“আপনার ছেলেকে বোঝান। দিল্লিতে ওর জন্য উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে।”
বক্তা এক বয়স্ক ভদ্রলোক। অভিজাত চেহারা। দিল্লি থেকে এসেছেন। কথাটা বলছেন এক বিধবা ভদ্রমহিলাকে উদ্দেশ করে। বোঝাতে চাইছেন, তাঁর ছেলে অসামান্য প্রতিভাধর। মহিলা দৃশ্যতই অপ্রস্তুত ও অসহায়। ছেলে যে বাড়ি ছেড়ে নড়তেই চায় না! কী করে বোঝাবেন তাকে?
বয়স্ক ভদ্রলোকের পরিচয়টা এবার দিতেই হয়। তাঁর নাম কে শংকর পিল্লাই। ভারতে রাজনৈতিক কার্টুনের জনক। এ দেশের সর্বকালের সেরা ব্যঙ্গচিত্র পত্রিকা ‘শংকর’স উইকলি’-র প্রতিষ্ঠাতা। ‘চিলড্রেনস বুক ট্রাস্ট’ নামে শিশুসাহিত্য প্রকাশনা সংস্থাও তাঁরই তৈরি। এই ‘শংকর’স উইকলি’ ত্রিশ-চল্লিশের দশকে বহু নবীন কার্টুনিস্টকে তাঁদের কাজ দেখাবার সুযোগ করে দিয়েছিল, যাঁরা পরে রাজনৈতিক কার্টুনের ক্ষেত্রে নিজেদের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন, খ্যাতি পেয়েছেন। সেই হেন শংকর পিল্লাই, উপরোক্ত যুবককে দিল্লিতে নিয়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ উপরোধ করছেন তাঁর মা-কে।

কে সেই যুবক? তার নাম রেবতীভূষণ ঘোষ। শংকর পিল্লাই দেখেছিলেন, একেবারে কমবয়সে কী অবলীলায় অসাধারণ পশুপাখির স্কেচ করতে পারত সে। দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। বুঝেছিলেন প্রতিভার আঁতুড়ঘর এই যুবক। বস্তুত, বাংলা কার্টুনের ঐতিহ্য ও ইতিহাসে একাধিক অবিস্মরণীয় নাম রয়েছে, যাঁদের কাজ আজও বাঙালি মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখে। তাঁদেরই মধ্যে অন্যতম ছিলেন রেবতীভূষণ ঘোষ (১৯২১-২০০৭)। নিঃসন্দেহে বাংলার অন্যতম সেরা কার্টুনিস্ট, অলঙ্করণ এবং ক্যারিকেচার শিল্পী হিসেবে তিনি চিরস্মরণীয়।

রেবতীভূষণের জন্ম হয়েছিল হাওড়ার বালিতে। গঙ্গাতীরে বিশাল পৈতৃক বাড়ি। চারপাশের শান্ত স্নিগ্ধ প্রাকৃতিক পরিবেশে বড় হওয়ার অভিজ্ঞতা তাঁকে আজীবন প্রভাবিত করেছিল। প্রকৃতি থেকেই নিয়েছিলেন ছবি আঁকার প্রথম পাঠ। ছেলেবেলায় গ্রামে যাত্রা দেখতে যেতেন। ঝলমলে পোশাক পরা রাজা, সেপাইদের দেখে খুব মজা লাগত তাঁর। বাড়ি ফিরে এসেই কাগজে আঁকতেন তাদের, ইচ্ছে করেই খানিকটা মজার ঢংয়ে স্কেচ করতেন, যাতে দেখলেই হাসি পায়। কার্টুন আঁকা নিজের চেষ্টায় রপ্ত করেছিলেন এভাবেই।
১৯৪২ সাল। ভারত ছাড়ো আন্দোলনে উত্তাল গোটা দেশ। স্বাধীনতা সংগ্রামের উত্তেজনা চারিদিকে। রেবতীভূষণের কাছে একটা সুযোগ এল আচমকাই, তাঁর আশৈশব অনুপ্রেরণা অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে দেখা করার। ভারতীয় চিত্রকলায় স্বদেশী রীতির প্রয়োগ প্রথম করেছিলেন অবনীন্দ্রনাথ। সে সময় শিল্পী হিসেবে খ্যাতির শীর্ষে ছিলেন তিনি। অবন ঠাকুরের শিষ্যত্ব নিলেন রেবতী। তাঁর তুলির টানে জোর এল, গতি এল, অনুভূতি এল।

কলকাতার রিপন কলেজে সংস্কৃতে স্নাতক পড়াকালীন রেবতীভূষণের প্রথম রাজনৈতিক ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশিত হল। প্রখ্যাত বাঙালি সাহিত্যিক প্রমথনাথ বিশী তখন রিপন কলেজে অধ্যাপক। কলেজের দেয়াল পত্রিকায় রেবতীর আঁকা ছবি তাঁর চোখ টানল। তিনি ছাত্রকে ডেকে বললেন, এ ছবি কোনও ভালো পত্রিকায় প্রকাশ হওয়া দরকার। মূলত তাঁর উৎসাহেই সে সময়কার অন্যতম প্রধান ব্যঙ্গ-পত্রিকা ‘সচিত্র ভারত’-এ প্রকাশিত হয় রেবতীভূষণের আঁকা ছবি। এবং সেখান থেকেই শুরু হয় তাঁর দীর্ঘ কর্মময় যাত্রা।
কলেজের পড়া শেষ করে বার্মা শেল কোম্পানিতে জুনিয়র ক্লার্ক পদে যোগ দেন রেবতীভূষণ। অবসরে কার্টুন আঁকতেন। কিন্তু অল্পকালের মধ্যেই চাকরি হারিয়ে পুরো সময়ের জন্য কার্টুনে মনোনিবেশ করেন। সমস্ত মূলধারার বড় পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হতে লাগল তাঁর কাজ। আনন্দবাজার পত্রিকা, সত্যযুগ (টাইমস অফ ইন্ডিয়ার বাংলা সংস্করণ), যুগান্তর, সচিত্র ভারত, দৈনিক বসুমতী, শনিবারের চিঠি, অচলপত্র, বেতার জগৎ, উল্টোরথ এবং নবকল্লোলের মতো প্রথম সারির পত্রপত্রিকায় দেখা যেতে থাকল তাঁর ব্যঙ্গচিত্র।

এর পাশাপাশিই ছোটদের জন্য কাজ শুরু করলেন। মজার ছবি, কার্টুন প্রকাশিত হতে লাগল শিশুসাথী, সন্দেশ, শুকতারা এবং মৌচাক পত্রিকায়। সে সময়েই দৈনিক যুগান্তরে তিনি একটি কলাম শুরু করেন, যার নাম ছিল ‘ব্যঙ্গবৈঠক’। সেখানে শুধু কার্টুন নয়, রেবতীভূষণের লেখা মজার ছড়াও প্রকাশিত হতে শুরু করে। তুলি আর কলমের সেই আশ্চর্য মেলবন্ধন অচিরেই পাঠকমহলে ব্যঙ্গবৈঠককে তুমুল জনপ্রিয় করে তোলে।
শুধু কি কার্টুন? রেবতীভূষণ হাত লাগিয়েছিলেন অ্যানিমেশনেও। কলকাতায় চল্লিশের দশকে প্রথম অ্যানিমেশন স্টুডিও তৈরি করেছিলেন মন্দার মল্লিক। রেবতীভূষণ তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেন নিজে অ্যানিমেশন তৈরি করবেন বলে। ছবির নাম দেন ‘আকাশ পাতাল’। শহরে তখন ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব। ঠিক হল, একটি কুড়ি মিনিটের ছোট ছবি করা হবে ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধে সচেতনতা প্রচারে। ছবির নাম ‘কুইন অ্যানোফিলিস’। তাতেও কাজ করলেন রেবতীভূষণ।
৫ সেপ্টেম্বর ২০২১ রেবতীভূষণ শতবর্ষ স্মরণে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল কলকাতা কার্টুনদল। বিশিষ্ট কার্টুনিস্ট দেবাশীষ দেব, কার্টুন ঐতিহাসিক বিশ্বদেব গঙ্গোপাধ্যায়, শুভ্রজিৎ চক্রবর্তী এবং প্রদীপ পারেখ হাজির ছিলেন রেবতীভূষণের কাজ নিয়ে আলোচনায়। তাঁকে নিয়ে তৈরি দেবাশীষ দেবের একটি তথ্যচিত্রও দেখানো হয়। এবার ৫ ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া কার্টুন মেলায় পাওয়া যাবে রেবতীভূষণের স্মরণে ভারতীয় ডাক বিভাগের তৈরি ডাকটিকিট-সহ, রেবতীভূষণ ২০২২ ক্যালেন্ডার, পোস্টকার্ড সেট-সহ নানা মেমোরাবিলিয়া।
তবে অ্যানিমেশনের দুনিয়ায় তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ ১৯৫১ সালে নিউ থিয়েটার্সের সঙ্গে। এক মহা ধুরন্ধর মেঠো ইঁদুরকে নিয়ে তৈরি তাঁর অ্যানিমেশন ‘মিচকে পটাশ’ ছিল এক অনবদ্য সৃজন। চরিত্র চিত্রণ থেকে গল্প তৈরি, সবক্ষেত্রে অসামান্য প্রতিভার ছাপ রেখেছিলেন রেবতীভূষণ। বাঙালি আত্মঘাতী জাতি। তাই সংরক্ষণের অভাবে আজ তার একটি প্রিন্টও আর অবশিষ্ট নেই। সব নষ্ট হয়ে গিয়েছে সময়ের আঘাতে।

চল্লিশের দশক থেকেই ‘শংকর’স উইকলি’-তে নিয়মিত ছবি পাঠাতেন রেবতীভূষণ। তাঁর পশুপাখির স্কেচ দেখে নতুন করে মুগ্ধ হলেন শংকর। প্রায় প্রতিটি কার্টুনেই মুখ্য চরিত্রে থাকত কোনও না কোনও জন্তুজানোয়ার। শংকর এবার আর দেরি না করে রেবতীকে প্রস্তাব দিলেন ‘চিলড্রেনস বুক ট্রাস্ট’-এ যোগ দেবার জন্য। কিন্তু সমস্যা সেই একই। দিল্লিতে যাবার নামেই রেবতীর উৎসাহে ভাটা পড়ে যায়। আসরে নামলেন খুশওয়ন্ত সিং, ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অফ ইন্ডিয়া-র সম্পাদক। অনেক করে রেবতীভূষণকে বোঝালেন, এ প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না। অবশেষে চিঁড়ে ভিজল। রেবতীভূষণ দিল্লি যাত্রা করলেন।

‘চিলড্রেনস বুক ট্রাস্ট’-এ সিনিয়র আর্টিস্ট এবং একের পর এক ছোটদের বইতে অলঙ্করণ করতে লাগলেন। ‘দ্য ক্লেভার কাফ’, ‘দ্য কিংস চয়েস’, ‘দ্য ফুলস প্যারাডাইস’, ‘মাংকি অ্যান্ড দ্য ওয়েজ অ্যান্ড আদার স্টোরিজ়’ এসব বইগুলি হাতে হাতে ফিরতে লাগল রেবতীভূষণের ছবি, ঝকঝকে ছাপা আর ঝরঝরে লেখনীর গুণে। ততদিনে রাজধানীতে মন বসেছে রেবতীর। ঠিক করলেন, এখানেই থাকবেন। পরবর্তী কুড়িটা বছর কেটে গেল দিল্লিতেই। ‘চিলড্রেনস বুক ট্রাস্ট’-এ ছবি আঁকার পাশাপাশি ফ্রিল্যান্স হিসেবে ছবি আঁকতে থাকলেন ‘ন্যাশনাল হেরাল্ড’, ‘হিন্দুস্থান টাইমস’, ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’, ‘পাইওনিয়র’, ‘ফিনানশিয়াল এক্সপ্রেস’, ‘দিল্লি স্টেটসম্যান’, ‘সাপ্তাহিক হিন্দুস্তান’, ‘জনযুগ’, ‘দিনমান’ প্রভৃতি নামীদামি পত্রপত্রিকা ও সংবাদপত্রে।
কুড়ি বছর একটানা দিল্লিতে থেকে কাজ করার পর রেবতীভূষণ একদিন ফিরে এলেন কলকাতায়। কিন্তু এসে দেখলেন পুরনো যোগাযোগগুলো সব নষ্ট হয়ে গিয়েছে। কারও সঙ্গেই আর সংযোগ নেই, খোঁজখবরও নেই অনেকের। রেবতীভূষণ সাদাসিধে ভালোমানুষ ছিলেন। নাম-যশ-খ্যাতির পিছনে ছোটার ইচ্ছে বা স্বভাব কোনওটাই তাঁর ছিল না। ফলে ক্রমে সমকালীন শিল্পীদের তুলনায় একটু পেছনের সারিতে পড়ে যেতে লাগলেন। খ্যাতি এবং জনপ্রিয়তা, দুই নিরিখেই এ সময়টা ছিল রেবতীভূষণের কিছুটা প্রতিকূলে। তথাপি, তুলি থেমে থাকেনি কখনও। একের পর এক অনবদ্য কার্টুন দিয়ে গেছেন ‘দ্য স্টেটসম্যান’ এবং ‘আজকাল’ পত্রিকায়। এত বছরের দীর্ঘ কর্মজীবনে কখনও প্রদর্শনীই করেননি রেবতীবাবু। প্রথম প্রদর্শনী হয় ১৯৯৭ সালে, কলকাতার অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসে।

রেবতীভুষণ ছিলেন আদ্যন্ত স্বশিক্ষিত। ছবির ক্ষেত্রে কোনও প্রথাগত বা অ্যাকাডেমিক তালিম তাঁর ছিল না। তা সত্ত্বেও তাঁর প্রতিটি রাজনৈতিক কার্টুন দেখলে বোঝা যায় ভারতের রাজনীতি-অর্থনীতি বিষয়ে কী প্রগাঢ় ছিল তাঁর বোধ, চেতনা এবং জ্ঞান। ভারতীয় সনাতন শিল্পকলা সম্পর্কে অসাধারণ ছিল তাঁর প্রজ্ঞা। শেষের দিনগুলি রেবতীভূষণ ফিরে গিয়েছিলেন সেই গঙ্গার ধারের পৈতৃক বাড়িতে, প্রকৃতির মাঝখানে। পাড়ার বাচ্চাদের নিয়ে সময় কাটাতেন। আর ছিল তাঁর পাখির সঙ্গে কথা বলা। নিরন্তর পাখির সঙ্গে কথা বলে চলতেন তিনি। শুধু প্রকৃতিপ্রেমীকই নয়, রেবতীভূষণ ছিলেন ভালো সাঁতারু। কবিতা লিখতেন, গানও গাইতেন। সবমিলিয়ে জীবনকেই ভালোবাসতেন রেবতীভূষণ।
সব ছবি লেখকের সংগ্রহ থেকে প্রাপ্ত।
মূল ইংরেজি নিবন্ধ থেকে অনুবাদ: পল্লবী মজুমদার
কর্মসূত্রে বেঙ্গালুরুর বাসিন্দা বিবেক পেশাগত ভাবে তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার কর্মী। কিন্তু নেশায় আদ্যন্ত কার্টুনিস্ট এবং পর্যটক। সঙ্গে রয়েছে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালিখির অভ্যাস ও সম্পাদনা। তাঁর লেখা তিনটি বইও ইতিমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে। খেলাধুলোয় তাঁর উৎসাহের কথা বেরিয়ে এসেছে সেই বইয়ের মাধ্যমেই। দ্য আমেজিং অলিম্পিকস: ডাউন দ্য সেঞ্চুরিজ়, দ্য ওয়র্ল্ড চেজ়িং দ্য কাপ এবং ফুটবল ফান বুক পাঠকমহলে খুবই সমাদৃত হয়েছে। বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান কার্টুন গ্যালারিতে তাঁর কার্টুন নিয়ে একক প্রদর্শনীও হয়েছে।