রবিঠাকুর যে গান গাইতে পারতেন খুব ভালো, এ সংবাদ সে সময়ের বহু লেখা পড়ে জানা যায়। কিন্তু কবি যে কোনও বাদ্যযন্ত্র বাজাতে জানতেন, এমন তথ্য খুব একটা খুঁজে পাওয়া যায় না। ‘রবীন্দ্রস্মৃতি’ গ্রন্থে এই প্রসঙ্গে ইন্দিরা দেবী একবার লিখলেন, ‘আমার অনেক সময় আশ্চর্য বোধ হয় যে, রবিকাকা কখনো কোনো যন্ত্র বাজানোর দিকে মনোযোগ করেননি। যদিও পিয়ানোয় বসে বসে এক আঙুল দিয়ে ঠুকে গানে সুর বসানোর চেষ্টার কথা মনে পড়ে।’ ইন্দিরা দেবীর এই কথাটিকেই যেন কবি একবার সরল সহজভাবে স্বীকার করলেন।
বললেন, ‘জীবনে… একবারই এঞ্জিনিয়ারিং করতে নেবেছিলুম।…তার পর থেকে যন্ত্রে হাত লাগানো আমার বন্ধ, এমন-কি, সেতারে এসরাজেও তার চড়াই নি।’

হ্যাঁ, কবির সেই জীবনের একবারটি এঞ্জিনিয়ারিং করার ইতিহাসটি বড়ো মজার। জানতে হলে যাওয়া যাক শিলাইদহে। সেবার শিলাইদহে থাকাকালীন কবির হঠাৎ একটি অদ্ভুত শখ হল। শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে তখন জ্যোতিদাদার আমন্ত্রণে কবি গিয়েছেন। বয়সও তাঁর কম। কবিতা লিখছেন প্রায় প্রতিদিনই। তা সেই কুঠিবাড়ির দোতলায় ছাদের লাগোয়া ঘরে বসে কবিতার খাতা ভরানোর ইতিহাস সম্পর্কে ‘ছেলেবেলা’য় লিখলেন,
‘একলা থাকার মন নিয়ে আছি। ছোটো একটি কোণের ঘর, যত বড়ো ঢালা ছাদ তত বড়ো ফলাও আমার ছুটি। অজানা ভিন্ দেশের ছুটি, পুরোনো দিঘির কালো জলের মতো তার থই পাওয়া যায় না। বউ-কথা-কও ডাকছে তো ডাকছেই, উড়ো ভাবনা ভাবছি তো ভাবছিই। এই সঙ্গে সঙ্গে আমার খাতা ভরে উঠতে আরম্ভ করেছে পদ্যে। সেগুলো যেন ঝরে পড়বার মুখে মাঘের প্রথম ফলনের আমের বোল।’
এই সময়ে কুঠিবাড়িতে মালি এসে রোজ ফুলদানিতে ফুল সাজিয়ে দিয়ে যেতেন। এই ফুল দেখে রবীন্দ্রনাথের একদিন শখ হল ফুলের রঙিন রস দিয়ে কবিতা লিখলে কেমন হয়!

যেমন ভাবনা তেমনই কাজ।
জ্যোতিদাদাকে বললেন তাঁর শখের কথা।
জ্যোতিদাদা ভাইয়ের এই শখের কথা শুনে মনে মনে হাসলেও ছুতোর ডেকে পাঠালেন। ছুতোর এলেন এবং কল তৈরি হল ফুলের রস বের করার।
কাঠের বাটিতে ভরা ফুলের উপর দড়ি বাঁধা নোড়া যতই পিষে রস বের করুক না কেন, তা শেষে কাদা হয়ে যায়।
এ ভারি মুশকিলের কথা!
ফলে সেই শখ আর কিছুতেই পূরণ হল না।
জীবনে এই একবারই তিনি এঞ্জিনিয়ারিং করতে নেমেছিলেন।
কে জানে হয়ত এই চরম ব্যর্থতাই তাঁকে বাকি জীবনে যন্ত্রের থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল।
প্রাক্তন সাংবাদিক। পড়াশোনা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। ষোলো বছর বয়স থেকে কলকাতার নামী পত্রপত্রিকায় লেখালেখির হাতেখড়ি। ছোটোদের জন্য রচিত বেশ কিছু বই আছে। যেমন 'বিশ্বপরিচয় এশিয়া', 'ইয়োরোপ', 'আফ্রিকা' সিরিজ ছাড়া 'দেশবিদেশের পতাকা', 'কলকাতায় মনীষীদের বাড়ি', 'ঐতিহাসিক অভিযান', 'শুভ উৎসব' ইত্যাদি। এছাড়া বর্তমানে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নানা গবেষণার কাজে নিবেদিত। ইতিমধ্যেই এই বিষয়ে দুটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। 'রবীন্দ্র-জীবনে শিক্ষাগুরু' এবং 'রবীন্দ্র-গানের স্বরলিপিকার'। বর্তমানে একটি বাংলা প্রকাশনা সংস্থায় সম্পাদক।