“Georgie Porgie, pudding and pie,
Kissed the girls and made them cry,
When the boys came out to play,
Georgie Porgie ran away”
আমার বাপু এই নার্সারি রাইমস কোনওকালেই পছন্দ হত না। ছেলেগুলো কেন এমন? ভালো ভালো সব খাবার তাদের জন্যেই? আর মেয়েদের তারা এভাবেই আবহমান কাল ধরে কাঁদিয়েই চলবে? আবার দেখুন, তৃতীয় লাইনে অন্য ছেলেরা যখন ডাকাবুকোর মতো খেলতে মঞ্চে নামে, আগের ছেলেদুটি কাপুরুষের মতো পালিয়ে যায় ভয়ে। এই পদ্য নিয়ে অনেক বাদানুবাদের পরে তৃতীয় বাক্যে “বয়েজ়” শব্দের পরিবর্তে “গার্লস”করে দিতে বেশ শান্তি হয়, কারণ সেখানেই মেয়েদের উত্তরণ। নারীমুক্তি এবং নারীশক্তির জয়ের কারণে।
তবে কিনা, এক্ষণে আমাদের আলোচ্য নারীমুক্তি নয়, নার্সারি রাইমে মধ্যে লুকিয়ে থাকা খাদ্যদ্রব্যটি। হ্যাঁ, পুডিংয়ের কথাই বলছি। বাঙালির নৈশাহারের শেষপাতে পুডিং দিয়ে মধুরেণ সমাপয়েৎ অনেককাল আগের বনেদিয়ানা। তবে এই সুস্বাদু, সহজপাচ্য মেঠাইয়ের উৎপত্তির মূলে কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশদের সংসার পাতা। নোবেলজয়ী পদার্থবিদ স্যার জে জে থমসনের ইলেকট্রন আবিষ্কারের সময় তাঁর অভিনব “প্লাম পুডিং মডেল”-এর কথা মনে পড়ে? তাঁর পরমাণুর এই থ্রি-ডি নকশামতে প্রত্যেক পরমাণুর মধ্যে প্লাম বা আলুবোখরার মতো ছোটো ছোটো কণা নেগেটিভলি চার্জড ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ইলেকট্রনের অনুরূপ আর তারা শক্ত করে এমবেডেড বা গাঁথা পুডিংরূপী বিশাল পরমাণুর মধ্যে। এ তো গেল ১৯০৪ সালের কথা।

তবে পাশ্চাত্যের সাহেব-মেমেরা মধ্যযুগে এই বিশেষ মিষ্টান্ন তৈরি শুরু করেছিলেন। ১৬১৫ সালে প্রকাশিত ‘দ্য ইংলিশ হাউজওয়াইফ’ নামে গার্ভাস মারখামের বইয়ে সেই প্রমাণ রয়েছে। বইটিতে তিন ধরনের পুডিং তৈরির প্রণালি বর্ণনা করা হয়েছিল। বয়েল্ড পুডিং, ব্রেড পুডিং ও রাইস পুডিং। ১৮৩৭ সালে যুক্তরাজ্যের আলফ্রেড বার্ড কর্নফ্লাওয়ার সহযোগে যে পুডিং তৈরি করেন, তা ছিল সম্ভবতঃ প্রথম বিক্রয়যোগ্য বাজারি পুডিং। আলফ্রেড বার্ড কর্নফ্লাওয়ার দিয়ে সেই পুডিং বানিয়েছিলেন, কারণ তাঁর স্ত্রীর নাকি ডিমে অ্যালার্জি ছিল।
১৮৬১ সালে প্রকাশিত ইসাবেলা বিটনের লেখা ‘দ্য বুক অব হাউজহোল্ড ম্যানেজমেন্ট’-এ পুডিং তৈরির উপকরণ হিসেবে দুধ, চিনি কিংবা ফলমূলের পাশাপাশি গরুর চর্বিরও উল্লেখ পাওয়া যায়। আমরা সেই স্নেহ পদার্থ রূপে সামান্য মাখন ব্যবহার করি। উনিশ শতকের শেষে এবং বিশ শতকের গোড়ায় বইয়ের এই রেসিপি এবং বার্ডের কাস্টার্ড পাউডার ব্যবহার করে পুডিং তৈরি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। সেই থেকে আজ অবধি পুডিংয়ের বিস্তর ভেরিয়েশন দেখা যায়।
বিদেশি মিষ্টিতে প্লামের ব্যাবহার খুব জনপ্রিয়। বিশ্বায়নের দৌলতে প্লাম কেক, প্লাম পুডিং পরিচিত নাম এখন আমাদের কাছেও। তবে আবারও যদি স্যার জেজে থমসনের প্লাম পুডিং মডেল স্মরণ করি তাহলে অস্বীকার করতেও পারি না স্যুইট ডিশে নানারকম ফলের ব্যবহার। প্লাম ছাড়াও আঙুর, স্ট্রবেরি, ব্লুবেরি এসবও পুডিংয়ের অঙ্গ বটে। তবে প্রাথমিক উপকরণ হল দুধ আর ডিম। কেউ সেই দুধ ঘন করে পাঁউরুটি মিশিয়ে। কেউ কর্নফ্লাওয়ার। ঠান্ডা ঘন চিনি দিয়ে ফোটানো দুধে ফেটানো ডিম দিয়ে ঘেঁটে দিলেই হল। এবার ইচ্ছেমতো গন্ধ, রঙ আর ফল ছড়াও। টাটকা ফল না দিলে ড্রাই ফ্রুটস আর সেদ্ধ পুডিংয়ের ক্ষেত্রে প্রেশার প্যানে আর বেকড পুডিংয়ে আভেনে বসালেই হল। ঠান্ডা হলে ফ্রিজে।

তবে পুডিংয়ের আর একটি উল্লেখযোগ্য ধাপ হল, যতক্ষণে দুধ-চিনি-ডিমের মিশ্রণ ঠান্ডা হচ্ছে ততক্ষণ যে পাত্রটিতে পুডিং বানানো হবে অর্থাৎ পুডিং মোল্ডটি নিয়ে মাথা ঘামানো আবশ্যক। পুডিং মোল্ডে চিনি দিয়ে চড়বড় করে পুড়িয়ে মাখন দিতে হবে। চিনির ক্ষেত্রে, বেশি তাপমাত্রায় উত্তপ্ত করলে চিনি গাঢ় বাদামি রঙ ধারণ করে, এটাকে ক্যারামেলাইজেশন বলে।
১৯১২ সালে ফরাসি রসায়নবিদ ল্যুই ক্যামিল মেইলারড জৈব প্রোটিন সিন্থেসিস করতে করতে আবিষ্কার করে ফেলেন রন্ধনপ্রণালীর অন্যতম এই পন্থা, যার নাম ক্যারামেলাইজেশন। এর অর্থ আর কিছুই নয় চিনি অর্থাৎ সুক্রোজ উচ্চতাপে ভেঙে যায় গ্লুকোজ আর ফ্রুক্টোজে। তার রঙ, গন্ধ সব বদলে আমূল রাসায়নিক পরিবর্তন হয়ে যায়। অথচ এই অবস্থা রান্নাতে অসামান্য স্বাদ এনে দেয়। এখন তো বেকারি থেকে মিষ্টির দোকান এমনকী চিনে খাবার প্রস্তুতিতেও এই পদ্ধতি দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। পাশ্চাত্যের মনভোলানো ক্যারামেল পুডিং আজ আমাদের প্রাচ্য দেশের নামীদামি রেস্তোরাঁ-সহ ব্রিটিশ আমলে নির্মিত ক্লাবগুলির হেঁশেলের অন্যতম মিষ্টান্নও বটে।

রবিঠাকুরের ব্যাঙ্গাত্ম্যক নাটক “বিনি পয়সার ভোজে”ও পাই এই পুডিং এর কথা।
“বাবু হোটেল থেকে খাবার কিনে আনতে গেছেন? বলিস কী রে! আজ তবে তো রীতি খানা! খিদেটিও দিব্যি জমে এসেছে। মটন-চপের হাড়গুলি একেবারে পালিশ করে হাতির দাঁতের চুষিকাঠির মতো চক্চকে করে রেখে দেব। একটা মুর্গির কারি অবিশ্যি থাকবে- কিন্তু, কতক্ষণই বা থাকবে! আর দু-রকমের দুটো পুডিং যদি দেয় তা হলে চেঁচেপুঁচে চীনের বাসনগুলোকে একেবারে কাঁচের আয়না বানিয়ে দেব।”
এমনই ছিল সেসময়ের বাঙালির পুডিং প্রীতি। তবে পুডিং প্রস্তুতির জন্য স্বতন্ত্র ছাঁচ বা মোল্ডের কথা বলেছেন পাকপ্রণালীর রচয়িতা বিপ্রদাস বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ও। এইজন্য আমার বাড়িতে দিদিশাশুড়ির আমলে হগ মার্কেট থেকে কেনা ক্রাউন অ্যালুমিনিয়ামের দুটি পুডিং পাত্র আমার মডিউলার কিচেনেও সসম্মানে স্থান পেয়েছে। সে যুগে তিনি মাটির উনুনের নীচে একটি প্রকোষ্ঠ বানিয়েছিলেন। রান্নার শেষে নিভু আঁচে বসালেই সন্ধের মধ্যে পুডিং জমে যেত। আমরা বানাই আভেনে। প্রেশার কুকারেও উত্তম পুডিং হয়। এই সাহেবি মেঠাইতে মিষ্টি কম হয়। ইচ্ছেমতো গন্ধ দেওয়া যায়। আমাদের ছোটবেলায় মা, দিদিমাকে দেখেছি নিউ মার্কেট থেকে কেনা ছোট্ট শিশিবন্দি “এসেন্স অফ ভ্যানিলা” আনতে। আসল ভ্যানিলা ফুলের গন্ধের অনেকটাই পাওয়া যেত সেসবে আর সামান্য দিলেই কাজ হত। এখন ভেজালের যুগে আমাদের হাতে যেসব ভ্যানিলা আসে সেগুলি অনেকটাই ঝাঁঝহীন তাই বেশি পরিমাণে দিতে হয়।

রোমানিয়ান প্রবাদে বলে “বেটার সাম অফ আ পুডিং দ্যান নান অফ আ পাই”। আমাদের অর্থে দাঁড়ায় অনেকটা নেই মামার চেয়ে কানামামা ভালো। তাই পুডিংকে যখন সর্বজনীনভাবে ভারতীয় মিষ্টান্ন আখ্যা দেওয়া হয়েইছে তখন পুডিংয়ের জোগাড় না থাক আমাদের এলাচ গুঁড়ো দেওয়া চালের পায়েস বা রাইস পুডিং (সাহেবদের দেওয়া নাম) এও দিব্য চলে যাবে নৈশাহার। কারণ সব পায়েসই পুডিং কিন্তু সব পুডিংই পায়েস নয়।
বিপ্রদাসবাবুর পাকপ্রণালীতে একগুচ্ছ পুডিংয়ের নাম পেলাম। নারিকেলের পুডিং থেকে গাজরের, বার্লি থেকে প্লাম পুডিং, অ্যাপল পুডিং থেকে অরেঞ্জ পুডিং তবে ডুমুরের পুডিং বলে তিনি যাকে আখ্যা দিয়েছেন তা যজ্ঞিডুমুর বা ফিগস নামক ড্রাইফ্রুট কুচিয়ে, তা বুঝতে বাকি রইল না। এমন যে কোনও ড্রাইফ্রুট কুচি পুডিংয়ে বিশেষ মাত্রা যোগ করে। তবে ক্রিশ্চানদের বড়দিনের খ্রিস্টমাস পুডিং বড় এলাহিভাবে বানানো হয়। সেখানে রসে ফেলা লেবুর খোসা, বাদাম চূর্ণ, বৈচিত্র্যময় শুকনো ফল, মাখন, মোরব্বা সব যোগ করা হয় দুধ, ডিম আর পাউরুটির সঙ্গে। কোথাও আবার খ্রিস্টমাস পুডিংয়ে মাংসের কিমা যোগ করা হয়। সেখানে অবিশ্যি চিনি থাকে না, বলাই বাহুল্য।
*ছবি সৌজন্য: sortedfood, The Spruce Eats, Allrecipes, Tiffinboxfood
রসায়নের ছাত্রী ইন্দিরা আদ্যোপান্ত হোমমেকার। তবে গত এক দশকেরও বেশি সময় যাবৎ সাহিত্যচর্চা করছেন নিয়মিত। প্রথম গল্প দেশ পত্রিকায় এহং প্রথম উপন্যাস সানন্দায় প্রকাশিত হয়। বেশ কিছু বইও প্রকাশিত হয়েছে ইতিমধ্যেই। সব নামীদামি পত্রিকা এবং ই-ম্যাগাজিনের নিয়মিত লেখেন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, রম্যরচনা ও প্রবন্ধ।