বিপরীতের সমন্বয় দিয়েই বুঝি পৃথিবী সচল থাকে। ‘তটের বুকে লাগে জলের ঢেউ / তবে সে কলতান উঠে’… কিন্তু ওই ‘সমন্বয়’টা জরুরি। তট যদি বুকে নগরশহর সাজিয়ে নিয়ে নদীর পাশে ক্রমশ ঘেঁষে আসতে থাকে, সেটা জলের পক্ষে সুবিধাজনক হয় না।
ঠিক সেরকম নদীও যদি কূলের বাধা ছেড়ে অনেকখানি উপছে ওঠে, স্থলভূমির কাছে সেটা খুব আকাঙ্ক্ষিত নয়। বৈপরীত্যেরও শৃঙ্খলা থাকে। সেই শৃঙ্খলাটিকে জেনে ও মেনে চললে মানুষের সঙ্গে মানুষের ধাত্রী প্রকৃতির সম্পর্ক অর্থাৎ পরিবেশের সুস্থতা ও সৌন্দর্য বজায় থাকে।
নদীর দেশের লোক আমরা, নদীর কথাই বলি। মাঝে মাঝে মনে হয়, প্রকৃতির যত সংস্থান আছে‒ পর্বত, সমুদ্র, অরণ্যানী, তৃণভূমি‒ সবকিছুর মধ্যে নদীই যেন সবচেয়ে সুন্দর, সবচেয়ে রহস্যময়। প্রাণের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ধাত্রী। কোনও সন্দেহই নেই যে এ আমার নিজস্ব ভালবাসার কথা। কিন্তু একথার সমর্থনও আমার সমাজ সাহিত্য সংস্কৃতিজোড়া।
এই পূর্বভারত যে স্মরণাতীত কাল থেকে প্রাকৃতিক সম্পদে অতুলনীয় আর এখানকার মানুষরা সেই সম্পদের কুশলী ব্যবহার জানতেন বলে এ অঞ্চল সারা পৃথিবীর কাছে এক সুখী সম্পন্নতার রূপকথা ছিল- তার মূল কারণ নদী। সিন্ধু গঙ্গা ব্রহ্মপুত্রের মতো নদীরা হিমালয় পর্বতের বিভিন্ন হিমবাহ থেকে বেরিয়ে, ঘন বনের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ঢালুতে নেমেছে। মৌসুমী বৃষ্টিপাতের প্রবল ধারায় পাহাড়ের মাটি কিছু কিছু করে ধুয়ে নেমেছে সে সব নদীতে। সমতলে গড়িয়ে এসে বর্ষার নিয়মিত বন্যায় নদীস্রোতে বয়ে আসা সেই মিহি ঊর্বর মাটি উপছে দু’পাশের সমতল ভূমিকে ঊর্বর করেছে। এ কথা আলাদা যে সেই উর্বর জমিতে অগণ্য রকমের শস্য ও ফল ফলিয়েছেন যে কৃষকেরা, কিছু ক্ষমতাশালী লোক তাদের কাছ থেকে অন্যায়ভাবে সেই ফল-ফসল দখল করেছে, কিন্তু তাতে নদী বা সামগ্রিকভাবে প্রকৃতির দান অপ্রমাণ হয় না।

শুধু ভূমিকে গঠন করা বা সামাজিক প্রাথমিক অর্থনীতির ভিত তৈরি করাই নয়, আমাদের মতো নদীমাতৃক দেশে সমাজসংস্কৃতি ভাবনার মধ্যেও অনেকখানি বিস্তৃত হয়ে থাকে নদী। ভারতীয় সাহিত্য বিচার করতে গিয়ে যদি বহুচর্চিত কোনও একক বিষয়ের কথা কেউ খোঁজেন- অবশ্যই নদীকে তিনি পাবেন। সাহিত্যের পরিশীলিত ক্ষেত্রের বাইরে, মৌখিক চর্চায় বিস্তৃত জগতও নদীর জলে ছলছল। যেমন- ‘নদী নদী কোথায় যাও / বাপভায়ের বার্তা দাও’-এর মতো অজস্র ছড়া…, আশ্চর্য সব গান যেগুলোর মধ্যে নদীর ভিন্নভিন্ন এলাকার বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট। ‘বহতা পানি নির্মলা’ আবার ‘নদীর ধারে বাস / ভাবনা বারোমাস’-এর মতো গণনাতীত প্রবাদ বা লোকোক্তির বিশাল ক্ষেত্র।
শুধু ভূমিকে গঠন করা বা সামাজিক প্রাথমিক অর্থনীতির ভিত তৈরি করাই নয়, আমাদের মতো নদীমাতৃক দেশে সমাজসংস্কৃতি ভাবনার মধ্যেও অনেকখানি বিস্তৃত হয়ে থাকে নদী। ভারতীয় সাহিত্য বিচার করতে গিয়ে যদি বহুচর্চিত কোনও একক বিষয়ের কথা কেউ খোঁজেন- অবশ্যই নদীকে তিনি পাবেন। সাহিত্যের পরিশীলিত ক্ষেত্রের বাইরে, মৌখিক চর্চায় বিস্তৃত জগতও নদীর জলে ছলছল। যেমন- ‘নদী নদী কোথায় যাও / বাপভায়ের বার্তা দাও’-এর মতো অজস্র ছড়া…, আশ্চর্য সব গান যেগুলোর মধ্যে নদীর ভিন্নভিন্ন এলাকার বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট। ‘বহতা পানি নির্মলা’ আবার ‘নদীর ধারে বাস / ভাবনা বারোমাস’-এর মতো গণনাতীত প্রবাদ বা লোকোক্তির বিশাল ক্ষেত্র।
বাংলার নিজস্ব রামকথা কৃত্তিবাস পুঁথিতে শুধু গঙ্গানদীর উপাখ্যানই এক বড় ও গুরুত্বপূর্ণ অংশ জুড়ে রয়েছে। মঙ্গলকাব্য, চৈতন্যলীলা, সত্যপীর ইত্যাদি নানা পাঁচালি যেন নদীকথায় ভেজা। এতটা প্রত্যক্ষ ছাড়াও ভারতের সৌন্দর্যশাস্ত্রে আমাদের ধীরগামিনী, প্রশস্ত, সমৃদ্ধিময় নদীদের চলন কি কোথাও প্রভাবিত করেনি আমাদের নরনারীর আদর্শ রূপকল্পনাকে যা ভরাট প্রশস্ত ও ধীরগামী?
বড়নদী আর তাদের দুই তীরের উদার বিস্তৃত সজল সমতলে জীবন কাটানো মানুষেরা যে সাধারণভাবে হবেন সহজজীবনে সন্তুষ্ট, প্রসন্ন-স্বভাব, সৃষ্টিশীল– এটাই তো সবচেয়ে স্বাভাবিক মনে হয়। জলের প্রসাদে এঁদের জীবনযাপন ছিল অপেক্ষাকৃত সহজ। জীবনযাপনের প্রাথমিক প্রয়োজনটুকু মিটিয়ে নিয়ে এঁরা রচনা করেছেন অসাধারণ সব কারু ও চারুশিল্প, সাহিত্য, দার্শনিক মত। ছবি, সুর, স্থাপত্য, ভাস্কর্য। মণ্ডনকলা। এদেশের রঙের ব্যবহারে, আলপনার নকশাতে পর্যন্ত জলের ছবি, ঢেউয়ের রেখা, জলজ উদ্ভিদের প্রাধান্য। মৃৎশিল্পে, বুননে। তাঁতিরা জানেন গঙ্গাজলে সুতো ভিজিয়ে রাখলে সুতোয় অনেক ভাল রঙ ধরে। এমনকি গঙ্গাজলি নামেই একটি বিশিষ্ট রঙ অতি আদরের ছিল বাংলার শাড়িধারিণীদের কাছে।

জলের প্রভাবে এইসব সূক্ষ্মচর্চা ছাড়াও আমাদের নিত্যদিনের প্রয়োজনে জলকে ব্যবহারের কতরকম যে প্রযুক্তি আবিষ্কার ও আয়ত্ত করেছিল মানুষ, ভাবলে আশ্চর্য লাগে। কী করে তাহলে মাত্র শ’খানেক বছরের মধ্যে দেশ জলসংকট ও জলপ্রলয়ের এই বিকট অবস্থায় এসে পৌঁছল!
এমন নয় যে আগেকার অবস্থায় পুরোটাই দুধ আর মধুর সমুদ্র ছিল। সমস্যা তখনও ছিল- অনাবৃষ্টি অতিবৃষ্টি হঠাৎ কোনও বছর ফসলে পোকা লাগা বা পঙ্গপালের আক্রমণ, রাজায় রাজায় যুদ্ধবিগ্রহে কখনও চাষির ফসল নষ্ট…। সাধারণ মানুষের জীবনে দুঃখকষ্ট তখনও ছিল। কিন্তু প্রাকৃতিক কারণে খুব প্রকাণ্ড বিপর্যয়ের সংখ্যা ছিল অনেক কম। সাধারণ বন্যা খরা অজন্মা গ্রামের মানুষরা কষ্ট করে হলেও সামলে নেবার কৌশল জানতেন। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় পশ্চিম রাজস্থানে জয়সলমির থেকে আরও আটাত্তর কিমি পশ্চিমে থর মরুভূমি ঘেঁষা জায়গায় ‘বিপরাসর’ নামে এক বিরাট জলক্ষেত্র আছে যার বয়স সাতশো বছরের বেশি।
স্থানীয় জল সংরক্ষণের কৌশলকে কাজে লাগিয়ে এটি তৈরি করা হয়েছিল। বছরে একশো ত্রিশ থেকে তিনশো মিলিমিটার বৃষ্টিপাতের দেশে স্থানীয় মানুষরা বলছিলেন, যদি কখনও পাঁচ বছরও বৃষ্টি না হয়, ওই অঞ্চল শুষ্ককণ্ঠ হবে না। এমনকী কাছাকাছি রামগড় শহরের ব্যবহারের জলও ট্যাঙ্কারে ভরে বিপরাসর থেকেই যায়।
পাহাড় থেকে লবণাক্ত উপকূল অঞ্চল থেকে নিচু সমতল বা মালভূমি– সব জায়গার সমাজ নিজের মতো করে বৃষ্টিজল সংরক্ষণ করত। বীজও। এছাড়া উৎপাদনে প্রাকৃতিক নিয়মগুলোকে সম্মান করে চলার জন্য সমাজে একধরনের পারস্পরিকতার নীতি মেনে চলতে হত। প্রাকৃতিক নিয়ম মানুষের ব্যক্তি ও গোষ্ঠিগত জীবনকে এতটাই নিয়ন্ত্রণ করত।
প্রাকৃতিক নিয়মের মধ্যে থেকেও মানুষের নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী প্রকৃতিকে পরিবর্তিত করে নেওয়ার পারস্পরিক বৈপরীত্য এভাবে সমন্বয় সাধন করে চলেছে অনেক শতাব্দী ধরে। ফলে কেউ কারও ক্ষতি না করেই অক্ষুণ্ণ থাকা সম্ভব হয়েছে।
কিন্তু যদি এই সমগ্র সমন্বয় ব্যবস্থাটিকে নিয়ে যাওয়া হয় এর বিপরীত পরিস্থিতিতে? অর্থাৎ প্রাকৃতিক নিয়মের বিশালতা ও অলঙ্ঘ্যনীয়তাকে স্বীকার করে নিয়েও সুকৌশলে তার বৈপরীত্য সাধন করার বদলে যদি প্রাকৃতিক নিয়মের বিপরীতে যাবার চেষ্টা করে ক্ষমতাগর্বী মানুষ? কেমন দাঁড়ায় তাহলে প্রাকৃতিক সম্পদের সঙ্গে মানুষের জীবনযাপনের সম্পর্ক?

যখন থেকে নিয়ম বহির্ভূত জলের জন্য প্রকৃতির অফুরন্ত জলের ধারাগুলির স্বাভাবিক গতিপথে বাধা দিতে শুরু করল কিছু মানুষ, প্রকৃতির একটি প্রধান নিয়ম লঙ্ঘিত হল, যে জল সর্বদাই নীচের দিকে গড়িয়ে যাবে। নদীর সচ্ছন্দ গতিধারার মাঝখানে ইচ্ছেমত প্রাচীর তুলে ক্ষমতা তাকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা শুরু করল। স্রোতে ভেসে আসা পলিমাটির পথ গেল আটকে, ব্যহত হল ভূমিগঠনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। নদী নিজের শ্লথগতিতে পৌঁছে যেখানে সেই পলিমাটি জমা করে বদ্বীপ গঠন করে, সেই সমগ্র কার্যপথ-যাত্রাটি ব্যহত হল।
সেখানেই থামল না। মাটি তার স্বাভাবিক উর্বরতায় যতখানি ফসল উৎপন্ন করত, কিছু মানুষের লোভ সেই মাত্রা লঙ্ঘন করে রাসায়নিক দিয়ে, অপ্রাকৃতিক, প্রকৃতিবিরোধী বীজ দিয়ে মাটির গর্ভ আঁচড়ে বার করে আনতে চাইল তার চেয়ে অনেক বেশি শস্য। মুখে বলল, অধিক জনসংখ্যার কথা। বাস্তবে দেখা গেল মাঠ, ঝোপঝাড় জলাভূমি কি নদী থেকে পাওয়া স্বাভাবিক খাদ্যের ভাণ্ডার শেষ। আগের চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যক মানুষ হারিয়েছে নিজেদের পায়ের তলার মাটি, অথচ রয়ে গেছে একইরকম ক্ষুধার্ত। মাটির স্বভাবিক গঠন ও প্রাণশক্তি গেছে জ্বলে।
এই অবৈজ্ঞানিক হস্তক্ষেপের মাত্রা বাড়তে বাড়তে আজকে সমস্ত পৃথিবী ‘ত্রাহি ত্রাহি’ রব তুলেছে। সামগ্রিকভাবে মানুষের জীবনযাত্রা একেবারে বিপর্যস্ত। চূড়ান্ত বিপদের অবস্থায় টলমল করছে মানুষ ও জীবজগতের অস্ত্বিত্ব। দুটি বৃহৎ শক্তি যদি নিজেদের পারস্পরিক সম্পর্কের ওজন না বুঝে বৈপরীত্যের স্পর্ধায় ফুঁসে ওঠে– তাহলে যা হতে পারে সেই অবস্থা ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে।
তথাকথিত ‘সভ্যতা’র দাপটে আজ মানুষ আর অন্য সব আশ্চর্য সংস্থান যেগুলো পৃথিবীকে ‘পৃথিবী’ করে রেখেছে এতকাল ধরে, এরা দাঁড়িয়েছে এক অসম চ্যালেঞ্জে, মুখোমুখি। প্রকৃতির প্রাথমিক নিয়মগুলো অবিমৃষ্যকারিতায় বিকৃতিপ্রাপ্ত ও ধ্বংস হতে বসেছে। বিজ্ঞানের নিয়ম অনুযায়ী যে কোনও স্থানচ্যুতির নির্দিষ্ট মাত্রা আছে- ঘড়ির দোলক যতখানি বাঁদিকে যায় ঠিক ততটাই ডানদিকে সরে। নদীর জলধারা স্ফীতিকালে একদিকে যতখানি মাটি ভাঙে, বিপরীতে ততটাই মাটি জমা করে। প্রাণীদের খাদ্যখাদক শৃঙ্খলা কোথাও ব্যহত হলে সংকট তৈরি হয়। সেই নিয়মকে লঙ্ঘন করে যে বৈপরীত্য- তা নিজের অস্তিত্বের নিয়মগুলোকেও লঙ্ঘন করছে।
বৈপরীত্যের প্রাকৃতিক শৃঙ্খলা ভাঙার অর্থ আত্মধ্বংসের পথে যাওয়া।
ছবি সৌজন্য: Wikimedia Commons
জয়া মিত্র বাংলা ভাষার এক জনপ্রিয় কবি ও গদ্যকার। সত্তরের দশকে সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং রাজনৈতিক বন্দীদশাও কাটিয়েছেন। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, এই সমস্ত মাধ্যমেই তাঁর অনায়াস যাতায়াত। লেখালেখি করেন ছোটবড় একাধিক সংবাদমাধ্যম ও পত্রপত্রিকায়।জল, প্রকৃতি, পরিবেশ, নারী ও শিশু বিষয়ে ওঁর কাজ উল্লেখযোগ্য। 'হন্যমান', 'জলের নাম ভালোবাসা', 'রূপুলি বেতের ঝাঁপি', 'মাটি ও শিকড়বাকড়' জয়া মিত্রর কিছু জনপ্রিয় ও সমাদৃত বই।