বাঙালির একটা পরিচয় হতেই পারতো গ্যাস, অম্বল, বুকজ্বালা এই ত্রিধাতুতে তৈরি নশ্বর এক অস্তিত্ব। “বাঙালির সেরা ফুটবল”কে একটু বদলে বলা যেতে পারে – বাঙ্গালির সেরা অম্বল! খুব দূষণীয় যে হবে এমনও নয়। পাঠকেরা প্রশ্ন করবেন – আরে বাবা, বিষয়টা কি? কি কারণে হয় এগুলো? সঙ্গত প্রশ্ন। তার আগে দু-একটা কথা বলে নিই। একজন একক ব্যক্তির কোন রোগ হলে, যেমন অম্বল, আমরা তাকে বলি ব্যক্তিগত অসুখ বা ক্লিনিক্যাল ডিজিজ যার চিকিৎসা ডাক্তারবাবুরা করে থাকেন। আবার একই সময়ে যদি দেখা যায় এ রোগ সমাজের বহুসংখ্যক মানুষকে আক্রমণ করছে শুধু নয় সমাজের দুর্বল সম্প্রদায় এ রোগের শিকার হচ্ছে তখন সেখানে চলে আসে জনস্বাস্থ্য বা পাব্লিক হেলথ-এর প্রশ্ন। তাহলে একটা রোগ একই সঙ্গে ব্যক্তিক এবং সামাজিক। যখন রোগটি ব্যক্তিক স্তরে থাকছে তখন একজন ব্যক্তি তার পছন্দ এবং অভিরুচি অনুযায়ী যেভাবে খুশি চিকিৎসার সুযোগ নিতে পারে। কিন্তু বহুক্ষেত্রেই দেখা যায় সামাজিক অসাম্য ও ইনইক্যুইটি তথা পক্ষপাত বা অবিচারের জন্য মানুষ এমন এক পরিবেশে থাকতে বাধ্য হচ্ছে যেখানে পানীয় জলে প্রচুর অ্যামিবা, ব্যাক্টেরিয়া বা ভাইরাস রয়েছে, আর্থিক অস্বচ্ছলতার জন্য যে খাবার খাচ্ছে তা বিভিন্ন শারীরিক উপসর্গের জন্ম দিতে পারে, যে মানসিক চাপ বা সাইকোসোশ্যাল স্ট্রেস বহন করছে তাও বিভিন্ন অসুখের বীজক্ষেত্র তৈরি করে। এরকম একগুচ্ছ অবস্থাকে চিকিৎসার দৃষ্টিকোণ থেকে বলি সোশ্যাল ডিটারমিনেন্টস অফ হেলথ বা স্বাস্থ্যের সামাজিক নির্ধারক। তাহলে গ্যাস-অম্বল-বুকজ্বালার মতো বাঙ্গালি অস্তিত্বের একটি রোগই হোক বা হার্টের অসুখ, ক্যানসার বা ব্রেন স্ট্রোকের মতো হাই-টেক রোগ হোক সবক্ষেত্রেই ব্যক্তিগত পরিসরের ক্লিনিক্যাল হেলথ এবং সামাজিক পরিসরের পাব্লিক হেলথ হাত ধরাধরি করে থাকে। দামী, পাঁচতারা, বেসরকারি হাসপাতল বা ক্লিনিকে গিয়ে ব্যক্তির অসুখের চিকিৎসা করালেও যতক্ষণ না পাব্লিক হেলথের অবস্থা স্বাস্থ্যবান হয়ে উঠছে ততক্ষণ কেবল টারশিয়ারি সেন্টার-এর ওপরে ক্রমাগত চাপ পড়বে, অথচ রোগীর তৃপ্তিসাধন করা সম্ভব হবেনা। যেমনটা পশ্চিমবাংলা এবং ভারতের সর্বত্র সরকারি হাসপাতালগুলোর চিত্র – যেখানে একজন চিকিৎসককে একদিনে ৩০০ রোগীকেও দেখতে হয়।
চিকিৎসাবিজ্ঞান এবং গ্যাস-অম্বল-বুকজ্বালা
আমাদের পাকস্থলীতে খাবার এসে পৌঁছয় খাদ্যনালী দিয়ে। পাকস্থলীতে খাবারের পাচন ঘটে। এর জন্য প্রচুর পরিমাণে হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিডের ক্ষরণ হয়, ক্ষরণ হয় প্রোটিন বিপাকে সাহায্যকারী বিভিন্ন ধরনের এনজাইম বা উৎসেচক। ফলে খাবারের চরিত্রের জন্য যদি অস্বাভাবিক রকমের অ্যাসিড তৈরি হয় তাহলে বলি অম্বল হয়েছে। রাসায়নিক ভাষায় অ্যাসিড, ক্ষার বা জলের অবস্থা মাপার জন্য যে রাসায়নিক স্কেল ব্যবহার করা হয় তাকে বলা হয় পিএইচ স্কেল। ০ থেকে ১৪-র মধ্যে এর অবস্থান। জলের ক্ষারীয় বা অ্যাসিডিক কোন চরিত্রই নেই। এজন্য এর পিএইচ ৭ অর্থাৎ একেবারে মধ্যিখানে। ডানদিকে গেলে অর্থাৎ যত বেশি ১৪-র কাছাকাছি হবে তত বেশি ক্ষারীয়। আবার বাঁদিকে গেলে অর্থাৎ যত বেশি ০-র কাছাকাছি তত বেশি অ্যাসিডিক। যদি কারও অতিরিক্ত অম্বল হয় তাহলে পিএইচ ১-এর আশেপাশে চলে যেতে পারে। পাকস্থলীর দেওয়ালের সমস্ত প্রতিরোধ সত্ত্বেও সেখানে ক্ষত বা আলসার তৈরি হবে। একে আমরা গ্যাস্ট্রিক বা পেপটিক আলসার বলি। এর ফলে পেটে ব্যথা হতে পারে, ব্যথা পিঠের দিকে পেছনে যেতে পারে।
আরেকটি শারীরবৃত্তীয় বিষয় সংক্ষেপে বোঝা দরকার। আমরা জল বা শক্ত ও তরল যে খাদ্যই খাই না কেন সেসব বস্তু খাদ্যনালী দিয়ে নীচে নেমে যায় খাদ্যনালীর মাংসপেশির ক্রমাগত ধীর সংকোচন-প্রসারণের সাহায্যে। একে আমরা পেরিস্টলসিস বলি। এর স্বাভাবিক অভিমুখ যেকোন পতনশীল বস্তুর মতো পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকে। এরকম অভিমুখে পাকস্থলী থেকে খাদ্য এসে পৌঁছয় ক্ষুদ্র এবং বৃহদন্ত্রে। কোন অস্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় কারণে পেরিস্টলসিস-এর অভিমুখ যদি উলটো দিকে হয়? তাহলে খাদ্যনালীর নীচের দিকে যে স্ফিংক্টার বা ভালভ থাকে তাকে অতিক্রম করে খাদ্যনালী বেয়ে ওপরে উঠে আসবে। গলার কাছে দলা পাকিয়ে থাকবে, ঢোক গিলতে অসুবিধে হবে, ক্রমাগত গলা জ্বালা ও অস্বস্তি হবে – ডাক্তারি পরিভাষায় গ্যাস্ট্রো ইসোফেগাল রিফ্লাক্স ডিসঅর্ডার (জি ই আর ডি)। বাংলায় বললে বুকজ্বালা। এছাড়া যেসমস্ত খাদ্য আমাদের পাকস্থলী এবং অন্ত্রে প্রবেশ করে সেগুলো ভেঙ্গে যায়, দেহাভ্যন্তরের ব্যাক্টেরিয়ারাও কাজ করে। ফলে বিভিন্ন চরিত্রের গ্যাস তৈরি হয় – যেমন মিথেন। এগুলো পাকস্থলীতে বা অন্ত্রে জমা হলে পেট ভার হয়ে থাকবে, আইঢাই করবে শরীর। আমাদের চালু ভাষায় আমরা একে বলি “গ্যাস”।
প্রতিকারের উপায়
(১) রাতে শোবার সময় বালিশ ৬-৮ ইঞ্চি উঁচু করে শুতে হবে। ভালো হয় যদি খাবার ২ ঘন্টা বাদে শোয়া যায়। এ সময়টায় বসে থাকলে ভালো।
(২) যে স্ফিংক্টার বা ভালভের কথা বলেছিলাম সে স্ফিংক্টার দুর্বল করে দেয় এমন খাবার – চর্বি জাতীয় খাবার, পিপারমেন্ট, টক খাবার, পেঁয়াজ, চকোলেট, কফি, মদ – পরিহার করতে হবে।
(৩) একই কারণে শ্বাসকষ্টের এবং হার্টের কিছু ওষুধ, ঘুমের ওষুধ, বিশেষ কিছু প্রেসারের ওষুধ ইত্যাদি ডাক্তারবাবুর সাথে পরামর্শ করে বন্ধ রাখা দরকার।
(৩) ধূমপান বন্ধ রাখা দরকার।
(৪) প্রতিবারে অল্প পরিমাণে খেতে হবে, পেট ভরে নয়।
(৫) দেহের ওজন কমানো।
ওষুধের জগতে সবচেয়ে ফলদায়ী হল প্রোটোন পাম্প ইনহিবিটর বা ওমিপ্রাজল, ল্যান্সোপ্রাজল, এসওমিপ্রাজল এবং প্যান্টোপ্রাজল ধরনের ওষুধ। এগুলো খাবার ৩০ মিনিট আগে খাওয়া উচিৎ। এরা পাকস্থলীর পিএইচ কমিয়ে সবকটা উপসর্গ কমাতেই সাহায্য করে। কিন্তু একটা সতর্কবাণী আছে। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত গবেষণাপত্রে দেখা যাচ্ছে প্রোটোন পাম্প ইনহিবিটর দীর্ঘদিন ধরে খেলে কিডনির ক্ষতির আশঙ্কা বেড়ে যায়।
এজন্য যাই করুন ওষুধের ব্যাপারে অবশ্যই ডাক্তারবাবুর সাথে পরামর্শ করে চলুন। নাহলে এক বিপত্তি এড়াতে গিয়ে আরও বৃহত্তর বিপত্তি যেন আমরা যেন ডেকে না আনি।
পেশায় ডাক্তার। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি বিষয়ে গবেষণায় নিযুক্ত। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করেন। বর্তমান ঠিকানা রায়গঞ্জ।
valuable writing….khub valo
খুব ভালো লিখছেন… অনেক কিছু জানতে পারলাম…