নোবেল জয়ের পর রবীন্দ্রনাথকে যে কত রকমের এবং কত ধরনের মানুষের সঙ্গে পরিচিত হতে হয়েছিল নানা সময়ে ভাবলে অবাক হতে হয়। এই সমস্ত মানুষের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হওয়ার পিছনে আর-একটি উদ্দেশ্য ছিল ‘বিশ্বভারতী’ গড়ে তোলার লক্ষ্যে তাঁর নিরবচ্ছিন্ন চেষ্টা।
আজ এমনই একজনের কথা বলব আমাদের এই ‘কবি-সমীপে’ পর্বে। তবে তিনি একেবারেই লেখক সম্প্রদায়ভুক্ত নন।
ফিরে যাওয়া যাক ১৯১৬ সালে। রবীন্দ্রনাথ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরে যাবেন বক্তৃতা দিতে। তা বক্তৃতার আয়োজন তো করতে হবে। কিন্তু কে বা কারা করবেন সেই বিপুল আয়োজন? এসব ভাবতে ভাবতেই কবির বইয়ের প্রকাশনা সংস্থা, ম্যাকমিলান কোম্পানি কয়েকটি মার্কিন বক্তৃতা ব্যবসায়ী সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করা শুরু করে দিল। বক্তৃতা ব্যবসার ব্যাপারে আজ থেকে একশো বছর আগে এদেশের মানুষের তেমন কোনও ধারণাই ছিল না। যাই হোক, একটি সংস্থা, জেমস্.বি.পন্ড লিসিয়াম ব্যুরোর সঙ্গে ম্যাকমিলানের চুক্তি হল, রবীন্দ্রনাথের মার্কিন দেশে বক্তৃতা সফরের দায়িত্ব তারা নেবে। এবং সেই মর্মে ম্যাকমিলান কোম্পানিকে তারা জানাল যে ‘স্যার রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতা সফর আমেরিকার বক্তৃতা সফরের ইতিহাসে অন্যতম বৃহত্তম ঘটনা হবে।’

সেই অনুসারে ১৯১৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর জাপান থেকে রবীন্দ্রনাথের জাহাজ ‘কানাডা-মারু‘ আমেরিকার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে। সঙ্গে আছেন পির্য়াসন এবং মুকুলচন্দ্র দে।
১৮ সেপ্টেম্বর সিয়্যাটল বন্দরে জাহাজ নোঙর করে। লস এঞ্জেলেস টাইমস পত্রিকায় ১৯ সেপ্টেম্বর এই মর্মে একটি সংবাদ ছাপার ব্যবস্থা করে সেই বক্তৃতা ব্যবসায়ী জেমস্. বি. পন্ড। রবীন্দ্রনাথের উক্তি সহযোগে সংবাদটি ছিল এমন,
‘The lectures I am to give in the United States are for the purpose nearest to my heart — to get funds to carry on my school for boys in India.’
উক্ত সংবাদে রবীন্দ্রনাথকে ‘Shakespeare of India’ আখ্যা দেওয়া হয়। রবীন্দ্রনাথ যখন সিয়্যাটলে নামেন তখন জেমস্ বি পন্ড এসে তাঁকে সাদর অভ্যর্থনা জানান। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে বলেন, পন্ড এখানে যতগুলো বক্তৃতার ব্যবস্থা করতে পারবেন, তিনি ততগুলো বক্তৃতাই অনায়াসে দেবেন। কারণ এতে শান্তিনিকেতনের জন্য তাঁর অর্থসঞ্চয় বৃদ্ধি পাবে।
এদিকে পন্ড প্রথমে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে চুক্তি করেন এইভাবে যে তিনি বারো হাজার ডলার পারিশ্রমিক দেবেন কবিকে। পরে, আরও আলোচনা হবার পর ফের চুক্তি করেন। সেই চুক্তিতে ঠিক হয় আমেরিকার বিভিন্ন শহরে ঘুরে ঘুরে মোট চল্লিশটি বক্তৃতা দেবেন কবি এবং সেই সুবাদে পারিশ্রমিক পাবেন বক্তৃতা প্রতি পাঁচশো ডলার করে। তাছাড়া সঙ্গীসাথীদের যাতায়াত ও ভাল হোটেলে থাকা খাওয়ার খরচ।

মনে রাখতে হবে, সেই সময়ে শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ের আর্থিক অবস্থা এতটাই দৈন্যদশায় পৌঁছেছিল যে বোলপুরের ব্যবসায়ীরা পর্যন্ত ধারে চাল ডাল দিতে অস্বীকার করছিল। এর উপর পাটের ব্যবসার জন্য তারকনাথ পালিতের কাছ থেকে নেওয়া তিরিশ হাজার টাকার ঋণ মাথার উপর ঝুলছে। উপরন্তু তারকনাথ পালিত উইল করে তার স্বত্ব কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে দিয়ে গেছেন। ফলে কবির ঋণ এখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে পরিশোধ করতে হবে এবং তা এক বছরের মধ্যেই।
বোঝাই যাচ্ছে পঞ্চান্ন বছরের কবির উপর কী পরিমাণ চাপ ছিল সেই সময়ে। যাই হোক, হোমস্ পন্ডের আয়োজনে ও বদান্যতায় প্রথম বক্তৃতা দিতে পঞ্চান্ন বছরের কবি সিয়্যাটেলের সানসেট ক্লাবে উপস্থিত হলেন ২৫ সেপ্টেম্বর। দুপুর আড়াইটায় পৌঁছে গেলেন। পরনে নরম বাদামি সিল্কের জোব্বা, দুই হাত জোড় করে তিনি শ্রোতৃবর্গকে অভিবাদন জানালেন। মহিলাদের ক্লাবের সভানেত্রী শ্রীমতী স্মিথ বেশ বড় শ্রোতৃমণ্ডলীর সামনে বক্তা প্রাচ্যের কবি রবীন্দ্রনাথের পরিচয় করিয়ে দিলেন।
প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে বক্তৃতা দিলেন রবীন্দ্রনাথ। বিষয় ছিল ‘The Cult of Nationalism’! সমস্ত টিকিট বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। সেদিন সন্ধ্যায় আবার ম্যাকৌলে থিয়েটারে তাঁকে এ বিষয়েই ভাষণ দিতে হল। Seattle Post-Intelligence কাগজে এই খবর ছাপা হল এমন, ‘It was a literary feast of beauty and wisdom…. Tagore is not an entertainer. He is here to say something and he has something to say.’

এদিকে কবিসঙ্গী পিয়ার্সন এইদিনের খবর চিঠিতে রথীন্দ্রনাথকে জানালেন,
‘from the two lectures we get $ 600.’
কিছুদিন পর ১৬ অক্টোবর রবীন্দ্রনাথও পুত্র রথীন্দ্রনাথকে লিখেছিলেন,
‘বক্তৃতার ঝড়ের মুখে শহর থেকে শহরে ঘুরে বেড়াচ্চি। আমার agent দুই পুরুষে এই কাজে নিযুক্ত — সে বলে, এতলোককে দিয়ে তারা বক্তৃতা করিয়েছে কিন্তু কখনো এমন লোকের ভিড় ওরা দেখেনি। জায়গার অভাবে লোক ফিরে ফিরে যাচ্চে। আমার বোধ হচ্চে ঠিক এই সময়েই বিধাতা আমাকে এখানে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন।’
সেবার ১৮ সেপ্টেম্বর ১৯১৬ থেকে ১৯১৭ সালের ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত ১২১ দিনে প্রায় ৭ হাজার মাইল ভ্রমণ করে ৫৭টি বক্তৃতা দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
খুব স্বভাবতই এই সফরে কবি এবং কবির বক্তৃতা ব্যবসায়ী এজেন্ট পন্ডের উদ্দেশ্য ভীষণভাবে সফল হয়েছিল। আমেরিকার সেই সফরের হিসেবে দেখা যায় জেমস্ পন্ড নিয়মিত বক্তৃতার আয় ব্যয়ের হিসেব দিতেন, চুক্তি পরিষ্কার রাখার জন্য। তারকনাথ পালিতের কাছ থেকে নেওয়া ঋণ এই সফরের বক্তৃতা থেকে উপার্জিত অর্থ দিয়েই শোধ হয়েছিল।
এইবারের মার্কিন সফরের চূড়ান্ত সাফল্য দেখে কবি আবার ঠিক করলেন ১৯২০ সালের অক্টোবর মাসে যুক্তরাষ্ট্রে যাবেন। যোগাযোগ করলেন জেমস্ পন্ডের সঙ্গে। পন্ড কিন্তু সেবার কবিকে আমেরিকায় আসতে মানা করলেন। কবিকে স্পষ্ট জানালেন, এখন আসবেন না। এখন এদেশের অবস্থা এই জাতীয় বক্তৃতা সফরের অনুকূল নয়। এবং তিনি এই সময়ে সফরের দায়িত্বও নিতে অপারগতার কথা জানালেন। সেইসময়ে পন্ড পিয়ার্সনকেও বুঝিয়েছিলেন যে আমেরিকায় রবীন্দ্রনাথের জনপ্রিয়তা আর আগের মতো নেই। আসলে ‘স্যার‘ উপাধি ত্যাগের জন্য ব্রিটিশদের বিরক্তি সাগরপারের মার্কিন দেশেও আছড়ে পড়েছিল।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথ পন্ডেরর পরামর্শ অগ্রাহ্য করে আবার গেলেন মার্কিনদেশে। নিষেধ অমান্য করা সত্ত্বেও পন্ড কিছু বক্তৃতার আয়োজন করে দিলেন কবির জন্য, কিন্তু সাফল্য এল না পূর্বের মতো। রবীন্দ্রনাথও অক্লান্ত পরিশ্রম করলেন। এমন পরিশ্রম করেছেন যে ট্রেনের পুলম্যান কামরায় রাত কাটাতে হয়েছে একস্থান থেকে অন্যস্থানে যাবার জন্য, যাতে সময় ও অর্থ বাঁচে।
আরও পড়ুন: পীতম সেনগুপ্তের কলমে: রবীন্দ্রনাথ ও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ: এক নিভৃত সাক্ষাৎ
যদিও পন্ড রবীন্দ্রনাথের কাছাকাছি থাকতেন সবসময়, কিন্তু ব্যবস্থাপনা বিশেষ কোনও সুরাহা করে উঠতে পারেননি এইবার। এর অন্যতম কারণ তাঁর ব্যবসাও তখন দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল। ফলে তাঁর উপর উদ্যোক্তারা আর বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। এবং পন্ডের সততা নিয়ে রথীন্দ্রনাথ ও পিয়ার্সনের মধ্যে মনোমালিন্য দেখা দেয়। ফলে পন্ডের সঙ্গে আর কোনও দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করতে রাজি হলেন না কবি। আমেরিকা সফরের মন্দ অভিজ্ঞতা সম্পর্কে সানফ্রান্সিসকো থেকে একটি চিঠিতে হ্যারিয়েট মনরোকে কবি জানান,
‘… আমি এখন সার্কাসের সিংহ; সারা জীবন আমি অভ্যস্ত হয়েছি চারপাশে বিশ্রামের অবকাশে, আকাশের অবকাশে; দিনের পর দিন এই ঠাসা কর্মসূচি আমার পক্ষে স্বাস্থ্যকরও নয়, আরামপ্রদও নয়। যাই হোক চেষ্টা করছি যাতে আমাকে খুশি খুশি দেখায় এবং আপনাদের আমেরিকান ডলারের তালে তালে নৃত্য করে যেতে পারি।…’

পন্ডের একটি স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, একবার এক সভায় যাবার আগে গাড়িতে কবির জামাকাপড়ের সুটকেসটি ফেলে আসা হয়েছে। ফলে তাঁর সেই পরিচিত পোশাক পাওয়া যায়নি। এদিকে অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিতে যেতে তো হবেই। কী হবে তাহলে। কবি খুব বিরক্ত হচ্ছেন। জেমস্ পন্ড অনুনয় করে বলছেন পোশাকের ব্যবস্থা করা হচ্ছে জলদি। তৎসত্ত্বেও কবি ক্ষুব্ধ। অবশেষে কবিকে সিল্কের শার্ট আর টুইডের ট্রাউজার পরানো হল। এই অবস্থায় বক্তৃতামঞ্চে উঠলেন তিনি। বয়সকালে তাঁকে প্যান্ট শার্ট পরতে হয়েছিল বলে খুব বিরক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু উপায়ও ছিল না কোনও।
১৯২১ সালের ২৫ জানুয়ারি সম্ভবত পন্ডের উপর বিরক্ত হয়েই কবি একটি চিঠিতে জানান, তিনি পশ্চিমের এই কর্মকর্তাকে অন্তর থেকে ঘৃণা করেন। তাঁর মধ্যে যে সন্ন্যাসী আছে তার প্রতি অগাধ প্রত্যয় থাকলেও, তার মধ্যে যে কর্মকর্তা বা কেজো লোকটি আছে, সে-ই তার জীবনের সকল শক্তিকে দাবি করে এবং পেয়েও বসে।
ছবি সৌজন্য: লেখক
তথ্যঋণ:
১) রবিজীবনী ৬-৭-৮-৯ম খণ্ড : প্রশান্তকুমার পাল
২) রবীন্দ্রজীবনী ৩য় খণ্ড : প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়
৩) রবীন্দ্র রচনাবলী ৭ম খণ্ড : পশ্চিমবঙ্গ সরকার
৪) চিঠিপত্র ২-৩ : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
৫) সিলেক্টেড লেটার্স : রবীন্দ্রনাথ টেগোর
৬) রবীন্দ্রনাথ টেগোর : দ্য মীরিয়াড মাইন্ডেড ম্যান : কৃষ্ণা দত্ত ও অ্যান্ড্রু রবিনসন
৭) আ প্যাসেজ টু ইণ্ডিয়া : এডওয়ার্ড মরগ্যান ফরস্টার
প্রাক্তন সাংবাদিক। পড়াশোনা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। ষোলো বছর বয়স থেকে কলকাতার নামী পত্রপত্রিকায় লেখালেখির হাতেখড়ি। ছোটোদের জন্য রচিত বেশ কিছু বই আছে। যেমন 'বিশ্বপরিচয় এশিয়া', 'ইয়োরোপ', 'আফ্রিকা' সিরিজ ছাড়া 'দেশবিদেশের পতাকা', 'কলকাতায় মনীষীদের বাড়ি', 'ঐতিহাসিক অভিযান', 'শুভ উৎসব' ইত্যাদি। এছাড়া বর্তমানে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নানা গবেষণার কাজে নিবেদিত। ইতিমধ্যেই এই বিষয়ে দুটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। 'রবীন্দ্র-জীবনে শিক্ষাগুরু' এবং 'রবীন্দ্র-গানের স্বরলিপিকার'। বর্তমানে একটি বাংলা প্রকাশনা সংস্থায় সম্পাদক।
‘বিশ্বভারতী’ গড়ে তোলার লক্ষ্যে কবির যে নিরবচ্ছিন্ন চেষ্টা, তা লেখক সুন্দর বর্ননার এবং লেখার মাধ্যমে তা তুলে ধরলেন, সমৃদ্ধ হলাম আবারও।