তখন স্কুলে পড়াশুনোর সঙ্গে ‘সর্ব ভারতীয় চারু কলা কেন্দ্রে’ চতুর্থ বর্ষে আঁকা শিখছি। তেল রঙ আর চারকোল সবে ধরেছি। সঙ্গে থিয়োরি পরীক্ষাও দিতে হবে। এই গাব্দা একটা আর্টের বই – তাতে ভ্যান গগ, পল গঁগা, পল সেজান, পিকাসো, রবি বর্মা, যামিনী রায় সবই পড়তে হত। ভাস্করদের মধ্যে শুধু মাইকেলএঞ্জেলো আর রামকিঙ্কর বেইজ সিলেবাসে ছিল। সেই প্রথম রামকিঙ্করের ভাস্কর্যের সঙ্গে পরিচয়। কিন্তু তখনও মর্ডানিজম বা ‘মর্ডান স্কাল্পচার’ ব্যাপারটা বিশেষ বুঝতে শিখিনি। তাই ভাবতাম – মাইকেলএঞ্জেলোর ভাস্কর্য কি বলিষ্ঠ, ‘হিউমান-লাইক’, এমনকি কুমারটুলির প্রতিমার গড়ন কি স্বাভাবিক, তাহলে রামকিঙ্করের ‘সাঁওতাল পরিবার’ এরকম প্রচলবিরোধী বা ‘নন্‌-কনফরমিস্ট’ কেন?

এর কিছুদিন পর শান্তিনিকেতন গেছি। সেখানে রামকিঙ্করের সৃষ্টি চাক্ষুস দেখার প্রথম সুযোগ হল। আমার এক দূর-সম্পর্কের দাদু– আমরা মাখন-দাদু বলতাম, শান্তিনিকেতনে থাকতেন। ছবি-টবি আঁকতেন। তিনি আবার রামকিঙ্করের বিরাট ভক্ত। খুব রসিক মানুষ এবং গল্প ভালো বলতেন। যদিও ক্ষ্যাপা গোছের বদনামও ছিল। তাঁর কাছে আবদার হল– রামকিঙ্করের সম্বন্ধে, তাঁর ভাস্কর্যের ব্যাপারে শোনার। 

-উরিব্বাস্‌, মরতে হবে না কি? – মাখন দাদু চোখ টিপলেন।

-কেন?

-ঘটক রামকিঙ্করকে নিয়ে ডকু ছবি বানাতে গেল, অসমাপ্ত রেখে ইহলোক ত্যাগ করল। সমরেশ ‘দেখি নাই ফিরে’ লিখতে বসল সেই নাপিতের ব্যাটাকে নিয়ে– তাও আর শেষ হল কোথায়? এক টিপ্‌ নস্যি নিয়ে মাখন দাদু, স্বভাব-চরিত অভব্য ভাবে রুক্ষ রসিকতা করেছিল। তারপর যোগ করেছিলেন – ও যে বিরল প্রতিভা, স্পর্শাতীত, পট অফ গোল্ড, ফাদার অফ মর্ডান ইন্ডিয়ান স্কাল্পচার, ওঁকে ছুঁয়ে দেখা অত সোজা নাকি। পরামানিক ক্ষুর ছেড়ে যেই বাটালি, হাতুড়ি ধরেছে অমনি আর্টের দুনিয়ায় রেভোলিউশন হয়েছে, বুঝলি। 

তখন মাখন দাদুর কথা বিশেষ কিছু বুঝিনি। এর কয়েক বছর পরে ঋত্বিক ঘটকের রামকিঙ্কর কে নিয়ে তথ্যচিত্রটা দেখার সুযোগ হয়েছিল। আরও অনেক পরে সমরেশ বসুর ‘দেখি নাই ফিরে’ ও পড়েছি। আশ্চর্য হয়েছি রামকিঙ্করের কিউবিস্‌ম থেকে ইমপ্রেশনিজ্‌ম এবং রিয়েলিজমে অবাধ বিচরণ দেখে। ২৫শে মে, ১৯০৬ সালে বাঁকুড়ায় জন্ম রামকিঙ্করের। লাল মাটির ভূমিপূত্রের প্রথম আর্টের দুনিয়ায় আকৃষ্ট হন মৃৎশিল্পী অনন্ত সূত্রধরের প্রতিমা বানানো দেখে। কিশোর কাল থেকে ছবি আঁকা শুরু। তখন স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রতিকৃতি আঁকতেন। ষোলো বছর বয়সে রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের চোখে পড়েন। রামানন্দ তখন “প্রবাসী” প্ত্রিকার সম্পাদক। তাঁরই সুপারিশে বিশ্বভারতীর কলাভবনে প্রবেশ মাত্র উনিশ বছর বয়েসে। একবার রামকিঙ্কর কবিগুরুর পোর্ট্রেট আঁকছিলেন। কবি তাঁকে বলেছিলেন, একটি বাঘ যেমন তাঁর শিকারকে ক্ষিপ্রতার সঙ্গে ধাওয়া করে, রামকিঙ্কর ও যেন তাঁর সৃষ্টির প্রতি একই রকম উদ্যম নিয়ে এগিয়ে যান। কথাটার গভীরতা শিল্পীর মনে বিশেষ দাগ কেটেছিল। তারপর থেকেই তাঁকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি, বা কিঙ্করের নিজের ভাষায় – ‘দেখি নাই ফিরে’। তাঁর ছবি ও ভাস্কর্যে সেই প্রাণশক্তির সন্ধান আমরা সব সময় পাই। 

Ramkinkar Baij sculpture
সাঁওতাল পরিবার- রামকিঙ্কর বেইজের ভাস্কর্য

কাট টু ২০০৬ সাল। রামকিঙ্করের জন্মশতবর্ষ। দিল্লিতে আর বি আইয়ের সামনে হঠাৎ মাখন দাদুর সঙ্গে দেখা। ললিত কলা অ্যাকাডেমিতে এসেছিলেন রামকিঙ্করের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে একটি এগ্‌জিবিশনে। বয়সের ভারে দাদু তখন কিছুটা ন্যুব্জ। কথাবার্তা তবু চাঁছাছোলা। একথা সেকথার পরে রামকিঙ্করের কথা উঠল। তখন আর্টের বিষয়ে আমি আরেকটু সমঝদার হয়েছি। বললাম – রামকিঙ্করকে নিয়ে তোমরা এবার আর কোথায় প্রদর্শনী করছ?

-ধুর, ধুর, এদেশের কিচ্ছু হবে না। শতবর্ষেও মহান শিল্পী ব্রাত্য। এখানে আর বি আইয়ের সামনে কিঙ্করের যক্ষা-যক্ষী ধুলোময়, আবার গত বছর হাঙ্গেরিতে কিঙ্করের ১৯৪০ এ তৈরি কবিগুরুর অমন সুন্দর ‘বাস্ট’ স্কাল্পচারটা ব্যালাটন লেকের পাশ থেকে সরিয়ে মিউজিয়ামে গৃহবন্দী করেছে। তার বদলে, সেই জায়গায়, নতুন মূর্তি কমিশন্‌ড হয়েছে। 

-না, না কেন এমন বলছ? – আমি যুক্তি সাজাই – ওঁকে তো পদ্মভূষণ, দেশিকোত্তম, ডি লিট সবই প্রদান করা হয়েছে। হাঙ্গেরির ব্যাপারটায় নিশ্চয় অন্য কোনও কারণ আছে।

-কারণ না ছাই। দেশের কিছু বুদ্ধিজিবীর হঠাৎ মনে হল সেটি নাকি মোটেই কবিগুরুর প্রতিচ্ছবি নয়। রবিভক্তদের ভালোবাসার আতিশয্য, বুঝলে হে ছোকরা। কত বোঝনদার এলেন দেখি। এমনি আর্টই বোঝে না, তাঁরা আবার অ্যাবস্ট্র্যাক্ট বুঝবে, তাহলেই হয়েছে। সত্যজিৎ রায় কিন্তু প্রতিবাদ করেছিলেন। কিন্তু কি আর হল বল? আচ্ছা, তুমিই বল – এই যে আর বি আইয়ের সামনে যক্ষা-যক্ষী দেখছ, এরকমটি আগে কখনও দেখেছো কি? এদের হাতে মুষল আর মানি-ব্যাগ – উফ্‌ কী মর্ডান, তাই না? অদ্ভুত। ন’জন আর্টিস্টের কাজের মধ্যে এটি বাছা হয়েছিল – কে আর মনে রেখেছে এখন। 

sculpture of Rabindranath Tagore by ramkinkar Baij
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আবক্ষ মূর্তি। রামকিঙ্কর বেইজ।

শুনে খারাপ লেগেছিল তো বটেই। হাঙ্গেরিতে কবিগুরুর আবক্ষ মূর্তি দেখার আমার সুযোগ হয়নি তবে তাঁরই করা ১৯৩৭ এর রবিমূর্তিটি দেখেছিলাম দিল্লির ন্যাশানাল গ্যালারি অফ মর্ডান আর্টে। ভারতে এটিই সম্ভবত প্রথম কিউবিস্ট পোর্ট্রেট স্কাল্পচার। সাধারণ মূর্তির থেকে কতটা আলাদা, অথচ বুঝতে অসুবিধে হয়না যে এটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মুখ। 

তবে আরেকটু আগে থেকে শুরু করা যাক। তাঁর ভাস্কর্যের আগে তাঁর আঁকা ছবির দিকে আলোকপাত করি। অন্য সকলের মতো রামকিঙ্করও জলরঙ, তেলরঙ দিয়েই শুরু করেছিলেন। শান্তিনিকেতনে এসে কবিগুরু ও নন্দলালের মতো মানুষদের সংস্পর্শে এসে, পাশ্চাত্য শিল্পের সঙ্গে পরিচয় হয়। এরপর থেকেই পল্ সেজানের ইমপ্রেশনিজ্‌ম, পিকাসোর কিউবিজমের প্রভাব লক্ষ্য করা যায় কিঙ্করের ছবিতে। কিন্তু শিকড় থেকে কখনও বিছিন্ন হননি এই মাটির শিল্পী। চিরকাল সাঁওতালদের জীবন তাঁর প্রিয় বিষয় রয়ে গেছে। ঘুরে ফিরে এসেছে ছবিতে আর ভাস্কর্যে। যে কোনও মিডিয়ামে সমান সাবলীল ছিলেন রামকিঙ্কর– ছবি আঁকা কি পেন্সিল স্কেচ, অথবা টেরাকোটা ভাস্কর্য থেকে শুরু করে কংক্রিট, ব্রোঞ্জ কিংবা প্লাস্টার অফ প্যারিস। 

অবিশ্যি এখানে আমরা রামকিঙ্করের শিল্পের পঞ্জিকা বানাতে বসিনি। সে তো গুগল সার্চ করে নিলেই পাওয়া যাবে। বরং অবাক বিস্ময়ে আমরা বোঝার চেষ্টা করি এই অসামান্য প্রতিভার জীবন দর্শনকে। কত সাধারণ ছিল তাঁর জীবন যাপন। চুল অবিনস্ত্য, পরনে একটা সাধারণ লুঙ্গি বা কদাচ প্যান্ট। অধিকাংশ সময় খালি গা। কখনও একটা ফতুয়া বা হাফ শার্ট। মাথায় অসমীয়াদের মতন কৃষকের টুপি (যাকে ঝাপি বলে)– সেটাই যেন তাঁর ট্রেডমার্ক।

ঋত্বিক ঘটকের তথ্যচিত্রে আমরা দেখি অতি সাধারণ একটি ভগ্নপ্রায় বাড়িতে তাঁর বাস। চাল থেকে বৃষ্টির জল পড়ে অনবরত। জল আটকাতে কিঙ্কর তাঁর তেলরঙের ক্যানভাস গুলো দিয়ে ভাঙ্গা চাল ঢেকে রেখেছেন। এহেন শিল্পীর চেতনা ও মননে যে একটা সমাজতান্ত্রিক পলিটিক্যাল অনুরুক্তি থাকবে, সেটাই তো স্বাভাবিক। ১৯৪২ এ তাঁর একাধিক ছবিতে দেখি যুদ্ধবিরোধী চিন্তন। ১৯৪৩ এর বাংলার মনন্তর ও আকালের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও বিষোদ্‌গার দেখি তাঁর ‘থ্রেসর’ (Thresher) ভাস্কর্যে – যেখানে খড় ঝাড়ছে যে মহিলা, তার মাথাটাই নেই। দুর্ভিক্ষ কতটা বিকলাঙ্গ করে দেয় সমাজ ব্যবস্থাকে সেটাই বোঝানো হয়েছে এর মধ্যে দিয়ে। 

এমন শিল্পীর জীবনে প্রেম, ভালোবাসা এসেছিল? আজীবন অকৃতদার রামকিঙ্কর নাকি থাকতেন রাধারানী দাসির সঙ্গে। কিন্তু রাজা রবি বর্মার যদি অঞ্জনিবাই মালপেকার থাকে, পিকাসোর যদি ম্যারি ওয়াল্টার থাকে, রামকিঙ্করের অনুপ্রেরণা তাহলে কে ছিলেন। শুধুই সাঁওতাল রমণী? অগত্যা এই লেখাটার জন্য আবার শরনাপন্ন হতে হল, আমার কাছে শিল্পের এনস্লাইকোপিডিয়া বা ‘সিধু জ্যাঠা’ থুড়ি – মাখন দাদুর কাছে। 

Buddha by Ramkinkar Baij
গৌতম বুদ্ধ। রামকিঙ্কর বেইজ।

‘বারো বছর দেরি করে ফেলেছো হে ছোকরা। নইলে হয়ত চাক্ষুস দেখার সুযোগও হয়ে যেত। ২০১১ সালেই তিনি এই ধরাধাম ত্যাগ করেছেন; কিঙ্করের মারা যাবার ৩১ বছর পরে’। ফোনের ওপারে বার্ধক্যে কাঁপা গলায় মাখন দাদু আক্ষেপ করলেন। 

 

আরও পড়ুন: রামমোহন রায় ও যুক্তি রাজ্যের রাজনীতি

 

গভীরে ঢুকতে চাইলাম। যা জানলাম তা হল– রামকিঙ্করের থেকে ষোলো বছরের ছোট – মণিপুরের রাজবংশের মেয়ে মহারাজ কুমারি বিনোদিনী দেবীর কথা। মনে পড়ে গেল রামকিঙ্করের আঁকা একাধিক ছবি ও ভাস্কর্য বিনোদিনীকে নিয়ে। ছবিগুলোর মধ্যে অনেক গুলোই ন্যুড। কিন্তু কে ছিলেন এই বিনোদিনী দেবী?

 বিদুষী মহিলা তিনি। ছোটবেলা থেকেই পাশ্চাত্য শিক্ষায় বড় হয়েছেন। বাড়িতে ব্রিটিশ ইংরাজি শিক্ষিকা হিসেবে মিসেস জলি বহাল ছিলেন। পরবর্তীকালে শিলং এর সেন্ট মেরী’জ কলেজে ভর্তি হন। এরও অনেক পরে শান্তিনিকেতনে আগমন বিশ্বভারতীতে ভাস্কর্য শেখার জন্য। সেখানেই পরিচয় রামকিঙ্করের সঙ্গে। কিন্তু দুজন সম্পূর্ণ বিপরীত পরিবেশ ও অর্থনৈতিক পরিকাঠামোয় বড় হওয়া দুই ব্যক্তিত্ব একে-অপরের যথেষ্ঠ ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। মণিপুরের প্রথম মহিলা গ্র্যাজুয়েট, পরবর্তীকালে পদ্মশ্রী, বিনোদিনী নিজ-গুণে এক অত্যন্ত ভাল ছোটগল্পকার ছিলেন । অথচ কিঙ্কর ও বিনোদিনীর সম্পর্ক নিয়ে সেই সময়েও গসিপ্ কিছু কম ছিল না। বিনোদিনীকে সরাসরি জিজ্ঞেস করাও হয়েছিল তিনি রামকিঙ্করকে বিয়ে করলেন না কেন? বিনোদিনী অকপট বলেছিলেন – রামকিঙ্কর একজন খুব ভাল আর্টিস্ট ছিলেন কিন্তু তার মানে এই নয় যে তিনি খুব ভালো স্বামীও হতে পারতেন। 

Yakshi sculpture RBI head office
রিজার্ভ ব্যাংক হেডকোয়ার্টারে রামকিঙ্করের গড়া যক্ষী মূর্তি

একদম খাঁটি কথা। ঋত্বিক ঘটকের তথ্যচিত্রে দেখতে পাই পরিচালক রামকিঙ্করকে মুখের উপর বলেছেন – আপনি একটা ক্ষ্যাপা লোক, আর কিঙ্কর তাই শুনে হাসছেন। একজন প্রকৃত শিল্পীই আরেকজন শিল্পীর ব্যক্তি সত্তাকে ঠিক চিনেছেন। তাই তো সুকুমার রায় যেমন হাঁস ও সজারু মিলিয়ে হাঁসজারু তৈরি করেছিলেন, রামকিঙ্কর ও অবলিলায় কল্পনা করতে পারেন – মোষ-মাছি। কী সেটা? না, গরমকালে মোষগুলো যখন জলে নেমে, ল্যাজের ঝাপটায় মাছি তাড়ায় সে দৃশ্য আমাদের সকলের কাছে খুব চেনা। কিন্তু রামকিঙ্কর মোষের ল্যাজকে মাছের ল্যাজ হিসেবে কল্পনা করে সেই ‘বকচ্ছপ’ মূর্তি বানিয়েছেন যা এখনও শান্তিনিকেতনে লেডিজ হোস্টেলের সামনে যে ফোয়ারা আছে, সেখানে বর্তমান।

যদিও রামকিঙ্করের পশুপাখি নিয়ে বাকি স্কেচ বা আঁকাগুলি আরও বাস্তবানুগ। আর্ট ইতিহাস-রচয়িতা আর শিবাকুমার রামকিঙ্করকে নিয়ে সব চেয়ে বিস্তারিত গবেষনা করেছেন। ফলস্বরূপ ‘রামকিঙ্কর বেইজ’ নামক বইটি। সেই শিবাকুমারের মতে, রামকিঙ্কর একজন কৃষকের চোখে এই পশুপক্ষীদের দুনিয়াটিকে দেখতেন। সম্পূর্ণ রোমান্টিসিজম বর্জিত, অথচ সংবেদী মনোভাব দিয়ে। তবে কুকুর, শুয়োর, গরু-বাছুরের মধ্যেও কিঙ্করের বিড়ালের প্রতি একটু বিশেষ পক্ষপাতিত্ব দেখা যায়। মার্জার নিয়ে একাধিক স্কেচ দেখতে পাওয়া যায়।

শুধু পশুপাখি নয়, বরং সর্বময় প্রকৃতি নিয়েই রামকিঙ্করের কাজ। চারদিকের পরিবেশ থেকে কংক্রিট, দড়ি, সিমেন্ট – যেখানে যা পেয়েছেন, তাই দিয়ে ভাস্কর্য তৈরি করেছেন তিনি। আমরা পেয়েছি সাঁওতাল পরিবার, মিল-কর্মী, বুদ্ধমূর্তি, সুজাতা ইত্যাদি শান্তিনিকেতনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নানা ভাস্কর্য। আবার একদিকে যেমন কবিগুরুর আবক্ষ মূর্তি তৈরি করেছেন, তেমনি নিজের ছাত্রের ও অবয়ব গড়েছেন। ভাস্কর্য ছিল তাঁর ধ্যান, জ্ঞান, সব কিছু। কিন্তু এহেন মহান শিল্পীর শেষ জীবনটা খুব একটা সুখে কাটেনি। শিবাকুমারের রিসার্চ থেকেই আমরা জানতে পারি যে একাধিক জায়গা থেকে রামকিঙ্করকে প্রত্যাখ্যাত হতে হয়েছিল। দিল্লির সেই যক্ষা-যক্ষী ভাস্কর্যের কাজ শেষ করার আগেই তাঁর তহবিল শেষ হয়ে যায়। বাড়তি ফান্ড চাইতে তাঁকে কন্ট্রাক্টের কাগজ দেখিয়ে সীমাবদ্ধতা মনে করিয়ে দিয়ে অপমান করা হয়। ‘কঙ্কালিতলার দিকে’ আরেকটি অসাধারণ ভাস্কর্য। এখানে দেখা যায়, দুজন মানুষ একটা বাচ্চা ছেলেকে (যার মুখটা ছাগলের আকৃতির), টেনে হিঁচড়ে বলি দিতে নিয়ে যাচ্ছে। রামকিঙ্কর এটি বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে বসাতে চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন। মনে আঘাত পেয়েছিলেন। অথচ এই ভাস্কর্যটিই, তাঁর মৃত্যুর বহু বছর পরে, ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে নিউ ইয়র্কে চড়া দামে (২২,৫০০ মার্কিন ডলার) নিলাম হয় । মজার ব্যাপার হল, চিরকাল দারিদ্র্যের মধ্যে থাকা রামকিঙ্করের ছবি বা ভাস্কর্য কিন্তু সব সময় এমনই বিরাট দামে নিলাম হয়েছে। তবে সব কিছু ছাপিয়ে গেছে রামকিঙ্করের – ‘ফেস্টিভ ইভ্‌’ বা ‘উৎসবের প্রাক্কালে’ নামক তৈলচিত্রটি। ছবিটি ২০১৩ সালে সাড়ে বাহান্ন লক্ষ টাকায় নিলাম হয়। 

২৩ মার্চ ১৯৮০ সালে প্রস্ট্রেট গ্ল্যান্ডের সমস্যায় পি জি হাসপাতালে ভর্তি হন শিল্পী। হাসপাতালে থাকা কালীন ও তিনি দুর্গামূর্তি গড়েন – যা তাঁর শেষ ভাস্কর্য। ঐ বছরেই ২-আগস্ট শিল্পী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর যা কিছু সামান্য সম্পত্তি ছিল, তা তিনি উত্তরাধিকার হিসেবে রাধারানী দাসি ও ভাইপো দিবাকর বেইজ কে দিয়ে যান। 

শুনেছি রামকিঙ্করের খুব পছন্দের ফুল ছিল জলপদ্ম। তাই সেই ফুলের সহযোগে, আজ এই মহান ভাস্করের জন্মদিনে জানাই শতকোটি প্রণাম।

ছবি সৌজন্য: Wikipedia

Kuhoki alias Souvik Maiti

‘কুহকী’ তাঁর ছদ্মনাম। এ নামেই প্রকাশিত হয়েছে “একলব্য অতঃপর ও অন্যান্য গল্প" বইটি, যা পাঠকের ভালোবাসা পেয়েছে। কুহকীর জন্ম ১৯৭৫-এ কলকাতায়। আইআইটি থেকে ইলেক্ট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ার, বর্তমানে একটি বহুজাতিক তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় কর্মরত। বিজনেস ম্যানেজমেন্ট পেশা হলেও দেশবিদেশের সিনেমার বিশেষ অনুরাগী। নেশা, সাহিত্যচর্চা ও ছবি আঁকা।

2 Responses

  1. খুবই ভাল লাগলো। অশেষ ধন্যবাদ আপনাকে।
    ড: শিভাকুমারের রামকিঙ্কর বেজ- এর উপর বইটি সম্বন্ধে একটু জানতে চাই। আপনার email বা mobile number দিলে বাধিত হব। 🙏🏽
    দেবাংশু সেন debangshu_sen@yahoo.com 9748778733

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *