ঊষাদি, মানে ঊষা গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার পরিচয় হয় আশির দশকে। তখন আমি গোবরডাঙায় থাকি। টুকটাক নাটক করি আর একটা পত্রিকা চালাই। পত্রিকার নাম ছিল ‘শিল্পায়ন’। একদিন শিল্পায়নের জন্য ঊষাদির একটা সাক্ষাৎকার নিতে ওঁর কড়েয়া রোডের বাড়িতে যাই। সেই সাক্ষাৎকারে ঊষাদি একেবারে মনপ্রাণ খুলে একটা লম্বা আড্ডা দেন। সেটাই আমাদের আলাপের শুরু।

নব্বইয়ের গোড়ায় আমি কলকাতা চলে আসি। তখন আমি কেয়া চক্রবর্তীকে নিয়ে কিছু কাজ করতে চাইছিলাম। ঊষাদিকে সে কথা জানাতেই আপ্লুত হয়ে আমাকে সমস্ত রকমভাবে সাহায্য করার আশ্বাস দিয়েছিলেন। ঊষাদি কেয়া চক্রবর্তীকে অসম্ভব ভালোবাসতেন। যাঁদের অনুপ্রেরণায় ঊষাদি থিয়েটার করতে আসেন, কেয়া চক্রবর্তী তাঁদের মধ্যে অন্যতম। ঊষাদির কাছেই শুনেছি, ওঁর বিয়ের রেজিস্ট্রেশনে সাক্ষীদের মধ্যে একজন ছিলেন কেয়া চক্রবর্তী। কেয়া যখন মারা যান তখন নাকি ঊষাদিরই একটা শাড়ি পরেছিলেন। নাট্যজগতের আরও যে দুই নারী ওঁকে থিয়েটার করার অনুপ্রেরণা এবং সাহস জুগিয়েছিলেন তাঁরা হলেন তৃপ্তি মিত্র এবং নটী বিনোদিনী। ওঁর প্রতিষ্ঠা করা ইন্টিমেট থিয়েটারের নামও রেখেছিলেন বিনোদিনী কেয়া মঞ্চ। ওঁর ইচ্ছে ছিল মঞ্চে বিনোদিনীর ভূমিকায় অভিনয় করার, কিন্তু সেই ইচ্ছে আর সফল হয়নি।

ঊষাদির স্নেহ এবং বন্ধুত্ব যাঁরা পেয়েছেন তাঁরা প্রত্যেকেই জানেন, খুব কম মানুষই ঊষাদির মতো করে বন্ধুদের পাশে দাঁড়াতে পারেন। যখন পত্রিকা চালাতাম, ঊষাদি একটা অসম্ভব ভালো লেখা লিখেছিলেন আমার পত্রিকার জন্য। এমনকি বিজ্ঞাপনও জোগাড় করে দিয়েছিলেন। শুধু জোগাড় করেই ক্ষান্ত দেননি, বিজ্ঞাপনের টাকা সময়মতো পেয়েছি কিনা, সেই খোঁজও নিতেন।

আমার থিয়েটার শুরু করার পেছনেও ঊষাদির অনুপ্রেরণা কাজ করেছে। ঊষাদি, আশিস গোস্বামী, এঁরা সেই সময় আমার পাশে না দাঁড়ালে হয়তো আমি থিয়েটারের দল শুরুই করতে পারতাম না। তারপর নয়ের দশকেই একসময় ‘সংসৃতি’র যাত্রা শুরু হল। আমি ঠিকই করেছিলাম, আমি যদি কোনওদিন দল করতে পারি, তার প্রথম অনুষ্ঠান হবে ঊষাদিকে নিয়ে। সেই পরিকল্পনা মাফিক ১৯৯৪ সালে আমাদের প্রথম অনুষ্ঠান ছিল ‘ঊষার মুখোমুখি’ সেমিনার। সেমিনারটা হয় বাংলা অ্যাকাডেমি প্রেক্ষাগৃহে।

‘উইঙ্কল টুইঙ্কল’ মঞ্চস্থ করার সময় নিজের ফ্ল্যাট বন্ধক রেখে টাকা জোগাড় করেছিলাম। ঊষাদি কী ভাবে যেন সেটা জানতে পেরে আমাকে প্রচণ্ড বকাবকি করেছিলেন। কিন্তু নাটকটা দেখার পর আমাকে জড়িয়ে ধরে প্রায় শিশুর মতো কান্নাকাটি করেছিলেন। মঞ্চে যেমন দাপটের সঙ্গে অভিনয় করতেন, পরিচালনা করতেন, মঞ্চের বাইরে ছিলেন তেমনই সরল সাদামাটা একজন মানুষ।

তখন আমার ‘ড্রিম ড্রিম’ নাটকের রিহার্সাল চলছে। শেই সময়ে একদিন বললেন “আমাকে নিয়ে একটা ডকুমেন্টারি কর।” সেই ডকুমেন্টারির কাজ শুরু করতে গিয়েই ওঁর নাটকের ডকুমেন্টেশনের কাজেরও শুরু। ওঁর প্রচুর নাটকের ডকুমেন্টেশনের কাজ করেছি। হঠাৎ করেই ফোন করে ডেকে পাঠাতেন। আমিও ক্যামেরা নিয়ে হাজির হয়ে যেতাম। ঘণ্টার পর ঘণ্টা রিহার্সাল এবং মঞ্চে উপস্থাপনার শ্যুট করেছি। তার মাঝে মাঝেই আমাদের আড্ডাও চলেছে।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রের মতোই নাটকের জগতেও পুরুষের আধিপত্য বেশ চোখে পড়ার মতো। কিন্তু এই মেল ডমিনেটেড নাট্যজগতে ঊষাদি একজন জনপ্রিয় এবং বিশিষ্ট মহিলা নাট্যকার হিসেবে দৃষ্টান্ত। হিন্দি ভাষায় থিয়েটার করলেও ঊষাদির থিয়েটার চিরকাল বাংলা থিয়েটারের সঙ্গে থেকেছে এবং বাঙালি দর্শকদের মধ্যে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। তথাকথিত হিন্দি থিয়েটারের বাইরেও একটা জায়গা তৈরি করতে পেরেছিলেন ঊষাদি। আবার হিন্দিভাষীদের মধ্যেও নতুন দর্শক তৈরি করতে পেরেছিলেন। কোনও ভাষার বন্ধনের  মধ্যে নাটককে আটকে রাখায় বিশ্বাসী ছিলেন না উনি। চেয়েছিলেন শিক্ষিত মধ্যবিত্তের গন্ডির বাইরে নিজের কাজ এবং নাটকের আর্ট ফর্মটা ছড়িয়ে দিতে। হাওড়ার কারখানা বেল্টে, কলকাতার এবং শহরতলির বসতি এলাকায় গিয়ে নাটক করেছেন। নাটকের ফর্ম নিয়েও কম পরীক্ষা নিরীক্ষা করেননি। শুধু প্রসেনিয়ামেই কাজ করেননি, মইয়ৎ কিংবা গিরগিট-এর মতো নাটক করেছেন, কাজ করেছেন ওপেন স্পেসে। আবার ইন্টিমেট থিয়েটার নিয়েও কাজ করেছেন। কত কম প্রপ নিয়ে স্পেসকে কত ভালো ভাবে মঞ্চে ব্যবহার করা যায় তাও উনি ওঁর কাজে দেখিয়েছেন। আজ পর্যন্ত ঊষাদির কোনও নাটক আমি কখনও মিস করিনি। ওঁর প্যাশন, জেদ, সর্বোপরি নাটকের প্রতি ওঁর ভালোবাসা দেখে মুগ্ধ হয়েছি।

রঙ্গকর্মীর একটা নতুন নাটকের রিহার্সাল চলাকালীন আমি শ্যুট করেছিলাম, কিন্তু সেটা আমার একেবারেই পছন্দ হয়নি। সপ্তাহ দুয়েক আগেই ওঁর সঙ্গে ফোনে সেটা নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। আমরা ঠিক করেছিলাম এই লকডাউনটা উঠে গেলে আবার নতুন করে ওই শ্যুটটা করব। সেটাই ঊষাদির সঙ্গে আমার শেষ কথা। আজ ঊষাদি চলে গেলেন। আমার নাট্যজীবনেরও একটা অধ্যায় যেন ওঁর সঙ্গে শেষ হয়ে গেল। ঊষাদি নেই, কিন্তু ওঁর কাছ থেকে শেখা জেদ আর কাজের প্যাশন আমার সঙ্গে থেকে যাবে আজীবন।

নাটকের জগতে দেবেশ চট্টোপাধ্যায় পরিচিত নাম। উইঙ্কল টুইঙ্কল, ব্রেন, ড্রিম ড্রিমের মতো একাধিক জনপ্রিয় ও সমাদৃত নাটকের পরিচালক। সম্প্রতি চলচ্চিত্র ও শর্ট ফিল্ম পরিচালনার কাজেও হাত দিয়েছেন।

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *