প্রয়াত টেরি প্র্যাচেটের সঙ্গে এখনকার ওয়েব-সিরিজ পিপাসু ভারতীয় তরুণ প্রজন্ম কতখানি পরিচিত জানি না, তবে বিশ্বসাহিত্যে ‘ফ্যান্টাসি‘ ঘরানার বিশ্রুত লেখকদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। ‘পাতাল লোক’ দেখার সময় তাঁর কথা কেন বারবার মনে পড়ছিল, তার পুরোটা বোঝাতে গেলে অনেক কথা বলতে হয়। অতটা দরকার নেই। তবে তাঁর লেখা আমার অতি প্রিয় একটি বই “Guards, guards!!!” এর ভূমিকা থেকে খানিকটা তুলে দিলে হয়তো ব্যাপারটা কিছুটা পরিষ্কার হবে।
“Whatever the name, their purpose in any work of heroic fantasy is identical: it is, round about Chapter Three (or ten minutes into the film) to rush into the room, attack the hero one at a time, and be slaughtered. No one ever asks them if they wanted to. This book is dedicated to those fine men.”
বাংলা তর্জমায় – “… সাধারণ দেহরক্ষী, পদাতিক, পুলিশ – যে নামেই ডাকা হোক না কেন, প্রায় সব বীররসাত্মক কাহিনীতেই এঁদের ভূমিকা প্রায় এক। উপন্যাসের তৃতীয় পরিচ্ছেদ নাগাদ (বা সিনেমার ক্ষেত্রে, মিনিট দশেকের মাথায়) এঁরা অকুস্থলে দৌড়ে আসেন, একে একে নায়ককে আক্রমণ করেন, এবং খেলাচ্ছলে প্রহৃত/নিহত হন। তাঁদের কেউ জিজ্ঞেস করেনি তাঁরা এই পরিণতি চেয়েছিলেন কি না। এই উপন্যাসটি সেই অসামান্য মানুষগুলির উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত…”

পাতাল লোকও এরকম কিছু দাবার বোড়ের গল্প। একটি আদ্যন্ত ডার্ক থ্রিলার; কিন্তু ‘গ্যাংস অফ ওয়াসেপুর’ বা ‘সেক্রেড গেমস’-এর মতো নোয়ারসুলভ পৈশাচিক বীভৎসতা অল্প কিছু দৃশ্য ছাড়া মাত্রায় তুলনামূলক ভাবে অনেক কম। হয়তো এত সযত্নলালিত বলেই পাতাল লোকে এই দৃশ্যগুলির অভিঘাতও অনেকটা বেশি।
তবে সেটা সিরিজটার মূল সুর নয়। মূল সুর একটাই… ক্রমবর্ধমান অস্বস্তি। ঠান্ডা ঘরে, নরম সোফা কৌচে গা এলিয়ে দামী স্মার্টফোনে ওয়েব সিরিজ ‘বিঞ্জ’ করা দর্শকমাত্রেই জানেন, অনস্ক্রিন ‘পুওর ইন্ডিয়া’জ অপ্রেশন‘ দেখে ফেসবুকে জ্বালাময়ী আপডেট দেওয়ার মেজাজই আলাদা। এই বেচে এর আগে বহু সিনেমা-সিরিজ হিট করেছে; ভবিষ্যতেও করবে নিশ্চয়। কিন্তু পাতাল লোক সেখানে একটু ব্যতিক্রম। আসলে পরিচালকদ্বয় অবিনাশ অরুণ আর প্রোষিত রায়ের খাপছাড়া বেয়াদপির ফলে ঘামে ভেজা, ভিড়ে চ্যাপ্টা ওই ‘বিশ্রি দেখতে‘ ভারতের সঙ্গে দর্শকের আরামদায়ক দূরত্বটা থাকে না।
কী বেআক্কেলে পরিচালক দু’টো! কোথায় সাধারণ নিম্নমধ্যবিত্ত লোকগুলোর প্রাত্যহিক মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা, বেঁচে থাকার লড়াই এবং সর্বোপরি ধনী ভারতের হাতে বঞ্চনা – এইসব দিয়ে একটা জম্পেস চাট বানিয়ে অলস সন্ধ্যায় সিঙ্গল মল্টের সঙ্গে পেশ করবেন, তা না আপনারা তাদের একেবারে দর্শকের বৈঠকখানায় এনে সামনে আয়নার মত দাঁড় করিয়ে দিলেন!

সিরিজের মূল চরিত্রগুলির মধ্যে এক সঞ্জীব মেহরা (নীরজ কবি) ছাড়া সবাই সমাজের নিম্নবিত্ত মানুষ, যাঁদের আমরা রোজ দেখি, রাস্তায়, অফিসে, দোকানে, বাজারে। কিন্তু লক্ষ্য করি না। আবছা অবয়বের মতো জীবনের বিভিন্ন প্রয়োজনে তাঁদের সঙ্গে কচ্চিৎ কদাচিৎ মোলাকাত হয় বটে, কিন্তু সেই প্রয়োজনের পরিসরের বাইরে তাঁরা কী ভাবে থাকেন, কী ভাবে বাঁচেন আর উঁচুতলার মানুষের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কতখানি অসহায়, – সেটা স্বাচ্ছন্দ্যের পক্ষে একটু বেশিই তীব্রভাবে মনে পড়িয়ে দেয় পাতাল লোক।
পাতাল লোক দর্শন-অভিজ্ঞতার কথা বলতে গেলে প্রথমেই যেটার কথা বলতে হবে, সেটা হলো চিত্রনাট্য ও পরিচালনা। অসম্ভব টানটান। সিরিজ বেশ কয়েকবার মূল ঘটনাস্রোত থেকে বেরিয়ে চরিত্রগুলোর নেপথ্য কাহিনিতে যাওয়া-আসা করেছে। এমনকি মূল ঘটনার বাইরে ছোটোখাটো অন্যান্য গল্পও কিছু আছে। কিন্তু গোটা সিরিজে বাড়তি কোনও মুহূর্ত পাওয়া ভার। নিঃশ্বাস ফেলতে দেয় না সিরিজটা শেষ পর্যন্ত। এই মেদহীনতা ছাড়াও অবশ্য এই চিত্রনাট্যের একটা বিশাল পাওয়া, যে ভাবে গল্পটা চিত্রনাট্যকার সুদীপ শর্মা ও তাঁর টিম বিভিন্ন এপিসোডে বিভিন্ন চরিত্রের চোখ দিয়ে কিছুটা, আবার কিছুটা প্রাইমারি ন্যারেটিভে বলেছেন। মানে এই স্টাইলটা নিঃসন্দেহে খুব নতুন নয়, কিন্তু বলবার কায়দায় এইখানে সেটা একটা অন্য মাত্রা পেয়েছে। সত্যি বলতে কি, একটা ওয়েব সিরিজে যে এই ন্যারেটিভ সিনেমার থেকেও অনেক অনেক বেশি কার্যকর হতে পারে, সেটা এর আগে উপলব্ধি হয়নি।

সিরিজের দ্বিতীয় পাওনা অভিনয় এবং তার শীর্ষে সিরিজের ‘নায়ক‘ হাথিরাম চৌধরী (জয়দীপ আহলাওয়াত)। ইনি দিল্লির একটি অত্যন্ত অনামী, অবহেলিত থানার সামান্য সাব ইনস্পেক্টর। অসম্ভব মাথা গরম, খিটখিটে, ছেলের সঙ্গে বিশ্রি ব্যবহার করেন, গায়ে হাত তোলেন না বলে ছেলের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত বলে মনে করেন। আবার অন্যদিকে সৎ, খুব সহজ ভাবে সেকুলার, জেদি এবং গোয়েন্দা হিসেবেও নেহাত ফেলনা নয়। এরকম বৈপরীত্যে ভরা রক্তমাংসের চরিত্র সম্বন্ধে দর্শকদের সহানুভূতি আদায় করার চেষ্টা করতে গেলে স্টিরিওটাইপের ফাঁদে পা দেবার প্রবল সম্ভাবনা। সেটা যে হয়নি, তাতে স্ক্রিপ্টের বেশ খানিকটা সহায়তা থাকলেও সিংহভাগ কৃতিত্ব জয়দীপের। নিঃসন্দেহে এই সিরিজের শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার।
সঞ্জীবের চরিত্রে নীরজ কবি যথারীতি অনবদ্য। তাঁর চরিত্র সম্পর্কে বেশি বলতে গেলে গল্পের অনেকটাই বলে ফেলতে হয়। তাই অত ভিতরে না গিয়ে বলা যাক, একটা নেতিবাচক চরিত্র যে শুধু অনায়াস অভিনয়ের সূক্ষ্মতায় কতটা স্তরীভূত হয়ে উঠতে পারে, ডিটেকটিভ ব্যোমকেশ বক্সির অনুকূল ডাক্তার এবং সেক্রেড গেমসের পারুলেকরের পর আবার প্রমাণ করলেন নীরজ। তৃতীয়ত, বিশাল ত্যাগীর চরিত্রে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘স্ত্রী’ সিনেমায় ‘জানা’-র চরিত্রে যাঁরা তাকে দেখেছেন, হলফ করে বলতে পারি, তাঁদের পক্ষে এই চরিত্রটিতে তাঁকে কল্পনা করা প্রায় অসম্ভব। সঈফ আলি খানের ল্যাংড়া ত্যাগী আর তব্বুর লেডি ম্যাকবেথ ছাড়া আর কোনও অভিনেতার বিবর্তনে এহেন বিস্মিত হয়েছি বলে মনে তো পড়ে না!

হাথিরামের স্ত্রী রেণু চৌধরীর চরিত্রে গুল পনাগ সতেজ বাতাসের মতো। অনেকদিন বাদে পর্দায় দেখা গেল তাঁকে। অন্যদের মধ্যে ইমরান আনসারির চরিত্রে ঈশ্বক সিং দাগ কাটেন। নীরজের স্ত্রী ডলির চরিত্রে স্বস্তিকা ভালোই, তবে একটু ম্যানারিজম চলে এসেছে। যদিও তাঁর বিশেষ কিছু করার ছিল না। সারা ম্যাথিউসের চরিত্রে নিহারীকা দত্ত মন্দ নয়। আরেক বাঙালিনী অনিন্দিতা বোস একটিই মাত্র এপিসোডে চলনসই অভিনয় করেছেন।
এছাড়া সিরিজে ক্যামেরার কাজের মুন্সিয়ানা লক্ষ্যণীয়। অবিনাশ অরুণ আর সৌরভ গোস্বামী বেশ কিছু শট নিয়েছেন যা দৃশ্যগুলিকে আলাদা মাত্রা দেয়। অভিষেকের স্কুলের দৃশ্য, বা লক আপে হাথিরাম আর মেরি লিংডোর কিছু দৃশ্য এরকম কয়েকটি উদাহরণ। অবশ্য সিরিজের মিউজিক সম্পর্কে দেখার আগে যতটা শুনেছিলাম, ততটা নয়। মানে বেশ ভালো, তবে আহামরি মনে হয়নি।
এবার আসি ক্লাইম্যাক্সের কথায়। মোচড় বা ‘প্লট টুইস্ট‘ জিনিসটা আধুনিক সিনেমা-সিরিজের কল্যাণে এতই বহুলব্যহৃত, যে দশ বারোটা টুইস্ট ছাড়া একটা থ্রিলার কেউ বানালে কাগজে খবর হবে। এবং এই সিরিজও যথারীতি তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু এর শেষ টুইস্টটা বেশ অদ্ভুত। নতুন রকম। আশা করি সীমিত সময়ের আধুনিক থ্রিলার যত তৈরি হবে, এরকম ক্লাইম্যাক্স আরও দেখব।
আর কী, এখনও বসে আছেন? লকডাউনও উঠে গেছে। এরপর পট করে আপিস কাছারি যাওয়া শুরু হলে বাড়িতে শুয়ে ওয়েব সিরিজ বিঞ্জ করার বিলাসিতা দুর্লভ হয়ে পড়বে। যান যান, সময় থাকতে দেখে ফেলুন। বাজারে এ দিকে ‘চোকড‘ এসে গেল!
পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। তিতিবিরক্ত হতে হতেও আইটি শিল্পতালুকে মজদুরি করতে বাধ্য হন। কিন্তু সবচেয়ে পছন্দের কাজ হাতে মোবাইলটি নিয়ে আলসেমি করে শুয়ে থাকা। চেহারাছবি নিরীহ হলেও হেব্বি ভালোবাসেন অ্যাকশন ফিলিম, সুপারহিরো আর সাই ফাই। সঙ্গে চাই সুরেশের রাবড়ি, চিত্তরঞ্জনের রসগোল্লা-পান্তুয়া, কেষ্টনগরের সরভাজা ইত্যাদি নানাবিধ মিষ্টান্ন।
ভালো আর মন্দ, দুরকম মন্তব্যই পড়েছিলাম। তাই দেখব, দেখব না, দেখব’খন – এরকম অবস্থানে ছিলাম। কিন্তু দেখতে বসলে “ঘামে ভেজা, ভিড়ে চ্যাপ্টা, বিশ্রী দেখতে” ভারত যে ঘরে ঢুকে পড়ে, সেকথাটা কেউ বলেননি। ‘সেক্রেড গেমস’ ডার্ক থ্রিলার হলেও, তার চরিত্রদের সঙ্গে আমার বা আমাদের নিত্যদিন দেখা সাক্ষাৎ হয়না। আর,সে প্রসঙ্গ এসেছে তো অভিনয়ের সূত্রে। কিন্তু ‘পাতাললোক’ ঠিক কতটা ডিস্টার্বিং? ‘আর্টিকল ফিফটিন’-এর চেয়েও বেশি? নাহ, এবার তো নিজেকেই মীমাংসা করতে হবে।
আর্টিকল ফিফটিন আমি দেখিনি ধ্রুবদা। তবে এই সিরিজটার কথা বলতে পারি, এই সিরিজের অস্বস্তিটা ঠিক ধাক্কা দেয় না। তিলে তিলে, কুরে কুরে খায়।