অনুভবের বৈচিত্র্য এবং প্রকাশভঙ্গির সারল্য কখনো কখনো কবিতার সম্পদ হয়ে উঠতে পারে। অঞ্জনা বসুর অনেক কবিতাই তার উদাহরণ। তাঁর কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য স্বতঃস্ফূর্ততা ও স্বচ্ছতা। সেটা অধিকাংশক্ষেত্রেই পাঠককে স্পর্শ করেছে। তাঁর রবীন্দ্র-বিষয়ক কবিতাগুচ্ছের মধ্যে যে ঘন আবেগের স্ফূরণ আছে তা প্রচলিত কবিস্তুতির চেয়ে অনেকটাই স্বতন্ত্র। তিনি যখন বলেন,
“যে স্টেশন থেকে তোমার রেলগাড়ি
ছাড়ল এক অজানা দেশের উদ্দেশে,
তার ঠিক পরেই আমার রেলগাড়ি এসে
থামল ঐ একই স্টেশনে
মাঝখানে রইল ক্ষণকালের ব্যবধান”
তখন সংহত বেদনার আভাস তাঁর উচ্চারণকে দেয় এক অনন্যতা। কিন্তু সেই সঙ্গে একথাও বলবার, যিনি এভাবে বলতে পারেন , তিনি কেন আর একটু মিতভাষী নন! মাঝে মাঝে অতিরিক্ত প্রাঞ্জলতা কবিতাকে একেবারে আটপৌরে করে দেয় , যাকে কবিতা বলে চেনা মুশকিল হয়।
এই কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলিকে বিষয়ের ভিত্তিতে তিন ভাগে ভাগ করা যায়– ব্যক্তিগত অনুভবভিত্তিক, পৌরাণিক কাহিনিভিত্তিক এবং পারিপার্শ্বিক সচেতনতাভিত্তিক। প্রথমোক্ত কবিতার মধ্যে বেশ কিছু কবিতা রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর সৃজন সম্পর্কে কবির উপলব্ধির অভিব্যক্তি। “একটি নমস্কারে”, “ফিরে এসো কবি”, “বাইশে শ্রাবণ”, “অন্তরঙ্গ”, “অবুর এপার-ওপার”, “অমল-সুধার প্রেম-কাহিনি” এই জাতীয় কবিতা। শেষোক্ত কবিতায় একটি গাছ ও একটি নদীর রূপকল্পে অমল ও সুধার পুনর্নির্মাণ মন ছুঁয়ে যায়। এই কবিতাগুলি ভাবনার মৌলিকতায় রূপকল্পের ব্যবহারে স্বতন্ত্র উল্লেখের দাবি রাখে। পুরাণভিত্তিক কবিতা মাত্র একটি আছে — “ভীষ্মের প্রতি”। তবে এটিকে কবির সমাজসচেতনতার প্রকাশ বলে গণ্য করলেও ভুল হবে না। সমাজে নারীর অবস্থান নিয়ে যেসব কবিতা তিনি লিখেছেন, একে তার মধ্যে অনায়াসেই ফেলা যায়। পারিপার্শ্বিক অসংগতি বা অন্যায়ের বিরুদ্ধে যেখানে তিনি সরব হয়েছেন, সেখানে আর একটু ইঙ্গিতধর্মী হলে কবিতাগুলি আরও মর্মস্পর্শী হত।
“স্তবক” নামটির মধ্যে এই কাব্যগ্রন্থের নির্যাস নিহিত। আকাশনীল প্রচ্ছদে প্রস্ফুটিত পুষ্পস্তবক নানা বর্ণে রসে রঞ্জিত কাব্যপংক্তির একটি স্তবক হয়ে উঠেছে । তবে গ্রন্থের বহিরঙ্গে যে যত্নের ছাপ স্পষ্ট, কবিতার বিন্যাসে তা কিঞ্চিৎ অনুপস্থিত। আর একটু পরিকল্পনা করে কবিতাগুলিকে সংকলিত করলে বিষয়বৈচিত্র্যের দিকটি আরো পরিস্ফুট হত। এ বার কয়েকটি ভালো-লাগা কবিতার কিছু পংক্তি উদ্ধৃত করা যাক বরং।
“একটি জীবন শুধু পদ্মপত্রে জল নয়।
একটি জীবন কখনো বা
পাহাড়ের মতো ভারী হয়।
একটি জীবন শুধু নিরুচ্চার বটবৃক্ষ
শিকড় নামিয়ে দেয়
ভূগর্ভের অনেক গভীরে।
টেনে আনে সমস্ত নির্যাস”
এ কবিতাটির নাম মিলন-বাসর। কবিতার অন্তর্লীন জীবনবোধের গভীরতা পাঠককে নাড়া দেয়। জীবন-মৃত্যুর বৈপরীত্য সত্ত্বেও তাদের পারস্পরিক একাত্মতা কবি খুব সূক্ষ্ম ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।
“ঘুম, ঘুম, ঘুম। শিখণ্ডির ক্লান্ত
দুচোখে ঘুমভার নেমে আসছে।
আজ আর নিদ্রাহীন আঁখি মেলে
আকাশের তারা গুনবে না সে।
আজ কুরুক্ষেত্রের বিশাল প্রান্তরে
সুতীক্ষ্ণ শর যাঁর শয্যা,
সেই চির-একা মহাবাহু ভীষ্মের
কথা ভাবতে ভাবতে
শিখণ্ডি গভীর নিদ্রায় মগ্ন হবে।”
এই কবিতার নাম ভীষ্মের প্রতি। আগেও একবার এই কবিতাটির নাম করেছি। এখানে রাজকুমারী অম্বার দৃষ্টিকোণ থেকে ভীষ্মের চরিত্রের বিশ্লেষণ খুবই অন্যরকম। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, পরবর্তীকালে অম্বার শিখণ্ডি হওয়ার কাহিনির মধ্যে দিয়ে সমাজে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের অস্তিত্ব-সঙ্কটের এক মরমী উচ্চারণ খুঁজে পাওয়া যায় এখানে।
“আজ কতকাল পরে এই একুশ শতকে বসে
তোমার জীবনস্মৃতির পাতা খুলে দেখি,
চার দেওয়ালের আন্দামানে এক বাউল-মন
শিশুর একলা নি:সঙ্গ দুপুর।
দেখতে পাই , সন্ধেবেলা ফ্যাকাশে প্রদীপের
আলোর নীচে পুঁথির কালো কালো অক্ষর
ভয় দেখাচ্ছে ক্লান্ত , শ্রান্ত নিদ্রালু
এক অনীহ বালককে।
তখন একুশ শতকের এই মায়ের বুকে ব্যথা বাজে।”
এই কবিতাটির নাম অবুর এপার-ওপার। রবি ঠাকুরের অবু চরিত্র এ কাব্যের মূলে। বস্তুত, এ রকম বেশ কয়েকটি কবিতা রয়েছে এই সঙ্কলনে যাদের কথা গোড়াতেই উল্লেখ করেছি। এই কবিতাগুচ্ছের বৈশিষ্ট্য, এগুলি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে রচিত হলেও এদের বাচনভঙ্গি একেবারেই ভক্তের প্রণামের মতো নয়। যেমন এই কবিতাটিতেই ছোট্ট অবুর প্রসঙ্গ টেনে শিশু হিসেবে রবীন্দ্রনাথকে কল্পনা করে তাঁর প্রতি যে ভাবে এক মাতৃত্বের বন্ধন রচনা করেন কবি, তা সত্যিই ব্যতিক্রমী।
ইংরেজি সাহিত্যে লেডি ব্রাবোর্ন কলেজের মেধাবী ছাত্রী সুতনুকা কর্মজীবন শুরু করেছিলেন আজকাল-এ সাংবাদিকতা দিয়ে, গৌরকিশোর ঘোষের সাহচর্যে। কাজ করেছেন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, হামদি বে, তপেন চট্টোপাধ্যায়ের মতো কিংবদন্তীদের সঙ্গে। পরে সরকারি স্কুলে ইংরেজি সাহিত্যের মাস্টারিতে মনোনিবেশ করেন। তবে কবিতার সঙ্গে তাঁর ওঠাবসা-ভালোবাসায় ছেদ পড়েনি কখনও। কবিতা ছাড়াও লিখেছেন প্রবন্ধ, ছোটদের ইংরেজি শেখানোর কলাম, ছোটগল্প। বর্তমানে অবসর জীবন কাটাচ্ছেন দেশ-বিদেশ ঘুরে আর অজস্র বই পড়ে।
I am supporting thisSamalochola