শতবর্ষেরও অধিককাল আগে বোলপুরের ঘরে বসে গুরুদেব লিখেছিলেন, “আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে/ তব অবগুন্ঠিত কুণ্ঠিত জীবনে/ কোরো না বিড়ম্বিত তারে।” কিন্তু কোরো না বললেই তো আর চলে না, আনন্দবসন্তসমাগমে ছাপোষা নরনারীর হৃদয়ে যতখানি পুলকের সঞ্চার ঘটে, ততটাই আশঙ্কা থাকে সুস্থ শরীর ব্যতিব্যস্ত হওয়ার। মাঘের শেষ আর ফাল্গুনের শুরু মানেই বঙ্গদেশে ‘প্রখর তপনতাপ’। মিইয়ে পড়া ব্যাকটেরিয়া ভাইরাস-ও বসন্তের ছোয়াঁচ পেয়ে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে আচমকা। ফলত সংক্রমণ, জ্বর। মানবসভ্যতার ইতহাসে যে গুটিকয় সংক্রমণকে একেবারে সমূলে উৎপাটন করে ফেলা গেছে তার পুরোধায় থাকে বাংলার কাঙ্ক্ষিততম ঋতুর সমনামের রোগটি, অর্থাৎ বসন্ত। তবে নির্মূল হয়েছে কেবল গুটিবসন্ত রোগটিই, যার পোশাকি নাম ‘স্মল পক্স’। জলবসন্ত বা ‘চিকেন পক্স’ এখনও বহাল তবিয়তে উপস্থিত এবং শীতের শেষে ও মূলত গোটা ফাল্গুন-চৈত্র জুড়ে প্রায়শ মানুষ এই চিকেন পক্স-এ আক্রান্ত হয় আজও।
গুটিবসন্ত: অতীতকথা
পৃথিবীতে শেষবার স্মল পক্স বা গুটিবসন্তের বড় মাপের মহামারি হয়েছিল ভারতে, ১৯৭৪ সালে। সংবাদমাধ্যমের রিপোর্ট অনুযায়ী উত্তরপ্রদেশ এবং বিহারে এক লাখ দশ হাজারের বেশি মানুষ গুটিবসন্তে আক্রান্ত হয়েছিল। মৃতের সংখ্যা ছিল কুড়ি হাজারেরও বেশি। গুটিবসন্তের সেই মহামারি ঠেকাতে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েছিলেন ডাঃ মহেন্দ্র দত্ত এবং ডাঃ ল্যারি ব্রিলিয়ান্স। ডাঃ ল্যারি সে সময় ছিলেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) কর্মকর্তা।
১৯৭৪ সালে ভারতের সেই মহামারি ঠেকাতে নজিরবিহীন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল বলে জানা যায়। এক কোটি গুটিবসন্তের টিকা দেওয়া হয়েছিল সবমিলিয়ে। কাজে লাগানো হয়েছিল ১,৩৫,০০০ স্বাস্থ্যকর্মীকে। মারাত্মকভাবে আক্রান্ত বিহার রাজ্যে সেই উদ্যোগের নেতৃত্বে ছিলেন ডাঃ মহেন্দ্র দত্ত। ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রক থেকে তাঁকে বিহারে পাঠানো হয়েছিলো। বসন্তের প্রকোপ চলাকালীন বছর খানেকের বেশি সময়ব্যাপী তিনি সেখানেই ছিলেন।
একটি স্মৃতিচারণে ডাঃ দত্ত লিখছেন, “দুটো দল কাজ করছিল আমাদের। একটি দলের কাজ ছিল নতুন রোগী খুঁজে বের করা, অন্য দলটির কাজ রোগের বিস্তার নিয়ন্ত্রণে রাখা। আমার দায়িত্ব ছিল এই দুই দলেরই তদারক করা, কোথাও অসুবিধা দেখা দিলে দ্রুত সেটা দূর করা। প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল গুটিবসন্ত। ফ্লু ভাইরাসের একজনের কাছ থেকে আরেকজনের শরীরে ছড়িয়ে পড়ছিল গুটিবসন্তের জীবাণু। দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার অন্যতম কারণ ছিল ঘন জনবসতি।” অন্যদিকে ডাঃ ল্যারি লিখছেন, তিনি এবং তার কয়েকজন সহকর্মী তখন টাটানগরে গিয়ে যা দেখলেন, তা তিনি সারাজীবন ভুলতে পারবেন না। “ট্রেন থেকে স্টেশনে নেমে দেখলাম প্লাটফর্মে এবং আশেপাশে কাঠের স্তূপের মতো মৃত শিশুরা পড়ে আছে। টিকিট কাটছেন এমন একজন ভদ্রলোক যার হাতে গুটিবসন্তের চাকা। আমি ভাবলাম এই লোকটি এখন ট্রেনে চেপে হয়তো হাজার মাইল দূরে তার গ্রামে ফিরে যাবে এবং সেখানে গিয়ে জীবাণু ছড়াবে। আমরা তৎক্ষণাৎ বুঝলাম এই টাটানগর থেকেই গুটিবসন্তের জীবাণু রপ্তানি হচ্ছে।”
ডাঃ এডওয়ার্ড জেনার নামে এক ব্রিটিশ ডাক্তার ১৭৯০ সাল নাগাদ গুটিবসন্তের টিকা আবিষ্কার করেন। তাঁর প্রাথমিক গবেষণা ছিল ‘কাউ পক্স’ বা গোরুর দেহে বাসা বাঁধা পক্সের জীবাণু নিয়ে। সে সময় ব্রিটেনে মোট জনসংখ্যার ১০% মারা যেত স্মল পক্স-এ। ফলে এর প্রতিষেধক আবিষ্কার ছিল যুগান্তকারী ঘটনা। ১৭৯৮ সালে ডাঃ জেনার একটি দীর্ঘ শিরোনামে এই প্রতিষেধকের প্রয়োগ শুরু করেন। নামটি ছিল ‘ইনকুয়্যারি ইনটু দ্য ভ্যারিওলি ভ্যাকসিন নোন অ্যাজ দ্য কাউ পক্স’। ১৯৭৫ এর মে মাসের ২৩ ও ২৪ তারিখে ভারতের সর্বশেষ গুটিবসন্তের রোগী পাওয়া যায়।
শীতলা বনাম জ্বরাসুর
ভারতবাসীরা কীভাবে শীতলা পুজো করে গুটিবসন্তের বিভীষিকা থেকে নিজেদের বাঁচানোর চেষ্টা করত, ব্রিটিশ পর্যবেক্ষকরা তা বিভিন্ন সময়ে দেখিয়েছেন। তিন শতাব্দী আগে কলকাতার ‘ব্ল্যাক হোল’ খ্যাত জে জেড হলওয়েল এই দেবীর আরাধনা বিষয়ে লিখেছেন। দুই শতাব্দী আগে জন মুর তাঁর ‘হিস্ট্রি অব স্মল পক্স’ বইতে শীতলার কথা উল্লেখ করেছেন। এক শতাব্দী আগে সি এইচ বাক লিখেছেন, ‘শীতলা মাতা হলেন সাত বোনের এক গোষ্ঠীর নেত্রী, এই সাত দেবীই মহামারী ঘটিয়ে থাকেন এবং তাঁকে নিয়মিত তুষ্ট করা নারী ও শিশুদের দায়িত্ব।’
গুটিবসন্ত নামক ভয়াবহ ব্যাধিটির দায়িত্ব নেওয়ার জন্যই প্রধানত শীতলার অবয়ব সৃষ্টি। গ্রামাঞ্চলে এই গুটিবসন্ত রোগ একদা ‘মায়ের দয়া’ নামে অভিহিত ছিল। তাই কেউ বসন্ত রোগে আক্রান্ত হলে লোকদেবী শীতলার আরাধনা করে রোগাক্রান্ত ব্যক্তির আরোগ্য চাইতেন। লোকশ্রুতি এই যে, দেবী দুর্গা অথবা পার্বতী মর্ত্যলোকে শিশুদের জ্বরের প্রকোপ থেকে মুক্ত করতে শিবের সহায়তায় জ্বরাসুর নামে এক ভয়ানক অসুরকে বধ করেন। গুটিবসন্ত নির্মূল হওয়ার পরেও বাংলার সংস্কৃতির সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য থেকে গেছে শীতলা পুজো ও শীতল ষষ্ঠী। মাঘ মাসের ষষ্ঠ দিনে দেবী শীতলার পূজার প্রচলন। শীতলা দেবীর বাহন হল গাধা। প্রচলিত মূর্তিতে শীতলা দেবীর মাথায় হাতপাখার মুকুট, এক হাতে জলের কলসি ও অন্য হাতে ঝাড়ু দেখতে পাওয়া যায়। বলা বাহুল্য এই চরিত্রচিত্রণ রূপকার্থে। সাদামাটা শাড়ি পরিহিতা নারীটি গ্রামীণ জীবনযাত্রায় একেবারে পাশের বাড়ির মেয়ে, যার হাতের ঝাঁটাটি রোগব্যাধিকে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করতে এবং কলসির সুধারস মানবজাতিকে শান্তিপ্রদান করতে সক্ষম বলে বিশ্বাস করা হয়। হাতপাখাটি শীতলতার প্রতীক। কোনও কোনও অঞ্চলে শীতলার হাতে নিমপাতার ঝাঁটা থাকে। এই নিমপাতা অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল হিসাবে অধুনা সারা বিশ্বে আদৃত। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে শীতলা নামেই, কিংবা ভিন্ন নামে এই দেবীর পূজার চল রয়েছে। তবে শীতলা আদৌ বৈদিক দেবী নন। বঙ্গে পূজিত এই দেবী রয়েছেন প্রচলিত লোকগাথায়, যেমন শীতলা কথা, মঙ্গলকাব্য। অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে কবি মাণিকরাম গাঙ্গুলি তাঁর ‘ধর্মমঙ্গল’ কাব্যে শীতলার বন্দনা করেছেন। দ্বিজ হরিদেব বা কবি জগন্নাথ, এমনকী আরও এক শতাব্দী আগের কবি বল্লভ এবং কৃষ্ণরাম দাসের লেখাতেও শীতলার স্তুতি দেখতে পাওয়া যায়।
গুটিবসন্ত চিরতরে বিদায় নিলেও বাংলাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় এখনও শীতলা পূজার প্রচলন। প্রসঙ্গত, অধিকতর ভয়াবহ স্মল পক্স-কে নির্মূল করা গেছে, কিন্তু চিকেন পক্স সারা বিশ্বে এখনও বিদ্যমান। তাই সতর্কতায় দোষ নেই। চিকেন পক্স ভাইরাস ঘটিত ব্যাধি যা ‘ভ্যারিসেলা জসটার’ জীবাণুর মাধ্যমে দ্রুত সংক্রামিত হয়। তবে ভরসার কথা এই যে, একবার কোনও ব্যক্তি চিকেন পক্স বা জলবসন্তে আক্রান্ত হয়ে গেলে দ্বিতীয়বার আর ওই রোগের সম্ভাবনা থাকে না। কেননা রক্তে ওই ভাইরাসের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি বা রোগ প্রতিরোধের উপাদান তৈরি হয়ে যায়। ১৯৯৫ সালে জলবসন্তের টিকা আবিষ্কৃত হয়েছে। শিশু ও গর্ভবতী মায়েদের কিংবা পর্যটকদের এই টিকা বিশেষভাবে দেওয়া হয়। ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করার ১০ থেকে ২১ দিনের মধ্যে লক্ষণ দেখতে পাওয়া যায়। জ্বর, ফোসকা, মাথাধরা জাতীয় লক্ষণগুলো বজায় থাকে ৫ থেকে ১০ দিন পর্যন্ত। ভাইরাস ঘটিত সংক্রমণ হওয়ায় জলবসন্তের নির্দিষ্ট ওষুধ নেই। লক্ষণভিত্তিক চিকিৎসাই একমাত্র উপায়। তবে এই ভাইরাস স্নায়ুর প্রান্তে সুপ্ত থেকে গেলে পরবর্তীকালে হারপিস জসটার বা শিংগেল্স নামক আরেকটি রোগের সম্ভাবনা থেকে যায়। বায়ুবাহিত চিকেন পক্স প্রতিরোধে প্রতিষেধক ছাড়াও, প্রাথমিক কিছু সাবধানতা যেমন, প্রচুর জল খাওয়া, খালি পেটে না থাকা, ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার অন্য যেকোনও সংক্রমণের মতোই জলবসন্তের বিরুদ্ধেও মোকাবিলা করতে সক্ষম।
বাংলার লোকসংস্কৃতিতে যে বিবিধ ষষ্ঠীব্রত পালনের উল্লেখ রয়েছে, শীতল ষষ্ঠী তার মধ্যে একটি। যেকোনও ষষ্ঠীর ব্রতই প্রধানত সন্তানের মঙ্গলকামনায় জননীরা পালন করে থাকেন। শীতলা পুজো ও শীতল ষষ্ঠীর ক্ষেত্রেও তার অন্যথা ঘটেনা। মাঘ মাসের ষষ্ঠ দিন ছাড়াও, অঞ্চল সাপেক্ষে সমগ্র ফাল্গুন-চৈত্র মাস জুড়ে মহিলাদের মধ্যে শীতল বা ঠান্ডা খাবার খাওয়ার রীতি। এই লোকাচারের সঙ্গে ভারতীয় চিকিৎসাশাস্ত্র আয়ুর্বেদের তুলনা করলে বোঝা যাবে, বসন্তের প্রাক্কালে সূর্যের দক্ষিণায়ন-বশত তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। এ সময় ত্রিদোষের মধ্যে (বায়ু-পিত্ত-কফ) পিত্তের সঞ্চয় ও কফের প্রকোপ লক্ষ্য করা যায়। বাইরের তাপমাত্রার সঙ্গে শরীরের আভ্যন্তরীণ তাপমাত্রার সাম্যাবস্থা রক্ষা করতে, ত্রিদোষের স্বাভাবিক ক্রিয়া অব্যাহত রাখতে, এবং ক্রমবর্ধমান উষ্ণতার সঙ্গে শরীরকে খাপ খাইয়ে নিতেই এই শীতল খাবার ও শীতল আচারবিধির প্রচলন শুরু বলা যেতে পারে।
অবন্তিকা পাল। জন্ম ১৭ জুন ১৯৮৬, হাওড়া। কলকাতার স্থায়ী বাসিন্দা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে জে.বি.রায়. স্টেট আয়ুর্বেদিক মেডিকেল কলেজ ও হসপিটাল থেকে আয়ুর্বেদ চিকিৎসাশাস্ত্রে স্নাতক। স্নাতকোত্তর স্তরে মনস্তত্ত্বের পাঠ দ্বিতীয় বর্ষে অসমাপ্ত থেকে গেছে। তবে লেখার পরিসরে সমাজবিজ্ঞান ও মানবাধিকার চর্চা অব্যাহত। কবিতার সঙ্গে নৈকট্য আশৈশব। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ২০১৩-তে। ২০১৭-এ প্রথম প্রবন্ধের বই। প্রথম সারির বাংলা দৈনিক, একাধিক জনপ্রিয় পত্রিকা ও ওয়েবম্যাগাজিনে তাঁর নিবন্ধ প্রকাশিত হয় নিয়মিতভাবে। সিএএ-বিরোধী আন্দোলনের সময়ে কবি ফৈজ আহমেদ ফৈজ-এর সর্বজনবিদিত 'হম দেখেঙ্গে' (দেখে নেবো আমরাই) কবিতাটির বাংলা অনুবাদ করে অবন্তিকা জাতীয় স্তরের সংবাদমাধ্যমেও জায়গা করে নিয়েছেন।
খুব সুন্দর হয়েছে ।