সময়টা ১৮৫২ সালের এক সকালবেলা। দেরাদুনের একটা ছোট্ট পাহাড়ি শহরে এক বাঙালি গণিতজ্ঞ নিমগ্ন জটিল অংকের সমাধানে। সামনে তাঁর স্তূপ করা ফাইল, কাগজপত্র। একটা অংক তিনি বারবার করে চলেছেন। নিজের মনেই বলছেন, কোথাও ভুল হচ্ছে না তো? নাঃ, বারবারই তো এক ফলই তো দেখাচ্ছে। তারপরই লাফিয়ে উঠলেন সেই বাঙালি ভদ্রলোক। প্রায় বিজ্ঞানী আর্কিমিডিসের ‘ইউরেকা ইউরেকা’ স্বগতোক্তির মতোই– ‘পেরেছি, আমি পেরেছি’ বলতে বলতে ছুটলেন তাঁর বস সার্ভেয়ার জেনারেল অ্যান্ড্রু ওয়া-র অফিসে। তাঁকে বললেন – ‘আ পিক ডেজিগনেটেড xv হ্যাড বিন ফাউন্ড টু বি হায়ার দ্যান এনি আদার হিদারটু মেজার্ড ইন দ্য ওয়ার্ল্ড।’ এই বাঙালি আঙ্কিকের নাম রাধানাথ শিকদার, যিনি হিমালয়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গটির উচ্চতা মেপে ফেলেছিলেন জটিল গাণিতিক সমাধানে। আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গটিকে। ভেঙে দিয়েছিলেন তৎকালীন সুন্দরী কাঞ্চনজঙ্ঘার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ হওয়ার অহংকার। খাতায় কলমে হিসেব কষে প্রমাণ করে দিয়েছিলেন,  নগাধিরাজ হিমালয়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ পিক এক্সভি (xv)।

হ্যাঁ, তখন এভাবেই রোমান হরফে নামকরণ করা হত হিমালয়ের শৃঙ্গগুলির, যেসব শৃঙ্গের নাম স্থানীয় ভাষায় পাওয়া যেত না। কিন্তু কেন হিমালয়ের চূড়াগুলির এভাবে নামকরণ করা হচ্ছিল, তার অবশ্য একটা পূর্ব ইতিহাস আছে। কী সেই ইতিহাসকথা? ভারতে উপনিবেশ স্থাপনের একশো বছর পরে ১৮০২ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতীয় উপমহাদেশে বৈজ্ঞানিক জরিপকাজ শুরু করে। উইলিয়াম ল্যাম্বটন এবং স্যর জর্জ এভারেস্টের নেতৃত্বে শুরু হয় গ্রেট ট্রিগনোমেট্রিক সার্ভে (জিটিএস)। ল্যাম্বটন মারা যাওয়ার পরে ১৮২৩ সাল থেকে এই জরিপের দায়িত্ব এসে পড়ে জর্জ এভারেস্টের ওপর। ১৮৩০ সালের শেষাশেষি এই গ্রেট ট্রিগনোমেট্রিক সার্ভে হিমালয় অঞ্চলে পৌঁছে যায়। জর্জ এভারেস্ট এই কাজের জন্য একজন দক্ষ গণিতজ্ঞের খোঁজ করছিলেন, যিনি ত্রিকোণমিতিতে পারদর্শী হবেন, সেই সঙ্গে পদার্থবিদ্যাতেও যথেষ্ট পণ্ডিত হতে হবে। তবেই এই জিটিএস প্রকল্পে অংশ নিতে পারবেন। 

radhanath sikdar
মাত্র উনিশ বছর বয়সে জরিপ বিভাগে যোগ দেন রাধানাথ শিকদার

হিন্দু কলেজের শিক্ষক জন টাইটলার উনিশ বছর বয়সী ছাত্র রাধানাথের নাম সুপারিশ করেন জর্জ এভারেস্টের কাছে। এই কলেজের ছাত্র থাকাকালীনই রাধানাথ পড়ে ফেলেছেন নিউটনের প্রিন্সিপিয়া ম্যাথামেটিকা, ইউক্লিডের উপপাদ্য, অ্যানালেটিক্যাল জিওমেট্রি, জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত বিভিন্ন বই। জ্যামিতির কঠিন সম্পাদ্য– দুটি বৃত্তের মধ্যে সাধারণ স্পর্শক আঁকার নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন। এদিকে মেধাবী হলেও ছাত্র রাধানাথের তখন পড়াশুনো চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার খরচ জোগাড় করা দুষ্কর। জর্জ এভারেস্টের জহুরির চোখ চিনতে ভুল করেনি রাধানাথের প্রতিভা। দেশ জুড়ে জরিপের কাজের জন্য ১৮৩১ সালের ১৯ ডিসেম্বর, রাধানাথ শিকদারকে মাসে তিরিশ টাকা বেতনে জিটিএস –এর ‘কম্পিউটার’ পদে নিয়োগ করলেন জর্জ এভারেস্ট। 

ভাবুন একবার, আজ থেকে প্রায় দুশো বছর আগে, যখন কম্পিউটার আবিষ্কার হয়নি, তখন একটি চাকরির পদের নাম ছিল ‘কম্পিউটার’! সে যাই হোক, মেধাবী, কর্মঠ, একনিষ্ঠ রাধানাথ শিকদারের কাজে খুবই সন্তুষ্ট ছিলেন জর্জ এভারেস্ট। তিনি হিমালয়ের শৃঙ্গ মাপার কাজে দেরাদুনের সিরঞ্জে পাঠালেন রাধানাথ-সহ অন্য সাতজন কম্পিউটার পদাধিকারীকে। তাঁদের মধ্যে রাধানাথই গণিতে পারদর্শিতার জন্য এভারেস্টের সবচেয়ে প্রিয় কর্মী হয়ে উঠেছেন। এবং এতটাই যে রাধানাথ একবার ডেপুটি কালেক্টর পদের জন্য আবেদন করছেন, খবর পেয়ে এভারেস্ট নিয়মের গেরোয় আটকে দিয়েছিলেন রাধানাথের বদলি হওয়া। রাধানাথের কাজের প্রশংসা করে তাঁর বাবাকে চিঠিও দিয়েছিলেন এভারেস্ট। একজন বাঙালি নিজের প্রতিভার জোরে ব্রিটিশ পদকর্তার কাছে এতটা অপরিহার্য হয়ে উঠেছিলেন এটা কম গর্বের কথা নয়।

Mount_Everest
উচ্চতা মাপার আগে শৃঙ্গের নাম ছিল XV

১৮৪৩ সালে জর্জ এভারেস্ট অবসর নেওয়ার পরে তাঁর পদে মনোনীত করে গেলেন অ্যান্ড্রু ওয়া-কে। ওয়া-র নেতৃত্বে তখন হিমালয়ের চূড়া পর্যবেক্ষণের কাজ চলছে। সে এক ভীষণ কঠিন কাজ। হিমালয়ের শৃঙ্গ মাপার জন্য ভরসা শুধুমাত্র থিয়োডোলাইট যন্ত্র। সেই যন্ত্র নিয়ে পাহাড়ি অঞ্চলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উঠতে হবে। পর্যবেক্ষণ করে জানা গেল, নেপালের জঙ্গলে থিওডোলাইট যন্ত্র নিয়ে না উঠলে হিমালয়ের সুউচ্চ শৃঙ্গগুলির উচ্চতা মাপা সম্ভব নয়। কিন্তু তখন ব্রিটিশ আর নেপালরাজের মধ্যে শত্রুতার সম্পর্ক। নেপালে বিদেশিদের যাওয়া নিষিদ্ধ। তখন জেমস নিকলসন কোনওভাবে নেপালের তেরাই নামে একটা তৃণভূমি থেকে যন্ত্রের সাহায্যে কিছু পর্যবেক্ষণ করে তার পরিসংখ্যান জমা দিলেন ওয়া-কে। পরে আরও একজন অ্যাংলো ইন্ডিয়ানও পূর্বসূরির পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে রিপোর্ট জমা দেন। কিন্তু তাঁরা কেউই ওই শৃঙ্গটির বিশ্বে উচ্চতম হওয়া বিষয়ে আলোকপাত করতে পারেননি। হিমালয়ের পূর্বপ্রান্তের এই শৃঙ্গটিকে অ্যান্ড্রু ওয়া পিক নাম্বার ‘xv’ নামে চিহ্নিত করলেন। কিন্তু তার উচ্চতা মাপার কাজটা অসমাপ্তই রয়ে গেল। এদিকে ঘটনাচক্রে সেই পর্যবেক্ষণের ফাইল এসে পড়ল বাঙালি আঙ্কিক রাধানাথ শিকদারের হাতে। হিমালয় পর্বতে সকলের অগোচরে সবচেয়ে উঁচুতে মাথা তুলে দাঁড়ানো সেই শৃঙ্গকে খাতায় কলমে মেপে ফেলার ইতিহাস তৈরি করে ফেললেন তিনি।

শুধু কী গণিত, এই পিক ফিফটিন–এর উচ্চতা মাপার ক্ষেত্রে রাধানাথ তাঁর পদার্থবিদ্যার জ্ঞানকেও কাজে লাগালেন। কীভাবে? রাধানাথ দেখলেন, পাহাড়ের যত উপরে যাওয়া যায়, বাতাসের ঘনত্ব তত কমতে থাকে। ফলে আলোর গতিপথ সরলরেখা না হয়ে বেঁকে যায়। এদিকে থিওডোলাইট যন্ত্র উচ্চতা মাপে আলোকরশ্মির গতির উপর নির্ভর করে। কিন্তু গতিই যেখানে বদলে যাচ্ছে, সে মাপ নির্ভুল হবে কী করে? ফলে রাধানাথ ঠিক করলেন, উচ্চতা মাপার সময় বায়ুর ঘনত্বের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আলো কতটা সরে যাচ্ছে (প্রতিসরণ) সেই সংশোধনীটি মাপের মধ্যে যুক্ত করবেন। এর ফলে শৃঙ্গের উচ্চতা নির্ভুলভাবে গণনা করা সম্ভব হল!  এই পিক নম্বর পনেরোই পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ, যার উচ্চতা রাধানাথের গণনায় দাঁড়ায় ২৯০০০ ফুট। এবার রাধানাথ তাঁর রিপোর্ট পেশ করলেন অ্যান্ড্রু ওয়া-র কাছে। কিন্তু তারপরেও ওয়া পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ হিসেবে এই আবিষ্কারের খবর প্রকাশ করলেন না। তিনি আরও একজন অ্যাংলো ইন্ডিয়ানকে ফের হিসেব কষে দেখতে বললেন। তাতেও ফল হল একই। কিন্তু ‘রাউন্ড ফিগার’ বলে কেউ যদি হিসেবের নির্ভুলতায় সন্দেহ প্রকাশ করে? তাই তার সঙ্গে দুই যোগ করে ওয়া লিখলেন, পনেরো নম্বর শৃঙ্গের উচ্চতা ২৯০০২ ফুট।  

উচ্চতা তো মাপা হল। কিন্তু নামকরণ হবে কীভাবে? জর্জ এভারেস্টের প্রচলিত নিয়ম ছিল, যে কোনও ভৌগোলিক উপাদানের স্থানীয়, প্রচলিত নামটিই বহাল রাখতে হবে। কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দীর মানচিত্র অনুযায়ী এই পিক ফিফটিন শৃঙ্গকে তিব্বতিরা চোমোলাংমা (পৃথিবীর মা) বলত। আর নেপালিরা ডাকত সাগরমাথা নামে। এবার, একই শৃঙ্গের দু’টি নাম তো গ্রাহ্য নয়। অ্যান্ড্রু ওয়া ব্রিটেনের রয়্যাল জিওগ্রাফিক্যাল সোসাইটির কাছে প্রস্তাব পাঠালেন– পৃথিবীর এই সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গের নাম হোক জর্জ এভারেস্টের নামে। সেই অনুযায়ী ১৮৫৬ সালের মার্চে, রাধানাথের গণনার প্রায় চার বছর পরে পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গের নাম হল মাউন্ট এভারেস্ট, উচ্চতা ২৯০০২ ফুট। 

theodolite
এই থিওডোলাইট যন্ত্র দিয়েই গোড়ায় শৃঙ্গের উচ্চতা মাপা হত

ফলে সর্বোচ্চ শৃঙ্গকে সর্বোচ্চ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেও তার  নামকরণের সময় উপেক্ষিতই রয়ে গেলেন নেপথ্যের কারিগর রাধানাথ শিকদার। আসলে, এটাই ছিল ব্রিটিশ সরকারের ঔপনিবেশিক মানসিকতা। কোনও আবিষ্কারের সঙ্গে ভারতীয় কারও নামকে মর্যাদা দেওয়া বা এদেশের সর্বোচ্চ পদে কাউকে বসতে দেওয়ার ঘোর বিরোধী ছিলেন ব্রিটিশ রাজপুরুষরা। রেডিও আবিষ্কারের সঙ্গে বাঙালি জগদীশচন্দ্র বসুর নামটাও এভাবেই লেখা হয়নি ইতিহাসের পাতায়। এভাবেই যুগের পর যুগ ভারতীয়দের সঙ্গে নিরলসভাবে বঞ্চনা করে গিয়েছে ব্রিটিশরা। মজার কথা হল, এভারেস্টকে আবিষ্কারের সঙ্গে রাধানাথ শিকদারের নাম নথিভুক্ত না হওয়ায় কিছুদিন পরে বিতর্কও তৈরি হল এই নিয়ে যে, সত্যিই কি রাধানাথ শিকদার এভারেস্ট আবিষ্কার করেছিলেন? সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘দেশে বিদেশে’ বইটিতে রাধানাথ শিকদারের মতো বাঙালির প্রতিভার প্রতি ব্রিটিশরাজের এই অপমান আর বঞ্চনার সূত্রসন্ধান মেলে দুটি চরিত্র– রমজান খান আর আহমেদ আলির কথোপকথনে। সেটুকু অংশ শোনাই পাঠককে: 

‘… রমজান খান বললেন, বাঙালি আপন দেশে বসে, এভারেস্টের গায়ে ফিতে না লাগিয়ে, চুড়োয় চড়তে গিয়ে খামকা জান না দিয়ে ইংরেজকে বাতলে দেয়নি, ওই দুনিয়ার সবচেয়ে উঁচু পাহাড়?
আমি বললুম হাঁ, কিন্তু নাম হয়েছে ইংরেজের…’ 

Everest
ঔপনিবেশিক বঞ্চনায় শৃঙ্গের নামের সঙ্গে জুড়ল না রাদানাথের নাম। নাম হল জর্জ এভারেস্টের নামে।

অথচ, রাধানাথ শিকদারের গণনায় মাউন্ট এভারেস্ট বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গের মর্যাদা পাওয়ার পরে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে জিটিএস সম্বন্ধে রিপোর্ট পেশ করার সময়ে অ্যান্ড্রু ওয়া বিশেষভাবে উল্লেখ করেছিলেন রাধানাথ শিকদারের কথা। জর্জ এভারেস্ট কিংবা অ্যান্ড্রু ওয়া– দুই সার্ভেয়ার জেনারেলেরই রাধানাথ শিকদারের ওপর অসীম নির্ভরতা ছিল। রাধানাথ শিকদারের অংকের জ্ঞান ও তাঁর অন্যান্য অবদানের স্বীকৃতিতে জার্মানির ব্যাভেরিয়ান সোসাইটির ফিলোজোফিক্যাল সোসাইটি তাঁকে সদস্যপদও দেয়। এমনকী বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা তাঁর ‘প্রোগ্রেস অফ ফিজিক্স ইন পাস্ট টুয়েন্টি ফাইভ ইয়ার্স’ বইতেও রাধানাথের ভূমিকার কথা লেখেন। কিন্তু মুষ্টিমেয় মানুষের এইসব জবানবন্দির কথা আর কে-ই বা কতদিন মনে রাখে? রাখেওনি। ম্যানুয়াল অব সার্ভেয়িং অফ ইন্ডিয়া-এর প্রথম দুটি সংস্করণে রাধানাথের কৃতিত্বের উল্লেখ থাকলেও ১৮৭৫ সালে তৃতীয় সংস্করণ থেকেই রাধানাথ শিকদারের নামটা বেমালুম লোপাট করে দেওয়া হয়। ততদিনে অবশ্য রাধানাথ আর ইহজগতে ছিলেন না। ফ্রেন্ড অফ ইন্ডিয়া সংবাদপত্রে একে ‘মৃতদেহের ওপর আঘাত’ বলে উল্লেখ করা হয়।

রাধানাথ শিকদার ও মাউন্ট এভারেস্ট আবিষ্কার নিয়ে বিতর্ক বহুদিন পযর্ন্ত জিইয়ে ছিল। ১৯০৪ সালে নেচার পত্রিকায় সিডনি জেরালড বারার্ডের নিবন্ধ– ‘মাউন্ট এভারেস্ট: দ্য স্টোরি অফ আ লং কনট্রোভার্সি’ নিবন্ধ বিতর্কে ফের ইন্ধন জোগায়। অনেকে যুক্তি দেন, যখন এভারেস্ট মাপার কাজ চলছিল, তখন তো রাধানাথ শিকদার কলকাতায় বদলি হয়ে এসেছিলেন, তাহলে তিনি কীভাবে উচ্চতা মাপলেন? কিন্তু এসব কথা ধোপেই টেঁকে না। কারণ, এভারেস্ট মাপার সময় রাধানাথ কলকাতাতেই থাকুন বা দেরাদুনে– তিনি যে গণনা করেই এভারেস্টের উচ্চতা মেপেছিলেন তার অনেক প্রমাণ ইতিহাসের ধুলোমাখা ফরাসের তলায় ঢাকা পড়ে রয়েছে।

তবে রাধানাথ শিকদারের কীর্তি শুধু হিমালয়ের উচ্চতা মাপাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। ১৮৫১ সালে তিনি সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার চিফ কম্পিউটার পদে উন্নীত হন। একইসঙ্গে আবহাওয়া অফিসের সুপারিনটেন্ডেন্ট পদেরও দায়িত্ব সামলাতেন।এই বিভাগটিকেও আধুনিকভাবে গড়ে তোলার কাজে রাধানাথের অনেক কৃতিত্ব ছিল। ১৮৫৩ সাল থেকে তিনিই দৈনিক আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়ার রীতি চালু করেন, যা সেসময় জাহাজ চলাচলের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তবে এই বিভাগে তাঁর সবচেয়ে আলোকোজ্জ্বল অবদান, ব্যারোমিটার রিডিং নেওয়ার সঠিক পদ্ধতির উদ্ভাবন। তাপমাত্রা ওঠানামার ফলে পারদের সঙ্গে সঙ্গে ব্যারোমিটারের ভেতরের পেতলের স্কেলটিরও সংকোচন প্রসারণ ঘটে। ফলে শুধু পারদের সংকোচন প্রসারণ মেপে যে উষ্ণতার রিডিং পাওয়া যায়, তা সঠিক হয় না। রাধানাথ শিকদার এই সংশোধনীর জন্য একটি তালিকাও প্রস্তুত করেন। 

Letter
সার্ভেয়ার জেনারেলকে লেখা রাধানাথের চিঠি

১৮৬২ সালে জরিপ বিভাগ থেকে অবসর নেওয়ার পরে জেনারেল অ্যাসেমব্লিজ় ইনস্টিটিউশনে (আজকের স্কটিশচার্চ কলেজ) গণিতের অধ্যাপক হন রাধানাথ। প্যারীচাঁদ মিত্রের সহযোগিতায় মহিলাদের জন্য মাসিক পত্রিকা সম্পাদনা এবং প্রকাশ করতে শুরু করেন। সেই পত্রিকাতেই প্রথম প্রকাশিত হয় প্যারীচাঁদ মিত্রের বিখ্যাত উপন্যাস ‘আলালের ঘরের দুলাল’। আর্ট অ্যান্ড ক্রাফটস সোসাইটিরও প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রাধানাথ। আসলে ডিরোজিওর ছাত্র রাধানাথ বরাবরই ছিলেন উদারপন্থী, বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহের বিরোধী। বিধবাদের পুনর্বিবাহ ও নারীশিক্ষার জন্যও অনেক কাজ করেছেন। সমস্ত বৈষম্যের বিরুদ্ধে সবসময় স্পষ্টভাবে প্রতিবাদ করতেন।  তেমনই এক ঘটনার উল্লেখ মেলে ডঃ শংকরকুমার নাথের লেখায়, যা প্রকাশিত হয়েছিল রাধানাথের জন্মের দুশো বছর পর। ১৮৪৩ সালে এইচ ভ্যানসিটার্ট নামে দেরাদুনের এক গোরা ম্যাজিস্ট্রেট রাধানাথের অনুমতি না-নিয়েই তাঁর অধীনস্থ কুলিদের বেগার খাটাতে শুরু করেন। খবর পেয়ে রাধানাথ কুলিদের ফেরত নিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে ভ্যানসিটার্টের সব মালপত্রও আটকে দেন। ক্ষুব্ধ ভ্যানসিটার্ট রাধানাথের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকলে রাধানাথের দুশো টাকা জরিমানা হয় বটে, কিন্তু তারপর থেকে জরিপ বিভাগের কর্মীদের বেগার খাটানোর প্রথাও বন্ধ হয়। 

রাধানাথ শিকদার ছিলেন প্রকৃত অর্থে একজন আধুনিক মানুষ। সবধরনের গোঁড়ামি থেকে মুক্ত।  শেষজীবনে খ্রিস্টধর্ম নিয়ে চন্দননগরে বাস করতেন। ১৮৭০ সালের ১৭ মে মৃত্যু হয় রাধানাথ শিকদারের। আজও একথা মনে করলে বেদনার্ত হতে হয় যে, যে মানুষটির জটিল গণনায় হিমালয়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গটি অপরিচয়ের হিমেল ওড়না সরিয়ে বেরিয়ে এসেছিল সর্বসমক্ষে, সেই এভারেস্টের গায়ে ব্রিটিশদের নাম খোদাই হয়ে গিয়েছে চিরকালের মতো। আর কালের যাত্রাপথে বিস্মৃতির হিমশৈলের নীচে চাপা পড়ে গিয়েছে রাধানাথ শিকদারের নাম। পরবর্তীকালে রাধানাথের সম্মানে কিছু স্মারক ও সৌধ নির্মিত হয়। কিন্তু এইসব স্মারকের চেয়ে ঢের বেশি জরুরি ছিল তাঁর জীবন ও সাধনাকে সম্মান জানানো। আজ হয়তো ইতিহাসের পাতায় কিংবা এভারেস্টের পাথুরে শরীরে কোথাও লেখা নেই রাধানাথ শিকদারের নাম। না থাক, পরবর্তীকালে বহ পর্বতারোহী এভারেস্টের পথে পা বাড়িয়েছেন। সেই যাত্রাপথে কারও যদি স্মরণে আসে এই অবহেলিত মানুষটির নাম, তাঁর জন্য কারও একফোঁটা অশ্রু যদি বরফ হয়ে রয়ে যায় সেই শৃঙ্গের পাদদেশে, তাঁর মধ্যেই বেঁচে থাকবেন কৃতি বাঙালি রাধানাথ শিকদার।

তথ্যঋণ: শিবনাথ শাস্ত্রী: রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ
শংকরকুমার নাথ: রাধানাথ শিকদার: তথ্যের আলোয় 
ছবি সৌজন্য: Wikipedia, The wire, Mathigon

শৈশবের পাঠ শুরু কলকাতায়। মায়ের কর্মসূত্রে মেয়েবেলার পড়াশুনো পূর্ব মেদিনীপুরে, লেখালেখিতে হাত পাকানো। নব্বইয়ের দশকে পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে স্নাতক। জীবনের বাঁক বদল করে সাংবাদিকতায় আসা। বিভিন্ন পত্রপত্রিকার ফিচার ও সংবাদ বিভাগে লেখালেখি। কবিতা ও গল্প নিয়ে একটু আধটু চর্চার মুক্ত বাতাস জোগাচ্ছে পেশাতেও।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *