এ কথা এখন সকলেই জানে যে, স্বাধীন ভারতের প্রথম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব ১৯৫২ সালে আমাদের চারটি মহানগরীতেই সম্পন্ন হয়েছিল। এ কথাও পুরনো হয়ে গেছে যে, সেই উৎসবে দেখানো ছবিগুলির মধ্যে ইটালীয় নববাস্তবাদী ছবি ডি’সিকার “বাইসাইকেল থিভস” ও রসেলিনির  “ওপেন সিটি রোম” আমাদের চলচ্চিত্রে বাস্তবতার মোড় ঘুরিয়ে দেয়। যা ছিল নেহাত নাচগান ও সস্তা গল্পের বিনোদন, অর্থাৎ শহুরে লোকনাট্য, তা ধীরে ধীরে বাস্তবতার চুম্বনে সময়ের রেখাচিত্রে রূপান্তরিত হয়ে যায়। ভারতীয় সিনেমার ইতিহাস রচয়িতারা বারে বারেই দাবি করেন এই যে, ক্যামেরা স্টুডিয়োর বাইরে বেরিয়ে এল, সে সাধারণ মানুষের তুচ্ছ গল্প বলার অধিকার পেল, প্রথমে সত্যজিৎ রায়ের “পথের পাঁচালী”তে। তারপর সেই প্রবণতা ছড়িয়ে পড়ল ঋত্বিক ঘটক,মৃণাল সেন ও রাজেন তরফদার-সহ বাংলা সিনেমার আনাচেকানাচে।

যদি আরও গুরুত্বের সঙ্গে বিচার করা যায়, তা হলে দেখা যাবে ইতালীয় সেই নববাস্তববাদ গাঙ্গেয় উপত্যকাকে প্লাবিত করার আগেই, হানা দিয়েছিল আরব সাগরের তটরেখায়। বিমল রায় তাঁর “দো বিঘা জমিন” (১৯৫৩) ছবিতে যে ভূমিহীন চাষির কাহিনি বললেন, তাঁর সাহস ও উদ্দীপনা তৈরি হয়েছিল বে-রোজগার  আন্তোনিয়ো রিখি-র দুর্ভাগ্যলিপি থেকেই।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে, সীমাহীন বেকারত্বের যুগে, বেচারা আন্তোনিয়ো রিখি একটা চাকরি পায়: শহরের পথে পথে সিনেমার পোস্টার সাঁটতে হবে। চাকরির শর্ত মেটাতে কোনওক্রমে সে একটা পুরনো সাইকেল কেনে এবং প্রথম দিনেই সেটা চুরি হয়ে যায়। আপাতভাবে একজন গরিবের জীবনে, ইতালির রুগ্ণ ইতিহাসে, সাইকেল চুরি তেমন একটা ঘটনাই নয়। কিন্তু রোম শহরে সেই ঘটনাকে যে খ্রিস্টের পুনরুত্থানের চেয়েও বড় ব্যাপ্তি দেওয়া যায়, তা শিল্পী বলেই ডি’সিকা প্রমাণ করতে পেরেছিলেন।

বিমল রায়ের ছবিতে যখন ভূমিচ্যুত কোনও গ্রাম্য কৃষক, হাতে টানা রিকশা চালায়, তখন তা আসমুদ্র হিমাচলের আকাশে বিদ্যুৎবহ্নি! সামান্য একটা হাতে টানা রিকশা– যা এক কালে ভারত, চিন, দক্ষিণ এশিয়ার নানা শহরে স্থানীয় পরিবহনের অঙ্গ ছিল, তা হয়ে ওঠে গ্রাম-শহরের অন্তর্বর্তী সাঁকো। কী অলৌকিক সমাপতন যে ডি’সিকার সাইকেল আর বিমল রায়ের রিকশা দারিদ্রের ম্যানিফেস্টোতে রূপক হিসেবে কাজ করে। রিকশা বিষয়ে আবেগ-বিধুরতা প্রকাশ করার সময় মনে রাখতে হবে, এই রিকশাটি শ্রম-অভিযাত্রা নিয়ে ভারতে আধুনিকতা বিষয়ে এক প্রাসঙ্গিক মন্তব্য। ডিসিকার বাইসাইকেল চোর ছবিতে অসহায় নায়কের ভূমিকায় ছিলেন লাম্বার্তো মাজিয়োরানি, এক জন অশিক্ষিত রাজমিস্ত্রি। আর এই মানুষটিকে ডিসিকার পছন্দ হওয়ার কারণ, তিনি সিনেমার চলাচলে অনভ্যস্ত তাই অভিনয় করতেই পারবেন না। গরিবরা সাধারণত নির্বাক, অভিব্যক্তিহীন হন। ডিসিকা তা-ই চেয়েছিলেন। সে জন্যই নিজে এক জন সুদর্শন ও রোম্যান্টিক নায়ক হওয়া সত্ত্বেও বেছেছিলেন এক জন মজুরকে, যিনি নামহীন নাগরিকে পর্যবসিত হবেন। কোনও ছদ্মবেশী দেবতা বলে যাঁকে মনে হবে না।

সেই তুলনায় বিমল রায়ের রিকশাচালকের কাজটা কঠিন। এই ভূমিকাকে নশ্বরতামুক্ত করে রেখে গিয়েছেন বলরাজ সাহনি, যিনি ইংরেজি, উর্দু ও হিন্দি ভাষায় অনায়াস স্বচ্ছন্দ, বিলেতে বিবিসি-তে নিয়মিত ঘোষক ছিলেন এবং তার আগে ত্রিশের দশকে শান্তিনিকেতনে ইংরেজি ও হিন্দি পড়াতেন। বাস্তবিক, শান্তিনিকেতনের দাম্পত্যই তাঁকে রবীন্দ্রনাথের “দুই বিঘা জমি” কবিতাটি পড়তে ও আত্মস্থ করতে প্ররোচনা দেয়। তথ্য এই, “দো বিঘা জমিন” ছবিটির চিত্রনাট্যকার ছিলেন হৃষিকেশ মুখার্জি ও পল মহেন্দ্র। কিন্তু সত্যত রবীন্দ্রনাথের কবিতার পরিগ্রহণ ও সম্প্রসারণের যে সমকালীন মলাট, তা বলরাজ সাহনি ছাড়া বিমল রায় ভাবতেও পারতেন না। “শুধু বিঘে দুই ছিল মোর ভুঁই, আর সবই গেছে ঋণে।/ বাবু বলিলেন, ‘বুঝেছ উপেন? এ জমি লইব কিনে।’”—এটুকু জানার পর নিম্নবর্গীয় চাষি শম্ভু মাহাতো আদালতে যায় ও নিঃস্ব হয়। অতঃপর তার কলকাতায় আগমন। সঙ্গে, তার পিতার অমতেই আসে ছেলে কানহাইয়া।

আমাদের মনে পড়ে বাইসাইকেল থিভস। সেখানেও তো রোমের রাজপথ পর্যটনে হতভাগ্য জনকের সঙ্গী ছিল বালকপুত্র ব্রুনো। বিমল রায়ের ক্যামেরা যে প্রযত্নে হাওড়া স্টেশন, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের দৃশ্যাড়ম্বর হরণ করেছে, তাতে কমলকুমার মজুমদার থাকলে হয়তো বলতেন, “গ্রাম্যরা যে চোখে পাথরে কোঁদা যক্ষিণী দেখে” সে ভাবেই প্রাণহীন এই শহরের ইতিকথাও উন্মোচিত হয়েছে। আর কী অসামান্য় এই রিকশাওয়ালা—মোটেই ধীরোদাত্ত নয়, বরং নিয়তির দ্বারা নির্যাতিত, ভাগ্যের অভিশাপে নিথর। তাঁর সমস্ত আভিজাত্য ভুলে গিয়ে সর্বহারা চাষির ভূমিকায় নিজেকে মিশিয়ে দিতে পেরেছিলেন বলরাজ সাহনি। হয়তো ইতিপূর্বে আইপিটিএ-র অভিজ্ঞতা তাঁকে অঙ্গাবরণী দিয়েছে, আব্বাস সাহেবের “ধরতী কে লাল” (১৯৪৬) ছবিটি তাঁকে অভিমুখ দেখিয়ে দেয়। তবু তথাকথিত উন্নয়ন প্রক্রিয়া কী ভাবে পল্লিদেবতাকে শহরের রাজপথে নিগৃহীত করে তার প্রামাণ্য ও ধ্রুপদী দলিল এই “দো বিঘা জমিন”।

এই রিকশা নিয়ে শম্ভু মাহাতো চেষ্টা করে ঘোড়ার গাড়ির সঙ্গে দৌড়তে। সে পারবে না, এ পরাজয় পূর্বনির্ধারিত। কর্ণের মতোই তার চাকা বসে যায়, সে অচল হয়। কী অসামান্য সেই মুখের বৈভব বলরাজ সাহনির। ভারতীয় ইতিহাসে অধিরথ সুতপূত্র ছাড়া কেউ তার তুলনা নেই।

ভূমিহারা মৃত্তিকার সন্তানের জীবনী এত তীব্র ও মর্মান্তিক ভাবে এঁকে গেলেন বিমল রায়! অবাক হয়ে যাই, এই যন্ত্রের শহরে হাওড়া ব্রিজ, ভিক্টোরিয়া, মনুমেন্ট, ময়দানকে ছাড়িয়ে, যন্ত্রণার অবিনশ্বর স্মারক একটি যান: সামান্য হাতে টানা রিকশা ও তার বিধিনির্দিষ্ট চালক বলরাজ সাহনি। এই রিকশাটি পরিযায়ী। ভারতীয় কৃষক ও শ্রমিকের চিরকালীন ম্যাজিক কার্পেট!

sanjay-mukhopadhyay

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনেমার মাস্টার মশাই ছিলেন বলে বা সরকারি প্রতিষ্ঠান 'রূপকলা কেন্দ্র'-র অধিকর্তা ছিলেন বলে তাঁর নামের পাশে 'চলচ্চিত্রবেত্তা' অভিধাটি স্বাভাবিক ভাবেই বসে যায়। আসলে কিন্তু সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় একজন চিন্ত্যক ও আমাদের সাংস্কৃতিক আধুনিকতার ভাষ্যকার। কাব্য বা উপন্যাস, চিত্রকলা বা নাটক,জনপ্রিয় ছায়াছবি বা রবীন্দ্রসংগীত-যে কোন পরিসরেই সঞ্জয় এক ধরনের মৌলিক ভাবনার বিচ্ছুরণ ঘটান। সেই মনোপ্রবণতায় আকাদেমিয়ার জীবাশ্ম নেই বরং ছড়িয়ে থাকে মেধার কারুবাসনা। আলোচনাচক্রে, দেশে ও বিদেশে,বৈদ্যুতিন মাধ্যমের ভাষনে তিনি প্রতিষ্ঠিত বক্তা। ঋত্বিক ঘটকের প্রবন্ধাবলী সহ সম্পাদনা করেছেন একাধিক গ্রন্থ। অনুবাদ করেছেন ছটি বিখ্যাত সিনেমার চিত্রনাট্য। তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা আট। একমাত্র উপন্যাস 'বুনো স্ট্রবেরি' ইতিমধ্যেই তরুণ মহলের নজরে। হাইকোর্টসঙ্কুল এই শহরে তিনি নিজেকে 'আমুদে বাঙাল' ভেবেই খুশি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *