মিকেলাঞ্জেলো বলতেন, মার্বেলের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে অন্তহীন রহস্য ও সৌন্দর্য। সেটাকে টেনে বার করাটাই হল একজন ভাস্করের কাজ। ভাস্কর্যের আমি অল্পই বুঝি, কিন্তু মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে, বিশেষত অন্তরঙ্গ সম্পর্কের ক্ষেত্রে, কথাটার তাৎপর্য বিশেষ করে আমার মনে দাগ কাটে।
স্কুল–কলেজে একাধিক গুণী ছেলেমেয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। পরে তাদের ক’জনের গুণের সম্পূর্ণ স্ফুরণ দেখবার সৌভাগ্য আমার হল? সেটা কি শুধুই সুযোগের অভাব? পরবর্তীকালে যখন তাদের স্বামী বা স্ত্রীদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে, তখন দেখেছি তাদের অসাধারণ ক্ষমতা বা ক্ষমতার সম্ভাবনা সম্পর্কে তাদের স্ত্রী বা স্বামীদের চরম অনবধান বা অপরিসীম ঔদাস্য। গরিব, অনগ্রসর দেশে সুযোগের অভাব নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে; কিন্তু আমরা যেহেতু গরিব বা অনগ্রসর কোনওটাই আর নই, এখন বোধহয় একটু খেয়াল করা দরকার, কী ভাবে আমাদের অন্তরঙ্গ সম্পর্ক আমাদের সম্ভাবনা-প্রকাশের সহায়ক বা বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
অবাক হয়ে দেখলাম, ইজরায়েলের অধ্যাপক ও চিন্তাবিদ এরন বেনজেয়েভ ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের এই ফলাফলটার নামকরণ করেছেন ‘মিকেলাঞ্জেলো প্রভাব’। যে দম্পতিদের কথা আমরা আলোচনা করছি, তারা বিবাহিত কিনা, সে-প্রশ্ন অবান্তর। একজন পুরুষ ও নারী যদি কোনও ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে কিছুদিন কাটায়, একজনের ওপর অন্যজনের প্রভাব প্রচুর হওয়া স্বাভাবিক ও অনিবার্য। এবং সেই প্রভাবটা তাদের পরস্পরের ক্ষমতা ও সৃষ্টিশীলতা বাড়িয়ে দেয়, না কি তাদের স্ফুরণের বাধা হয়ে দাঁড়ায় সেটাই আলোচনা করা দরকার।
সুরজিৎ আমার সঙ্গে স্কুলে পড়েছিল। আর তনিকাকে পারিবারিক সূত্রে চিনি। দু’জনেই উকিল। আইন পড়ার সময় ওদের প্রণয়, পরে বিয়ে, এবং দীর্ঘদিন একই ওকালতি গোষ্ঠীতে একসঙ্গে কাজ। সুরজিৎ ভাল ছাত্র; আইন পরীক্ষাতে ভাল করেছিল। কিন্তু কিছুদিন পরেই দেখা গেল মক্কেলরা অধিকাংশক্ষেত্রেই তনিকাকে চায়। মহিলারা তো বটেই, এমন কি পুরুষ মক্কেলরাও। দু’জনের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি শুরু হল। এমনকি, সুরজিতের মনে হল তনিকা হয়ত মক্কেলদের এমন কিছু বলছে, যার ফলে এটা ঘটছে। অনেক অশান্তির পর সব কিছু বদলাতে শুরু করল, যখন সুরজিৎ একটা নতুন পরীক্ষা পাশ করে প্রধানত ব্যবসায়িক আইনের কাজে ঝুঁকল। এখন দু’জনেই শান্তিতে কাজ করছে। সুরজিৎ বুঝে নিয়েছে যে সে যত ভাল ছাত্রই হোক না কেন, সাধারণ মক্কেলরা তনিকার ধরনটাই বেশি পছন্দ করে। আর তনিকাও বুঝেছে, যে সুরজিতের ভাল বিশ্লেষণক্ষমতা ব্যবসায়িক আইনে অত্যন্ত ফলপ্রসূ এবং সেটা তনিকার আয়ত্তের বাইরে।। এটা বুঝতে দু’জনেরই অনেক সময় লেগেছে, অনেক অপ্রীতিকর দিন গিয়েছে। কিন্তু অবশেষে দু’জনেরই কাজ অন্যের পক্ষে ভাল হয়েছে, এবং দু’জনের যৌথ জীবন সাময়িক অস্বস্তির পর একটা ভাল পথ ধরেছে।
মৃদুল ও গোপার দাম্পত্য জীবনেও অশান্তির ঢেউ উঠেছিল। এত উত্তাল ভাবে, যে অনেকের ধারণা হয়েছিল যে ওরা হয়তো আলাদাই হয়ে যাবে। গোপা বৃত্তি নিয়ে লেখাপড়া করেছে, তুলনায় মৃদুল সাধারণ ছাত্র। কিন্তু মৃদুল অ্যাকাউন্টেন্সি পাশ করে ভাল চাকরি পেল। ইংরেজি সাহিত্য পড়ে গোপার সে সৌভাগ্য হল না। চাকরির খোঁজ করতে করতে গোপার বিয়ের সম্বন্ধ এল। নতুন, সুন্দর জীবনের সংকল্প নিয়ে গোপা বিবাহিত জীবন শুরু করল। দু’বছরেই সে-আশা তিরোহিত হল। ঘরসংসার নিয়ে গোপা উদয়াস্ত যা কিছু করে, মৃদুল সবই যেন ধরে নেয় অত্যন্ত স্বাভাবিক, স্ত্রীর কর্তব্য। কখনও এক বিন্দু অংশগ্রহণ করার কথা ভাবে না। অন্য দিকে, মৃদুল নীরব অসন্তুষ্টিতে ভোগে। যে সাপ্তাহিক পার্টি তার প্রধান বিনোদন, সে স্পষ্টই দেখতে পায়, গোপার কাছে সেগুলি একটা প্রায়-অসহনীয় দায়, এক ধরণের স্থূল করণীয়। দু’জনের মধ্যে দূরত্ব বেড়েই চলল। অবশেষে নিরুপায় হয়ে ওরা এক অভিজ্ঞ পরামর্শদাতার শরণাপন্ন হল। গোপা আবিষ্কার করল যে শুধু বিয়ের মধ্যে ওর প্রত্যাশার পূরণ হবার আশা কম, মৃদুলের উৎসাহী সমর্থনে গোপা একটা সাময়িক অধ্যাপনার চাকরি নিল। মৃদুল, গোপার উৎসাহী সমর্থনে, পার্টির সংখ্যা কমিয়ে অন্যান্য বিনোদনের দিকে মন দিল। এমনকি পার্টিতে আজকাল অধ্যাপকদেরও নেমন্তন্ন করে। মৃদুল শান্তিতে আছে; গোপা সফল শিক্ষক ও সুখী।
রঞ্জন ও স্নেহা উভয়েই প্রবাসী বাঙালি, থাকে বেঙ্গালুরুতে। দুজনেই কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ। দু’টো কোম্পানির কাজ নিয়ে অপরিচিত শহরে এসেছিল এবং বন্ধুদের মারফত পরিচয় হয়েছিল। হতে পারে নিঃসঙ্গতা, হতে পারে নিভৃত সময়ের একান্ত অভাব, তিন মাসের শেষে দু’জনে একসঙ্গে থাকতে শুরু করল – এবং গত তিন বছরে কোনও সামাজিক সম্পর্কের আলোচনা মুলতুবি থেকেছে। যা মুলতুবি থাকেনি, তা হচ্ছে বারংবার আলোচনা: কী ভাবে আমরা একসঙ্গে থাকব, কী ভাবে আমাদের সম্পর্ক আমরা নিয়ন্ত্রণ করব। আমি দু’জনকেই অল্পবিস্তর জানি। তাই জানি এরা পুরোপুরি ভিন্ন ধরনের লোক। ভিন্ন রুচি ও ভিন্ন মনোভাব। তাই এই পৌনঃপুনিক আলোচনার কথা শুনে চমৎকৃত না হয়ে পারিনি। কজন দম্পতি এত অকপটে এমন আলোচনা করে! স্নেহার বক্তব্য ছিল এই: আমি বাবা-মার বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে অন্য শহরে কাজ করতে এলাম স্বাধীনভাবে থাকব বলে। আর একজনের সঙ্গে রয়েছি বলেই সে-স্বাধীনতা বিসর্জন দিতে আমি রাজি নই। এছাড়াও আমার বাবা-মার সম্পর্কে, আমার দৃষ্টিতে, সর্বদাই একটা অসমতা ছিল; আমার নিজের সম্পর্কে আমি সেই ধরণের পুরুষকেন্দ্রিক অসমতা চাই না। রঞ্জন এই দৃষ্টিভঙ্গীতে অভ্যস্ত ছিল না – কজন ছেলেই বা থাকে – কিন্তু ওরও মনে হল স্নেহা যা বলছে সেটা শুধু যৌক্তিক নয়, ন্যায়সঙ্গত। এখন ওদের গৃহস্থালিতে একটা অনতিদৃশ্য সমতা চোখে পড়ে। কোনও কাজই, বাজার, রান্না, গোছগাছ, সম্মার্জন, ছেলের বা মেয়ের কাজ নয়, উভয়ের কাজ। ভালবাসার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জুড়ে রয়েছে পারস্পরিক চিন্তা ও সম্মান।
নারী পুরুষ নির্বিশেষে আমরা সবাই স্বকীয় ও স্বাধীন। এটা নীতি হিসেবে ঘোষণা করা সহজ, কিন্তু রীতি হিসেবে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রতিফলিত করা তত সহজ নয়। অনেক বছর আমরা একটা পুরুষকেন্দ্রিক সমাজে বাস করেছি। সম্ভবত একটা পুরুষকেন্দ্রিক পরিবারে বড় হয়েছি। যেটা বহুদিন দেখেছি ও যেটাতে আমরা অভ্যস্ত, সেটা যে গভীরভাবে অসমীচীন ও অন্যায়, সেই বোধটাই আমাদের দুর্বল বা সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিত। একবিংশ শতাব্দীর সমাজব্যবস্থা ও চিন্তাধারার সঙ্গে সেটা যে শুধু খাপ খায় না তা নয়, আমাদের প্রতিদিনের পুরুষ-নারী সম্পর্কের মূলে সেটা বিষোদ্গার করে। অজস্র সম্পর্ক তাই হয় শিথিল বা পঙ্কিল, নয় ভঙ্গুর বা ভগ্নমুখী। বন্ধুত্বের মতই সব ভালবাসার সেতু হওয়া দরকার সমতা ও সম্মান।
শুধু সে ভাবেই, মিকেলাঞ্জেলোর মত, মার্বেল থেকে টেনে বার করা যায় আর কারও অভিপ্রেত রহস্য ও সৌন্দর্য।।
মণীশ নন্দী দীর্ঘদিনের প্রবাসী। কর্মজীবনে মার্কিন দূতাবাস ও ওয়র্ল্ড ব্যাঙ্কের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অবসর গ্রহণের পর লেখালোখি নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। আ স্ট্রেন্জার ইন মাই হোম ওঁর সদ্যপ্রকাশিত বই।