রবিশঙ্কর কলকাতায় এসেছেন। ১৯৭০-এর ৭ এপ্রিল উনি পঞ্চাশ বছর পূর্ণ করলেন। শহরের নামী সঙ্গীত সংগঠন সুরেশ স্মৃতি সংসদ ওঁর জন্মদিন পালন করল রবীন্দ্রসদনে। সে সময়ের সেরা উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতশিল্পী বলতে যাঁদের নাম করা হত তাঁদের সবাই-ই প্রায় উপস্থিত মঞ্চে অথবা প্রেক্ষাগৃহে। রবিশঙ্করকে রীতিমতো আপ্লুত দেখাচ্ছিল। খুব স্পষ্ট সেটা দেখতে পাচ্ছিলাম কারণ আমার বসার জায়গা হয়েছিল উইংয়ে। এর কারণ, কড়কড়ে দশ টাকা নিয়ে কাউন্টারে গিয়ে অনুনয়-বিনয় করেও একটা টিকিট জোগাড় করতে পারিনি। চলে আসব চলে আসব করছি, ঠিক তখনই স্ত্রী উমাকে নিয়ে হলে ঢুকলেন বাবলুদা। আমায় দেখে বললেন,
— কী গো, চলে যাচ্ছ কেন?
— হাউজফুল। কোনও টিকিটই নেই।
— দাঁড়াও, দাঁড়াও, একটা ব্যবস্থা করছি।
বলে বাবলুদা হলে ঢুকে কাকে একটা ডেকে আনলেন। তিনি বললেন,
— রবিশঙ্কর শুনবেন, আগে থেকে টিকিট কাটতে পারেন না?
তাঁকে বললাম,
— এই দশ টাকাই তো তিনদিনের পকেট খরচ বাঁচিয়ে জমাতে হল। টিকিটটা কাটব কখন?
ভদ্রলোক পান চিবুনো মুখে হেসে ফেললেন। বললেন,
— এই হল গানবাজনার জন্য স্যাক্রিফাইস। আসুন, আপনাকে বক্সে বসিয়ে দিই। নিশ্চিন্তে বাজনা শুনুন।
এই নিশ্চিন্তে গান শোনার বক্স হল উইং। আশপাশে একটিও লোক নেই, অন্ধকারে একলা বসে একটা ঘোরের মধ্যে শুনে গেলাম সিংহেন্দ্র মধ্যম রাগ। তখন একেবারে অপরিচিত রাগটা শুনতে শুনতে গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। সুরেলা, গম্ভীর চলন ও মাধুর্যে মনে আসছে রবীন্দ্রনাথের একটা গান— ‘বাজে করুণ সুরে’। পরবর্তীকালে রবিশঙ্করের সঙ্গে আলাপ হয়ে, ঘনিষ্ঠতা হয়ে, কথায় কথায় বলেছিলাম উইংয়ের আড়ালে বসে শোনা ওঁর সিংহেন্দ্রমধ্যম নিবেদনের কথা। তাতে খুব খুশি হয়ে বলেছিলেন,
— চিনবে কী করে খোকা? ওটা তো কর্ণাটকী রাগ, যা আমি হিন্দুস্তানি স্টাইলে ও ফ্রেমে এনেছি। কিছুটা কিরওয়ানির ভাব আছে, তবে ভালো করে ধরতে হবে ওই রাগেই মুথুস্বামী দীক্ষিতারের কম্পোজ করা কৃতিত্ব শুনে। আর আমাদের রবিঠাকুর, যিনি গানবাজনার কোনও তল্লাটই বাদ দেননি তিনি বেঁধে ফেললেন ওই দারুণ গানটা, যার কথা তুমি বলছ: বাজে করুণ সুরে।
রবিশঙ্কর ওঁর জন্মদিনের আসর শেষ করেছিলেন অতি মধুর ও রোমান্টিক পঞ্চম সে গারা বাজিয়ে। হল সেদিন ভেঙে পড়ছিল ‘আ হা হা!’ ও হাততালিতে। পরে পণ্ডিতজির সঙ্গে ‘রাগ-অনুরাগ’ বইয়ের কাজ করার সময় ওঁর তখনকার সঙ্গিনী কমলাদি (কমলা চক্রবর্তী) বারবার আমায় বলেছেন, ‘‘জানো শঙ্কর, আমি সব সময় রবুকে বলি আমি তোমার পঞ্চম সে গারার পঞ্চম হতে চাই। যেখানে তুমি অপূর্ব, অপূর্ব সব সুর ঘুরে ঘুরে ফিরে আসে সেই পঞ্চমে।কমলাদির একথার মানে হল রবুদা যেন দুনিয়ার তাবৎ সুন্দরীর সঙ্গে মেলামেশা করেও শেষ অবধি ফিরে আসেন ওঁর কাছেই। যাই হোক, রবীন্দ্রসদনের সেই বাজনার পরদিন বাবলুদা আর আমি কফি নিয়ে বসেছিলাম রবিশঙ্করকে নিয়ে আলোচনায়। হঠাৎ কথার মধ্যে বাবলুদা বললেন,
— রবুদা-র সঙ্গে খুব দেখা করার ইচ্ছে। উনি ২০ বালিগঞ্জ পার্কে লালা শ্রীধরের বাড়িতে উঠেছেন। তোমার তো জুনিয়র স্টেটসম্যানে লেখা বেরিয়েছে ইমরাত খানকে নিয়ে। লেখাটা নিয়ে তুমিও চলো জার্নালিস্ট হিসেবে। কপাল ভাল থাকলে, কে জানে, ওঁরও একটা ইন্টারভিউ নিয়ে নিতে পারো।
পারতপক্ষে সেটাই ঘটে গেল পরদিন সন্ধ্যায়। রবুদাকে প্রণাম করতে গিয়ে ওই দুধে আলদা পা দুটো দেখে আমার স্বর্গত বাবার পদযুগল মনে পড়ে গিয়েছিল। আর ওঁকেও দেখলাম কী স্নেহের সঙ্গে আমার দিকে চেয়ে আছেন। শেষ মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞেস করলেন,
— কী করা হয়?
— ইংলিশ নিয়ে এমএ পড়ি।
— সুব্রত যে বলল তুমি কাগজে লেখালিখি কর?
— তা করি। জেএস-এ লিখি।
বলে হাতের জুনিয়র স্টেটসম্যানের কপিটা ওঁর হাতে তুলে দিলাম। উনি আমাদের নিয়ে বড় একটা সোফায় বসে লেখা পড়তে শুরু করলেন। আমি তো স্তম্ভিত। দুনিয়ার এক বিখ্যাততম এবং ব্যস্ততম মানুষ আমার লেখা ধরেই পড়া শুরু করলেন! আমি আর বাবলুদা নিঃশব্দে ওঁকে দেখে যাচ্ছি তখন।

একসময় হেসে ফেলে রবুদা বললেন,
— ইমরাত এটা আবার কী বলল? দাদা বিলায়েতের বাজনার গ্রেটনেস নিয়ে বলতে বলতে হঠাৎ yawn শব্দটা ব্যবহার করল কেন?
আমি বললাম,
— ঘুমপাড়ানি লোরি অঙ্গের মৌতাত বোঝাতে কথাটা বলেছেন।
— হ্যাঁ, হ্যাঁ, সে তো বুঝতেই পারছি। তবে yawn বললে dreaminess নয়, ক্লান্তি বোঝায়। লোরি অঙ্গের একটা আদরের দোলা আছে। সুরের ঘোর আছে। Yawn comes off as rather negative. বিলায়েতের ওই সেতার শুনে কারও হাই উঠতে পারে?
তারপর লেখা শেষ করে বললেন,
— তুমি গানবাজনার চর্চা কীভাবে করেছ?
— গান শুনে শুনে, বই পড়ে পড়ে। দুইয়েরই পোকা বনে গিয়ে।
রবুদা বললেন,
— গানের বই পড়তে পড়তে গান শুনতে পাও ভেতরে?
— হ্যাঁ, সারাক্ষণ!
রবুদা ওঁর ওই অপূর্ব হাসিটা হেসে বললেন,
— তুমি কি আমারও একটা ইন্টারভিউ চাইছ আজ?
আমি ভেতরে ভেতরে চমকেছি। চমকেছেন বাবলুদাও, উনিও তো এতটা আশা করেননি। ইতিমধ্যে চা, সিঙাড়া, সন্দেশ এসে গেছে টেবিলে। রবুদা বললেন,
— তোমরা খাও, আমি ভেতর থেকে আসছি।
আমি আর বাবলুদা দিব্যি চা, মিষ্টি খাচ্ছি তখন রবিশঙ্কর ফিরে এলেন। হাতে ওঁর ইংরেজি আত্মজীবনী ‘মাই মিউজিক, মাই লাইফ’ নিয়ে। বললেন,
— এই বই আমেরিকায় সবে বেরিয়েছে। এখানে আসেনি এখনও। আই ওয়ান্ট ইউ টু রিড ইট। পরেরবার আমি তোমার জন্যও একটা কপি নিয়ে আসব। I am fond of people who are fond of books … and music.
আমি বইটা পেয়েই পাতা ওল্টাচ্ছি যখন পাশ থেকে ওঁর মৃদু কণ্ঠে রসিক কথাটা কানে এল,
— স্যর, এবার ইন্টারভিউটা চালু হোক।
যা শুনে বাবলুদাও হেসে ফেলেছিল। আর এক অদ্ভুত নার্ভাসনেস থেকে সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত মগজে তড়িঘড়ি জিজ্ঞেস করে বসলাম ইংরেজিতে:
— How do you enjoy your enormous world fame?
প্রশ্নটা আজও ভুলিনি, যেমন ভুলিনি এর রবিশঙ্করীয় উত্তরটাও। বলেছিলেন,
— তুমি আমার আর আলি আকবরের সওয়াল-জবাব খুব follow করো বুঝি?
এও মনে আছে আমরা তিনজনই তখন ঠোঁটে চায়ের কাপ ধরে খুব হেসেছিলাম।
ইন্টারভিউ নেওয়ার জন্য টেপ রেকর্ডার ব্যবহারের চল তখনও হয়নি, আমি কলম চালিয়ে সাঁ সাঁ করে ঝড়ের গতিতে ওঁর যাবতীয় কথা লিখে যাচ্ছিলাম। তা দেখে শিল্পী একসময় হেসে বললেন,
— এভাবে লিখে দিনে কটা খাতা শেষ কর খোকা?
— আপনার মতন এমন সব কথা কোথায় আর রোজ শুনি? কোনও কথাই যে না লিখে পারছি না, পণ্ডিতজি।
রবিশঙ্কর ফের আমার মাথায় হাত রেখে বললেন,
— পণ্ডিতজি নয়, তুমি আমায় রবুদা বলবে। আমি দেড় মাস পরে ফের আসছি। তার মধ্যে লেখা ছাপা হয়ে গেলে এক কপি আমার জন্য এনো। সেদিন তোমার কপি ‘মাই মিউজিক, মাই লাইফ’-ও পাবে।

রবুদাকে প্রণাম করে দু’জনে ট্যাক্সি-ফ্যাক্সির তোয়াক্কা না করে পায়ে হেঁটে পার্ক সার্কাস মোড় অবধি এসে গেলাম। একটা কাবাব পরোটার দোকান দেখে বাবলুদা বললেন,
— একটু কাবাব ফাবাব হয়ে যাক?
আমি বললাম,
— বিলক্ষণ! তবে আজ দামটা আমি দেব।
বাবলুদা বিস্ফারিত নেত্রে শুধোলেন,
— কী জন্য?
আমি সত্যি কথাটা খুব শান্ত স্বরে বললাম,
– এত সুন্দর একটা ইন্টারভিউ প্রাপ্তিতে।
পরোটা কাবাব খেতে খেতে বাবলুদা সেই কথাটাই তুললেন যেটা আমার মনের ভেতরও ঘুরপাক খাচ্ছিল। জিজ্ঞেস করলেন,
– জেএস কি এত সিরিয়াস ইন্টারভিউ ছাপে?
– সেটাই তো কথা। ওরা চাইবে রবিশঙ্করের লুক, ফ্যাশন, বিটল, কানেকশন, লাইফস্টাইল এইসব।
বাবলুদা জিজ্ঞেস করলেন,
– তাহলে?
– হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ডের রবিবারের কাগজে তো লিখি। ওর এডিটর প্রভাংশু গুপ্ত মশাই আমার লেখা চান। ওঁকে গিয়েই দিই। কী বলেন?
বাবলুদা কাবারের শেষ টুকরোটা মুখে পুরতে পুরতে বললেন, “এক্সেলেন্ট আইডিয়া!” সেই রাতে ইন্টারভিউয়ের নোটস পড়তে পড়তে মনের ভেতর শুনছি রবিশঙ্করের সুরেলা কণ্ঠস্বর। আর হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ডের কথা মাথায় রেখে লেখার সময় থোড়াই জানি আর দেড়, দু’বছরের মধ্যে আমার সাংবাদিকের কর্মজীবন শুরু হবে এই কাগজেই! (চলবে)
*পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২২
*ছবি সৌজন্য: Alchetron
শংকরলাল ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট, কলকাতায়। ইংরেজি সাহিত্যে স্বর্ণপদক পাওয়া ছাত্র শংকরলাল সাংবাদিকতার পাঠ নিতে যান প্যারিসে। তৎপরে কালি-কলমের জীবনে প্রবেশ। সাংবাদিকতা করেছেন আনন্দবাজার গোষ্ঠীতে। লিখেছেন একশো ত্রিশের ওপর বই। গল্প উপন্যাস ছাড়াও রবিশংকরের আত্মজীবনী 'রাগ অনুরাগ', বিলায়েৎ খানের স্মৃতিকথা 'কোমল গান্ধার', হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিমালা 'আমার গানের স্বরলিপি'-র সহলেখক। অনুবাদ করেছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা থেকে সত্যজিৎ রায়ের চিত্রনাট্য পর্যন্ত।