নিঃশব্দে দুশো বছরে পা দিলেন এক যুগপুরুষ, যাঁকে কোনও একটি বিশেষণে আখ্যায়িত করা একেবারেই অসম্ভব। বাংলার নবজাগরণ যে নতুন জ্ঞানচর্চার দিগন্ত উন্মোচন করেছিল, সেই মনন ও পাণ্ডিত্যের ইতিহাস বাঙালি একেবারেই ভুলে গিয়েছে। তাই রাজেন্দ্রলাল মিত্রের মতো মনীষীর দুশো বছরও অতিক্রান্ত হয় বিস্মৃতিতে। ভারত নিয়ে কাজ করেছেন যেসব ইয়োরোপীয় মনীষীরা, তাঁদের নিয়ে বাঙালির গর্বের সীমা নেই। অথচ পস্টেরিটি স্বীকার করে না রাজেন্দ্রলালের মতো মনীষার ঋণ। তাঁর পূর্ণাঙ্গ জীবনী লেখার কাজটি করতে এগিয়ে আসেননি কেউই। মৃত্যুর বহু পরে, বিশ শতকের ষাটের দশকে অলোক রায় তাঁর একটি জীবনীগ্রন্থ লেখেন যা এখনও পর্যন্ত রাজেন্দ্রলাল বিষয়ে সবথেকে প্রামাণ্য কাজ।
কে ছিলেন রাজেন্দ্রলাল মিত্র? তিনি ভারততত্ত্ববিদ, পুরাতাত্ত্বিক, প্রাবন্ধিক, প্রত্নতত্ত্ববিদ এবং ভারতে বিজ্ঞানসম্মত ইতিহাসচর্চার পুরোধা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘জীবনস্মৃতি’-তে রাজেন্দ্রলাল বিষয়ে যা লিখেছেন, সেটিই তাঁকে চেনার জন্য যথেষ্ট হতে পারে–
‘রাজেন্দ্রলাল সব্যসাচী ছিলেন। তিনি একাই একটি সভা। এই উপলক্ষে তাঁহার সহিত পরিচিত হইয়া আমি ধন্য হইয়াছিলাম। এপর্যন্ত বাংলা দেশে অনেক বড়ো বড়ো সাহিত্যিকের সাথে আমার আলাপ হইয়াছে, কিন্তু রাজেন্দ্রলালের স্মৃতি আমার মনে যেমন উজ্জ্বল হইয়া বিরাজ করিতেছে এমন আর কাহারও নহে।’
১৮২২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি উত্তর চব্বিশ পরগনার শুড়া এলাকায় জন্ম রাজেন্দ্রলাল মিত্রের। বাবা জনমেজয় মিত্রের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। কিন্তু ব্রজবুলি এবং উর্দু ভাষায় কবিতা লিখতেন তিনি, এমন শোনা যায়। রাজেন্দ্রলালের পড়াশোনা শুরু হয়েছিল গোবিন্দচন্দ্র বসাকের হিন্দু ফ্রি স্কুলে। মাত্র পনেরো বছর বয়সে মেডিক্যাল কলেজে ডাক্তারি পড়তে ঢোকেন রাজেন্দ্রলাল। কিন্তু কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে ডাক্তারি পড়া ছেড়ে দেন ১৮৪১ সালে। আইনও পড়তে শুরু করেছিলেন। কিন্তু আইনজীবীও হলেন না শেষপর্যন্ত। মনোনিবেশ করলেন ভাষাশিক্ষায়। হিন্দি, ফারসি, সংস্কৃত ও উর্দু, গ্রিক, ল্যাটিন, ফরাসি ও জার্মান ভাষাচর্চা শুরু হল।
১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দে রাজেন্দ্রলাল এশিয়াটিক সোসাইটির সহকারী সম্পাদক ও গ্রন্থাগারিক নিযুক্ত হন এবং আমৃত্যু এশিয়াটিক সোসাইটির সঙ্গে যুক্ত থেকে কাজ করেছেন। ১৮৫৬-তে অবশ্য সরকার তাঁকে ওয়ার্ড ইনস্টিটিউশনের ডিরেক্টর নিযুক্ত করায় তিনি সহ-সম্পাদকের সবেতন পদটি ত্যাগ করেন। এশিয়াটিক সোসাইটিতে নিয়মিত ইংরেজিতে প্রবন্ধ লিখতেন রাজেন্দ্রলাল। ফলে সমকালীন ইউরোপীয় ঐতিহাসিকদের মধ্যে তাঁর যতখানি পরিচিতি তৈরি হয়েছিল, ভারতে তথা বাংলায় তার অর্ধেকও ছিল না। তথাপি এশিয়াটিক সোসাইটির হয়ে ১৮৫৪ থেকে শুরু করে আমৃত্যু ‘বিবলিওথিকা ইন্ডিকা’ নামে ঐতিহাসিক প্রবন্ধ সিরিজ় লিখে গিয়েছেন রাজেন্দ্রলাল মিত্র।

উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ভারতে চলছে ঐতিহাসিক খননকার্য। একের পর এক শিলালিপি, স্তম্ভলিপি, প্রাচীন স্থাপত্য, মুদ্রা আবিষ্কৃত হচ্ছে এবং অক্লান্তভাবে তাদের পাঠোদ্ধার করে চলেছেন রাজেন্দ্রলাল মিত্র। তাতে ভুলভ্রান্তি অবশ্যই ছিল, কারণ, মনে রাখতে হবে, প্রাচীন ভারতের ইতিহাস বলে কোনও সামগ্রিক চিত্র কিন্তু তখন ভারতীয়দের কাছে ছিল না। ফলে এক অন্ধকার সুড়ঙ্গপথে আলোর সন্ধার করতে করতে এগোচ্ছিলেন রাজেন্দ্রলাল। তাঁর নিজের কথাতেই: In the field (of Indian Archeology)… I am a humble labourer. অলোক রায়ের মতে:
“রাজেন্দ্রলালের এই একক প্রয়াস-প্রচেষ্টা পরবর্তীকালে ভারতবর্ষে ঐতিহাসিক গবেষণার পথ প্রস্তুত করে দেয়। তাঁর অনেক মতামত পরবর্তীকালে গৃহীত হয়নি সত্য, কিন্তু ঐতিহাসিক গবেষণা পূর্ববর্তী মতামতের সত্যতা পরীক্ষার মধ্য দিয়েই চিরকাল অগ্রসর হয়েছে।… রাজেন্দ্রলালের ঐতিহাসিক বিশ্লেষণী মন, তথ্যনির্ভরতা, যুক্তিপারম্পর্য, সত্যনিষ্ঠা এ-যুগেও ঐতিহাসিকদের শ্লাঘার বস্তু।”
১৮৫১ খ্রিষ্টাব্দে ‘ভার্নাকুলার লিটারেচার সোসাইটি’র সভ্য হন রাজেন্দ্রলাল এবং তারই অর্থানুকূল্যে নিজের সম্পাদনায় ‘বিবিধার্থ-সংগ্রহ’ নামে সচিত্র মাসিকপত্র প্রকাশ করেন। রাজপুতানার ইতিহাস লিখে সেখানে প্রকাশ করতে শুরু করলেন। এবং আরও একটা ঐতিহাসিক কাজ করলেন। এক মুসলমান চিত্রকরকে রাজপুতানার মানচিত্র আঁকার বরাত দিলেন। আরও পরে বাংলা ও অন্যান্য ভাষায় সমগ্র ভারতের মানচিত্রও তৈরি করেন তিনি। এই কাজে তাঁর দক্ষতার জন্য সরকারি আমন্ত্রণে উত্তর-পশ্চিম ভারতের ম্যাপও তৈরি করে দিতে হয়েছিল। ভারতের পাশাপাশি নেপালেও পুরোদমে চলেছে পুরাতাত্ত্বিক খনন এবং তার পাঠোদ্ধারের কাজ।

১৮৬২ সালে স্কুল বুক সোসাইটি ও ভার্নাকুলার লিটারেচার সোসাইটি একত্রিত হয় এবং পরের বছর এই সমিতির পক্ষ থেকে রাজেন্দ্রলালের সম্পাদনায় ‘রহস্য সন্দর্ভ’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এই দু’টি পত্রিকায় বিবিধ বিষয়ে নিজে লিখতে এবং অন্যান্য পণ্ডিতদের দিয়ে লেখানোর কাজ শুরু করেন রাজেন্দ্রলাল। গ্রন্থাগার, আগ্নেয়গিরি, মিশরের পিরামিড, বৌদ্ধদের মঠ থেকে শুরু করে মস্তিষ্ক, ভূতত্ত্ব, ভাষাবিজ্ঞান, অ্যাজ়টেকদের নরবলি ইত্যাদি বহু বিচিত্র বিষয়ে এখানে লেখা ছাপা হতে লাগল। আসলে রাজেন্দ্রলাল মনেপ্রাণে চাইতেন সাধারণ মানুষের ইতিহাস এবং ভূগোলের চর্চা যেন ব্যহত না হয় বইপত্র বা নথির অভাবে। বিশেষত শিশুরা যেন সহজে খেলার ছলে জগতের নানা বিষয়ে বিজ্ঞানসম্মত ধারণা তৈরি করতে পারে।
এই একই কারণে ভাষাতত্ত্বেও একের পর এক কাজ করে গেছেন তিনি। ইয়োরোপীয় ভাষাগুলির সঙ্গে ভারতীয় ভাষার সম্পর্ক নিয়ে চর্চা করতে গিয়ে শব্দের রূপ ও ধ্বনিগত পরিবর্তনকে বৈজ্ঞানিকভাবে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন রাজেন্দ্রলাল। এমনকী রাজেন্দ্রলাল বাঙালিকে চিঠি লেখাও শিখিয়েছেন বললে অত্যুক্তি হয় না। তাঁর চার খণ্ডে লেখা ‘পত্রকৌমুদী’ এর প্রমাণ। গুরুজন বা স্নেহভাজনকে পত্র, পাট্টা-কবুলিয়ৎ প্রভৃতি স্বত্ব এবং আদালতের আইনি চিঠির লিখনশৈলীর পার্থক্য সহজ ভাষায় বুঝিয়ে দিয়েছেন। আর আক্ষেপ করেছেন: “এতদ্দেশীয় মুসলমানেরা পত্রের পরিমাণ ও রঞ্জন বিষয়ে অদ্যাপি মনোযোগী আছে; কিন্তু হিন্দুসমাজে তাহার আর কোন অনুধাবন নাই।”
১৮৮০-র দশকে বাংলার সাহিত্যিকদের একত্রিত করে একটি সভা তৈরি করার পরিকল্পনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। বিভিন্ন বিষয়ে বাংলা পরিভাষা তৈরি করা এবং বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চার উন্নতিই এই সভার লক্ষ্য ছিল। ‘সারস্বত সমাজ’ নামে এই সভার সভাপতি হবার জন্য প্রথমেই ঠাকুরবাড়ি থেকে অনুরোধ গেল বিদ্যাসাগর মশাইয়ের কাছে। কিন্তু তিনি পত্রপাঠ বিমুখ করলেন স্বয়ং রবিকে। বললেন, ‘আমি পরামর্শ দিতেছি, আমাদের মতো লোককে পরিত্যাগ করো—‘হোমরাচোমরা’দের লইয়া কোনো কাজ হইবে না, কাহারও সঙ্গে কাহারও মত মিলিবে না।’ ফলে রাজেন্দ্রলাল মিত্রকে সভাপতি করা হল। কিন্তু বিদ্যাসাগরের কথা যে অক্ষরে অক্ষরে ফলে গিয়েছিল, সে কথা রবীন্দ্রনাথ নিজেই জীবনস্মৃতি-তে পরে উল্লেখ করেছেন। কী লিখেছেন, দেখা যাক:
“তিনি (বিদ্যাসাগর) এ সভায় যোগ দিতে রাজি হইলেন না। বঙ্কিমবাবু সভ্য হইয়াছিলেন, কিন্তু তাঁহাকে সভার কাজে যে পাওয়া গিয়াছিল তাহা বলিতে পারি না। বলিতে গেলে যে-কয়দিন সভা বাঁচিয়া ছিল, সমস্ত কাজ একা রাজেন্দ্রলাল মিত্রই করিতেন। ভৌগোলিক পরিভাষা নির্ণয়েই আমরা প্রথম হস্তক্ষেপ করিয়াছিলাম। পরিভাষার প্রথম খসড়া সমস্তটা রাজেন্দ্রলালই ঠিক করিয়া দিয়াছিলেন। সেটি ছাপাইয়া অন্যান্য সভ্যদের আলোচনার জন্য সকলের হাতে বিতরণ করা হইয়াছিল। পৃথিবীর সমস্ত দেশের নামগুলি সেই সেই দেশে প্রচলিত উচ্চারণ অনুসারে লিপিবদ্ধ করিবার সংকল্পও আমাদের ছিল। …বিদ্যাসাগরের কথা ফলিল— হোমরাচোমরাদের একত্র করিয়া কোনো কাজে লাগানো সম্ভবপর হইল না। সভা একটুখানি অঙ্কুরিত হইয়াই শুকাইয়া গেল।… তখন যে বাংলা সাহিত্য সভার প্রতিষ্ঠাচেষ্টা হইয়াছিল সেই সভায় আর কোনো সভ্যের কিছুমাত্র মুখাপেক্ষা না করিয়া যদি একমাত্র মিত্র মহাশয়কে দিয়া কাজ করাইয়া লওয়া যাইত, তবে বর্তমান সাহিত্য-পরিষদের অনেক কাজ কেবল সেই একজন ব্যক্তি দ্বারা অনেকদূর অগ্রসর হইত সন্দেহ নাই।”

কিন্তু কাজের মানুষ রাজেন্দ্রলাল এসবে ভ্রূক্ষেপ করবার মানুষ ছিলেন না। অ্যালবার্ট হলে সারস্বত সমাজের দ্বিতীয় অধিবেশনেই ভূগোলের বাংলা পরিভাষার প্রথম খসড়া প্রকাশ করলেন রাজেন্দ্রলাল মিত্র। পৃথিবীর সমস্ত দেশের নাম সেই দেশের প্রচলিত উচ্চারণ অনুসারে লেখবার পদ্ধতি এই খসড়াতে উল্লেখ করেছিলেন তিনি। ভূগোলের প্রেক্ষাপটে ইতিহাসকে চেনানো– এই ছিল রাজেন্দ্রলালের উদ্দেশ্য। দীনবন্ধু মিত্র রাজেন্দ্রলালের জীবদ্দশাতেই তাঁকে নিয়ে কবিতা লিখে ফেলেছিলেন। কী লিখেছিলেন দেখা যাক:
বিজ্ঞেন্দ্র রাজেন্দ্রলাল বিজ্ঞান-আধার,
বিলাত পর্যন্ত খ্যাতি হয়েছে বিস্তার,
ভূতপূর্ব-বিবরণে দক্ষতা অক্ষয়,
ক্ষত্র-বংশে তুলেছেন সেনরাজচয়,
রহস্যসন্দর্ভ-পত্র-যোগ্য-সম্পাদক,
পিতৃহীন ধনশালী শিশুর শিক্ষক।
রাজেন্দ্রলাল মিত্রের বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের মুগ্ধতার কথা আগেই উল্লিখিত হয়েছে। কিন্তু আরও একটু উল্লেখের লোভ সামলানো দায়, কারণ জীবনস্মৃতি গ্রন্থে বারবার রাজেন্দ্রলালের মনীষার কথা লিখছেন তিনি। নিজেকে তাঁর তুলনায় ‘অর্বাচীন’ বলে উল্লেখ করতেও দ্বিধা করছেন না। জীবনস্মৃতির পাতা থেকে তুলে দেওয়া যাক সেই টুকরো কথা:
“মানিকতলার বাগানে যেখানে কোর্ট্ অফ ওয়ার্ডস্ ছিল সেখানে আমি যখন-তখন তাঁহার সঙ্গে দেখা করিতে যাইতাম। আমি সকালে যাইতাম— দেখিতাম তিনি লেখাপড়ার কাজে নিযুক্ত আছেন। অল্পবয়সের অবিবেচনাবশতই অসংকোচে আমি তাঁহার কাজের ব্যাঘাত করিতাম। কিন্তু সেজন্য তাঁহাকে মুহূর্তকালও অপ্রসন্ন দেখি নাই। আমাকে দেখিবামাত্র তিনি কাজ রাখিয়া দিয়া কথা আরম্ভ করিয়া দিতেন। সকলেই জানেন, তিনি কানে কম শুনিতেন। এইজন্য পারতপক্ষে তিনি আমাকে প্রশ্ন করিবার অবকাশ দিতেন না। কোনো একটা বড়ো প্রসঙ্গ তুলিয়া তিনি নিজেই কথা কহিয়া যাইতেন। তাঁহার মুখে সেই কথা শুনিবার জন্যই আমি তাঁহার কাছে যাইতাম। আর কাহারও সঙ্গে বাক্যালাপে এত নূতন নূতন বিষয়ে এত বেশি করিয়া ভাবিবার জিনিস পাই নাই। আমি মুগ্ধ হইয়া তাঁহার আলাপ শুনিতাম।
বোধ করি তখনকার কালের পাঠ্যপুস্তক-নির্বাচন সমিতির তিনি একজন প্রধান সভ্য ছিলেন। তাঁহার কাছে যে-সব বই পাঠানো হইত তিনি সেগুলি পেনসিলের দাগ দিয়া নোট করিয়া পড়িতেন। এক-একদিন সেইরূপ কোনো-একটা বই উপলক্ষ করিয়া তিনি বাংলা ভাষারীতি ও ভাষাতত্ত্ব সম্বন্ধে কথা কহিতেন, তাহাতে আমি বিস্তর উপকার পাইতাম। এমন অল্প বিষয় ছিল যে সম্বন্ধে তিনি ভালো করিয়া আলোচনা না করিয়াছিলেন এবং যাহা-কিছু তাঁহার আলোচনার বিষয় ছিল তাহাই তিনি প্রাঞ্জল করিয়া বিবৃত করিতে পারিতেন। …

কেবল তিনি মননশীল লেখক ছিলেন ইহাই তাঁহার প্রধান গৌরব নহে। তাঁহার মূর্তিতেই তাঁহার মনুষ্যত্ব যেন প্রত্যক্ষ হইত। আমার মত অর্বাচীনকেও তিনি কিছুমাত্র অবজ্ঞা না করিয়া, ভারি একটি দাক্ষিণ্যের সহিত আমার সঙ্গেও বড়ো বড়ো বিষয়ে আলাপ করিতেন— অথচ তেজস্বিতায় তখনকার দিনে তাঁহার সমকক্ষ কেহই ছিলনা। এমন-কি, আমি তাঁহার কাছ হইতে ‘যমের কুকুর’ নামে একটি প্রবন্ধ আদায় করিয়া ভারতীতে ছাপাইতে পারিয়াছিলাম; তখনকার কালের আর-কোনো যশস্বী লেখকের প্রতি এমন করিয়া উৎপাত করিতে সাহসও করি নাই এবং এতটা প্রশ্রয় পাইবার আশাও করিতে পারিতাম না। অথচ যোদ্ধৃবেশে তাঁহার রুদ্রমূর্তি বিপজ্জনক ছিল। ম্যুনিসিপাল-সভায় সেনেট-সভায় তাঁহার প্রতিপক্ষ সকলেই তাঁহাকে ভয় করিয়া চলিত। তখনকার দিনে কৃষ্ণদাস পাল ছিলেন কৌশলী, আর রাজেন্দ্রলাল ছিলেন বীর্যবান। বড়ো বড়ো মল্লের সঙ্গেও দ্বন্দ্বযুদ্ধে কখনো তিনি পরাঙ্মুখ হন নাই ও কখনো তিনি পরাভূত হইতে জানিতেন না। এসিয়াটিক সোসাইটি সভার গ্রন্থপ্রকাশ ও পুরাতত্ত্ব আলোচনা ব্যাপারে অনেক সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতকে তিনি কাজে খাটাইতেন। আমার মনে আছে, এই উপলক্ষে তখনকার কালের মহত্ত্ববিদ্বেষী ঈর্ষাপরায়ণ অনেকই বলিত যে, পণ্ডিতেরাই কাজ করে ও তাহার যশের ফল মিত্র মহাশয় ফাঁকি দিয়া ভোগ করিয়া থাকেন। আজিও এরূপ দৃষ্টান্ত কখনো কখনো দেখা যায় যে, যে-ব্যক্তি যন্ত্রমাত্র ক্রমশ তাহার মনে হইতে থাকে আমিই বুঝি কৃতী,আর যন্ত্রীটি বুঝি অনাবশ্যক শোভামাত্র। কলম-বেচারার যদি চেতনা থাকিত তবে লিখিতে লিখিতে নিশ্চয় কোন্-একদিন সে মনে করিয়া বসিত— লেখার সমস্ত কাজটাই করি আমি, অথচ আমার মুখেই কেবল কালি পড়ে আর লেখকের খ্যাতিই উজ্জ্বল হইয়া উঠে।
বাংলাদেশের এই একজন অসামান্য মনস্বী পুরুষ মৃত্যুর পরে দেশের লোকের নিকট হইতে বিশেষ কোনো সম্মান লাভ করেন নাই। ইহার একটা কারণ ইঁহার মৃত্যুর৪ অনতিকালের মধ্যে বিদ্যাসাগরের মৃত্যু৫ ঘটে— সেই শোকেই রাজেন্দ্রলালের বিয়োগবেদনা দেশের চিত্ত হইতে বিলুপ্ত হইয়াছিল। তাহার আর-একটা কারণ, বাংলা ভাষায় তাঁহার কীর্তির পরিমাণ তেমন অধিক ছিল না, এইজন্য দেশের সর্বসাধারণের হৃদয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা লাভ করিবার সুযোগ পান নাই।”

রাজেন্দ্রলাল মিত্রের বহুমুখী প্রতিভার বিস্তার থেকে সরে থাকেনি শিল্প-সাহিত্য-জ্ঞানচর্চার কোনও ধারাই। পত্রিকা সম্পাদনার কথা আগেই বলা হয়েছে। হিন্দু পেট্রিয়ট-এর মতো ক্ষুরধার রাজনৈতিক সংবাদপত্রও সম্পাদনা করেছেন কিছুদিন। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় নির্বাচকমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন। সোসাইটি ফর প্রোমোশন অফ ইন্ডাস্ট্রিয়াল আর্ট সংস্থার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সঙ্গীত চর্চা করতেন নিয়মিত। ফিলহারমনিক অ্যাকাডেমি অফ বেঙ্গলের সদস্য ছিলেন। ১৮৫৬ সালে ফোটোগ্রাফিক সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই তিনি তার কোষাধ্যক্ষ ও সম্পাদক ছিলেন। ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গেও, যার প্রমাণস্বরূপ ১৮৭৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে প্রথম ‘ডক্টর অফ ল’ উপাধি দেয়। রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন আজীবন। রাজা রাধাকান্ত দেব প্রতিষ্ঠিত ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন, যার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল পরাধীন ভারতে জনকল্যাণমূলক আন্দোলন গড়ে তোলা, তার সঙ্গেও সম্পৃক্ত ছিলেন দীর্ঘকাল, এমনকী পরপর ছ’বছর সভাপতির পদেও ছিলেন। কলকাতা পুরসভার নির্বাহী সমিতির সদস্য ছিলেন রাজেন্দ্রলাল।
সুবক্তা রাজেন্দ্রলাল ছিলেন তেজস্বী। মিথ্যাচার আর সামাজিক কলুষতার বিরুদ্ধে নিরন্তর প্রতিবাদ ছিল তাঁর। ফলে বারংবার নিন্দা আর বিদ্রূপের আঘাত সহ্য করতে হয়েছে তাঁকে। এমনকী বিদ্যাসাগর পর্যন্ত তাঁর সংস্কৃতজ্ঞান নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, ব্যঙ্গ করেছেন। হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ‘অহংত্ত্ব বড্ড বেশী, নহিলে হাজার-রাজার মাথার চুড়ো তুল্য কে উহার?’ তদানীন্তন বাঙালি বিদ্বজ্জনেরা তাঁকে ‘খিটখিটে’, ‘সবজান্তা’, ‘প্রচারমুখী’ এমন বহু বিশেষণে অভিষিক্ত করেছেন। কিন্তু তার কতখানি সত্য, আর কতখানি জল, তার জানবার কোনও প্রামাণ্য তথ্য আমাদের হাতে আর নেই। রাজেন্দ্র-জীবনীকার অলোক রায় নিরপেক্ষভাবেই লেখেন:
“যশের আকাঙক্ষা রাজেন্দ্রলালের ছিল না, এমন কথা বলি না, বরং ইতালীয় রেনেসাঁসযুগে যশের প্রতি এক নূতন ধরনের আকাঙ্ক্ষার কথা বুর্কহার্ট খুব বিস্তারিভভাবে আলোচনা করেছেন– কিন্তু রাজেন্দ্রলালের প্রয়াস-প্রযন্ত-নিষ্ঠার তুলনায় যশ তিনি অল্পই লাভ করেছেন। রেনেসাঁসযুগে ‘অহংত্ত্ব’ বেশী হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু প্রাথমিক উদ্দেশ্য যাই থাক না কেন, শেষ পর্যন্ত জ্ঞানচর্চাই উপায় ও লক্ষ্য হয়ে ওঠে। ঐতিহাসিক গবেষণায় রাজেন্দ্রলালের সাফল্য এবং কৃতিত্ব কতখানি তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ থাকতে পারে, কিন্তু উনবিংশ শতাব্দীতে বিরলতম ভারতীয় কয়েকজনের মধ্যে তিনি একজন, যিনি অন্য জীবিকার জন্য প্রস্তুত হয়েও, অন্যতর ক্ষেত্রে প্রভূত সাফল্যলাভের সুযোগ পেয়েও, জ্ঞানচর্চাতেই জীবন অতিবাহিত করলেন। পথিকৃতের মর্যাদা তিনি পেয়েছেন, কিন্তু সেই সঙ্গে অবিশ্বাস এবং বিদ্বেষলাভও পথিকৃতের ললাটলিপি।”
তথ্যসূত্র:
অলোক রায়: রাজেন্দ্রলাল মিত্র
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: জীবনস্মৃতি
আবু ইমাম: রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্র
আনন্দবাজার পত্রিকা: শুভাশিস চক্রবর্তীর প্রবন্ধ
ছবি সূত্র: Royal Asiatic Society of Great Britain and Ireland
লিখতে শিখেই লুক থ্রু! লিখতে লিখতেই বড় হওয়া। লিখতে লিখতেই বুড়ো। গান ভালবেসে গান আর ত্বকের যত্ন মোটে নিতে পারেন না। আলুভাতে আর ডেভিলড ক্র্যাব বাঁচার রসদ। বাংলা বই, বাংলা গান আর মিঠাপাত্তি পান ছাড়া জীবন আলুনিসম বোধ হয়। ঝর্ণাকলম, ফ্রিজ ম্যাগনেট আর বেডস্যুইচ – এ তিনের লোভ ভয়ঙ্কর!!
কলকাতার বেলেঘাটায় তাঁর বসত বাড়ি। বেলেঘাটা মেন রোড এবং হেমচন্দ্র নস্কর রোডের সংযোগকারী সড়কের নাম রাজেন্দ্রলাল মিত্র রোড। ভেঙে যাওয়া আলোছায়া সিনেমা হলের পরে বাঁ হাতে বসতবাড়িটি অবস্থিত ছিল। বাড়িটির ভেতরে ছিল বিরাট লাইব্রেরি। রাস্তার অন্য পাড়ে ছিল তাঁর পুকুরসমেত ভূসম্পত্তি। পাড়ার নাম রাসবাগান।এখন বোধ হয় সবটাই আকাশ ছোঁয়া বাড়ির গহ্বরে অন্তর্হিত। তবে রাস্তার নাম পাল্টায়নি।
লেখাটি পৰে আমি অনেক ধন্য হৈলাম । বাকী কথাৰ সাথে আমাৰ জন্যে অনেক কাজেৰ কথাই অনুভৱ হৈলো । বিশেষ কৰে মানৱ চৰিত্য বনাম হিন্দুদেৰ মতি । তা বাংঙ্গালি বলে কোনো কথা নেই ।