বাংলা কাব্য-সঙ্গীতের ইতিহাসে ব্রহ্মসঙ্গীতের ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ব্রাহ্মধর্মের ব্রহ্ম-উপাসনা, ব্রহ্মচিন্তাকে অন্তর্মুখী নিবিড় ও প্রাণময় করার জন্যই মুখ্যত ব্রহ্মসঙ্গীতের সৃষ্টি। বাংলাদেশের ব্রাহ্ম আন্দোলনের প্রবক্তা রাজা রামমোহন রায় (১৭৭৪-১৮৩৩ খ্রি) ব্রহ্মসঙ্গীতের প্রবর্তকও বটেন। যদিও বাংলাগানে ভক্তিগীতি বা ধর্মসঙ্গীতের ঐতিহ্য বহু প্রাচীন। রামমোহন স্বয়ং ছিলেন সঙ্গীতপ্রেমী। তাই ব্রাহ্মধর্মের ঈশ্বরচিন্তা, ব্রহ্মোপাসনা এবং তত্ত্ব-আলোচনাকে কিছুটা সরস করে তোলার চেষ্টা করেছিলেন এই সঙ্গীতের মাধ্যমে। রামমোহনের আবির্ভাবকালকে বলা যায় বাংলাদেশের সঙ্গীতে ‘শারদোৎসব পর্ব’। কবিগান, তর্জা, আখড়াই, যাত্রা ইত্যাদি এই সময়ে খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। রামমোহন স্বয়ং টপ্পা রচয়িতা এবং বাংলা টপ্পার অন্যতম জনক কালী মির্জার (১৭৫০ – ১৮২০ খ্রি) কাছে সঙ্গীতশিক্ষা করেছিলেন বলে জানা যায়।*
এই সময়কার কুরুচিপূর্ণ সঙ্গীতচর্চা রামমোহন রায়কে অত্যন্ত পীড়িত করেছিল। ফলে বাংলা গানের রুচি সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা তিনি অনুভব করেন। হয়তো এই কারণটিই তাঁকে ব্রহ্মসঙ্গীত রচনায় অনুপ্রাণিত করেছিল। তাঁর হাতেই প্রথম বাংলা গানের মাধ্যমে প্রচারিত হল বৈরাগ্য, নিরাসক্ত ঈশ্বরভক্তি। বস্তুত, ব্রহ্মসঙ্গীত হচ্ছে বাংলায় প্রচলিত লোকসুর, কীর্তন, রাগরাগিণীর সুরাশ্রিত ব্রহ্ম-বিষয়ক গান এবং বাংলার ওস্তাদি গায়কীতে তার রূপায়ণও চলে এসেছে আদিযুগ থেকে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির সঙ্গীতশিক্ষায় হিন্দুস্থানী রাগসঙ্গীতের পাশাপাশি রাগাশ্রিত ব্রহ্মসঙ্গীতের ব্যবহারও করা হত। ‘ব্রহ্মসঙ্গীত’ নামটি রামমোহনেরই দেওয়া। বিশ্বব্যাপী অখণ্ড বিশালতাকে উপলব্ধির মধ্যে এনে তাকেই তিনি রূপ দিতে চেয়েছিলেন এই গানে।
রামমোহনের অনুরোধে বাংলা টপ্পার জনক নিধুবাবু বা রামনিধি গুপ্ত (১৭৪১-১৮৩৯ খ্রি) একটি ব্রহ্মসঙ্গীত রচনা করেন । গানটি এখানে দেয়া গেল।
বেহাগ / আড়াঠেকা
“পরমব্রহ্ম তৎপরাৎপর পরমেশ্বর
নিরঞ্জন নিরাময় নির্বিশেষ সদাশয়,
আপনা আপনি হেতু বিভু বিশ্বধর
সমুদয় পঞ্চবোধ জানা জ্ঞান যথা বাস
পবঞ্চ ভূতাধিকার।
অন্নময়, প্রাণময়, মানস বিজ্ঞানময়
শেষেতে আনন্দময় প্রাপ্ত সিদ্ধ নয়।”**
ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাঙালি মানসে ব্রাহ্মসমাজ ও ব্রহ্মসঙ্গীতের এই যে প্রভাব, তার গোড়ার পর্বটি রামমোহনের নেতৃত্বে বিস্তৃত হলেও পরবর্তীকালে তার বিজয়পতাকা উড্ডীন রাখার দায়িত্ব ন্যস্ত হয়েছিল মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের উপরই। সুতরাং জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি যে ব্রাহ্মসমাজ ও ব্রহ্মসঙ্গীতের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠবে তা অবশ্যম্ভাবী। ঊনবিংশ শতকের বাঙালিদের অভিজাত সঙ্গীতচর্চায় জোড়াসাঁকো ও পাথুরিয়াঘাটা উভয় ঠাকুরবাড়ির দান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়। সেকালে উত্তর কলকাতার ‘ঠাকুরবাড়ি’ বলতে পাথুরিয়াঘাটা এবং জোড়াসাঁকো ‒ এই দুই বাড়িকেই বোঝাত। এই দুই ঠাকুরবাড়ির পূর্বপুরুষেরা যে একই পরিবার থেকে উদ্ভূত সে কথা আগেই বলা হয়েছে। ভারতীয় সঙ্গীতের ব্যাখ্যাকার ডঃ বিমল রায় লিখেছেন, “বাংলাদেশের সঙ্গীতে ঠাকুর-পরিবারের দান অপরিশোধ্য। ঠাকুর পরিবারের জন্যই বাংলার বাইরের গুণীদের সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎ পরিচয় ঘটেছে এবং ‘রাগ’ সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। …ঠাকুর পরিবারের দুই ভাই নীলমণি ও দর্পনারায়ণ যবে পৃথগন্ন হলেন, তখনও গান-বাজনার কোনও চিহ্ন কি ঠাকুরবাড়িতে দেখা গেছে? অথচ, নীলমণি ঠাকুরের নাতি দ্বারকানাথ (জোড়াসাঁকো) গানবাজনার চর্চা করতেন এবং দর্পনারায়ণ ঠাকুরের প্রপৌত্র হরকুমার (পাথুরেঘাটায়) সেতার বাজাতেন।…এদের পরে সেই সঙ্গীতচর্চা নিরবচ্ছিন্নভাবে দুই পরিবারেই চলে এবং এই দুই পরিবার দু-ভাবে বাংলার কৃষ্টিতে বিবর্তন নিয়ে আসে।”

রবীন্দ্রনাথের জন্ম ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে। এই সময় বাংলার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল কেমন ছিল সে সম্পর্কে কিঞ্চিৎ আলোচনা প্রয়োজন। রবীন্দ্রনাথের জন্মের পূর্বের পাঁচটা বছরকে বলা যেতে পারে বাঙালি ও বাংলা সমাজের পক্ষে মাহেন্দ্রক্ষণ। এই সময়ের মধ্যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, দেবেন্দ্রনাথের ব্রাহ্মধর্ম প্রচার, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিধবা-বিবাহ ও স্ত্রীশিক্ষা বিষয়ক আন্দোলন, নীলকরের হাঙ্গামা, সিপাহী বিদ্রোহ, হরিশ মুখার্জির হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকায় নীলকরের হাঙ্গামা সম্বন্ধে প্রতিবাদ, সাঁওতাল বিদ্রোহ, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের অভ্যুদয়, জাতীয় নাট্যশালা স্থাপন ও নাট্য সাহিত্য ও অভিনয়ের মধ্য দিয়ে যুগোচিত প্রতিভার আত্মপ্রকাশের প্রয়াস, কেশবচন্দ্র সেনের ব্রাহ্মসমাজে প্রবেশ ও ব্রাহ্মসমাজে নবশক্তির সঞ্চার ‒ এই ঘটনাগুলো প্রত্যেকটিই মধ্যযুগীয় মনোভাব থেকে বের হয়ে আসতে সহায়তা করেছিল। রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাবও এই মাহেন্দ্রক্ষণ ও বাংলার, নবজন্মের প্রত্যুষে। এই সময়ে বাঙ্গালির শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে একটা পালাবদলের যুগ শুরু হয়েছে। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি তখন ছিল বাঙালির সংস্কৃতি-চর্চার পীঠস্থান। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে ভারতীয় তথা বাংলা গানের পুনরুজ্জীবনের প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল। সেই সময়কার বাংলাগানের অবস্থা সম্বন্ধে কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় তাঁর ‘গীত সূত্রসার’ গ্রন্থে বলেছেন ‒ “খেয়াল ও ধ্রুপদীর সুরে ঈশ্বর বিষয়ক ব্যতীত অন্যান্য উন্নত বিষয়ের বাংলা গান নাই বলিলেই হয়। এটি আমাদের এক বৃহৎ অভাব রহিয়াছে। এইজন্যে এতদিনেও খেয়াল ধ্রুপদ বাঙালির জাতীয় সঙ্গীত হইতে পারে নাই। আরও হিন্দি গীতির রচনা প্রায়ই নিকৃষ্ট তাহাতে কবিত্ব অতি অল্প এবং এই গীতের বর্ণিত বিষয় সকলও শিক্ষিত লোকের রুচির উপযোগী নহে।
অতএব আমাদের কবি ও বাঙালি কলাবত উভয়ের একত্র হইয়া ঐ সকল সুরে সর্বদা ব্যবহার্য নানা বিষয়ে উত্তমোত্তম বাংলা গীত রচনা হওয়া উচিত। তাহা হইলে ঐ সকল সুরের প্রতি সর্বসাধারণের আস্থা ও প্রবৃত্তি হইয়া দেশময় বিশুদ্ধ সঙ্গীতজ্ঞানের বিস্তার নিবন্ধন জাতীয় সভ্যতার উন্নতি হইবে।”***
জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি তখন ছিল বাঙালির সংস্কৃতি-চর্চার পীঠস্থান। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে ভারতীয় তথা বাংলা গানের পুনরুজ্জীবনের প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল।
এই সময়ে অনাদৃত বাংলা গানের প্রতি প্রথম আধুনিক শিক্ষিত সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ হল ‘সঙ্গীত প্রভাকর’ পত্রিকায় লিখিত ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের কয়েকটি রচনা থেকে। বাংলা গানের এই দৈন্যদশা থেকে পুনরুজ্জীবনের মূলে যে কারণগুলি ছিল সেগুলি হল ‒ প্রথমত, আদি ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠার পর সমাজের উপাসনা এবং অনুষ্ঠানাদির জন্য ব্রহ্মসঙ্গীত রচনার তাগিদ আসে। ঠাকুর পরিবারের অনেকেই এই দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। দ্বিতীয়ত, জাতীয় জাগরণ উপলক্ষ্যে জাতীয় উদ্দীপনার জন্যে স্বদেশি গান রচনা করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছিল এবং তৃতীয়ত, তখনকার যুগের বাংলা নাটকের জন্যে নাট্যসঙ্গীত রচনা করার প্রয়োজনীয়তা।****
হিন্দুমেলার জন্মকাল থেকে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি বিবিধ সংস্কৃতিচর্চা এবং জাতীয় জাগরণের একটি প্রধান কেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছিল । শিশু বয়সে রবীন্দ্রনাথ তাঁর অগ্রজদের উৎসাহে হিন্দুমেলা এবং সঞ্জীবনী সভার অধিবেশনে সক্রিয় ভাবে যোগদান করেছিলেন। হিন্দুমেলা উপলক্ষ্যে রবীন্দ্রনাথের অগ্রজদের মধ্যে দ্বিজেন্দ্রনাথ রচনা করেন — ‘মলিন মুখচন্দ্রমা ভারত তোমারি’, সত্যেন্দ্রনাথ রচনা করেন — ‘মিলে সবে ভারত সন্তান’, গগনেন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘লজ্জায় ভারতযশ গাহিব কি করে।’
তাহলে দেখা যাচ্ছে যে রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাবকালে বাংলাগানের প্রতি বাঙালি জনসাধারণের আস্থা অনেকটা ফিরে এসেছিল। সর্বত্র বাংলা গানে নতুন সৃষ্টির একটা চাহিদা তৈরি হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাব সে চাহিদা পূরণে সব দিক থেকেই সফল হয়েছিল। তিনি তাঁর একক প্রচেষ্টায় বাংলাগানের এই দৈন্য দূর করে তাঁকে সমৃদ্ধির উচ্চশিখরে পৌঁছে দিয়ে গেছেন।
পরিশেষে একথা বলা যায় যে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীত সৃষ্টির বিষয়টি কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, সে সময়ের পারিপার্শ্বিক আবহাওয়া ছিল সংস্কৃতি চর্চার অনুকূল ‒ সর্বোপরি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মের অনেক আগে থেকেই এই পরিবারের সংস্কৃতি চর্চা তথা সঙ্গীত চর্চা শুরু হয়েছিল, যা সম্পূর্ণতা পেয়েছিল রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির মধ্য দিয়ে।
* বাঙ্গালীর রাগসঙ্গীত চর্চা/ দিলীপকুমার মুখোপাধ্যায়/ পৃ:৫৬
** বাঙ্গালীর রাগসঙ্গীত চর্চা/ দিলীপকুমার মুখোপাধ্যায়/পৃ:২২
***রবীন্দ্রসঙ্গীতের ক্রমবিকাশ ও বিবর্তন/ ডঃ দেবজ্যোতি দত্ত মজুমদার। পৃ ১
**** রবীন্দ্রসঙ্গীতের ক্রমবিকাশ ও বিবর্তন/ ডঃ দেবজ্যোতি দত্ত মজুমদার। পৃ ৪
রবীন্দ্রনাথের গানে সকাল ও সন্ধ্যা: পর্ব ১
খ্যাতিমান সঙ্গীতশিল্পী অর্ণব রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রবীন্দ্রনাথের গান বিষয়ে গবেষণা সম্পন্ন করেছেন। প্রবাদপ্রতিম সঙ্গীতগুরু আশিস ভট্টাচার্যের সুযোগ্য ছাত্র অর্ণব রবীন্দ্রসঙ্গীতে বিশেষভাবে পারদর্শী, এ ছাড়াও অন্য ধরনের গানেও তিনি যথেষ্ট পারঙ্গম। তিনি পেশায় শিক্ষক। গান তাঁর সবচেয়ে প্রিয়। তিনি ভ্রমণপিপাসু, সেই সঙ্গে উদ্যানচর্চায় আগ্রহী।