২০১৭ সালে প্রথমবার দেবেশদার বাড়ি যাই একটা ছোট পত্রিকার জন্য সাক্ষাৎকার নিতে। পরে নানা কারণে সাক্ষাৎকারটা প্রকাশিত হয়নি, কিন্তু আমার সঙ্গে দেবেশদার পরিচয়ের সেটাই সূত্রপাত। তারপর বহুবার ওঁর সঙ্গে লেখালেখি, পড়াশানোর ব্যাপারে প্রচুর আলোচনা হয়েছে, ওঁর কাছে প্রচুর উপদেশ, পরামর্শ এবং প্রশ্রয় পেয়েছি। দেবেশদা চলে গিয়ে আমার জীবনে এক অপূরণীয় শূন্যতা রেখে গেলেন।

দেবেশদার সঙ্গে আলাপচারিতা

দেবেশ রায় -‘বরিশালের যোগেন মণ্ডল নিয়ে যা বলার আমি তো ওই ১০৫০ পাতার মধ্যেই বলে দিয়েছি। আবার প্রশ্ন কেন?’

রিমি  – ‘না, আপনি তো যোগেন মণ্ডলকে অর্ধেকটা লিখেছেন। সমালোচনা নিন্দার মধ্যে দিয়ে যোগেনমণ্ডলের করাচী যাত্রায় উপন্যাসটি শেষ করেছেন। আরও কি কিছু বলার বাকি ছিল? উনি পাকিস্তানের আইনমন্ত্রী শ্রমমন্ত্রী হয়েও শেষপর্যন্ত ওঁকে ভরসা করে যে নমঃশূদ্ররা ভারতে আসেন নি, পাকিস্তানেই থেকে গিয়েছিলেন তাঁদেরকে ছেড়ে তো উনি একাই ফিরে এসেছিলেন। তাছাড়া, পূর্বপাকিস্তানে একের পর এক দাঙ্গা হয়ে চলেছে অথচ উনি নীরব ছিলেন। তাহলে যোগেন মণ্ডলকে পুরোপুরি আপনি লিখলেন না কেন? কেন এই অর্ধেক?’

দেবেশ রায় – অর্ধেক কেন হবে? একটা ১০৫০ পাতার উপন্যাস লিখে আমাকে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে? আপনারা উপন্যাসের মধ্যে কী খোঁজেন? হিন্দি সিনেমার নায়ক? আমার উপন্যাসে নায়ক নেই, মানুষ আছে। রক্ত মাংসের মানুষ যোগেন মণ্ডলের কথা লিখেছি। উনি কী করেন নি, কী করতে পারতেন এই বিশ্লেষণ করি নি। উপন্যাস তো বিশ্লেষণের জায়গা নয়। আর এরকম উপন্যাস নিয়ে প্রশ্নের উত্তর একজন লেখক দেবেনই বা কেন? তাহলে উনি শব্দখরচ করে উপন্যাসটা লিখলেন কেন?

রিমি – কিন্তু পাঠকের মনে তো প্রশ্ন আসবেই।

দেবেশ রায় –  আপনি পড়াশোনা করেন? কী পড়েন?

রিমি- আমি আপনার সব উপন্যাসই পড়েছি ‘মানুষ খুন করে কেন?’, ‘লগন গান্ধার’, ‘মফস্বলি বৃত্তান্ত’, ‘সময় অসময়ের বৃত্তান্ত’

দেবেশ রায়- না না, আমি ওই পড়ার কথা বলছি না। আপনি আপনার বিষয়ে কী কী পড়াশোনা করেন? নিয়মিত Economic Political Weekly  পড়েন? শেষ কোন সংখ্যাটি পড়েছেন?

রিমি- শেষ এবছর জানুয়ারির মাসের সংখ্যাটাই পড়েছি। মোদির পাকিস্তান নীতি বিষয়ক এডিটোরিয়াল লেখাটা।

দেবেশ রায় – সবকটা লেখাকে এককথায় বলুন দেখি। কী বলবেন?

চুপ করে রইলাম কিছুক্ষণ। এককথায় কী বলব? বাংলা সাহিত্যের জীবিত সবচেয়ে মেধাবী মানুষটির সামনে কী উত্তর দেব? কী উত্তর দেওয়া যায়? কিছু উত্তর অবশ্যই দিয়েছিলাম। কিন্তু তিনবছর আগের সেই উত্তর আজ আর মনে নেই। কারণ, ওঁর উত্তরটাই মাথার ভেতর সেঁধিয়ে রয়েছে। উনি বলেছিলেন,

-”ভারতবর্ষের প্রকাশ্য গোপনীয়তা। অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজ সর্বত্র। পারবেন এই বিষয়ের ওপর লিখতে? লিখুন দেখি? ‘ভারতবর্ষের প্রকাশ্য গোপনীয়তা’। কোনও সময়সীমা নেই, কোনও শব্দসংখ্যার সীমাও নেই। লিখতে পারলে আমাকে পাঠান। আমি সেতুবন্ধন-এ ছাপব।”

লেখা একটা দিয়েছিলাম। উনি সেতুবন্ধনে সেই লেখা প্রকাশও করেছিলেন। লেখাটি মেইল করার পর উনি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আপনার লেখাটি, যুদ্ধ নিয়ে, পড়লাম। নতুন করে ভাবা নতুন ভাবে দেখা, নতুন ভাষায় চমৎকার লেখা। আমি চেষ্টা করব পুজো সংখ্যায় ছাপতে যদি জায়গায় কুলায়। এরকম লেখাই চাই।– দেবেশ রায়’

স্তব্ধ হয়েছিলাম এই উত্তর পড়ে। এরপরও নববর্ষ বা বিজয়ার প্রণাম জানালে আশীর্বাদি উত্তরে বলেছেন, নতুন করে ভাবুন, কঠিন বিষয় নিয়ে লিখুন। বাংলা সাহিত্যে সত্তরের দশকেও তিনি ছিলেন সেই সময়ের তরুণ সাহিত্যিকদের স্পর্ধা। সত্তরের সেই তরুণরা আজ প্রবীণ। তাঁদের অনেকের স্মৃতিচারণেই দেবেশ রায়ের উৎসাহের কথা রয়েছে। সেই সত্তরেও তিনি যেমন তরুণদের লেখা নিজে থেকেই খুঁজে নিয়ে পড়তেন, তেমন ২০২০ পর্যন্তও এই সময়ের খ্যাত অখ্যাত তরুণদের লেখা পড়েছেন। সম্ভাবনাময় অনেকের সঙ্গেই তিনি কথা বলেছেন, কথা বলতে চেয়েছেন। আমাদের এই সময়ে যারা লেখালেখি করছি তাদের সকলের কাছেই এ এক বিরাট প্রাপ্তি।

সাক্ষাৎকার শব্দটা শুনে খুব রেগে গিয়েছিলেন সেই প্রথম দিন। বলেছিলেন,

-সাক্ষাৎকার আবার কী? এমনি কথা বলব। সাক্ষাৎকার দিতে পারব না।

জাদুবাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন করতেই আবার রেগে গিয়েছিলেন।

-এই আপনাদের ম্যাজিক রিয়ালিজম নিয়ে এত বাড়াবাড়ি কেন? ওটা মার্কেজের আমদানিকৃত নয়। আমাদের দেশের ময়নামতীর উপাখ্যান কী? অবশ্যই ম্যাজিক রিয়ালিজম। এই ধরুন আপনি ওই সিঁড়িটা দিয়ে উঠে আসছেন আমার ফ্ল্যাটের দিকে (খোলা দরজার বাইরে সিঁড়ির দিকে দেখালেন) এইবার আপনি পড়ে গেলেন। এখন আপনার ব্যথা হচ্ছে উঠতে পারছেন না। সেই সময় কোনও পরী এসে আপনাকে উঠিয়ে দিল। আপনার ব্যথা কমে গিয়ে একটা অন্য ভাবনার জগতে চলে গেলেন। এবার সত্যি সত্যি তো পরী আসে নি। এই যে পরীর হাত ধরে উঠে আপনি সোজা একটা হাঁটা লাগালেন এটাই ম্যাজিক রিয়ালিজম।

আমি কথাগুলো খাতায় নোট করছি দেখে উনি বললেন,

-লিখছেন কেন? কথাগুলো মাথায় রাখুন।

কথাটা শুনেই মনে হল বলি, আপনার মতো সেরিব্রাল লেখা বাংলাসাহিত্য আর দুটো পায় নি। কিন্তু প্রশ্ন করেছিলাম অন্য

-লেখায় মস্তিষ্কের প্রাধান্য বেশী থাকা উচিত না হৃদয়াবেগ?

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলেছিলেন,

-দস্তয়ভস্কি সকলেই পড়েন। দস্তয়ভস্কির মতো লেখা লিখবেন বলে। কিন্তু তা কি সম্ভব? মস্তিষ্কের মধ্যেই তো হৃদয়রহস্য লুকিয়ে আছে। তাকে টেনে হিঁচড়ে বার করাই তো পাঠকের কাজ। লেখক তো লিখে ফেলেছেন। এবার পাঠকেরও তো কিছু পরিশ্রম করা প্রয়োজন।

মনে পড়ছিল ‘সময় অসময়ের বৃত্তান্ত’-এর কথা। আসলে অসময়েই লেখকের সময়, কারণ অসময়ের ভেতর থেকেই জন্ম নেয় সেই প্রার্থিত লেখা।  আর সেই কারণেই দেবেশ রায় বারবার বলেন, লেখা পাঠকের প্রত্যাশা থেকে মুক্তি পান, পাঠকও লেখার ভার থেকে মুক্তি পাক।

পাঠকের সঙ্গে লেখার দেখা হয়ে যাক কোনও একটা অচেনা গলিতে শুঁয়োপোকার সঙ্গে প্রজাপতির যেমন দেখা হয় জন্মান্তরের আগে এবং পরে।

শব্দের প্রচলিত ব্যঞ্জনাকে হারিয়ে দেওয়া বাংলা সাহিত্য বোধহয় তাঁর কাছেই শিখেছিল। দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর প্রথম গল্প ‘হাঁড়কাটা’ নামটা শুনলে মনে হয় হাঁড়কাটা গলি নিয়ে কিছু লিখেছেন বোধহয়। অথচ হাঁড়কাটা তো নানকু কাহারের গল্প। মাংস কাটে যে নানকু কাহার। তিস্তাপারের বৃত্তান্তও তো তিস্তাপারের কথা নয়, তিস্তাপার থেকে উচ্ছেদ হওয়া মানুষের কথা। যাঁদের উদ্দেশ্যে তিনি তিস্তাপারের বৃত্তান্ত উৎসর্গ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘এই বৃত্তান্ত তাঁরা কোনওদিন পড়বে না কিন্তু তিস্তাপারে জীবনের পর জীবন বাঁচবে।’

রিমি দিল্লিনিবাসী, অর্থনীতির শিক্ষক। খবরের কাগজে ফ্রিলান্স সাংবাদিকতা ছাড়াও লেখেন গল্প, কবিতা ও প্রবন্ধ। তাঁর প্রকাশিত বই দুটি। ‘মিথ্যে ছিল না সবটা নামে কবিতা সংকলন ও দময়ন্তীর জার্নাল নামে গল্প সংকলন। ভালবাসেন এরোপ্লেনের ডানায় ভেসে থাকা মেঘ আর সেই উথালপাতাল ঢেউ ও চাপচাপ কুয়াশায় খুঁজে পাওয়া নতুন কোনও ক্যানভাস।

5 Responses

  1. “দস্তয়ভস্কি সকলেই পড়েন। দস্তয়ভস্কির মতো লেখা লিখবেন বলে। কিন্তু তা কি সম্ভব? মস্তিষ্কের মধ্যেই তো হৃদয়রহস্য লুকিয়ে আছে। তাকে টেনে হিঁচড়ে বার করাই তো পাঠকের কাজ। লেখক তো লিখে ফেলেছেন। এবার পাঠকেরও তো কিছু পরিশ্রম করা প্রয়োজন।”
    রিমি, তোর লেখাটা পড়লাম খুব মনোযোগ দিয়ে। খুব ভালো লাগল।

  2. ছোট লেখা কিন্তু খুবই ভালো। বরিশালের যোগেন মণ্ডল নিয়ে প্রশ্ন করেছিলাম। একই জবাব। উনি ওই পর্যন্ত লিখেছেন। আসলে উপন্যাস এক দার্শনিক উপস্থাপনা। উপন্যাস তো ইতিহাস রচনা নয়। পরবর্তী যোগেন মণ্ডল নিয়ে আর কেউ লিখতে পারে।

  3. “আমার উপন্যাসে নায়ক নেই, মানুষ আছে”( বর্তমান ভারতের পলিটিকাল প্রেক্ষাপটকে মাথায় রেখে মাপ মতো ছেঁটে নেয়া মানুষ, এটাই বলতে চাইলেন বোধহয়), দেবেশ রায় আজকের প্রয়োজনে ইতিহাসযাত্রা করেছেন, সেই অতীত-প্রেক্ষিত সমকালীন ভারতে দলিতদের বেঁচে থাকার শেকড়বাকড় বুঝতে সাহায্য করে, বর্তমানকে আরও তীব্রভাবে তুলে আনতে সক্ষম হয়, কারণ নমঃশূদ্রদের সমস্যা তো সুদূর অতীতেরই কন্টিনিউয়েশন (প্রয়োজনে প্রেক্ষাপট কয়েকহাজার বছর পিছনে নিয়ে যাওয়া যায়)
    কিন্তু ইতিহাসের লোকজনকে ইচ্ছেমতো ছেঁটে নিয়ে কোনো সমকালীন রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন করা যায়না, যোগেন মন্ডলকে আগাগোড়া তুলে এনে উপন্যাসটিকে ১৯৫০, যোগেনের পদত্যাগ ( ও সেই ঐতিহাসিক পদত্যাগপত্র) পর্যন্ত টানলে দেবেশ রায়ের এই উপন্যাসটি লেখার মূল উদ্দেশ্য ব্যহত হতো, তবে আড়াল-আবডাল অবলম্বন করে পল্লবিত যেকোনো বৈপ্লবিক তৎপরতা মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য, কারণ কোনো উপন্যাস উদ্দেশ্য পূরণ করতে পারে, উদ্দেশ্য পূরণ করতে কোনো উপন্যাসকে মাপজোকের আওতায় নিয়ে এলে সেই অসম্পূর্ণ ডকুমেন্টারি (যার একটা শৈল্পিক ব্যঞ্জনা আছে) বুমেরাং হয়ে উঠতে পারে। শেষ অধ্যায়ে না-নায়ক,না-খলনায়ক স্রেফ “মানুষ” যোগেনকে ঘিরে অমন হিরোয়িক আবেগ কিভাবে থরথর করে ওঠে বোঝা যায়না, আগের অধ্যায়ে দক্ষযজ্ঞের পূরাণকথা ও ধর্মকেতু-নিদয়ার মঙ্গলকাব্য-কাহিনীর ভেতর দিয়ে শুদ্রদের আবহমানকালের নীপিড়ন যেভাবে তুলে আনলেন ভোলা যাবেনা (যদিও তা প্রবন্ধের উপাদান, জোর করে উপন্যাসে যোগেনের মনোলগের সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে, উদ্দেশ্য স্থির করে নিয়ে উপন্যাস লিখলে এমনি হয়ে থাকে।)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *