মাটিতে দাগ টেনে চিত্র আঁকবার প্রসঙ্গ রামায়ণে আছে। সীতার বিবাহবাসরে রঙিন আলপনা আঁকা হয়েছিল। তাছাড়া বনবাসে থাকাকালীন লক্ষ্মণের সুরক্ষাগণ্ডি কেটে দেওয়ার ঘটনা সবাই জানেন। গণ্ডি পেরিয়ে যাওয়ার ফল ভুগতে হয়েছিল সীতাকে। রঙ্গোলি কিম্বা আলপনার রেখা ভারতবর্ষের মানুষের বিশ্বাসে আঁকা হয়ে আছে শুধুই উৎসবের সৌন্দর্যায়নের অঙ্গ হিসেবে নয়, সুরক্ষাবলয়ের গণ্ডি হিসেবেও। সেই কারণে শুধুমাত্র দেবদেবীর পূজা উপলক্ষে সাজসজ্জা অথবা ঘট স্থাপনের জন্য মাটিতে চিত্র আঁকা হয়, এমন নয়। বিবাহ, অন্নপ্রাশন উপলক্ষে আঁকা হয়। 

তাছাড়া, নবান্ন, পোঙ্গল- অর্থাৎ নতুন ফসল ঘরে তুলবার উৎসবেও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ভূমিচিত্র আঁকা হয়ে থাকে। মানুষের বিশ্বাস যে ওই চিত্রের রেখার বলয় অশুভ শক্তিকে দূরে রাখবে। দীপাবলি উৎসবের ঘনকৃষ্ণ রাতে অনেক বাড়িতে রঙ্গোলি এঁকে চারপাশে প্রদীপ জ্বালিয়ে সজ্জিত করা হয়। রঙের রেখার পাশে আগুনের সহাবস্থান, সেও ওই শুভ শক্তি ও সৌভাগ্যের আবাহনের ইঙ্গিত।

ভারতে স্থানভেদে ভূমিচিত্রের নাম ও আকৃতি-প্রকৃতি বদলে যায়। যেমন মধ্যভারতের একটা বড় অংশে এই ভূমিচিত্রকে বলা হয় রঙ্গোলি। ‘রঙ্গবল্লী’ (অর্থ- একধরনের লতা অথবা সারিবদ্ধ রঙের নকশা) সংস্কৃত শব্দ থেকে ‘রঙ্গোলি’ শব্দের উদ্ভব বলে ধরা হয়। আবার রাজস্থানে বলা হয় ‘মান্দানা’। রাজরাজড়ার দেশ রাজস্থানে ভূমিকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে তুলবার এই ‘মণ্ডন’ ক্রিয়াপদ থেকেই ‘মান্দানা’ শব্দটির উদ্ভব বলে ধরা হয়। গুজরাটে ‘গাহুলি’ অথবা ‘সাথিয়া’, বাংলায় ‘আলপনা’, বিহারে ‘আরিপানা’, ওড়িশায় ‘ঝুটি চিতা’, উত্তরপ্রদেশে ‘চৌকপুরানা’, উত্তরাখণ্ডে ‘আইপান’, দক্ষিণ ভারতে ‘কোলাম’, হিমাচল প্রদেশে ‘লিখনু’- ইত্যাদি নানা নামে এবং নানা ধাঁচে ভারতে ভূমিচিত্র আঁকবার প্রচলন আছে।    

ভূমিচিত্র আঁকার ব্যাপারে ভারতের বেশিরভাগ অঞ্চলে মূল ভাবনাটি অতীত কাল থেকেই মোটামুটি একইরকম। প্রথমে জায়গাটিকে গোবরের লেপ দিয়ে শুদ্ধ করে নেওয়া হয়। তারপর গাঢ় রঙের প্রলেপ দিয়ে, শুকিয়ে নিয়ে, ওই রঙের বিপরীতে সাদা গুঁড়ো কিম্বা রঙের প্রলেপ দিয়ে চিত্র আঁকা হয়। বেশিরভাগ অঞ্চলে বাড়ির মেয়েরা এই চিত্রকল্পের কাজ করে থাকেন। কারণ, মেয়েদের নরম হাতের সরু সরু আঙুল এ জাতীয় শিল্পসৃষ্টির সহায়ক। তাছাড়া, অন্দরমহলের সাজসজ্জার ভার যেহেতু বাড়ির মেয়েদের উপরেই ন্যস্ত থাকত বহুযুগ ধরে, সেই কারণেও এ ধরনের শিল্পসৃষ্টি মেয়েরাই করে থাকেন, কারণ এ চিত্র মূলত গৃহসজ্জার সহায়ক বলেই প্রচলিত।

Pre Historic Floor Art
(উপরে বাঁয়ে) কোঙ্কণ উপকূলে পাওয়া প্রস্তর যুগের পেট্রোগ্লিফে মণ্ডলাকার নকশা (ডাইনে) ব্রোঞ্জ যুগে তুরস্কে পাওয়া বায়ু দেবতার মন্দিরের মোজেইকে সহজ ত্রিভুজাকৃতি নকশা (নীচে বাঁয়ে) কোঙ্কণ উপকূলের পেট্রোগ্লিফে বৃত্তাকার গোলকধাঁধার নকশা (ডাইনে) চতুষ্কোণ নকশায় পাখির প্রতীক

ভারতের বাইরে ভূমি অলঙ্করণের ক্ষেত্রে অস্থায়ী কিম্বা স্বল্পমেয়াদি উপকরণ দিয়ে বানানো সূক্ষ্ম চিত্রকলার খোঁজ ইন্দোনেশিয়া ছাড়া আর কোথাও সেভাবে পাওয়া যায় না। বরঞ্চ স্থায়ী ধরনের মোজেইকের শিল্পকলা বহু প্রাচীন। মেসোপটেমিয়ার সভ্যতা, গ্রিক ও রোমান সভ্যতাই শুধু নয়, প্রাগৈতিহাসিক যুগে, অর্থাৎ ব্রোঞ্জ যুগের শেষের দিকে মোজেইক শিল্পের নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে তুরস্কের ‘উসাক্লি হয়ুক’ অঞ্চলে। বায়ু দেবতার মন্দিরের ভূমিতে ত্রিভুজাকৃতি নকশা দিয়ে অলঙ্করণ করা হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন রঙের ছোট ছোট নুড়ি মাটিতে গেঁথে।       

ভারতে প্রাগৈতিহাসিক যুগের শিল্পকীর্তির প্রসঙ্গে অনেকেই ভীমবেটকা গুহার দেয়ালচিত্রের কথা উল্লেখ করেন। ভূমি অলঙ্করণ ইত্যাদির কোনও উল্লেখ পাওয়া যায় না। কিন্তু সম্প্রতি প্রস্তর যুগের ভূমিচিত্রের নমুনা পাওয়া গেছে। ল্যাটেরাইট পাথরের উপরে খোদাই করা (পেট্রোগ্লিফ) নানা ভূমিচিত্রের সন্ধান মিলেছে মহারাষ্ট্রে এবং গোয়ার কোঙ্কণ উপকূলে। রত্নগিরি এবং রাজপুর এলাকায় পাওয়া এই ভূমিচিত্রগুলি যেহেতু পাথরের উপরে খোদাই করা, সেহেতু নষ্ট হয়নি। তবে খুব ভালো অবস্থায় সেগুলি রক্ষণাবেক্ষণ করা হচ্ছে, এমনটিও বলা চলে না। উপরন্তু ল্যাটেরাইট পাথর প্রায়শই খনন করা হয়ে থাকে বিভিন্ন খনিজ সম্পদের সন্ধানে। দিশাহীন খনন হয়ত অনাবিষ্কৃত ভূমিচিত্র খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনাকে নষ্ট করে দিতে পারে।

কোঙ্কণ উপকূলে পাওয়া প্রাগৈতিহাসিক যুগের এই ভূমিচিত্রগুলির বিষয়বস্তুর মধ্যে বিভিন্নরকম প্রতীকের ব্যবহার চমকে দিতে পারে। সমকেন্দ্রিক বৃত্ত, গোলকধাঁধার মতো গোলাকার চিত্র থেকেই হয়তো বর্তমান সময়ের গোল মণ্ডলাকার চিত্রের উদ্ভব। এছাড়া জন্তু জানোয়ারের ছবি, জীবনচক্র, উর্বরতার দেবী, ইত্যাদি নানা চিত্র দেখা যাচ্ছে। শুধুমাত্র গোল প্রতীক নয়। চতুষ্কোণ সীমানার মধ্যে পাওয়া যায় এক পাখির চিত্র। এছাড়া অস্ত্রধারী যোদ্ধার চিত্র কম নয়। হয়তো বা এরকম চিত্রের অনুসরণেই দেবদেবীর মূর্তি নির্মিত হয়েছিল সভ্যতার বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে। 

Harappa Seal Swastik Floor art
সিন্ধু সভ্যতায় হরপ্পাতে পাওয়া স্বস্তিক চিহ্নের সিলমোহর

স্থানীয় অধিবাসীদের বিশ্বাস যে মহাভারতের পাণ্ডবরা এসে এই চিত্র নির্মাণ করে গেছেন। সিন্ধ প্রদেশে পাওয়া পেট্রোগ্লিফে স্বস্তিকচিহ্ন পাওয়া যায়। সেটিরও সময়কাল নব্যপ্রস্তর যুগ। সিন্ধু সভ্যতার সময়ে হরপ্পা ও মহেঞ্জোদাড়োতে সিলমোহরে পাওয়া চিত্রের মধ্যেও নানা জ্যামিতিক আকার গোলাকৃতি মণ্ডলের মধ্যে সাজানো এরকম ছবি পাওয়া যায়। এছাড়া নানা রকমের স্বস্তিকচিহ্নের সিলমোহর পাওয়া গিয়েছে সিন্ধুসভ্যতার ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলিতে। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই ভারতীয় সভ্যতার মানুষের মধ্যে স্বস্তিক চিহ্ন এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক।

প্রস্তর যুগে মানুষ শস্য ফলন শিখে উঠতে পারেনি। সেই কারণে, শস্যদানার গুঁড়ো দিয়ে নয়, ভূমিচিত্রের জন্য বেছে নিয়েছে পাথুরে মাটি। আবার ল্যাটেরাইট ভয়ানক কঠিন পাথরও নয়। অতএব, প্রস্তর যুগের ছোটখাট পাথর নির্মিত যন্ত্র দিয়েই খোদাই করে ভূমিচিত্র তৈরি হয়েছিল। সভ্যতার বিবর্তনের পথে, শস্য ফলন শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গে ভূমিচিত্রের অন্যতম উপকরণ হিসেবে ভারতের বিভিন্ন অংশে ব্যবহার করা হতে লাগল শস্যদানা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভারতবর্ষের ভূমিচিত্র অঙ্কনের প্রধান উপকরণ চালের গুঁড়ো। অর্থাৎ ধানের অধিক ফলন যে সব অঞ্চলে, সেখানেই উঠে এসেছে নানা ধরনের অঙ্কনশৈলী। সেসব অঞ্চলে মানুষ সম্পন্ন ছিল এবং সহজ সরল জীবনযাত্রার মাঝে সৃষ্টিশীল কাজে ব্যয় করবার মত সময় ছিল হাতে। শস্য ফলিয়ে মানুষের পেট ভরবার পরেও অন্ন উদ্বৃত্ত হয়েছে। তাই সেই অন্ন ব্যবহৃত হয়েছে ভূমিচিত্রের শিল্পকলায়। 

Gahuli Jain Floor Art
জৈন উপাসনায় চালের অক্ষত শস্যদানা দিয়ে আঁকা ‘গাহুলি’তে স্বস্তিক একটি বেশ জনপ্রিয় প্রতীক

জৈন ধর্মের আচার হিসেবে ভূমিচিত্র নির্মিত হয় চালের গুঁড়ো কিম্বা পেস্ট দিয়ে নয়, চালের অক্ষত সম্পূর্ণ দানা দিয়ে। এ ধরনের চিত্রকে বলা হয় ‘গাহুলি’ অথবা ‘সাথিয়া’। ঈশ্বরের আসনের সামনে চালের স্তর বিছিয়ে আঙুল দিয়ে চালের দানা সরিয়ে সরিয়ে ফুটে ওঠে অপূর্ব চিত্র।  স্বস্তিক বহুল প্রচলিত প্রতীক ‘গাহুলি’ নির্মাণে। এছাড়া কলস, সূর্য, প্রদীপ, শঙ্খ ইত্যাদি প্রতীকও দেখতে পাওয়া যায়। গাঢ় রঙের ভূমি অথবা কাঠের টেবিলের উপরে সাদা চালের দানা ফুটে উঠে অপূর্ব রূপ ধারণ করে। সম্পূর্ণ হবার পরে সমগ্র চিত্রটিকে দেখে গোলকধাঁধার কথা মনে পড়বে।

Indonesian floor art
ইন্দোনেশিয়াতে বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানে ফুল, পাতা দিয়ে রঙ্গোলি বানানো হয়

যেসব অঞ্চলে চালের ফলন কম, গমের ফলন বেশি, উত্তর ভারতের সেসব অঞ্চলে ভূমিচিত্রের প্রধান উপকরণ হিসেবে চালের গুঁড়োর বদলে ময়দা ব্যবহৃত হয়। মধ্য এবং পশ্চিম ভারতের একটা বিরাট অংশে রঙিন ভূমিচিত্র- রঙ্গোলি আঁকা হয়। অতীতে প্রাকৃতিক রঙ, পাথরগুঁড়ো কিম্বা গাছপালা শুকিয়ে তার সঙ্গে বালি মিশিয়ে তৈরি করা হত। মশলা, যেমন হলুদের গুঁড়ো ব্যবহার করা হয় অনেক ক্ষেত্রে। সিঁদুরের ব্যবহারও দেখতে পাওয়া যায়। এখন অবশ্য অনেক ক্ষেত্রেই রাসায়নিক রঙ ব্যবহার করা হয় রঙ্গোলি আঁকবার জন্য।  চাল ছাড়াও অনেক ক্ষেত্রে রঙ্গোলি আঁকবার জন্য ডালের দানা, কিম্বা গোটা মশলার দানা ব্যবহার করা হয়। নানা রঙের ফুল, ফুলের পাপড়ি, বৃতি, গাছের পাতা এসব দিয়েও রঙ্গোলি আঁকা হয়ে থাকে। ইন্দোনেশিয়ার বালিতে বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানে ফুল দিয়ে নানা সূক্ষ্ম কারুকাজের মণ্ডলাকার ভূমিচিত্র আঁকা হয়ে থাকে।   

ভূমিচিত্রের মোটিফ এবং আকার বদলে যায় স্থানভেদে। উত্তর ভারতে ‘চৌকপুরানা’-তে চতুষ্কোণ বর্গাকার কিম্বা বরফি আকারের নকশার প্রাধান্য। ‘চৌক’ শব্দের অর্থ হল ‘চৌমাথা’। চৌমাথা শুধু যে পথের হয়, তা নয়। ঘরের মাঝে যে আঙিনা, সেটাকেও ‘চৌক’ বলা হবে। সেই আঙিনা পূর্ণ করে সাজিয়ে তোলার জন্য ‘চৌকপুরানা’। নানা রকমের প্রতীক ফুল, লতাপাতা আজকাল আঁকা হয়ে থাকে এই সব চিত্রে। তবে সাবেককালের নকশায় ত্রিভুজ, চতুর্ভুজের প্রাধান্য বেশি। বৃত্তাকার কাজের প্রাধান্য চৌকপুরানার চিত্রে অতীতে ছিল না। আবার উত্তরাখণ্ডের ‘আইপান’ চিত্রে চতুষ্কোণ সীমানার মধ্যে বৃত্তাকার  সূক্ষ্ম কাজ দেখতে পাওয়া যায়। ঈশ্বরের আসন পাতবার চৌকিতে এই কাজ করা হয়। সরলরেখার সাহায্যে এবং ত্রিভুজাকার জ্যামিতিক আকারের সাহায্যে চিত্রটি ভরাট করা হয়। এছাড়াও ত্রিশূল ইত্যাদি প্রতীক লক্ষ্য করা যায়। 

Aipan Floor art
উত্তরাখণ্ডের আইপান ভূচিত্রে ত্রিভুজ এবং জ্যামিতিক আকারের প্রাধান্য। ত্রিশূল প্রতীক শিবের অর্চনার উদ্দেশে

পার্বত্য, পাথুরে এলাকায়, যেমন রাজস্থানের ‘মান্দানা’ আঁকবার ক্ষেত্রে ত্রিভুজাকৃতি নকশার প্রাধান্য, আবার গাঙ্গেয় অঞ্চলে বাংলা, বিহার, এসব জায়গায় ফুল, লতাপাতা এসব নকশা বেশি আঁকা হয়ে থাকে। নদী অথবা সমুদ্রের ধারের অঞ্চলের নকশাতে ঢেউ, মাছ, শঙ্খ এসব নকশাও দেখতে পাওয়া যায়। অরণ্যবাসী মানুষের বাড়ির সামনে আঁকা  আলপনাতে গাছ, পাখি, জন্তু-জানোয়ার এসবের প্রাধান্য। উদাহরণস্বরূপ, মধ্যভারতের ‘গোন্ড’ আদিবাসীদের আঁকা নকশায় গাছপালা, ময়ূর, হাতি, সাপ, বাঘ, বন্য শূকর এরকম নানা বিষয়বৈচিত্র দেখা যায়। আবার পশ্চিম ভারতের ‘ওয়ার্লি’ আদিবাসীদের নকশায় সহজ জ্যামিতিক আকার ও রেখার সাহায্যে মানুষের দেহ আঁকা হয়। মানুষের প্রাত্যহিক কাজ, নাচগান, শিকার এরকম বিষয়বস্তু উঠে আসে ভূমিচিত্রে। উপকরণ হিসেবে আদিবাসীরা সাদা, লাল, গেরুয়া, এরকম নানা রঙের স্থানীয় মাটি ব্যবহার করে। যেসব অঞ্চলে কেওলিন সমৃদ্ধ মাটি আছে, সেইসব জায়গা থেকে সাদা রঙ, কিম্বা লোহাসমৃদ্ধ মাটি থেকে লাল রঙ বানিয়ে নেয় আদিবাসীরা। অর্থাৎ ভূপ্রকৃতি ও পরিবেশের প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষ করা যায় ভূমিচিত্রের নকশায়।  

Worli Floor Art
ওয়ার্লি আদিবাসীদের অঙ্কনে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের ছবি ফুটে ওঠে সহজ রেখার টানে

রঙ্গোলি, আলপনা, ইত্যাদি হিন্দুধর্মের বিভিন্ন উৎসবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মণ্ডলাকার ভূমিচিত্র কিম্বা বাস্তুশাস্ত্রে ব্যবহৃত বাস্তুপুরুষ মণ্ডলের নকশার মূল ভাবনা অনেকক্ষেত্রে একই রকম। বিষয়টা শুধু যে উৎসব উদযাপনের সঙ্গে জড়িত এমন নয়। বৈদিক যুগ থেকে চলে আসা এই ভাবনাগুলি হয়তো অনেকক্ষেত্রে স্থাপত্যবিদ্যার সঙ্গে জড়িত ছিল। চিত্রের কেন্দ্রীয় স্থানটিকে ‘ব্রহ্মস্থান’ বলা হয়। সমকেন্দ্রীয় বৃত্তের বিভিন্ন স্তরে কিম্বা বিভিন্ন দিকে বিভিন্ন দেবতার বাস, এভাবেই ‘মণ্ডলা’ এখনও আঁকা হয়ে থাকে। জ্যামিতিক এই চিত্রগুলিকে ধার্মিক আচার আচরণ থেকে বিযুক্ত করে স্থাপত্যবিদ্যার নকশা হিসেবেও দেখতে পারি আমরা। যে কোনও স্থপতি একটা ভূমির নকশা করে তবে কাজে হাত দেবেন, এটাই স্বাভাবিক। এই ধরনের প্রাথমিক নকশা থেকেই মণ্ডলা জাতীয় ভূমিচিত্রের উদ্ভব হওয়া সম্ভব। প্রয়োজন এবং সৌন্দর্যায়ন এক্ষেত্রে হাত ধরাধরি করে চলেছে। 

Rajasthan Mandana Floor Art
রাজস্থানের মান্দানা চিত্রে ত্রিভুজ ও জ্যামিতিক আকারের প্রাধান্য

মণ্ডলা জাতীয় চিত্র হিন্দু এবং বৌদ্ধ তন্ত্রের অন্যতম অঙ্গ। সাধনার বিভিন্ন স্তর, শরীরের বিভিন্ন চক্রের প্রতীক দেখানো হয় মণ্ডলাকার চিত্রে। এককথায় ‘মণ্ডল’ শব্দটির দ্বারা সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ব্যপ্তি বোঝানো হয়। তিব্বতিদের আঁকা চিত্রে নানা রঙ এবং সূক্ষ্ম রেখার দ্বারা রচিত নিখুঁত জ্যামিতিক ভারসাম্য বুঝিয়ে দেয় যে মণ্ডলাকার চিত্রনির্মাণ ধ্যান এবং সাধনার অন্যতম অঙ্গ। এখানেও সুরক্ষাবলয়ের মধ্যে শুভ শক্তির আবাহন, ধরনের মূল ভাবনা কাজ করে। ইউরোপে খ্রিস্টধর্মের উত্থানের আগে পৌত্তলিক পেগান ধর্মের বিস্তার ছিল। তাদের মধ্যেও ভূমিতে সুরক্ষাবলয় অঙ্কন করবার রেওয়াজ ছিল, এবং এখনও আছে। 

Tibetan Mandala Floor Art
তিব্বতের মণ্ডলা চিত্রনির্মাণ বৌদ্ধ সাধকদের সাধনপথের অঙ্গ

বৃত্তের মধ্যে পঞ্চমুখী তারার মতো চিত্র পেগান অথবা ভিক্কানদের মধ্যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। দীপাবলিতে যেভাবে রঙ্গোলির সঙ্গে প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখবার রেওয়াজ আছে, পেগানরাও পঞ্চমুখী তারার মতো ওই চিহ্ন ঘিরে বৃত্তাকারে মোমবাতি জ্বালিয়ে ভূমিতে অগ্নিবলয় নির্মাণ করে। পঞ্চমুখী তারার ওই প্রতীকের সঙ্গে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের পঞ্চভূতের তত্ত্বের বিশেষ মিল আছে।

(বাঁয়ে) উত্তর ভারতে অশুভ শক্তির বিনাশের জন্য রঙ্গোলির পাশে প্রদীপ। (ডাইনে) পেগান লোকাচারে পঞ্চমুখী তারা এঁকে মোমবাতি জ্বালানো

বর্তমান সময়ে ভারতের ভূমিচিত্রের বিভিন্ন প্রতীক এবং চিহ্নের ভাবনা নানা প্রাকৃতিক বিষয়বস্তু থেকে নেওয়া। অনেক প্রতীক মানুষ প্রাগৈতিহাসিক সময়কাল থেকে আঁকতে শুরু করেছে। পরবর্তী সময়ে নানা প্রতীক ধর্মীয় লোকাচার অথবা অধ্যাত্মভাবনার সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে। ভূমিচিত্রের মধ্যে খাদ্যশস্যের ব্যবহারের পিছনে ধর্মীয় বিশ্বাস কাজ করে। একটি অতি প্রচলিত বিশ্বাস হল- অন্নের মধ্যে লক্ষ্মীর বাস। অতএব, অন্ন অতি পবিত্র উপাদান। তাছাড়া বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ বিশ্বাস করে, যদি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রাণী, পিঁপড়ে এরা সেই অন্নের গুঁড়ো ভক্ষণ করে, সেই প্রাণীর ক্ষুন্নিবৃত্তি মানুষের জীবনে আশীর্বাদ বয়ে নিয়ে আসে। সনাতন ধর্মে নানা প্রকার যজ্ঞের বিধান আছে। অন্যতম হল ‘ভূতযজ্ঞ’, যেখানে মানুষ ছাড়া অন্যান্য জীব, এমনকী যাদের চর্মচক্ষে দেখা যায় না, আণুবীক্ষণিক জীব- এদেরও খাদ্যদান করে পরিতৃপ্ত করবার কথা আছে। খাদ্যশস্য দিয়ে ভূমিচিত্র নির্মাণ সেই ভূতযজ্ঞের অন্যতম অঙ্গ। 

Kolam Floor Art
কোলাম আঁকছেন এক নারী। প্রশ্ন ওঠে, ভূমিচিত্র কি একান্তভাবে নারীদের শিল্প?

ভারতে বেশিরভাগ জায়গায় এই ভূমিচিত্র, রঙ্গোলি অথবা আল্পনা উৎসব অনুষ্ঠানের জন্য আঁকা হয়ে থাকে বলে এদের স্থায়িত্ব কেবলমাত্র উৎসবের দিনগুলি। দক্ষিণ ভারতে বাড়ির সামনে নিয়মিত ‘কোলাম’ আঁকা হয়। মেয়েরা ব্রাহ্মমুহূর্তে ঘুম থেকে উঠে শুদ্ধাচারে বাড়ির সামনের অংশে ভূমিচিত্র আঁকে। সেক্ষেত্রেও অবশ্য তার স্থায়িত্ব একদিনের বেশি নয়। অবিচ্ছিন্ন রেখা ছোট ছোট ফাঁস কিম্বা লুপের মতো জুড়ে গিয়ে জ্যামিতিক ছন্দ বজায় রাখে। এই যে নির্ভুলভাবে প্রতিদিন ছবি আঁকা, এই ভারসাম্য বজায় রাখা, মেয়েদের জন্য এই কর্মযোগ যেন এক ধ্যানের মতো। মনকে স্থির রাখা প্রতিদিন চিত্রের রেখায়, বিন্দুতে- এই কাজ মনের জন্য অপূর্ব এক ব্যায়াম। 

সাদা রঙের আঁকা ভূমিচিত্রের মাঝে সিঁদুরের ফোঁটা ইঙ্গিত করে রক্তবিন্দুর। যে বিন্দু জীবনের একক এবং উৎস। সাধারণত ঝাড়ু দেওয়া হয় না, কিম্বা পা দিয়ে মাড়িয়ে যায় না কেউ এই চিত্র। হাত দিয়ে সরিয়ে মুছে দেওয়া হয় রঙের অথবা শস্যদানার গুঁড়ো; জল দিয়ে ধুয়ে দেওয়া যেতে পারে। চিত্র মুছে দিয়ে আবার আঁকা হয়, এ যেন ভারতীয় দর্শনের মূল কথা। ‘সবই মায়া- জীবন অনিত্য’ এই ভাবনার প্রতিফলন দেখতে পাই। কিন্তু জীবন হেলাফেলায় নষ্ট করবার মতো বস্তুও নয়, তাই ভূমিচিত্র মুছে দেওয়া হয় সম্মানের সঙ্গে। স্থানটি পরিষ্কার করে দেবার জন্য যথাযথ আচার পালন করা হয়। জীবনের এক চক্র শেষ হয়ে শুরু হয় আর এক চক্র।

 

*ছবি সৌজন্য: লেখক

জন্ম জুলাই, ১৯৭১, কলকাতায়। ২০০৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূবিদ্যায় পিএইচডি। গল্প, কবিতা লেখালেখি ছাড়াও ইংরেজি এবং জার্মান ভাষা থেকে অনুবাদের কাজ বিশেষ পছন্দের। ২০১৬ সালে প্রকাশিত প্রথম কবিতার বই ‘অরণ্যমেঘবন্ধুর দল’ বিশেষ সমাদৃত হয়েছে।

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *