এক সময় মানুষ গুহাতে থাকত। তার পর সে বুঝতে পারে বাড়ি বানিয়ে থাকাটা আরও সুবিধের। আজও চলছে তাই ঘর তোলা। কেউ কুঁড়ে ঘরে, কেউ চালায়, কেউ আড়াই তলা, কেউ ফ্ল্যাট। সামর্থ্য, পরিস্থিতি আর রুচি অনুযায়ী বেড়ে চলেছে বাসস্থান, দুনিয়াজুড়ে। সঙ্গে আপিস, দোকান, ধর্মস্থান, সেতু, কারখানা- আরও কত কী! দিন ফুরলে মানুষ ঘুমিয়ে পড়ে না আর, আলোয় মোড়া দুনিয়ায় জেগে ওঠে বসতি। স্যাটেলাইটের ছবিতে রাতের দুনিয়া দেখে ধাঁধা লাগে চোখে। এ কোন গ্যালাক্সি!

অথচ, বাসস্থান নির্মাণের আগে থেকে মানুষ ছবি আঁকে। আলতামিরা থেকে অজন্তা। পরে সিস্টিন চ্যাপেল থেকে সালভাদর দালি। নন্দলাল বসু। পরিতোষ সেন। কিছু মানুষ আর্টিস্ট হয়ে ওঠেন। কাজ দেখে আমরা চমৎকৃত হই, উত্তেজিত হই।  আপত্তি করি, রিয়্যাক্ট করি। খুশি হই, শান্তি পাই, ভাল লাগে। আর্টে অভ্যেস তৈরি হয়ে যায়। শিল্পরীতি, শিল্পনীতি নিয়ে আমাদের সুনির্দিষ্ট মতামত তৈরি হয়। মতপার্থক্য বাড়ে। জমে ওঠে শিল্পকলার বাজার- মুগ্ধতায়, তর্কে, টানাপড়েনে এবং বিক্রিবাটায়। এটা থাকবেই, না থাকলে শিল্পী খাবে কি?

আঁকা ছবির বিষয়বস্তু, স্টাইলিং, পারদর্শিতা আর মার্কেটিং স্ট্রাটেজি কোনও কোনও আঁকিয়েকে আর্টিস্ট করে তোলে। এটা মেনে নেওয়া ভাল যে, ছবির বিষয়বস্তু যা হোক তা হোক, রামকিঙ্করী খেয়ালে চলে না আজকের দিনে। এর কিছু ধাঁচ আছে, কায়দা আছে, চাহিদা আছে, অভ্যাসও আছে। সেটা ঠিকঠাক বুঝে কেউ কেউ ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট, ডাক্তার, আইটিবাজ, ল-ইয়ারদের চেয়েও কেউকেটা হয়ে ওঠেন। আমজনতা সম্মান করে। আবার খ্যাতির শিখরে অবস্থানকে হিংসেও করে। নামী শিল্পীরা অনেকটাই অধরা থেকে যান, সাধারণ মানুষ তাঁদের ঘাঁটায় না। এতক্ষন যা বলছিলাম তার প্রায় সবকিছুর বাইরে অবস্থান করতেন রথীন মিত্র। খ্যাতি কম ছিল না তাঁরও। পঁচানব্বই বছর বয়সে সদ্য প্রয়াত দীর্ঘদেহী, গুম্ফশশ্রু শোভিত ভিড়ে মিশে না যাওয়া মানুষটিকে নিয়েই এখন কথা হচ্ছে। 

কৃষ্ণনগরের মানুষ, ছোটবেলা, লেখাপড়া ওখানেই। পুঙ্খানুপুঙ্খ ডিটেলভরা কাজের জন্য প্ৰসিদ্ধ মৃৎশিল্পীদের আখড়া কৃষ্ণনগর।  স্বাধীনতার সময়ে গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজের ছাত্র। বৃত্তিপ্রাপ্ত বরাবরই, এবং ফার্স্ট বয়। ক্যালকাটা গ্রূপের কনিষ্ঠতম সদস্য। পরবর্তীকালে নামী মাস্টারমশাই, বহু প্রতিষ্ঠানে। দেশে বিদেশে ছবির প্রদর্শনী, সম্মান প্রাপ্তি। ঠিক যে বিষয়ের জন্য রথীন মিত্রকে আমরা চিনি, ঐতিহাসিক, পুরাতাত্বিক, বসতবাড়ি, শহর-গঞ্জের রেখা ডকুমেন্টেশন, তার ব্যাপারে বলার আগে একেবারেই অন্য কাজের উল্লেখ করে নিই। ‘দ্য গ্লিম্পসেস অফ ইন্ডিয়া ‘। মুম্বাইয়ের নারিমান পয়েন্টে এয়ার ইন্ডিয়ার জন্য ৩১২ ফিটের মিউরাল, দেশে অন্যতম বৃহত্তম! ওঁর কীর্তি, ১৯৭১ সালে। 

প্রথমে যে কথা হচ্ছিল, সভ্যতার চিত্ররূপ নিয়ে, সেখানে ফিরি। মানুষের কাছে মানুষই সবচেয়ে জরুরি।  তাই ছবিতে মানুষই প্রধান এলিমেন্ট। পোর্ট্রেট। রাজসভা, ঘর গেরস্থালি, অন্দরমহল। প্রকৃতির ছবির চাক্ষিক আবেদন প্রবল, আঁকা হয়ে আসছে বহু বছর ধরে। মনের অতি জটিল তরঙ্গপ্রবাহ নিয়ে রিয়ালিস্টিক, অ্যাবস্ট্রাক্টকে নিয়ে চর্চা হয়েছে, হয়ে চলেছে প্রভূত পরিমানে। কিন্তু বাড়ির বাইরের দৃশ্য, একটু দূর থেকে তাকিয়ে থাকা যে নির্লিপ্ত চেহারা, তা কমই টেনেছে শিল্পীদের। রথীন মিত্র ধরেছিলেন অজস্র বহু না দেখা এবং দেখা স্থাপত্যকে। বছরের পর বছর ধরে যাদের ফটোগ্রাফের অভাব ছিল না মোটেই।  এঁকেছিলেন শ’য়ে শ’য়ে। ব্রিটিশ ইন্ডিয়ায় কোম্পানি পেইন্টিং-এর উজ্জ্বল নাম ড্যানিয়েল। তৎকালীন ভারতবর্ষ, কলকাতার দৃশ্য খুঁজলে আজও সেগুলিই সামনে আসে। তখন ক্যামেরা আবিষ্কার হয় নি। এবারে আসল জায়গা। ফটোগ্রাফের উপস্থিতিকে পাল্লা দিয়ে হাতে আঁকা চালিয়ে যাওয়া নিঃসন্দেহে সাহসের পরিচয়। ডেসমন্ড ডোয়েগ থেকে সমীর বিশ্বাস এই কাজে বড় নাম। রথীনবাবুর কাজের বিস্তৃতি আরও বড়। এতটাই যে, আশির দশকে তার আঁকা প্রাচীন, ঐতিহ্যমন্ডিত বাড়ির ছবির দাপটে পুরোনো বাড়ি ভেঙে ফেলার ধ্বংসলীলায় মেতে ওঠা কলকাতা কর্পোরেশনও থমকে যায়। তৈরি হয় হেরিটেজ স্ট্রাকচারের তালিকা। শুরু হয় সংরক্ষণের চেষ্টা। কালো কালির কল্যাণে বেঁচে যায় এই শহরের ইতিহাসের অনেকটাই।  রথীন মিত্রর এই অবদানের বিষয়ে আবার আলোকপাত করছি। 

তা হলে কী আছে কিছু জরুরি, ঐতিহাসিক, স্মৃতি বিজড়িত দেওয়াল, খিড়কি, বারান্দা, দালান, ল্যাম্প পোস্ট বা বটের ঝুরি ভরা প্রায় স্থির, নট নড়নচড়ন স্টাইলে আঁকা ওঁর ছবিতে? আছে দেখতে না পাওয়া ওই জায়গার সঙ্গে সম্পৃক্ত মানুষগুলোর প্রাণের স্পর্শ। ওই চরিত্রগুলোকে আমরা ইতিহাসে জেনেছি, বুঝেছি নিজের মতো করে, কিন্তু সামনাসামনি দেখিনি। দেখার দরকার নেই। কিছুটা অনুভব আর আভাসই যথেষ্ট। এই অতি পেলব, নিস্তব্ধ, মায়াময় স্মৃতিসরণীতে রথীন মিত্রর ধীর পদচারণা আমাদের জন্য রেখে গেছে অমূল্য রেখা সম্পদ।  

শুভময় মিত্র আদতে ক্যামেরার লোক, কিন্তু ছবিও আঁকেন। লিখতে বললে একটু লেখেন। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে অনেকরকম খামখেয়ালিপনায় সময় নষ্ট করে মূল কাজে গাফিলতির অভিযোগে দুষ্ট হন। বাড়িতে ওয়াইন তৈরি করা, মিনিয়েচার রেলগাড়ি নিয়ে খেলা করা, বিজাতীয় খাদ্য নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করা ওঁর বাতিক। একদা পাহাড়ে, সমুদ্রে, যত্রতত্র ঘুরে বেড়াতেন। এখন দৌড় বোলপুর পর্যন্ত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *