খামখেয়ালিপনা রবীন্দ্রনাথের জীবনে বিরল ছিল না। তাঁর নানা ব্যবহারে বহুবার এমন দৃষ্টান্ত দেখা গেছে। এমনকী তাঁর সঙ্গীরাও কবির এই স্বভাবের ব্যাপারে ওয়াকিবহাল ছিলেন। কিন্তু যাঁরা কবিকে দূর থেকে দেখেছেন বা কবির সান্নিধ্যে এসেও খুব ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ পাননি, তাঁদের কাছে কবির এমন অদ্ভুত খেয়ালখুশি বেশ আশ্চর্যই লাগত। মহা ফাঁপরেও পড়তেন তাঁরা কখনও সখনও। একবার ফরাসি দার্শনিক রমা রল্যাঁকেও এমন বেকায়দায় পড়তে হয়েছিল।




সেবার, ১৯২৫ সালের অগস্ট মাসের মাঝামাঝি রবীন্দ্রনাথের ইউরোপ সফরে যাবার কথা। সেইমতো শান্তিনিকেতন থেকে ৯ অগস্ট কলকাতা চলে এলেন কবি। এলেন ঠিকই, কিন্তু এসেই অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ১৩ অগস্ট আনন্দবাজার পত্রিকায় খবর বেরল

ডা: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গতকল্য সুইজারল্যান্ডে যাত্রা করিবার কথা ছিল। যাত্রার প্রাক্কালে ডা: নীলরতন সরকার তাঁহাকে জানান যে তাঁহার হৃদযন্ত্রের পীড়া সম্পূর্ণ আরাম হয় নাই। তাঁহাকে যাত্রা স্থগিত রাখিতে উপদেশ দেওয়া হয়।’

অগত্যা ইউরোপ যাত্রা স্থগিত হল কবির। এরও প্রায় চারদিন পর কবি রমা রল্যাঁকে টেলিগ্রাম করে এ খবরটি জানান। স্বভাবতঃই রল্যাঁ খুব আশাহত হলেন। নিজের দিনপঞ্জি’-তে লিখলেনও সে কথা।

রবীন্দ্রনাথ আমাদের এক নতুন আশাভঙ্গের কারণ ঘটিয়েছেন। গত তিন মাস ধরে তিনি আমাদের জানাচ্ছিলেন, অগস্টে ভিলনাভে উপস্থিত হবেন। জুলাইয়ের মাঝামাঝি পর্যন্ত তাঁর ছেলে রথীন্দ্রনাথের চিঠিপত্রে জোর দিয়ে বলা হচ্ছিল যে ১ অগস্ট তিনি বোম্বাই থেকে যাত্রা করবেন। পরে, এক নতুন চিঠিতে কাজের অজুহাতে যাত্রা ১৫ অগস্ট পেছিয়ে গেল।’

খেয়াল করার মতো শব্দ ব্যবহার করলেন রমা রল্যাঁ। শব্দটি কাজের অজুহাতে’! একজন মনীষীর কলম কতটা আশাহত হলে অপর মনীষার প্রতি এমন শব্দচয়ন করেন! কিন্তু কেন করলেন এমন শব্দ ব্যবহার? পরের বাক্যগুলোয় চোখ রাখলে তার আঁচ পাওয়া যেতে পারে।

গতকাল (১৭ অগস্ট) কালিদাস নাগের একটি কথা আমাদের উদ্বেগে ফেলেছে; তিনি লিখেছেন যে, ইউরোপে তাঁর বিরুদ্ধে কিছু কিছু আক্রমণ তাঁকে অত্যন্ত আহত করেছে এবং তিনি যাবেন কিনা সে-সম্পর্কেও আর তিনি নিশ্চিত নন। অবশেষে আজ এক টেলিগ্রামে স্বাস্থ্যের কারণ দেখিয়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর যাত্রা নিশ্চিতভাবে খারিজ করেছেন।’

Rabindranath Tagore
ফরাসি দার্শনিক রমা রল্যাঁ

এরপর রল্যাঁ খুবই কাতর এবং দুঃখিত হয়ে দিনলিপির পাতায় কবির এই অকস্মাৎ উধাও হওয়া প্রসঙ্গে যে কথাগুলি লেখেন তা যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ শুধু নয়, কঠিনও। লিখেছিলেন

তাঁকে অভ্যর্থনার সমস্ত আয়োজন করা হয়েছিল।…সব কিছু ব্যর্থ হয়ে গেল। এই ভারতীয়দের উপরে নির্ভর করে কোনো কিছু শুরু করা প্রায় অসম্ভব। উৎসাহ এবং নিরুৎসাহের প্রতিটি ঝাপটার কাছে ওরা আত্মসমর্পণ করে। ওদের পাশে পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। নিজেদের পরিকল্পনার শেষপর্যন্ত নিয়ে যাবার জন্যে ওদের পিছনে লেগে থাকতে হয়।’




এখানে লক্ষণীয়, এবার রমা রল্যাঁ কিন্তু ভাববাচ্যে
ওদের’ মানে ভারতীয়দের উদ্দেশ করে হতাশা জ্ঞাপন করছেন। 

এমন এক কাজের জন্যে সময় দিয়ে এতো নিজেকে ক্লান্ত করেছি, যার সম্পর্ক আমার চেয়ে ওদের সঙ্গে অনেক বেশি এবং যে-কাজে ওদের কাছ থেকে কোনো সাহায্যই পাইনি। তাঁর সফর খারিজ করার ফলে যা কিছু নস্যাৎ হয়ে গেল রবীন্দ্রনাথ নিজে তার ধারণাও করতে পারবেন না।’

Rabindranath Tagore
সপরিবার রবীন্দ্রনাথ ও রমা রল্যাঁ

রবীন্দ্রনাথ কিন্তু বুঝেছিলেন কী ক্ষতি হয়েছিল এই সফরটি বাতিল করে। তিনি ২৩ সেপ্টেম্বর তারিখে রল্যাঁকে কৈফিয়তের ভঙ্গিতে একটি চিঠি লিখলেন

‘Personally I do not think that my over cautious doctor was wise in holding me back. He does not fully realise how great is the mental strain that my stay in India imposes upon me. It is the moral loneliness which is a constant and invisible burden that oppresses me most.’

সেপ্টেম্বর মাসের গোড়ায় যে তাঁর জেনোয়াতে পৌঁছনোর কথা ছিল, তা-ও কবি ২ অগস্ট ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন। এও লিখেছিলেন

আমার মনে হয় না তা হবে।’

তাহলে কি কবি নিজেই জানতেন যে তাঁর যাওয়া হবে না? তবে কেন রমা রল্যাঁকে তিনি তা আগে জানাননি, যিনি কিনা রবীন্দ্রনাথের অভ্যর্থনা ও বক্তৃতার জন্য বিপুল আয়োজন করেছিলেন! 

***

প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের এই দুই মনীষার প্রথম সাক্ষাৎ ঘটেছিল ১৯২১ সালের ১৯ এপ্রিল, কাপ মার্ত্যায়। রল্যাঁ নিজে রবীন্দ্রনাথকে প্রথম দেখার অভিজ্ঞতার কথা সযত্নে লিখেছিলেন তাঁর ভারতবর্ষ: দিনপঞ্জি’ গ্রন্থে। 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এসেছেন দেখা করতে, সঙ্গে তাঁর ছেলে। …পরনে ভারতীয় বেশ, কালো ভেলভেটের উঁচু টুপি, আর ছাই রঙের এক লম্বা জোব্বা। তিনি খুবই সুন্দর — প্রায় অতি মাত্রায় সুন্দর — লম্বা, মুখখানা সুন্দর, সুষম, খাঁটি আর্যজনোচিত, সেই টকটকে রঙ, যা সোনালি রৌদ্রমাখা জীবনের দান; উজ্জ্বল বাদামী দুই চোখ — তাতে সুন্দর চোখের পাতার ছায়া, খাড়া নাক, সাদা গোঁফের নিচে হাসিমুখ, রেশমের মতো দাড়ি তিন ভাগে ছুঁচোল, দুই সাদা ভাগের মাঝের ভাগ এখনো কালো।’

Rabindranath Tagore
কবি সমীপে দার্শনিক

কতটা গভীরভাবে দেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথকে, এ বর্ণনা তারই সাক্ষ্যবহন করে। রল্যাঁ এমনও বলেছেন,

আনন্দের বিষয়, তাঁর হাবভাব সহজ এবং শালীন। তিনি যা বলেন তা হৃদয়গ্রাহী এবং স্বতঃস্ফূর্ত।’




এর দু’দিন পর রমা রল্যাঁ ও তাঁর বোন
, ম্যাডেলাইনকে কবি মধ্যাহ্নভোজনে আমন্ত্রণ জানান। বিশ্বভারতীর আদর্শের কথা বলেন এবং প্রচারপত্রের মুদ্রিত কপিও দেন। দু’টি গানও গেয়ে শোনান তাঁদের। পরবর্তীতে ম্যাডালাইন রবীন্দ্রনাথের চতুরঙ্গউপন্যাস ফরাসিতে অনুবাদ করেন। তার ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন রমা রল্যাঁ স্বয়ং। 

রমা রল্যাঁ জীবনভর রবীন্দ্রনাথকে খুবই সম্মানের চোখে দেখেছেন। এমন কথাও বলেছেন

‘…তাঁর শান্ত কণ্ঠস্বর, সুষমাময় অঙ্গসঞ্চালন, ঘন ভ্রূর নীচে তাঁর উজ্জ্বল দুটি চক্ষু, তাঁর সর্বাঙ্গ থেকে বিচ্ছুরিত প্রশান্ত মহিমা। প্রথমবার তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়ালে তোমার মন আপনা থেকেই সম্ভ্রমে ভরে উঠবে, যেন গির্জায় প্রবেশ করেছ; তোমাকে কথা বলতে হবে নিম্নকণ্ঠে। আর তারপর, যদি এই মহান মানুষটিকে কাছ থেকে দেখবার সুযোগ হয়, তাহলে ক্রমে তুমি বুঝতে পারবে সেই সুষমাময় সঙ্গীতময়তার তলায় তলায় বহমান তাঁর অন্তঃসলিলা বিষাদকেএমন এক দর্শন যার মধ্যে কোনো ছলনা নেই, এবং তাঁর অন্তর্নিহিত মেধামণ্ডিত পৌরুষ, যা জীবনসংগ্রামের মুখোমুখি হতে পরাঙমুখ হয় না।…’

 

*ছবি সৌজন্য: লেখক
গ্রন্থঋণ:

১) রবিজীবনী ৮ম ও ৯ম খণ্ড : প্রশান্তকুমার পাল
২) রবীন্দ্রজীবনী ৩য় ও ৪র্থ খণ্ড : প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়
৩) পিতৃস্মৃতি : রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর
৪) ভারতবর্ষ – দিনপঞ্জি : রমা রলাঁ, অবন্তীকুমার সান্যাল অনূদিত
৫) রবীন্দ্র রচনাবলী ৭ম খণ্ড

Pitam Sengupta

প্রাক্তন সাংবাদিক। পড়াশোনা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। ষোলো বছর বয়স থেকে কলকাতার নামী পত্রপত্রিকায় লেখালেখির হাতেখড়ি। ছোটোদের জন্য রচিত বেশ কিছু বই আছে। যেমন 'বিশ্বপরিচয় এশিয়া', 'ইয়োরোপ', 'আফ্রিকা' সিরিজ ছাড়া 'দেশবিদেশের পতাকা', 'কলকাতায় মনীষীদের বাড়ি', 'ঐতিহাসিক অভিযান', 'শুভ উৎসব' ইত্যাদি। এছাড়া বর্তমানে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নানা গবেষণার কাজে নিবেদিত। ইতিমধ্যেই এই বিষয়ে দুটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। 'রবীন্দ্র-জীবনে শিক্ষাগুরু' এবং 'রবীন্দ্র-গানের স্বরলিপিকার'। বর্তমানে একটি বাংলা প্রকাশনা সংস্থায় সম্পাদক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *