“ইতিহাসের মূল্যবান উপকরণ
দেহ জুড়ে লেপটে আছে বীভৎস ক্ষণ
খুঁড়লেই বের হবে অজানা তথ্য
বুকের গভীরে রয়েছে প্রত্নতত্ত্ব।
হয়তো মহাকাল ভাসিয়ে নিয়ে যাবে
কালের হৃদপিন্ডে ঠিকই টিকে রবে।
তথ্যের কবর থেকে তথ্য উদ্ধার
প্রত্নতাত্ত্বিক খনন চলবে বারবার।”

এক নাম-না-জানা কবির লেখা এই পংক্তিগুলো খুব মিলে যায় বাঙালি প্রত্নতাত্ত্বিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে। সত্যিই তাঁর বুকের গভীরেই ছিল প্রত্নতত্ত্ব। হৃদয়ের গোপন বেদনার সেই প্রত্নতাত্ত্বিক খনন আজও বুঝি শেষ হয়নি। ইতিহাসের প্রত্নতাত্ত্বিক উপকরণ খুঁজতে গিয়ে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়কে অনেক অভিমানের স্তূপ খনন করতে হয়েছে। সরাতে হয়েছে অন্যায়-অপবাদের নুড়িপাথর। পরাধীন ভারতে ইতিহাসের পাতায় বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন সভ্যতা মহেঞ্জোদারোর আবিষ্কারক হিসেবে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম খোদাই করা হয়েছে অত্যন্ত আবছা অক্ষরে। অথচ প্রায় জন্মসূত্রেই রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনের সঙ্গে ইতিহাসের গাঁটছড়া।

১৮৮৫ সালের ১২ এপ্রিল তাঁর জন্ম এবং বেড়ে ওঠা মুর্শিদাবাদে, যেখানকার পথেঘাটে মিশে রয়েছে ইতিহাসের ধুলো। বাতাসে ওড়ে নানা আখ্যানের ফিসফাস। বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে ১৯০৩ সালে এফএ পাশ করার পরে ওই বছরেই বিয়ে করেন নরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের কন্যা কাঞ্চনমালাকে, যিনি পরে লেখিকা হিসেবে সুপরিচিত হন। একসময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং মিরজাফরের সৈন্যদল বহরমপুরে লুঠতরাজ চালালে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিবার সব বিত্তবৈভব ফেলে রেখে বনগ্রামের ছয়ঘরিয়া অঞ্চলে চলে আসেন। আর এখান থেকেই তরুণ রাখালদাস পড়াশুনোর জন্য কলকাতার উদ্দেশে পা বাড়ান। 

১৯০৭ সালে ইতিহাস নিয়ে স্নাতক হবার আগেই এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে ‘লেখ’ ও ‘মুদ্রা’ নিয়ে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখনী চিনিয়ে দিয়েছিল ইতিহাসের অনুসন্ধানে তাঁর জহুরির দৃষ্টি। ১৯১১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাশ করার পরেই ভারতীয় জাদুঘরের পুরাতত্ত্ব বিভাগে চাকরি পান রাখালদাস। পরের বছরই আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া (এএসআই)-এর ডিরেক্টর স্যর জন মার্শালের সহকারি তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে নিযুক্ত হন। পরবর্তীকালে মার্শালই মহেঞ্জোদারোর এলাকা জরিপ ও তার ঐতিহাসিক গুরুত্ব নির্ণয়ের জন্য রাখালদাসকে ওয়েস্টার্ন সার্কেলে পাঠান এএসআই-এর দ্বিতীয় অ্যাসিট্যান্ট সুপার হিসেবে। এখান থেকেই রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইতিহাসের কিংবদন্তি হয়ে ওঠার চড়াই-উতরাই ভাঙার শুরু। ইতিহাসের নেশায় ঘুরে বেড়ানো অখণ্ড ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে।

আরও পড়ুন: সুরসন্ধানী জটিলেশ্বর

১৯১৮ সাল নাগাদ, সিন্ধু অঞ্চলে (বর্তমান পাকিস্তানের লারকানা প্রদেশে) গ্রিক বিজয় স্তম্ভ খুঁজতে খুঁজতে তাঁর চোখে পড়ে স্তূপের ওপর ছড়িয়ে থাকা বৌদ্ধবিহার অর্থাৎ বৌদ্ধ ভিক্ষুদের ধ্যানের বেদির উপর। রাখালদাসবাবু নিশ্চিত হলেন স্তূপের নীচে অনেক পুরনো বসতি চাপা পড়ে রয়েছে,  যেখানে একসময় একটা উন্নত নগরজীবনের অস্তিত্ব ছিল। সিন্ধি ভাষায় মহেঞ্জোদারোর অর্থ– মৃত পুরুষের ঢিবি। এইসব স্থানীয় ধারণাকে গুরুত্ব দিয়ে শুরু হল খননকার্য। উদ্ধার হল ব্রোঞ্জ যুগের ধ্বংসাবশেষ। প্রচুর সিলমোহর, রাজা তথা পুরোহিতের আবক্ষ মূ্র্তি, সালংকারা নৃত্যরত নারীমূর্তি (ডান্সিং গার্ল)। উন্নত ধরনের নগর পরিকল্পনার প্রমাণ হিসেবে পেলেন, আচ্ছাদিত নিকাশী ব্যবস্থা (কনসিলড ড্রেন), সাধারণ স্নানাগার (কমন বাথ), উন্মুক্ত উঠোন, কেন্দ্রীয় বাজার, বাড়ি তৈরিতে ইটের ব্যবহার। এর আগে সিন্ধু অঞ্চলে যতটুকু কাজ হয়েছিল, সেখানে ওই ইটের ভগ্নাবশেষ পেয়ে ১৯১২ সালে কারমাইকেল চেয়ারের অধ্যাপক দেবদত্ত ভাণ্ডারকর রিপোর্ট দিয়েছিলেন ওই অঞ্চলের সভ্যতা দুশো বছরের পুরনো। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় প্রায় পাঁচ বছরের গবেষণায় ও পর্যায়ক্রমিক প্রত্নখননে আবিষ্কার করলেন, সিন্ধু অঞ্চলের এই মাটির নীচে চাপা পড়ে থাকা সভ্যতা প্রায় পাঁচ হাজার বছরের পুরনো। দু’বছর আগেই মহেঞ্জোদারো থেকে চারশো কিলোমিটার উত্তরে হরপ্পা সভ্যতার ক্ষেত্রেও সমসাময়িক সভ্যতার অস্তিত্ব আবিষ্কার করেছেন আর এক ইতিহাসবিদ দয়ারাম সাহানি।

Mohenjodaro ruins
মহেঞ্জোদারো সভ্যতার প্রত্নচিহ্ন।

মহেঞ্জোদারোর ধ্বংসের নেপথ্যে একাধিক কারণ অনুমান করা হয়। কারও মতে বহিরাগত আর্যদের আক্রমণে এই সভ্যতা বিলুপ্ত হয়েছিল, কারণ ঋগ্বেদে মহেঞ্জোদারো আক্রমণের উল্লেখ রয়েছে। কেউ বলেন, পৃথিবীর ভূ-পৃষ্ঠের চলনের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে (টেকটোনিক মুভমেন্ট) সিন্ধু নদীর জলের উৎস শুকিয়ে যাওয়ায় ওই সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যায়। আবার মতান্তরে মহেঞ্জোদারো মেসোপটেমিয়ার বাণিজ্যিক অংশীদার ছিল। মেসোপেটমিয়ার রাজনৈতিক ভারসাম্য নষ্ট হলে মহেঞ্জোদারোর সঙ্গে ব্যবসায়িক আদানপ্রদান বন্ধ হয়ে যায়। তবে যে কারণেই সভ্যতা বিলুপ্ত হোক, সেই মৃত সভ্যতার ভগ্নাবশেষ আবিষ্কার করে ফেললেন রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। এরপর তিনি তাঁর সমস্ত গবেষণালব্ধ রিপোর্ট, নমুনা, নথি আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার অফিসে স্যর জন মার্শালের কাছে জমা দিলেন। 
কিন্তু সেখানেও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক মানসিকতার শিকার হলেন রাখালদাস। স্যর জন মার্শাল মহেঞ্জোদরোর আবিষ্কার নিয়ে রাখালদাসের কৃতিত্বের বিন্দুমাত্র উচ্চবাচ্য করলেন না। অযথা কালক্ষেপ করতে লাগলেন নীরব থেকে। বরং রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়কে এএসআই–এর পশ্চিম সার্কেল থেকে পূর্ব সার্কেল কলকাতায় বদলি করে দিলেন। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় রয়ে গেলেন এক বিস্মৃত প্রত্নতত্ত্ববিদ হয়ে। একসময় তিনি আর ধৈর্য রাখতে পারলেন না। মহেঞ্জোদারো সংক্রান্ত বেশ কিছু গবেষণার পর্যবেক্ষণ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সহযোগিতায় ‘মডার্ন রিভিউ’ নামে পত্রিকায় প্রকাশ করে দিলেন। সেই সময় দ্য স্টেটসম্যান, হিন্দু, অমৃতবাজার পত্রিকা ইত্যাদি বেশ কিছু সংবাদপত্রে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি এই বঞ্চনার প্রতিবাদ করা হল। 

dancing girl sculpture mohenjodaro

মহেঞ্জোদারো থেকে উদ্ধার হওয়া নৃত্যরত মহিলার মূর্তি।

কিন্তু সেসবের কোনও তোয়াক্কাই করলেন না স্যর জন মার্শাল। উল্টে ১৯২৪ সাল নাগাদ প্রচার করা হল, স্যর জন মার্শালই মহেঞ্জোদারোর আবিষ্কারক। এমনকী জওহরলাল নেহরু পর্যন্ত তাঁর ডিসকভারি অফ ইন্ডিয়া বইতে মহেঞ্জোদাড়োর আবিষ্কারক হিসেবে স্যর জন মার্শালের নাম উল্লেখ করলেন। অথচ ১৯২৫ সালের আগে স্যর জন মার্শাল মহেঞ্জোদারোতে পা-ই দেননি। এই ঘটনা ছিল ব্রিটিশদের ভারতীয় মেধাকে অমর্যাদা ও অস্বীকার করার আরও একটা নজির। এর আগেও ১৯১৩ সালে লিপিবিদের চাকরিতে রাখালদাসকে ‘আনফিট’ বলে অমনোনীত করেন জন মার্শাল। ১৯১৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কারমাইকেল চেয়ার পদে অধ্যাপনার সুযোগও তাঁকে দেওয়া হয়নি, হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর সুপারিশ সত্ত্বেও। আসলে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মেধা, গবেষণা, সাধনা ব্রিটিশ কর্তাব্যক্তিদের ঈর্ষার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাই তাঁর গবেষণার পদে পদে বাধার সৃষ্টি করে কর্মক্ষেত্র থেকে নির্বাসন দেওয়ার জন্যই ১৯১৮ সাল নাগাদ কলকাতা থেকে বহুদূরে চাকরিক্ষেত্রে পাঠানো হয়। কিন্তু তিনি যে ইতিহাসের ভূমিপুত্র! তাই অনাবিষ্কৃত ইতিহাস মহেঞ্জোদারোতে যেন তাঁরই অপেক্ষায় ছিল গোপন দ্বার খুলে দেওয়ার জন্য।

রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় সিন্ধু প্রদেশে খননকার্য চালিয়ে এক হারিয়ে যাওয়া সভ্যতার চিহ্ন আবিষ্কার করলেন বটে, কিন্তু তাঁর মনের মধ্যে অভিমান স্তূপের আকার নিতে লাগল। আর সেই স্তূপে প্রায় বিস্ফোরণ ঘটে গেল পরবর্তীকালের একটি ঘটনায়। ১৯২৫ সালে ব্রিটিশরাজের তরফে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওপর চুরির অভিযোগ আনা হল। বলা হল, জব্বলপুরের ম্যাকডোনাল্ড সাহেবের চৌষট্ যোগিনীর মন্দির থেকে মূর্তি চুরি করেছেন রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। জব্বলপুরে শিক্ষা দফতরের পক্ষ থেকে একটা বিভাগীয় তদন্ত করানো হল। সেই ঘটনা আদালত পর্যন্ত গড়াল। পরবর্তীকালে দেখা গেল, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের এক পিওন সেই মূর্তি চুরি করেছিল। কিন্তু প্রমাণ সত্ত্বেও রাখালদাসবাবুর অপবাদ ঘুচল না। তাঁকে চাকরি থেকে অবসর নেওয়ানোর ঘোরতর চেষ্টা চলতে লাগল। অপমানিত রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৯২৭ সালে স্বেচ্ছাবসর নিলেন নামমাত্র পেনশনের বিনিময়ে। 

bronze bust from Mohenjodaro

মহোঞ্জোদারোর ব্রোঞ্জের আবক্ষ।

ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তকে আমরা পড়ি রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় মাটির নীচের অন্ধকার ভেঙে হারিয়ে যাওয়া মহেঞ্জোদারো সভ্যতার আলো খুঁজে বার করেছিলেন। কিন্তু সে ঘটনার নেপথ্যে যে কত আঁধার লুকিয়েছিল, তার খবর কে রাখে? মহেঞ্জোদারো আবিষ্কারের সময়ে ব্রিটিশ শাসকদের সহযোগিতার আড়ালে নেটিভদের প্রতি তাদের অবহেলার অসভ্য আচরণের কথা ইতিহাস হয়তো বা ক্ষমা করে দিয়েছে। তাই পরে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামই মহেঞ্জোদারোর আবিষ্কারক হিসেবে রয়ে গিয়েছে। কারণ… “মরে না, মরে না কভু, সত্য যাহা শত শতাব্দীর/ নাহি মরে উপেক্ষায়, আঘাতে না টলে,/ অপমানে না হয় অস্থির…।” যাইহোক, স্বেচ্ছাবসর নেওয়ার পরের বছরই, ১৯২৮ সালে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী চেয়ার প্রোফেসর পদে চাকরি নিলেন রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। মূলত মহেঞ্জোদারোর আবিষ্কারের সঙ্গে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম জড়িত থাকলেও তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। প্রাচীন হস্তলিপিবিদ্যা, প্রস্তরলিপি, মুদ্রাবিদ্যা, মূর্তিতত্ত্ব ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে গবেষণায় অবদান রয়েছে তাঁর। প্রাচীন হস্তলিপি বিদ্যা ও লিপি সংক্রান্ত গবেষণায় রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবদান অসামান্য। এ বিষয়ে তাঁর লেখা – দ্য অরিজিন অফ দ্য বেঙ্গলি স্ক্রিপ্টস বইটি তিনি উৎসর্গ করেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এবং থিওডোর ব্লককে। 

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জুবিলি গবেষণা পুরস্কার পেয়েছিলেন রাখালদাস। তিনিই প্রথম আদি বাংলা লিপির প্রতি পণ্ডিতদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। আজ আমরা যে বাংলা লিপিতে অভ্যস্ত হয়েছি, তা আসলে রাখালদাসেরই আবিষ্কার। সেই হিসেবে তিনি আমাদের অক্ষর-জনকও বটে। তাঁর লেখা ‘মেমোয়ার অফ দ্য এশিয়াটিক সোসাইটি’-তে প্রকাশিত হাতিগুম্ফা ও নানাঘাট অভিলেখের প্রাচীন হস্তলিপি এই বিষয়ের গবেষণায় প্রামাণ্য তথ্যভাণ্ডার। ভারতীয় মুদ্রা গবেষণার ক্ষেত্রেও রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবদান উল্লেখযোগ্য। তিনিই প্রথম ভারতীয় ভাষায় মুদ্রাতত্ত্বের ওপর বই রচনা করেন যেখানে ইতিহাস পুনর্গঠনে মুদ্রার গুরুত্ব বর্ণনা করেছিলেন। মধ্যযুগীয় ও উত্তর মধ্যযুগীয় ভারতের মুদ্রার ওপর রাখালদাসের লেখা প্রবন্ধ এশিয়াটিক সোসাইটির নানান জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ ও জাদুঘরে যেসব মুদ্রার সংগ্রহ রয়েছে সেগুলির মুখবন্ধতে আজও রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্বাক্ষর রয়েছে। 

বাঙ্গালার ইতিহাস রাখালদাস

তাঁর লেখা বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য, ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’

প্রাচীন ও মধ্যুগীয় ভারতের ইতিহাসের কলাস্থাপত্য ও মূর্তিতত্ত্বের গবেষণায় অনবদ্য অবদান রয়েছে রাখালদাস বন্দ্যোপধ্যায়ের। অসম, ত্রিপুরা, ওড়িশার ইতিহাস জানার জন্য তাঁর লেখা কয়কটি আকর গ্রন্থ রয়েছে। কুষাণ সম্রাট কণিষ্কের মূর্তিতত্ত্বের বিষয়ে তাঁর গবেষণা নানাভাবে আলোকপাত করে। শিল্প, স্থাপত্য এবং মূর্তিবিদ্যার অধ্যয়নে রাখালদাস অসামান্য অবদান রেখেছিলেন, যা প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ভারতের ইতিহাসকে রূপ দিয়েছিল, বলা যেতে পারে। আবার লেখক হিসেবেও রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবদান ভুলে যাওযার নয়। কর্মজীবনে থেকে তিনি চোদ্দোটি মনোগ্রাফ এবং বই, নয়টি উপন্যাস, তিনশোটিরও বেশি নিবন্ধ লিখেছেন। তাঁর লেখা বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য, দুই খণ্ডে প্রকাশিত ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’। তাঁর সাহিত্যবোধের ফসল– ‘শশাঙ্ক’, ‘ধর্মপাল’, ‘পাষাণের কথা’, ‘করুণা’, ‘পক্ষান্তর’, ‘ব্যতিক্রম’, ‘অসীম’ ইত্যাদি বইগুলি। 

তিনি একদিকে ইতিহাসের নেশায় ঘুরে বেড়িয়েছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। ক্ষপনকের মতো বিভিন্ন যন্ত্রপাতি দিয়ে খনন করেছেন মাটি-পাথর। ভরেছেন ইতিহাসের ভাণ্ডার, সংগ্রহশালা। অন্যদিকে তিনিই আবার গবেষণা করে লেখনী দিয়ে তথ্য ও তত্ত্বের অবতারণায় সারস্বত সাধনার ফসল ফলিয়েছেন, শস্যসম্ভারে ভরিয়েছেন বৌদ্ধিক প্রান্তর। ইতিহাসের দ্বৈত চারণভূমিতে এমন অনায়াস গতায়াত সত্যিই বিরল। কিন্তু নানা সময় কলকাতার গবেষণার ক্ষেত্র থেকে বহুদূরে চলে যেতে হয় রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়কে। অকালে জ্যেষ্ঠপুত্রের মৃত্যু গভীর শোক দিয়েছিল তাঁকে। ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ১৯৩০ সালে মাত্র পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে এই পৃথিবী থেকে বিদায় নেন রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর মাটি খুঁড়ে ইতিহাস অনুসন্ধানের কথা আমরা জানি। কিন্তু হৃদয় খুঁড়ে তাঁর বেদনার ভগ্নাবশেষের সন্ধান আমরা রাখিনি। এমনকী তাঁর নিজের জন্মভূমি মুর্শিদাবাদেও রাখালদাসের ঠিকানা অনেকেই আজ বলতে পারেন না। মহেঞ্জোদারোর মাটির নীচে ঘুমিয়ে থাকা সভ্যতাকে তিনিই জাগিয়েছিলেন জিয়নকাঠির স্পর্শে। আজও তিনি ঘুমিয়ে রয়েছেন ইতিহাসের ভূমিপুত্র হয়ে। সেই ঘুম ভাঙে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের সংগ্রহশালায় রাখা মুদ্রায়, মূর্তিতে, প্রস্তরলিপিতে হাত ছোঁয়ালে।

তথ্যসূত্র:

১. রাখালদাস ব্যানার্জি: দ্য ফরগটন আর্কিওলজিস্ট – পি কে মিশ্র
২. বাঙ্গালার ইতিহাস – রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়

ছবি সৌজন্য: Wikmedia Commons

শৈশবের পাঠ শুরু কলকাতায়। মায়ের কর্মসূত্রে মেয়েবেলার পড়াশুনো পূর্ব মেদিনীপুরে, লেখালেখিতে হাত পাকানো। নব্বইয়ের দশকে পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে স্নাতক। জীবনের বাঁক বদল করে সাংবাদিকতায় আসা। বিভিন্ন পত্রপত্রিকার ফিচার ও সংবাদ বিভাগে লেখালেখি। কবিতা ও গল্প নিয়ে একটু আধটু চর্চার মুক্ত বাতাস জোগাচ্ছে পেশাতেও।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *