আগুন, বই আর গোলাপ

আগের পর্বের লিংক: [] [] [] [] [] [] [] [] [] [১০] [১১] [১২] [১৩] [১৪] [১৫] [১৬] [১৭]

এমএ ফাইনাল পরীক্ষা একসময় শুরু হল ঠিকই, কিন্তু চারটে পেপার হতে না হতেই কেস ভন্ডুল। ফোর্থ পেপার শেষ করছি যখন, তখনই বিরাট হল্লা ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাস জুড়ে। বুঝে ওঠা দায় সেটা পরীক্ষার ঝামেলা, নাকি আন্দোলনকারীদের হামলা। আওয়াজ যত বাড়ে, সবাই তত হু হু করে কলম চালিয়ে খাতা ফিনিশ করতে লাগে। আমাদের রুমে ভিজিল্যান্সে ছিলেন আরকেডি, মানে প্রফেসর রমেন্দ্রকুমার দাস। ধুতি-পাঞ্জাবি-চাদরে নিপাট ভালমানুষ। ওঁর দাদা শৈলেন্দ্রকুমার দাসও ইংরেজির অধ্যাপক ছিলেন, যাঁর ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে একটা বই খুব বাজারে চলত। তো এই আরকেডি-রই পড়ানো বিষয়ই অনেকখানি জুড়ে ছিল ফোর্থ পেপারে। আর সেই পেপারের পরীক্ষায় এই ঝঞ্ঝাট দেখে বিষম উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছিল অধ্যাপককে। যা হোক, খাতা জমা করার পর ক্লাস ছেড়ে বেরতে না বেরতে খবর এল যে পরদিনের পরীক্ষা হচ্ছে না, পরে কবে হবে তা খবরের কাগজে জানিয়ে দেওয়া হবে। যা শুনে আমাদের এক সহপাঠীর এক মন্তব্য আজও কানে বাজে: ‘যাঃ শালা! এ পরীক্ষা এই সেঞ্চুরিতে শেষ হবে তো?’ ব্যাপারটা এমন ধাক্কায় ফেলেছিল আমাদের সবাইকে, যে ভালো করে হাসতেও পারিনি কেউ। বাড়ি ফেরার পথে বন্দনা জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কী করবে এখন?’ কী উত্তর দেব? মাথার মধ্যে গজগজ করছে তখন পরীক্ষার সব পড়া। পরীক্ষার নতুন তারিখ ঘোষণা না হওয়া পর্যন্ত এদের যথাযথ সামলে-সুমলেও তো চলতে হবে।

Marcel Proust
ঔপন্যাসিক মার্সেল প্রুস্ত।

বান্ধবীকে কোনও উত্তর করিনি, কিন্তু ভেতরে ভেতরে একটা আরামের হদিশ পাচ্ছিলাম। শুরু করব, শুরু করব করে যে ফরাসি উপন্যাসটা কতদিন ধরে খোলাই হচ্ছিল না, আগামী দিনকয়েক রাতের বেলা ওটাই পড়ে যাব। পরীক্ষার যাবতীয় পড়া সকাল, দুপুর, সন্ধেয়। খাওয়া-দাওয়ার পর রাতের পড়া হবে মার্সেল প্রুস্তের সাত খণ্ডের বিপুল, অতুলনীয় উপন্যাস ‘রিমেমব্রেন্স অফ থিংগস পাস্ট’-এর প্রথম খণ্ড ‘সোয়ানস ওয়ে’। প্রুস্ত বলতে ওই একটি পেপারব্যাক খণ্ডই বাড়িতে ছিল। সেদিন বাড়ি ফিরে খেয়েদেয়ে বিছানায় গিয়ে বইটার পাতা ওল্টাতেই— ওহ্ মাই গড! ওহ্ মাই গড! সে যে কী এক জগতে নিক্ষিপ্ত হওয়া! পরীক্ষার সমস্ত দুশ্চিন্তা, পরিশ্রম ও ক্লান্তি থেকে এ উপন্যাস আমায় উদ্ধার করে নিয়ে গেল অন্য আরামে-বিশ্রামে! কারণ, বইটা শুরুই হচ্ছে কথক-নায়কের রাতের বিছানায় গায়ে স্মৃতির আলোয়ান জড়িয়ে! কথক-নায়ক, যাকে শুধু উল্লেখ করা হচ্ছে M বলে গোটা উপন্যাসে, তার বলা শুরু করছে এভাবে…

“বহুদিন যাবৎই আমি বেশ তাড়াতাড়িই শুতে যাই। মাঝে মাঝেই এমনটা ঘটে যে বাতিটা হয়তো সবে নিভেছে, তার মধ্যেই আমার চোখ দুটো এমন জুড়েছে যে সময়ই পাইনি নিজেকে বলার ‘আমি ঘুমিয়ে পড়ছি’। আর আধঘণ্টা পরে ‘ঘুমোতে হবে, ঘুমোতে হবে’ এই ভাবনাতেই ফের জেগে উঠতাম আর যে-বইটা হাতে নিয়ে শুতে গেছিলাম সেটা তখনও হাতে ধরা মনে করে সেটাকে জায়গায় রেখে ফুঁ দিয়ে বাতি নেভানোর চেষ্টা করতাম। 

যা বইয়ে পড়ছিলাম ঘুমোতে যাবার আগে, তখনও তা মাথার মধ্যে ঘুরছে, তবে সেই ভাবনা একটা নতুন মোড় নিয়েছে; আমার মনে হতে শুরু করেছে যে বইয়ের বিষয়টা আসলে আমিই : একটা গির্জা, একটা সংগীত, প্রথম ফ্রঁসোয়া এবং পঞ্চম চার্লসের মধ্যে রেষারেষি। জেগে ওঠার পর কয়েক মুহূর্ত ভাবনাটা থেকে যেত; রাতে আমার চিন্তাশক্তি যে খুব ব্যাহত তা নয়, তবে ভাবনাটা চোখের ওপরে একটা আড়ালের কাজ করত আর সে-কারণে টেরও পেতাম না যে মোমবাতিটা আর জ্বলছে না। 

ব্যাপারটা বেশ দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে তখন, যেন পুনর্জন্মে এসে পূর্বজন্মের স্মৃতি নিয়ে খেলা চলছে; আমার বইয়ের বিষয় তখন আমার থেকে আলাদা হয়ে পড়ে, সেখানে আমার ফিরে যাবার বা না-যাবার স্বাধীনতা দিয়ে দেয়, তখনই আমার দৃষ্টিশক্তিও ফিরে আসে এবং আমি নিজেকে খুঁজে পাই এক অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশে, যা আমার চোখের পক্ষে সুখের ও আরামের, এবং আরও বেশি হয়তো তা আমার মনের পক্ষে, যে-মনের কাছে সেটা অকারণেই দুর্বোধ্য, আঁধার।….

আমি ফের ঘুমিয়ে পড়ি আর তারপর একটুখানি একটুখানি সময়ের জন্য জেগেো উঠি, কেবল কাঠের পাটার কচরমচর শোনার জন্য অথবা ক্রমাগত বদলে যাওয়া অন্ধকারের বর্ণালি দেখার জন্য, মুহূর্তের চেতনার ঝলকে ঘরময় ছড়িয়ে থাকা ঘুমের বিস্তার উপভোগ করতে। যে-ঘুম ভারী হয়ে ভর করেছে ঘরে তাবৎ আসবাবে। আমি যার একটি ক্ষুদ্র অংশ বই কিছু নই। যে-অবচেতনাতায় খুব শিগগির ফিরব। ঘুমের মধ্যে আমি ফিরে গেছি শৈশবের নানা ভয়ের স্মৃতিতে, যখন ভয় থেকে রক্ষা পেতে আমি মাথায় বালিশ চাপা দিয়ে স্বপ্নের রাজ্যে পাড়ি দিতাম।’’

Remeberance of the Things Past
প্রুস্তের কালজয়ী নভেল ‘রিমেমব্রেন্স অফ থিংগস পাস্ট’।

সারাদিনের পড়াশুনোর পর ‘রিমেমব্রেন্স অফ থিংগস পাস্ট’ বুকে নিয়ে শুতে যাওয়া আমার এক অমূল্য স্মৃতি। পরীক্ষার সমস্ত পড়ার পর এই তথাকথিত কঠিন নভেল (আমার তা কখনওই মনে হয়নি) পড়ে যে আরাম ও বিশ্রাম পেতাম, তাতে বেশ ক’সপ্তাহ পর পরীক্ষা শুরু হতে রীতিমতো ঝরঝরে হয়েই হাজরা ল’ কলেজে যাওয়া শুরু করলাম। হ্যাঁ, বাকি চারটে পেপারের পরীক্ষা ইউনিভার্সিটি নয়, ল’ কলেজে হল। এবং সৌভাগ্যক্রমে বেশ নির্বিঘ্নে কাটল। শেষদিনের পরীক্ষার পর মনটা কীরকম ভার হয়ে গেল। এই সব সহপাঠীদের সঙ্গে ফের কবে দেখা হবে কে জানে! কে কোথায় চলে যাব তা-ই বা কে জানে? প্রেসিডেন্সির ক্লাসের শেষ দিকে আমরা টি এস এলিয়টের অসাধারণ প্রবন্ধ সংকলন ‘দ্য সেক্রেড উড’-এর পাঠ নিতে যেতাম প্রফেসর অমল ভট্টাচার্যের কেয়াতলার ফ্ল্যাটে। প্রেসিডেন্সির এমএ ক্লাসের ওই বারোজন। স্যরের বাড়ি যেতে হত কারণ ক্যান্সারে আক্রান্ত তাঁর একটি পায়ের গোড়ালি থেকে কেটে বাদ দিতে হয়েছিল। কিন্তু সেই সার্জারির পরও স্যর বাড়িতেই ক্লাস নেবার কথা ভাবলেন! আর হায়, কী ক্লাস সে সব! স্যর একটা রিক্লাইনিং চেয়ারে হাতে এলিয়ট নিয়ে বসতেন, কোমর থেকে পা অবধি ঢাকা থাকত একটা ঘন লাল রঙের হাল্কা কম্বলে। আমরা ছাত্রছাত্রীরা ওঁকে ঘিরে বসতাম। একবার গ্রিক ট্র্যাজেডির বিবেচনায় এলিয়টের মতো ব্যাখ্যা করতে গিয়ে স্যর মুহূর্তের জন্য ওঁর অপারেশন হওয়া পা’টার দিকে চোখ ফেললেন যেন নিয়তির খেলার একটা নজির চোখে পড়ল। ওই চকিত দৃশ্য মনে গেঁথে গেল তক্ষুনি। স্মৃতিচারণায় আগেও এ কথা বলেছি। 

Sukumari Bhattacharya
বিদূষী পণ্ডিত সুকুমারী ভট্টাচার্য।

বলার এটাও যে ওই সব অপূর্ব ক্লাসের পর আরও একপ্রস্ত সুখ অপেক্ষায় থাকত আমাদের। তা হল স্যরের আশ্চর্য বিদূষী স্ত্রী সংস্কৃত পণ্ডিত সুকুমারী ভট্টাচার্যের পরিবেশন করা অপূর্ব সব স্ন্যাক্স ও কফি। সুকুমারীদি মানুষকে খাওয়াতে খুব ভালবাসতেন, এবং প্রতিবারই নতুন, নতুন কিছু পদ। এই স্ন্যাক্সপর্ব শেষে তিনি আরেকটা পদ রাখতেন, যার কোনও তুলনা পাইনি আজও। তা হল লং প্লে রেকর্ড চালিয়ে এলিয়টের স্বকণ্ঠে আবৃত্তি করা ‘ফোর কোয়ার্টেটস’ সুদীর্ঘ কবিতাটা শোনানো। একবার শোনালেন শেক্সপিয়ারের ‘কিং লিয়ার’ নাটকের শেষ দুটি অঙ্ক। আরেকবার গিলবার্ট অ্যান্ড সালিভানের অপরূপ অপেরা ‘দ্য পাইরেটস অফ পেনজান্স’। স্যর তখন পড়িয়ে ওঁর ঘরে চলে গেছেন, সেই দরজাও ভেজানো। যাতে ওঁর বিশ্রামে ব্যাঘাত না ঘটে। তবে একটু-আধটু সুর হয়তো তার মধ্যেই গলে ভেতরে গেছে। তা শুনে স্যর ঘর থেকেই গিন্নির উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন, ‘দরজাটা মেলে দাও, একটু অপেরাটা শুনি।’ সুকুমারীদি বালিকার খুশির উচ্ছ্বাসে দরজাটা খুলে দিয়ে এসে বললেন, ‘ট্র্যাজেডি পড়ানোর পর তোমাদের স্যর একটু ফূর্তির মেজাজ চাইছেন মনে হয়।’ হঠাৎ একদিন এরই মধ্যে স্যর চলে গেলেন। সোমনাথ মেমোরিয়াল হলে এক সকালে তাঁর শ্রাদ্ধবাসর হল। বিভিন্ন বয়সী ওঁর ছাত্রছাত্রীকুল সমবেত হয়েছিলেন সেখানে। স্যরের মাস্টারমশাই সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় গীতা থেকে পাঠ করলেন। সুকুমারীদি আমায় বললেন, ‘তুমি একটু স্যরের খেয়াল রাখো। ওঁকে যেন চেয়ে নিতে না হয়। উনি খেতে ভালবাসেন।’ কিছু সন্দেশ আর লুচি ওঁর প্লেটে দিতে সুনীতিবাবু আমায় বললেন সোফায় ওঁর পাশের জায়গাটা দেখিয়ে,
– এখানে বসো, আর শুনি তোমাদের মাস্টারের কথা। কীরকম লাগত ওঁর পড়ানো?
– অপূর্ব! 
একটা সন্দেশ মুখে দিয়ে চিবোতে চিবোতে মহৎ পণ্ডিত বললেন,
– ও জিনিস আর হবে না। ওরকম ছাত্র বা ওরকম মাস্টার। 
কিছুদিন পর চলে গেলেন প্রফেসর তারকনাথ সেন। প্রেসিডেন্সির যুগই যেন শেষ হতে বসল।    (চলবে)

 

পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ১৫ নভেম্বর ২০২২
ছবি সৌজন্য: Biblio, Wikipedia

Sankarlal Bhattacharya Author

শংকরলাল ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট, কলকাতায়। ইংরেজি সাহিত্যে স্বর্ণপদক পাওয়া ছাত্র শংকরলাল সাংবাদিকতার পাঠ নিতে যান প্যারিসে। তৎপরে কালি-কলমের জীবনে প্রবেশ। সাংবাদিকতা করেছেন আনন্দবাজার গোষ্ঠীতে। লিখেছেন একশো ত্রিশের ওপর বই। গল্প উপন্যাস ছাড়াও রবিশংকরের আত্মজীবনী 'রাগ অনুরাগ', বিলায়েৎ খানের স্মৃতিকথা 'কোমল গান্ধার', হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিমালা 'আমার গানের স্বরলিপি'-র সহলেখক। অনুবাদ করেছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা থেকে সত্যজিৎ রায়ের চিত্রনাট্য পর্যন্ত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *