বাজটা কাছেপিঠেই কোথাও পড়ল মনে হয়! সঙ্গে সঙ্গে কারেন্ট গেল!
আমাদের লাইব্রেরির পাঠচক্রে এ মাসের আলোচনাসভায় আমি ঠিক করেছি ‘রামমোহন আর সতীদাহ’ বিষয়ে কিছু বলব। কাগজে লিখে নিয়েই যাব। তবে বিষয়টা বেশ কঠিন। একটু পড়াশোনা দরকার। টেবিলের ওপর রামমোহনের ছবিটা রাখলাম। তাঁকে একটা প্রণাম করে খাতা কলম, বইপত্র গুছিয়ে নিয়ে সবে বসতে যাব তখনই এই জ্বালাতন। আজকাল প্রায়ই বিকেলের দিকে ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে আর তার দাপটে ইলেকট্রিকের বাতি নিভছে। তাই মোমবাতি দেশলাই টেবিলের ওপর হাতের কাছেই গোছানো থাকে। আমার গিন্নি নির্মলার সবদিকে নজর।
এ বাড়িটা আমার ঠাকুরদার আমলের। একতলাই ছিল, বাবা দোতলায় একটা ঘর তুলেছিলেন। বাকিটা ছাদ। দোতলার এই ঘরখানা আমার ছেলের ছিল। সে এখন চাকরি পেয়ে চেন্নাইয়ে আছে। ও চলে যাবার পর আমি এটার দখল নিয়েছি। খাওয়াদাওয়া আর ঘুমোনো ছাড়া এ ঘরেই থাকি। আমাদের বেডরুম অবশ্য নীচেই। নির্মলা একতলাতেই থাকে। কদাচিৎ ওপরে আসে। ইচ্ছে আছে সামনের বছর ছেলের বিয়ে দেব। তার আগে সামনের ছাদটাতে আর একটা ঘর তুলব। মাসকয়েক আগে হঠাৎ করেই হাতে বেশ কিছু টাকাপয়সা এসেছে।
এ পাড়াটা মোটামুটি আমাদের জ্ঞাতিগুষ্টি নিয়েই। বেশ সদ্ভাব আছে পরস্পরের। মাঝে নির্মলা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। তখন ডাক্তার, হাসপাতাল সব আমার ছোট জ্যাঠার ছেলেরা করেছে। আমার আর এক কাকার ছেলের প্রথম পক্ষের বৌটি যখন আগুনে পুড়ে মারা গেল, তখন থানা পুলিশের ঝামেলা আমিই সামলে দিয়েছি। এরকমই চলে।
লেখাটা আজ শেষ করতেই হবে। মোমবাতিটা জ্বেলে টেবিলে বই খুলে সতীদাহ প্রথার মেন পয়েন্টগুলো নোটবুকে টুকে রাখতে শুরু করলাম। সাল, তারিখ, সতীদাহের কারণ, নির্মমতা পড়তে পড়তে কেমন যেন ডুবে গেছিলাম । সত্যি কী নিষ্ঠুরই না ছিল তখনকার মানুষগুলো! হঠাৎ মনে হল ঘরে আমি একা নই। কেমন যেন টের পাচ্ছি একটা উপস্থিতি। চোর টোর এল নাকি? ব্যাপারটা কী দেখার জন্যে মোমবাতিটা হাতে নিয়ে উঠতে যাচ্ছি, হঠাৎ কানে এল একটা রিনরিনে মেয়েলি কণ্ঠস্বর!
– আপনাকে প্রণাম!
গা দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। এমনিতে ভূতপ্রেতে আমার খুব একটা বিশ্বাস নেই। কিন্তু এমন আবছা অন্ধকারে মোমের আলোয় গা ছমছম করল।
– আমায় ভয় পাবেন না। যেতে যেতে দেখলুম আপনি ওই মহাপুরুষকে প্রণাম করলেন, তাই বাজ ফেলে আলো নিবিয়ে আপনার কাছে এলুম। বেশি আলো আবার আমাদের সহ্য হয় না কিনা। আপনাকে প্রণাম।
আবার সেই রিনরিনে গলায় শব্দ। বেশ ভয় ভয় করছিল। তবুও ভাবলাম ইনি যখন বার বার প্রণাম জানাচ্ছেন তাহলে একটু আলাপ করে দেখাই যাক। আস্তে আস্তে প্রশ্ন করলাম:
– কে আপনি? আমাকে আপনি বলবেন না। আপনার থেকে আমি অনেক ছোট, যখন পৃথিবী ছাড়ি তখন আমার বয়েস এক কুড়ি এক।
– এক কুড়ি এক, মানে একুশ! আপনি কতদিন আগে পৃথিবী ছেড়েছিলেন?
– তা ধরুন গিয়ে প্রায় আড়াইশো বছর!
আমার হাঁ বন্ধ হচ্ছে না। তবে আস্তে আস্তে ভয়টা কাটছে। মনে হল জানতে চাই, কেন তিনি এত কাণ্ড করে এখানে উদয় হলেন। প্রশ্ন অবশ্য করতে হল না। কথা ভেসে এল:
– আপনি যাঁকে প্রণাম করলেন, তিনি আমার মতো অনেক অনেক মেয়ের কাছে দেবতা। কত অভাগিনীর জীবন যে তিনি রক্ষে করেছিলেন। আমি কিছু উত্তর দেবার আগেই রিনরিনে গলা হঠাৎ তীক্ষ্ণ হয়ে গেল: আগুনে জীবন্ত পুড়ে মরার যে কী জ্বালা! দেহই নেই এখন, কিন্তু আজও মনে সেই দগদগে স্মৃতি!
তাহলে কি ইনি একজন সতী! উফফ! আড়াইশো বছরের পুরনো এক সতীর মুখোমুখি সাক্ষাৎকার! আমার লেখাটা তো ফাটাফাটি হবে! বোধহয় আমার মনের কথা আন্দাজ করেই তিনি শুরু করলেন এক কঠিন জীবনকথা।
সে যুগের হিসেবে আমার একটু বেশি বয়েসেই বিয়ে হয়েছিল। সমাজের চোখরাঙানির ভয়ে আমার গরিব বাবা জোটালেন এক পয়সাওলা থুত্থুড়ে কুলীন বুড়ো। প্রথমদিনেই আমাকে দেখে আগের পক্ষের ছেলেমেয়েরা মুখ বেঁকাল। দেখলুম তাদের বয়েস আমার চেয়ে ঢের বেশি। কাজের লোকেরা আমাকে খেতে দিল। খাবার পর একটা ঘরে বসে আছি, বুড়োর ছোট ছেলে এসে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করল। আমি ভয় পেয়ে তাকাতেই সে বলল, ‘আমার বাবার ভীমরতি হয়েছে। তাই তোমার মতো পদ্মকলিকে বিয়ে করেছে। আহারে, ওই বুড়োতে কি তোমার মন মজে? ইচ্ছে করে সোনায় সোহাগে তোমায় ভরিয়ে রাখি। কোনও চিন্তা কোরও না, আমি আছি তোমার জন্যে। ভয় নেই, কাকপক্ষীতেও টের পাবে না।’
আমার গা ঘিনঘিন করছিল। বললুম: ‘আপনার লজ্জা করে না? আমি না সম্পর্কে আপনার মা?’ লোকটা হাসল। নোংরা একটা হাসি। তারপর কাছে ঘেঁষটে এসে আমার গালে টুসকি মেরে বলল: ‘আমার বাপ্ যদি নাতনির চেয়েও কমবয়সী একটা মেয়েকে নিয়ে বুড়ো বয়েসে রসের সাগরে ভাসতে পারে, তাহলে আমার অন্যায়টা কোথায় শুনি!’ ভীষণ রেগে তার গালে চড় কষাতে গেলুম। খপ করে আমার হাতটা ধরে জোরে মুচড়ে দিয়ে সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। কিন্তু যাবার সময় হিসহিসে গলায় শাসাল, ‘দেখি, কতদিন সতী থাকিস!’

শুরু হল আমার বিষে ভরা জীবন। সারা রাত অক্ষম বুড়ো বরের ভোগের আগুনে পুড়ি আর দিনের বেলা ভয়ে ভয়ে থাকি একটা নোংরা জোয়ান লোকের ফাঁদে পড়ার। সারাদিন চেষ্টা করতুম ওর কাছ থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে থাকার। তাও মাঝেমাঝেই লোকটা আমাকে উত্যক্ত করত, চেষ্টা করত ধরার। দিনে রাতে সে যে কী কষ্ট! মাঝেমাঝে মনে হত নিজেকে শেষ করে দিয়ে এই যন্ত্রণার হাত থেকে বাঁচি। জীবনে কী ছিল আমার! বাপ সমাজের চোখরাঙানিতে ঝুলিয়ে দিল একটা ঘাটের মড়ার সঙ্গে, শ্বশুরবাড়িতে শুধু চারদিকে জঘন্য শয়তান লোকজনের ভিড়!
তবু কেন জানিনা আমার বাঁচতে ভালো লাগত! চওড়া পাড় শাড়িপরা একগা গয়নায় ঢাকা আমার যে ছায়া আয়নায় ফুটে উঠত, তাকে আমি বড্ড ভালোবাসতুম। সব ভুলে গিয়ে চানের পর মন দিয়ে কপালে গোল করে সিঁদুরের টিপ আঁকতুম আর নিজেই নিজেকে দেখে মুগ্ধ হতুম! গরম ভাত আর মৌরলা মাছের টক আঙুল চেটে চেটে খেতুম। রাঁধুনি বামনি তখন সদয় হয়ে আরো চাট্টি ভাত আর মাছ ঢেলে দিত। জানত তো আমার মাছ খাবার আয়ু বেশিদিনের নয়। এর মধ্যেই আমার বুড়ো বর ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। একেবারে যায় যায় অবস্থা। কবরেজমশাই ওষুধপথ্য দিলেন আর বিধেন দিলেন বিশ্রাম আর যত্নের। সে সময়টা খুব ভাল করে বুঝলুম আমাকে আগলে রাখার জন্যে এবাড়িতে ওই বুড়োমানুষটা ছাড়া আর কেউ নেই। তাই খানিকটা হয়তো নিজেকে রক্ষে করতেই দিনরাত এক করে প্রাণপণ সেবা করে চললুম। আয়ুর জোরে নাকি আমার সেবার জোরে জানি না, উনি আস্তে আস্তে সেরে উঠলেন। ওঁর কেমন ধারণা হল, নতুন বৌ সাক্ষাৎ সাবিত্রী, তার জন্যেই তিনি যমের ঘর থেকে ফিরে এসেছেন!
একটু সুস্থ হয়েই বাড়ির সবাইকে ডেকে উকিলবাবুর সামনে নতুন উইল করে আমার স্বামী অদ্ধেক সম্পত্তি আমার নামে লিখে দিলেন। আগের পক্ষের বড় আর মেজো ছেলে রেগেমেগে আপত্তি জানাল বটে, কিন্তু ছোট ছেলে একটিও কথা বলল না। একটু অবাক হয়েছিলুম ঠিকই, কিন্তু ওর কুটিল মনের মধ্যে আসলে কী চলছিল, আমি স্বপ্নেও আন্দাজ করতে পারিনি। তবে ও লোকটাকে নিয়ে আর আমার খুব বেশি মাথাব্যথা ছিল না। স্বামীর কাছাকাছি থাকতুম তো তখন সব সময়। উইল হাতে আসার পর একটু নিশ্চিন্তও হলুম। মনে মনে ঠিক করে নিয়েছিলুম, উনি চোখ বুজলে পয়সাকড়ি নিয়ে বাপের বাড়ি চলে যাব। জানতুম ধনী বিধবার কদর বাপ ভাইয়েরা করবেই।
এরমধ্যে আরও বছর চারেক কেটে গেল। ইতিমধ্যে আমার স্বামীর ছোট ছেলে, ওই লোকটা দু’দুটো বিয়ে করেছে পরপর। দুই শ্বশুরই বেজায় ধনী। ভেবেছিলুম, বৌরা আসার পর লোকটা শুধরে গেছে। তাই দিন মোটামুটি কেটে যাচ্ছিল। তবে আমার স্বামী আর আগের মতো সুস্থ হলেন না। আগের সেই বড় অসুখটা তখনই ভেতরে ভেতরে বেশ বড়সড় ধাক্কা দিয়েছিল। এবার দু’মাস টানা ভুগে এক ভোরে উনি মারা গেলেন। বাড়ির লোক যখন শ্মশানযাত্রার আয়োজন করছে, তখন ওই লোকটা আমার ঘরে জরুরি আলোচনার জন্যে এল। বাকি লোকজনকে বাইরে পাঠিয়ে সে যে কথাটা পাড়ল, তাতেই আমার বুঝতে বাকি রইল না, কেন সে তখন বাবার উইলে আপত্তি জানায়নি।
তবু কেন জানিনা আমার বাঁচতে ভালো লাগত! চওড়া পাড় শাড়িপরা একগা গয়নায় ঢাকা আমার যে ছায়া আয়নায় ফুটে উঠত, তাকে আমি বড্ড ভালোবাসতুম। সব ভুলে গিয়ে চানের পর মন দিয়ে কপালে গোল করে সিঁদুরের টিপ আঁকতুম আর নিজেই নিজেকে দেখে মুগ্ধ হতুম! গরম ভাত আর মৌরলা মাছের টক আঙুল চেটে চেটে খেতুম।
একটানা বলার পর সেই অদেখা রমণী খানিক থামলেন। তারপর আবার শুরু হল। কেন জানি না আমার মনে হল এবার গলার সুরটা একটু বেশি তীব্র!
লোকটা আমার খুব কাছে এসে ফিসফিস করে বলল, ‘শোনও, সময় খুব কম। উইলের কাগজ নিয়ে তৈরি থেক। সারাজীবন তোমায় মাথায় করে রাখব সুন্দরী! তাই অদ্ধেক রাজত্ব আর রাজরানি দুই-ই চাই আমার! শ্মশান থেকে ঘুরে আসি। মাঝরাত্তিরে পালকি পাঠাব খিড়কির দোরে। সজাগ থেক। একেবারে এমন জায়গায় নিয়ে তুলব, যে কেউ টেরটি পাবে না। রটিয়ে দেব তুমি জলে ডুবে মরেছ! উফফ আর তর সইছে না! সেই প্রথমদিন থেকে কেমন মজে আছি সে তো তুমি জান!’ বলেই আমার থুতনিটা একটু নেড়ে দিল। মাথায় রক্ত উঠে গেছিল, গায়ের সব শক্তি দিয়ে তার গালে একটা সপাটে চড় কষিয়ে দিলুম। চড়টা খেয়ে লোকটা হিংস্র হয়ে গেল! বলে উঠল, ‘রানি হয়ে থাকতিস সহ্য হল না তাই না? যা তাহলে আগুনে ঝলসে ঝলসে মর!’ বলেই দরজা খুলে সামনের সব লোককে চিৎকার করে বলতে লাগল: ‘শাঁখ বাজাও, উলু দাও, ছোটমা সতী হবে।’
আমার পায়ের নীচে মাটি দুলে উঠল। খুব ভাল করে জানতুম আমার পরিণতি কী। আমি সতী হলে সবার সুবিধে। বাপের সব সম্পত্তি তখন তিন ছেলে সমান ভাগে পাবে। আমাকে সরাতে তাই রাজি সবাই হবেই! চিৎকার করে আপত্তি জানালুম। কিন্তু চারিদিকে তখন জয়ধ্বনি আর সঙ্গে শাঁখ আর উলু। আমার করুণ চিৎকার সেই আওয়াজে ঢাকা পড়ে গেল।
কাহিনিটা জমে উঠেছিল। কিন্তু আমার মনে একটা প্রশ্ন উঁকিঝুঁকি মারছিল। গল্প মাঝপথে থামিয়েই তাই জিজ্ঞাসা করলাম:
– তারপর তো আপনি সতী হয়ে পুড়ে ছাই হয়ে গেলেন। কিন্তু আমি যতদূর জানি সতীরা স্বর্গে যায়! আপনি ভূত থুড়ি পেত্নী হলেন কি করে?
– আমি আজ অবধি পেত্নী ছিলাম। রাত পোহালেই স্বর্গে যাব।
– তাহলে সতীরা কি কিছুদিনের জন্যে পেত্নী হয়?
আরও পড়ুন: মন্দার মুখোপাধ্যায়ের কলমে: মেয়েদের গপ্পো আড্ডা
উত্তর না দিয়ে রিনরিনে গলা আবার গল্প বলা শুরু করল। তবে একটু যেন ক্লান্ত, ধীরগতিতে।
– খবর বাতাসের গতিতে চারদিকে ছড়িয়ে গেল যে আমি সতী হচ্ছি। আমার সতীনের মেয়ে বৌ, যারা এতদিন আমার মুখও দেখত না, তারা পর্যন্ত আমায় প্রণাম করে গেল। আশপাশের গ্রাম থেকেও দলে দলে লোকজন আসতে লাগল। ঠিক হল সেইদিন নয়, তারপরের দিন সকালে দাহকাজ হবে। আমি শুধু চেঁচিয়ে যাচ্ছিলুম যাতে একটা লোক অন্তত আমার কথা শোনে। কিন্তু বলির পাঁঠার কান্না কে শোনে বলুন? চিৎকার করে করে একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়লুম। কে যেন এসে এক গেলাস শরবত এনে দিল। শরবত খেয়ে প্রাণটা জুড়িয়ে গেল আর কেমন যেন ঘুম ঘুম পেতে লাগল। কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছি বুঝিনি। কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলুম জানি না, জেগে দেখি প্রায় সন্ধ্যে নেমে এসেছে।
প্রথমটা মাথাটা কেমন যেন ঝিম মেরে ছিল। তারপরই বুঝতে পারলুম যে আমাকে কিছু একটা খাওয়ানো হয়েছে যাতে নেশার ঘোরে থাকি। তাতে এদের পোড়ানোর সুবিধে। সজ্ঞানে কি কেউ আগুনে পুড়তে চায়? ইচ্ছে করছিল তখন সব কিছু ছারখার করে দিতে। কিন্তু কতটুকু সাধ্য আমার! সেই কথা ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। তাই নেশা কেটেছে, এটা কাউকে বুঝতে না দিয়ে ঘুমের ভান করে মটকা মেরে পড়ে থাকলুম। ভোর থেকেই আমাকে সাজানো শুরু হল। সব বুঝছি কিন্তু কাউকে সেটা জানতে দিচ্ছি না। কে যেন আরও শরবত খাওয়াতে এল। মুখে না তুলে গালের কষ বেয়ে গড়িয়ে ফেলে দিলুম, লোকে বুঝল না সত্যিটা। ওরা বলাবলি করছিল আমি বুঝি নেশার ঘোরে এমনটা করছি।
এদিকে ওরা আমার গায়ে বেশ করে ঘি আর কত কিছু মাখিয়ে আমাকে চিতায় বসিয়ে দিল। বুড়োর মাথাটা তুলে দিল কোলে। একটুও প্রতিবাদ করিনি, জানতুম ফল হবে না। মনে তখন শুধু বদলা নেবার চিন্তা। আগুন জ্বলে উঠল। চারদিকে ঢাকঢোলের আওয়াজ আর জয়ধ্বনি। সারা গা জ্বলে যাচ্ছে, যন্ত্রণায় কাবু হয়ে নুয়ে যাচ্ছে সারা শরীর। এমন সময় চিতার খুব কাছে এসে দাঁড়াল সেই শয়তান লোকটা, মুখে একটা নোংরা হাসি। আমি এই সুযোগেরই অপেক্ষায় ছিলুম। চারপাশের লোক তখন মজা দেখতে ব্যস্ত। আমি একলাফে সোজা লোকটার গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে প্রাণপণে জড়িয়ে ধরলুম। সব লোক চমকে উঠল। অনেকেই দৌড়ে এসে ছাড়াবার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু আমি তাকে আরও আষ্টেপৃষ্টে ধরেছি। দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন। ভীষণ ধস্তাধস্তি চলল বেশ খানিকক্ষণ। তবে আমি কি আর অত লোকের সঙ্গে যুঝতে পারি? আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে পড়লুম। একসময় আমাকে লোকগুলো আবার চিতায় তুলে দিল।
আমি বাকরুদ্ধ হয়ে এই রোমহর্ষক কাহিনি শুনছিলাম। কেমন যেন বিহ্বল হয়ে প্রশ্ন করে ফেললাম:
– আর সেই লোকটা?
এবার একটা চাপা হাসির মতো শব্দ পেলাম।
– পেত্নী হয়েই আগে তাকেই দেখতে গেছিলুম! আধপোড়া চেহারা দেখে মনে কী আনন্দ! অনেকদিন বেঁচেছিল ওইভাবে। তিনি থামলেন। কিন্তু আমি তখন অধৈর্য্য! বলে উঠলুম:
– আপনার কী হল?
– আমি গেলুম সটান যমালয়ে। চিত্রগুপ্ত বিধান দিলো আমার নাকি অনন্ত নরকবাস। আমি মা হয়ে ছেলেকে কুনজরে দেখেছি। তাই মরণকালে তাকে জড়িয়ে ধরেছিলুম। আমি প্রচণ্ড রেগে প্রতিবাদ করলুম আর যমরাজকে খুলে বললুম সব কথা। তিনি বুঝলেন যে জীবনে আমি কোনও অন্যায় করিনি, তাই স্বর্গেই আমার জায়গা হবে। কিন্তু একজন মানুষকে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছিলুম তো, তাই প্রথমে কিছু কাল নরকবাস করতে হবে, ওই যুধিষ্ঠিরের মতন আর কী। পেত্নী হয়ে আমি ঘুরে বেড়াতে লাগলুম! অনেক অনেক দিন!
আরও পড়ুন: অভিরূপ মুখোপাধ্যায়ের কলমে: প্রত্যেক মুহূর্তে তুমি কবি
তারপর একদিন জানলুম রাজা রামমোহনের চেষ্টায় বন্ধ হয়েছে সতীদাহ প্রথা। সেই থেকে ওঁকে ভগবান মেনেছি। তারপর কত ভাল কত মন্দ দেখলুম। কাল আমি স্বর্গে চলে যাব। আর দেখব না এই পৃথিবী। আমার আর জন্ম হবে না। তাই আজ একটু শেষবারের মতো ঘুরে ফিরে দেখছিলুম। আর আপনাকে ওঁর ছবির সামনে দেখে একটা প্রণাম জানালুম। তবে দুঃখু একটাই, চিতায় পোড়ানো উনি আইন এনে বন্ধ করলেন ঠিকই, কিন্তু মানুষ কি বদলাল? এত বছর পরও তো এখনও কত কত বৌকে ঘরে ঘরে আগুনে পুড়িয়ে মারছে ওই সম্পত্তির লোভে!
আমি একটা ধাক্কা খেলাম। আমার খুড়তুতো ভাই কয়েকমাস আগে প্রথম বৌটির গায়ে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল। বৌটি বাপের বাড়ি থেকে টাকা পয়সা আনতে রাজি হয়নি তাই। আমি রাজনৈতিক দাদাদের ধরে করে ব্যাপারটা চেপে দিই। প্রমাণ হয়, ঠাকুরঘরে সন্ধ্যাবাতি দেবার সময় আঁচলে প্রদীপের আগুন ধরে যায়, তার থেকেই মৃত্যু। ভাইটিকে অবশ্য বেশ মালকড়ি খসাতে হয়েছিল ব্যাপারটা চাপা দেবার জন্যে। তা তো হবেই, খুন বলে কথা। দালালি হিসেবে সেই টাকার অর্ধেক আমার পকেটে আসে। ভাই অবশ্য জানে, পুরো টাকাটাই ওই দাদাদের দিতে হয়েছে। সে বেজায় খুশি। ওসব নিয়ে বেশি চিন্তা করার সময় নেই তার। নতুন বৌ এনেছে ঘরে মাসখানেক হল। ওই হিসসার টাকাতেই ঘরটা তুলব। তারপর ছেলের বিয়ে দেব। এই সব ভাবতে ভাবতে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ আমার কানে এলো রক্তজল করা চিৎকার!
– তুইও তাহলে ঘোর পাপী! কোন সাহসে তুই ওঁর ছবিকে প্রণাম করিস! পুড়ে মর তুই! বোঝ পোড়ার জ্বালা কী!
আমি দেখতে পেলুম লেলিহান আগুনের শিখা আমার দিকে এগিয়ে আসছে। আমার মনের ভাবনা ও কী করে পড়ে ফেলল? আতঙ্কে গলা দিয়ে স্বর বেরচ্ছিল না। তাও বলে চললাম:
– ক্ষমা করুন, ক্ষমা করুন!
এবার কানে এল আরও জোরে চিৎকার!
– দেখ কাণ্ড! নিজেও পুড়বে আর আমাকেও পুড়িয়ে মারবে!
সারা শরীরে হঠাৎ ঠান্ডা জলের ধারা এসে লাগল। তীব্র কাঁপুনি হতে লাগলো আমার!
– কী গো কথা বলছ না কেন? স্ট্রোক ট্রোক হল নাকি! শুনছ! চোখ মেল!
চেয়ে দেখি নির্মলা। কারেন্ট এসে গেছে। রাতের খাবার বেড়ে ডেকে ডেকে আমার সাড়া না পেয়ে নির্মলা ওপরে উঠে এসে দেখেছে আমি ঘুমোচ্ছি আর মোমবাতি উল্টে আগুন লেগে গেছে! সঙ্গে সঙ্গে জগের জল ঢেলেছে আর তাতেই আমি জেগেছি।
স্বপ্ন দেখছিলাম! উঃ কী ভয়ানক স্বপ্ন! আগুনে বিশেষ কিছু ক্ষতি হয়নি অবশ্য। শুধু আমার নোটপত্তর সব পুড়ে গেছে। ঠিক সময় নির্মলা না এসে পড়লে কী যে হত! ভেবে এখনও আমার হৃৎকম্প হচ্ছে! তবে আশ্চর্যের ব্যাপার, ঘর থেকে একটা জিনিস উধাও হয়েছে। ফ্রেমে বন্দী রামমোহন রায়! রাতে বিছানায় শুয়েই স্থির করলাম, পাঠচক্রে জানিয়ে দেব রামমোহন নয়, আমি জগদীশ বোসকে নিয়ে আলোচনা করতে চাই। গাছপালাই ভাল, নিরাপদ।
অদিতি ঘোষ দস্তিদার পেশায় গণিতের অধ্যাপিকা। নেশা লেখালিখি। নিউজার্সিতে থাকেন। সারা পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন। আমেরিকা থেকে প্রকাশিত 'অভিব্যক্তি' পত্রিকার সম্পাদক। মিশিগান থেকে প্রকাশিত 'উদ্ভাস' এবং কলকাতার 'কাফে টেবিল' প্রকাশনার 'অবসর' পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীতেও রয়েছেন। ছোটগল্প ও অণুগল্প লেখা বিশেষ পছন্দের।
ভাল লাগল। রেশ থেকে যায় ।