আরপি কাকু বাবার চেয়ে সাত বছরের বড় ছিলেন। তবু কেন জেঠু না বলে কাকু বলতাম? কোনওদিন ভেবে দেখিনি। আরপি কাকুও ভেবে দেখেছেন বলে মনে হয় না। আরপি কাকুর কাছে বয়স একটা সংখ্যামাত্র। একদিন বয়স নিয়ে কথা হতে বললেন, ‘‘বেশি বয়স, ছোট-বড়ো, সবটাই রিলেটিভ…।’’ আমি স্বাভাবিকভাবেই দ্বিমত হলাম। প্রশ্ন করলাম ‘কেন’, ব্যাখ্যাও চাইলাম। উনি আমার বোঝার মতো করে বললেন— ‘‘একজন ৮৮ বছরের মহিলা আর তার ৮৬ বছরের বোন চেঁচিয়ে কাঁদছে আর তাদের ৮৪ বছরের ভাইকে নিয়ে বলছে আঁতুড়ে ছেলেটা চলে গেল! এ রকম তো হামেশাই হচ্ছে!’’
এইভাবে রসিকতা দিয়ে বোঝানোর ব্যাপারটা আরপি কাকুর একটা ট্রেডমার্ক ছিল। যেমন একবার একটি লোকের বোকামির পরিমাণ বোঝাতে গিয়ে একটা অদ্ভুত কথা বলেছিলেন। তিরিক্ষি মেজাজে সমানে বলে যাচ্ছেন, লোকটা ভারী বোকা! কতটা বোকা? জানতে চাওয়ায় জবাব দিয়েছিলেন, ‘‘যদি লোডশেডিংয়ে কালীঘাটে ধরা পড়ে, পাঁঠা বলে বলি হয়ে যাবে!’’ রামকৃষ্ণ পরমহংসের প্রতি পরম শ্রদ্ধা ছিল আরপি কাকুর, সেটা প্রায় বিস্ময়ের রূপ নিত। আমার পরে মনে হয়েছে, রসিকতার মোড়কে বোঝানোর ধরনটাও হয়তো পরমহংসের প্রতি ওঁর অনুরাগের একটা বড় কারণ।
আরপি কাকুর পাণ্ডিত্য নিয়ে অনেকেই অনেক বলেছেন আর লিখেছেন। নতুন করে আমার আর কিছু বলার নেই। শুধু সাহিত্য নয়, শিল্প, স্থাপত্য, বিজ্ঞান, সঙ্গীত ইত্যাদি নিয়েও অগাধ পাণ্ডিত্য আর কৌতূহল ছিল ওঁর। মিগুয়েল দে সার্ভান্তেসের ডন কুইকজোট বা ঈশ্বর গুপ্ত, উনি পাতার পর পাতা মুখস্থ বলতে পারতেন। ভাষার সঙ্গে গভীর প্রেম ছিল। নতুন প্রজন্মের মুখের ভাষা কেমন বদলাচ্ছে, সে প্রসঙ্গে একদিন জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘একটা ব্যাপার কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি না। আজকাল লোকে বলে অবস্থা টাইট আর প্রেস্টিজ ঢিলে! কোনটা বেশি প্রিক্যারিয়াস? টাইট না ঢিলে?’’
আরপি কাকুর ইংরেজি নিয়ে বলতে গেলে ২০২১-এর পাঠককে মনে করানো দরকার, উনি কিন্তু ওঁর বন্ধু সত্যজিৎ রায়ের মতোই বাংলা মিডিয়াম স্কুলে পড়েও বহু সাহেবকে ইংরেজি শিখিয়ে দিতে পারতেন। চার্লস ডিকেন্সের ভক্ত ছিলেন। আরও অনেকেরই ভক্ত ছিলেন। ভারতীয় ইংরেজি লেখাপত্রও নজর করতেন নিয়মিত। মাইকেল মধুসূদন, জি ভি দেসানি থেকে অমিতাভ ঘোষ। সমসাময়িক যে দু’জনের লেখাকে উনি খুবই উচ্চাসনে রাখতেন, তাঁরা হলেন সলমন রুশদি আর অমিতাভ ঘোষ। অমিতাভ ঘোষ পড়ে উনি ওঁর প্রিয় কথাটা ব্যবহার করেছিলেন, ‘জুতিয়ে দিলে!’ রুশদির ‘সেটানিক ভার্সেস’ নিয়ে যখন বিতর্ক চলছে, এ দেশে বইটা নিষিদ্ধ হল, তখন উনি ওটা বিলেত থেকে আনিয়ে পড়ে ফেললেন আর খুব তারিফ করলেন। যেমনটি তারিফ করেছিলেন ‘মিডনাইটস চিলড্রেন’ পড়েও।
আর একজন ভারতীয় ইংরেজি লেখক মুলকরাজ আনন্দ তো আরপি কাকুর ঘনিষ্ঠ বন্ধুই ছিলেন। কলকাতায় এলে ওঁর বাড়িতে থাকতেন। আমার বহুবার সৌভাগ্য হয়েছে, আরপি কাকু আর মুলকরাজ আনন্দের সঙ্গে সারাদিন কাটানোর আর ওঁদের আলোচনা গেলার। ওঁদের মূলত কথা হত আর্ট নিয়ে। মুলকরাজ তখন ‘মার্গ’ পত্রিকার সম্পাদক। আরপি কাকুর বাড়িতে গুণী এবং বিখ্যাত মানুষদের হাটই বসত যেন। এম এফ হুসেন, রঘুবীর সিংহ, কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, পরিতোষ সেন… আরও কত কে-ই না আসতেন!
বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার হরিসাধন দাশগুপ্তের দাদা কালীসাধন দাশগুপ্তের ‘পান’ বাংলা ভাষার অঙ্গ হয়ে গেছে। উনিও ছিলেন আরপি কাকুর বন্ধু। রাধাপ্রসাদ নয়, কালীসাধনই সত্যজিৎ রায়ের নাম দিয়েছিলেন ‘ওরিয়েন্ট লংম্যান’ আর রেশন কার্ডের বাংলা করেছিলেন ‘খাইবার পাস’। ‘পান’ করাটা কালীসাধন তাঁর পৈতৃক সম্পত্তি বলে মনে করতেন। ওঁর সামনে অন্য কেউ ‘পান’ করলে উনি বেজায় বিরক্ত হতেন, আর ভাল ‘পান’ করলে আহত।
আরপি কাকুর আর এক বন্ধু আর্মিতে ছিলেন। তিনি ফোর্ট উইলিয়ামে পোস্টেড হয়ে এলে আরপি কাকু তাঁর কাছ থেকে নিয়মিত আর্মি রাম আনাতেন। সেই রামের সন্ধানে অনেকেই আসতেন। আসতেন কালীসাধনও। উনি একদিন এসে দেখলেন বাজারি রাম রয়েছে। জিজ্ঞেস করলেন, আর্মি রাম নেই কেন? আরপি কাকু মুচকি হেসে বলেছিলেন, ‘‘সেই রামও নেই, সেই যোদ্ধাও নেই।’’ কালীসাধন একাধারে আর্মি রাম না পেয়ে আর ভাল ‘পানে’ আহত হয়ে বাজারি রাম না খেয়েই চলে গেলেন। কালীসাধনই এক পাত্তর রামের নামকরণ করেছিলেন, ‘জয়রামবাটি’!
আমি আরপি কাকুর বন্ধুপুত্র। কিন্তু কোনওদিন আমায় সেটা বলে পরিচয় করাতেন না। সব সময় বলতেন, ‘মাই ফ্রেন্ড! আমার বন্ধু!’ আমি ওঁর থেকে প্রায় অর্ধ শতকের ছোট। আরপি কাকুর জামাই প্রমিত ঘোষ বলে, ‘‘জিৎ আমার শ্বশুরের কনিষ্ঠতম ঘনিষ্ঠ বন্ধু!’’
আরপি কাকু চলে গেছেন দু’দশক হয়ে গেল। কিন্তু আজও কোনও তথ্যের ধন্দে পড়লে মনে হয়, আরপি কাকুকে একটা ফোন করি!
ছবি সৌজন্য: সঞ্জীৎ চৌধুরী
সঞ্জিত চৌধুরীর জন্ম কলতাতায় এবং লেখাপড়া সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। পেশায় আলোকচিত্রী এবং পরিচালক সঞ্জীৎ একজন প্রিন্ট ও গ্লাস নেগেটিভ সংগ্রাহকও। ওঁর ছবি দেশে বিদেশে একাধিক প্রদর্শনীতে জায়গা করে নিয়েছে। তিনি একজন বিশিষ্ট খাদ্যবিশারদ ও রন্ধন ইতিহাসবিদ হিসেবেও সুবিদিত।
এমন রসিক লোক আমাদের এই পোড়া দেশে ছিলেন ভাবা যায় না। বুদ্ধি মত্যা র চরম নিদর্শন।ওনাকে প্রনাম।