(১)

প্রথমে একটু সময় লেগে যাবে চোখটা সইয়ে নিতে। চামড়া পোড়ানো তাত,ক্রমশঃ তা-ও সয়ে যাবে। আলো আঁধারিতে পাগলের মতো ড্রাম বাজাচ্ছে প্রাগৈতিহাসিক ক’জন মানুষ, মানুষী।

মেয়ে তো নয়! যেন পাগলিনী এক। মাথা ঝাঁকাচ্ছে ড্রামের তালে তালে। এলোচুল ঢেকে দিচ্ছে মুখ-চোখ-নাক। দু’হাতে ধরে আগুনের তরবারি। খোলা তরোয়ালের ফলায় দাউ দাউ জ্বলছে মন্দিরের চূড়ার মতো লাল মায়াবি শিখা। বিশাল পাখা দিয়ে হাওয়া চালাচ্ছে দুই সুঠাম পুরুষ তাঁবুর দু দিকে। আবলুশ কালো গা। তৈলাক্ত ত্বকে লাল আগুনের স্রোত পিছলে যাচ্ছে। আলো আর অন্ধকার, লাল আর কালো দপদপ করছে হাওয়ার দমকে। অ্যাজটেক প্রাচীনতা থেকে চুরি করে আনা সুর, ঢেউ এর মতো উঁচু নীচু হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। তাঁবুর গা থেকে, মানুষের গা থেকে, আগুনের গা থেকে প্রতিফলিত হয়ে মিশে যাচ্ছে মূল শব্দস্রোতে। দূর থেকে যেন কাছে আসছে। আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। যখন একদম কাছে, দু’হাতে কান চেপে ধরছি,পর্দা ফাটানো আওয়াজ মাথার খুলি ফুটো করে ঢুকে পড়ছে। ঘেঁটে দিচ্ছে সব বোধবুদ্ধি। আগুনের আঁচ অন্ধ করে দেবে যেন চোখ। বন্ধ করে রাখলেও শ্বেত আগুনের শলাকা চোখের পাতা পুড়িয়ে ঢুকে যাচ্ছে মাথার ভেতর, চোখের লেন্স ঝলসে দিয়ে। আর এই শব্দ আর তাপ ঠেলা মেরে মেরে আমাকে পৌঁছে দিচ্ছে কত কত যুগ পেছনে। মাংস পোড়া গন্ধ, বুনো জন্তুর গন্ধ, চিৎকার করে উচ্চারিত দুর্বোধ্য যত শব্দ। ছিটকে দিচ্ছে আমাকে আমার অস্তিত্বের বাইরে কোথাও। আমার গায়ের রঙ বদলে যাচ্ছে,গলার স্বর। বদলে যাচ্ছে আমার শরীরের নিজস্ব গন্ধ। তাঁবুর দেওয়ালে ছায়া ফেলে ছুটে যাচ্ছে বুনো শুয়োরের দল। হাতে বর্শা নিয়ে পিছনে তাড়া করে কারা ওরা? নিজেকে দেখতে পাচ্ছি ওই দলে। বুনো জন্তুর চামড়ার পোশাক। আমি, রেবন্ত, শুভঙ্কর। আলো আর ছায়ার অদ্ভুত বিভ্রমে মিলে মিশে যাচ্ছে অতীত বর্তমান। ন্যায়,অন্যায়। নিকষ কালোর গভীরে মিলিত হচ্ছে নারী পুরুষ। নারীগর্ভে স্থাপিত হচ্ছে ভ্রূণ। জন্ম নিচ্ছে সন্তান। কত হাজার বছর আগের গল্প?

আগুন নিস্তেজ হয় ক্রমে। পড়ে থাকে ছাই। ছাইয়ের তলায় লুকোন জ্বলন্ত অঙ্গার। তার ওপর পা ফেলে ফেলে ধেই ধেই নেচে চলে কারা। ছোট দল বড় হয় ক্রমে। দ্রুততর হয় লয়। সীমিতার দিকে হাত বাড়ায় ঐ নাচের দলের আগুন মানুষ। তার ধকধক জ্বলা চোখ চিনতে পারে সীমিতা। ভুল একবার করেছে, দ্বিতীয়বার নয়। অন্ধকার হাতড়ে অতি কষ্টে বেরনোর রাস্তা আবার খুঁজে নেয় সীমিতা।

(২)

পঁচিশ বছর পর বন্ধুদের দেখা হচ্ছে পুনর্মিলন উৎসবে। নতুন কোনও গল্প হয়না এই বিষয় নিয়ে। তবে ব্যাপারটা হল ডিসেম্বরের পুনর্মিলন উৎসবটা গল্প নয়। প্রতি বছর হয়। এবছরও হচ্ছে। পঁচিশ বছরটা ঠিক কোন কারণে যে বিশেষ, তাও জানা নেই সঠিক । গল্পের বীজ হয়ে ওঠার কারণটা এরকম হওয়া সম্ভব যে, কলেজ পাশের পঁচিশ বছর মানে জীবনের উতরাইয়ের বছরগুলো পার। কয়েকজনের সঙ্গে আর দেখা হওয়া সম্ভব নয়। এই সংখ্যাটা কমবে না, বেড়েই চলবে। কালের নিয়ম টাইপের একটা শব্দ এক্ষেত্রে বসানো যেতে পারে। আপাতত সুস্থ যখন ঘুরে আসা যাক। ডান হাঁটু রিপ্লেস করতে হবে। সামনের বার হয়তো সে সব ঝামেলা, কে বলতে পারে? তনিমার ডেলিভারি আসছে বছরের এপ্রিলে। আমার কলকাতায় থাকা অনিশ্চিত তার পরের কয়েকটা মাস। বিম্বির বেলায় তনিমার মা গিয়েছিলেন। এবার হয়তো বুবাই আমাকে যেতে বলবে। কম করে তিন মাস। আমার চাকরিটা কোনওদিনই কোনও ভাবনার বিষয় ছিলনা। বুবাই এর ঝামেলাটা তো টেনে দিল মা। ওই শরীর নিয়ে। মায়ের দায়িত্বটা স্কিপ করলে, ঠাম্মির দায়িত্বটাও? এই প্রসঙ্গ এখানেই থামানো ভালো। ছেলেদের আর মেয়েদের দায়িত্ব ভাগ বা চাকুরিরতা মেয়েদের স্বাধীনতার সীমাবদ্ধতা নিয়ে পঁচিশতম রি-ইউনিয়নের স্যুভেনিরের গল্পটা যা-তা রকম বোরিং হবে।

শুভঙ্কর যাবেনা সেটা জানা। তবু জিজ্ঞাসাটা বাধ্যতামূলক।

– তোমাদের ওই হাইফাই কলেজের জমায়েতে আমার মতো ছাপোষা কেরানিকে টানছ কেন সেটা বুঝি। তোমার তুলনায় তোমার বরের ডিগ্রিটা কতটা নিষ্প্রভ সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে। বাট একটু খেয়াল রেখো তোমার জন্যে আনন্দবাজারে তোমার বাবা যে বিজ্ঞাপনটা দিয়েছিলেন তাতে তোমার স্ট্যাটিস্টিক্সটা ঠিক কি ছিল।

– বয়ানটা আমিই তৈরি করে দিয়েছিলাম, বলেছি তোমাকে। আমার হাইট আর গাত্রবর্ণের ওপর আমার হাত ছিলনা।

– কিন্তু দেশে মহানুভব ছেলের অভাব ছিল ডার্লিং। আই ওয়াজ নট ইয়োর ফার্স্ট চয়েস। নাইদার অফ ইওর পেরেন্টস। তোমাদের লিস্টের মাথায় আইআইটি, আইআইএম ছিল। তারপর যাদবপুর, প্রেসি, জেভিয়ার্স ঘুরে, নামতে নামতে এই আশুতোষের কেমিস্ট্রি। বিজ্ঞাপনের বয়ান তুমি লিখেছিলে? দাবিহীন পাত্র – নিজেকে খুব আধুনিক দেখানোর শখ, তাই তো? ক্যাশ আমরা চাইনি কিন্তু। তোমার বাবা জমা করেছিলেন আমার অ্যাকাউন্টে। জানতে না তুমি?

– ওটা বড় জেঠুর উপহার ছিল শুভ। আমাদের হানিমুনের জন্যে।

– ওটা আমাকে, আমাদের পরিবারকে অপমান করার অজুহাত ছিল। আর যা ছিল তা মুখ ফুটে বলিও না আমাকে। ইউ নো বেটার দ্যান মি।

এ সব কথা পুজোর পরের। কালীপুজো, ভাইফোঁটা পার করে। যখন দিন ছোট হতে শুরু করেছে। এটা বছরের ঠিক সেই সময়টা যার জন্যে অপেক্ষা করে থাকি। কেন অপেক্ষা করি, কিসের, সে সব জিগ্যেস করলে বলতে পারব না। দুপুর না পেরোতে ঝপ করে মরে যাওয়া রোদ, বিষণ্ণ বিকেল বা সকালে ঘুম ভেঙে চারদিক অস্পষ্ট করে দেওয়া কুয়াশা, বড্ড মায়াময়। এই কম উজ্জ্বল অপরাহ্ন, কুয়াশার চাদরে মোড়া হেমন্তে একটা নিরাপত্তার আশ্বাস। বরাবর।

তালাপড়া স্মৃতি কুঠুরির দরজা কি খোলো না কখনও তুমি গোপন স্থান থেকে লুকোনো চাবি সন্তর্পণে বার করে? ত্রস্ত হয়ে থাকো তুমি। গাছের একটা পাতা খসার শব্দেও চমকে উঠে তাড়াতাড়ি কুঠুরি বন্ধ করতে যাও। তারপর আবার। পরতে পরতে জমানো স্মৃতি একটার পর একটা তুলে নাও হাতে। ধুলো জমিয়েছ দিনের পর দিন ধরে ওদের গায়ে। এখন সাবধানে ধুলোর স্তর সরিয়ে টেনে আনো। চোখের সামনে মেলে ধরো একটার পর একটা পাতা। বড় ভঙ্গুর অবয়বগুলো যে কোন মুহূর্তে চুরচুর হয়ে ভেঙে যেতে পারে। গুঁড়িয়ে ধুলো হয়ে যেতে পারে। একবার ভেঙে গেলে তৈরি করা যাবেনা আর। সব কিছু এত অন্যরকম এখন। তাই একটা গল্পের ফরম্যাটে। একটা খেলার মতোও। পাঠকের দায়িত্ব গল্পটাকে আলাদা করে নেওয়া।

(৩)

-ভাল আছিস?

পঁচিশ বছরে সব পাল্টে যায়। শেষ দেখা,গলার স্বর শোনার পর পঁচিশটা বছর। সময়ের থাবা আজকাল বড় বেশি প্রতিহিংসাপরায়ণ। এই মুহূর্তের চেহারাটার সঙ্গে বাইশ বছরের তরুণীর কতটা মিল? কুশল জিজ্ঞাসাটা আবার। ভাল আছিস?

– প্রশ্নটা তত সহজ নয়, যখন মাঝে পঁচিশটা বছর কেটে যায়। আগে বল তুই কেমন? ছেলে ইউ এস?

– আমার আপডেট রাখিস এখনও?

– তুই ভুলে গিয়েছিস। পুরোন প্ল্যানিং ছিল এই রকমই। বলেছিস কতবার।

– প্লীজ সীমিতা, তামাদি হওয়া হিস্ট্রি বইয়ের পাতা খুলে বসিস না। বরকে আনিসনি? কেন? এই তনুশ্রী! ডাকতেই মাটি ফুঁড়ে যেন। আর আমিও উত্তরটা পেয়ে গেলাম ।

– না রে শুভঙ্করকে আনিনি। খুব আসতে চেয়েছিল । কোনরকমে কাটিয়েছি। তনুশ্রীর মতো আর দু’একজনকে দেখলে নিজের ফাটা কপাল নিয়ে পুরনো দুঃখটা চাগিয়ে উঠলে প্রবলেমে পড়ব।

-অ্যাবসলিউটলি। শুভকে পটালি কি দিয়ে বল তো?

– টপ সিক্রেট। তোর বউয়ের সামনে বলা যাবে না।

– আরে, রিল্যাক্স ইয়ার। আমার কোনও টেনশন নেই। রেবন্ত আর তোমাকে নিয়ে উড়ো খবর এসেছিল কিছু। ফার্স্ট ডেটেই ব্যপারটা জানতে চেয়েছিলাম সোজাসুজি। একটা গ্রুপ ফটো ছিল তোমাদের, এক্স্কারশনে গিয়েছিলে, মাইথন? তো সেই ফটো দেখে আমি নিশ্চিন্ত হয়েছিলাম।

হেসে ফেলেছিলাম। আর হাসিটা মেকি ছিলনা।

– তনুশ্রী, ফালতু সময় অপচয় কোরোনা।

এসব কথা গা সওয়া। হাই ভোল্টেজ শক একবারই খেয়েছিলাম। প্রথম প্রত্যাখ্যানের পর। আমি প্রোগ্রামের দিকে যাই। ছেলে বলছিল প্রীতি পটেলের ফায়ার ডান্স, ইউ শুড নেভার মিস মম।

– তোমরা দেখবেনা প্রোগ্রাম? তনুশ্রী, বাই দা ওয়ে, শেষ ডিসেম্বরেও ঘাম জমছে তোমার কপালে। পোস্ট মেন্স্ট্রুআল হট ফ্লাশ। হরমোন নিতে হবে তোমাকে। আফটার অল, রেবন্তর সঙ্গে তোমার খেলাটা, যাকে ভালো বাংলায় দাম্পত্য বলে, সেটাতে হরমোনের বিরাট রোল।

(৪)

-ভাল আছিস?

-না ভালো ছিলাম না একটুও। এখন আবার ভাল থাকব।

দু’জন দু’দিকে তাকিয়ে বলে।

– এক মাস ছুটির পর এবারের এই ফেরাটাই শেষ। এর পর ছুটি শেষে আর হস্টেলে ফেরা নেই।

দম বন্ধ লাগে এই কথাগুলোয়। এবার ছুটিতে বাড়িতে মা অন্তত তিনবার জিগ্যেস করেছে, “রেবন্ত বলেছে কিছু তোকে? বাড়িতে জানে তো তোর কথা?”

-মা, কী যে বলো আবোল তাবোল । এখন কেউ ওসব কিছু ভাবছি না আমরা।

গলা কেঁপে যায় কেন সীমিতা তোমার ?

-ঠাণ্ডা লেগেছে। সীজন চেঞ্জের সময়ে তো বরাবরই।

চোখ জ্বালা করে কেন সীমিতা?

-চোখটা দেখাতে হবে। পাওয়ার বেড়েছে মনে হয়।

পাওয়ার বাড়লো কেন সীমিতা? রাত জেগে রেবন্তর অ্যাসাইনমেন্ট করতে গিয়ে তো।

ফাইনাল ইয়ার। ফাইনাল ইয়ার সব তছনছ হয়ে যাবার বছর সীমিতার। রেবন্তর বিদেশ যাবার প্রস্তুতির বছর। ক্যম্পাসিং চলছে। চাকরি পাচ্ছে সীমিতা আর টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। এমএস করতে চলে যাচ্ছে রেবন্ত। এয়ারপোর্টে ওর মা বলছে “তোর গায়ের রঙটা যদি আর একটু পরিস্কার হত, তাহলে তোকেই তো…”

– আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে কাকিমা। ইন্টার্নশিপটা শেষ হলেই বিয়ে। অঘ্রাণে রেজিস্ট্রি।

(৫)

ছোট দিনের বেলার কাল পেরিয়ে গেল এ বছরের মতো। ভোর রাতে ঘুম ভাঙছে। টুকটাক আওয়াজ। শুভঙ্করের কি ট্যুর আছে? ভোরের ফ্লাইট? মনে পড়ছে না। গা, হাত, মুখ সব জ্বলছে এখনও। বাড়ি এসে হড়হড় করে বমি করেছে। মেয়েটা যেমন আগুন উগরোচ্ছিল তেমন সব উগরে দিচ্ছিল সীমিতা। আগুন যেমন নিস্তেজ হয়ে এল, তেমনই এক অপরিসীম ক্লান্তি সর্বাঙ্গে।

-কেমন লাগছে এখন? ইলেকট্রালের জলটা খেয়ে নাও।

-শুভঙ্কর ?

-বল।

-জেঠু তোমার অ্যাকাউন্টে ওই টাকাটা ভরেছিল কেন জান?

– জানি। সব জানি।

– আর কি বাকি থাকে তবে?

– বুবাই ফোন করেছিল। বললাম ফায়ার ডান্স দেখে তোর মা অজ্ঞান প্রায়।

সীমি, বুবাই কিন্তু তনিমাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছে। ওর গায়ের রঙ দেখেনি। হাইট, ওয়েট দেখেনি। রেবন্তর মতো হার্টলেস হয়নি বুবাই । সেখানেই আমি জিতে গেছি। আশুতোষের কেমিস্ট্রি অনার্স।

কতদিন পর সীমিতার কপালে আলতো হাত ছোঁয়ায় শুভঙ্কর। – সন্তানের লোভ আমারও ছিল। ডাক্তার বলেছিল সব জানিয়ে যেন বিয়ে করি। একটু দেরি হল শুধু জানাতে।  আয়াম সরি।

দীর্ঘ শীতের শেষে দিন বড় হচ্ছে। কুয়াশা ফুঁড়ে ইনফ্রা রেড তাপ পুড়িয়ে দিচ্ছে পুরনো আবর্জনা । কুয়াশা সরে যাচ্ছে, নিরাপত্তার অভাব বোধ হচ্ছেনা কিন্তু।

নিজের লেখা শুরু দেখতে দেখতে চোদ্দ পনেরো বছর। লেখা মূলত নিজের সঙ্গে কথা বলা। পাঠক সংখ্যা হাতে গোনা। কিছু বন্ধুর প্রশ্রয় ও সহযোগিতা জুটেই যায় তবু....

2 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *