রং!

এই নিয়ে কত কাব্য, কত গান, কত সাহিত্য যুগযুগান্ত ধরে! রং নিয়েই দোল উৎসবে মাতামাতি। প্রকৃতির রং দেখতে ছুটে যাওয়া ফুলের বনে! ক্যালাইডোস্কোপের রঙে রাঙানো ছেলেবেলার দিনগুলি! রঙে রঙে রঙিল আকাআআআশ বলে তার সপ্তকে টান না দিলে বসন্ত আসে না আমাদের শহুরে নিখিলে। তাহলে আজ, এই শীত-শুরুর হিমহিম সকালে, আপনাদের একটা রঙের গল্পই শোনাই? 

আসলে আমি সারাটা দিনই নানা রকমের গল্প বলি আর শুনি। বলতে পারেন, আমার জীবনের উদ্দেশ্যটাই হল রাজ্যের গল্প বলা আর শোনা। তবে এ গল্পটা ঠিক গল্প নয়। শুনতে গল্পের মতো হলেও আদতে সত্যি। ঠিক যেন তপন সিনহার সিনেমা! গল্প হলেও সত্যি। গল্পের গোড়াটা অবশ্য আমার বাড়িতেই। চ্যারিটির মতো গপপোও বিগিন্স অ্যাট হোম! 

একদিন আমি আর আমার মেয়ে লিফটে চড়ে যাচ্ছি। লিফটে আরও একজন আছেন। আমাদের ওপরের ফ্ল্যাটের এক দক্ষিণ ভারতীয় ভদ্রমহিলা। আমার মেয়ের বয়স তখন বছর চারেক। ও খানিকক্ষণ মহিলার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকার পর হঠাৎ বলে উঠল, “মা, হোয়াই ইজ শি ব্রাউন?” প্রসঙ্গত, আমার মেয়ের গায়ের রঙ, ওই ভারতবর্ষে যাকে মোটামুটি ফর্সা বলে, সে রকম। আমি দেখলাম, মেয়ের কথায় ভদ্রমহিলা নিমেষে কেমন হকচকিয়ে গেলেন। মুখে অপ্রস্তুত ভাব।

আমি অপ্রস্তুত না-হওয়ার ভান করে বললাম, “আমরা তো সবাই ব্রাউন পুতু। শি ইজ ইওর ফ্রেন্ড অ্যান্ড কালার ডাজনট্ ম্যাটার!” মহিলা হেসে মাথা নাড়লেন। বাড়ি ফিরে একটা বাদামি রঙের প্যাস্টেল নিয়ে পুতুকে বোঝাতে বসলাম, কী ভাবে একটাই রঙ দিয়ে কখনো হালকা, আবার কখনো গাঢ় রঙ করা যায়। একটা রঙের কতগুলো শেড হয়। মোদ্দা কথা, সেদিন আমি আমার চার বছরের মেয়েটিকে বোঝাতে চেয়েছিলাম যে আমরা সবাই আসলে একই রঙের বিভিন্ন শেড। আর তাতে আমাদের অন্যের সাথে বন্ধুত্বে-ভালবাসায় কিচ্ছুটি আসে যায় না।

আমার স্বামী এবং আরও অনেকে যদিও বললেন, “এতটুকু মেয়েকে এত শক্ত শক্ত জীবনদর্শন শিখিয়ে কী লাভ?” কিন্তু আমার বক্তব্য হল, আমরা ছোট থেকে কালো-ফর্সা, রোগা-মোটা, লম্বা-বেঁটে, গরিব-বড়লোক ভেদাভেদ দেখতে দেখতে, শিখতে শিখতে হঠাৎ একদিন কী ভাবে মহাপুরুষ জাতীয় কিছু হয়ে যাব? কী করে আচমকা একদিন সকালে উঠে বিভাজনের মানসিকতাটা পুরোপুরি উবে যাবে? সব মানুষকে আমরা নিজে নিজেই সমান ভাবে দেখতে শুরু করব? এ কি সম্ভব? শিক্ষা, বেড়ে ওঠা, বোধ, জ্ঞান এসবের প্রয়োজনীয়তা কি তাহলে মিথ্যে? 

এখন মনে পড়ে, খুব ছোটবেলায় আমার স্কুলে একটা ছেলের বড় বড় চুল ছিল। কারণ জানি না। হয়তো মানত টানত ছিল। আমি তার পনিটেল বাঁধা চুল দেখে খুব হাসতাম। একটি ছেলে ছিল ভীষণ রোগা আর শান্ত। তাকেও আমার খুব অদ্ভুত লাগত। মাঝে মাঝে ওর পাশে বসে খোঁচাতাম, “কী রে, কথা বলিস না কেন তুই?” আজ এই বয়সে এসে খুব মনে হয়, সেই সময়, ওই ছেলেটির আত্মবিশ্বাস যদি তলানিতে এসে ঠেকে থাকে, বা ঠেকেছিলও হয়তো… তার জন্য কিছুটা হলেও আমি দায়ী। আমার এটাও মনে হয় যে কেন কেউ তখন আমাকে শেখায়নি বা বলেনি যে, কাউকে দেখে অন্য রকম লাগলেই বা কেউ প্রতিবাদ করতে না-পারলেই তাকে আমি ‘বুলি’ করার লাইসেন্স পেয়ে যাই।

এই বুলি করার মধ্যে কিন্তু একটা অসম্ভব নেশা আছে! একা বা দল বেঁধে আমি বা আমার চেনা অনেককে আমি খুব ছোট বয়সেই বুলি করতে দেখেছি। আর ধীরে ধীরে যখন বড় হয়েছি, তখন বুঝেছি এই জিনিসটা কতখানি স্লো পয়জনের মত। দিনের পর দিন এর ফলে একটু একটু করে একটা মানুষ কুঁকড়ে যায়, গুটিসুটি মেরে সেঁধিয়ে যায় কোথাও। ক্রমে উঠে আসার চেষ্টাও ছেড়ে দেয়। এই যে দুর্বল শরীরের ছেলেটা বা কালো মেয়েটা প্রথম প্রথম স্কুলে আসতে চায় না, এলেও শেষের বেঞ্চটায় গিয়ে বসে, বন্ধু বানাতে পারে না, কলেজে গিয়ে আড়ালে লুকিয়ে থাকে, চুপ করে থাকে, তোতলায়, বেশিরভাগ সময় একটা স্বাভাবিক জীবনে আসতেই পারে না, লোকসমক্ষে বেরতে সঙ্কোচ পায়— এসব কিছুর জন্য আসলে কে দায়ী? ওর দুর্বল শরীর? মস্তিষ্ক? গায়ের রঙ? ওজন? স্বভাব? নাকি ছোটবেলার স্কুলে ওরই বয়সী গুটিকয়েক ছেলেমেয়ে, যারা ওকে দেখে ওর ভিন্নতার দিকে আঙুল তোলে? ওকে কৌতুকের পাত্র করে তুলে ওর মনোবল নামক বস্তুটা পায়ে পিষে দেয়?

না। সমীকরণটা বোধহয় এত সরল নয়। এখানে আমাদের খুঁজতে হবে এই আঙুল তোলার মানসিকতার উৎসমুখ। কেন বুলি করার প্রাথমিক ইচ্ছে জাগে শিশুমনে। বুঝতে হবে যে, শিশুরা রোজ স্বাভাবিক ভাবে যা দেখে, তার চেয়ে আলাদা কিছু হলেই তাতে তাদের চোখ আটকায়। তারা খেয়াল করে। উৎসুক হয়। কেন, কী ভাবে হল সেটা জানতে চায়। অর্থাৎ, একজন সাধারণ গায়ের রঙের ভারতীয় শিশু খুব সাদা বা খুব কালো চামড়ার কোনও মানুষকে দেখলে অবশ্যই খেয়াল করবে। কিন্তু গোড়াতেই তাদের কাউকে খারাপ ভাবে বা ঠাট্টার পাত্র হিসেবে দেখবে না। সেটা তারা কখন করবে? যখন দেখবে আশপাশের বড় মানুষরা সেই আপাত ভাবে ভিন্ন মানুষটির প্রতি স্বাভাবিক ব্যবহার করছে না। কখনও গোলাপি মোড়কের ক্রিম মেখে পরতে পরতে ছ’সপ্তাহে ফর্সা করবার চেষ্টা করছে। কোথাও হাইট ইনক্রিজার লাগিয়ে লম্বা হয়ে যাওয়ার উপদেশ দিচ্ছে। আবার কেউ বা অদ্ভুতদর্শন সনা বেল্ট কিনে পেটের মেদ নিমেষে কমিয়ে সাইজ জিরো হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছে। আর বোকাবাক্সের পর্দায় প্রতিনিয়ত দেখানো হচ্ছে যে, এগুলো না করলে কেউ চাকরি পাচ্ছে না, কারও স্বামী ছেড়ে চলে যাচ্ছে কিম্বা কেউ স্কুলে হাসির খোরাক হচ্ছে। ফলে আমাদের ছেলেমেয়েরা বুঝতে শুরু করছে, কালো হওয়া খারাপ, মোটা হওয়া খারাপ, ফর্সা সুন্দর, ঝকঝকে না হলেই জীবনটাই বৃথা!   

অতএব জীবনের সার্থকতার এই মেকি ভ্যালিডিটিটা ভার্চুয়ালি পেতে তাদের হাতে হাতিয়ার কী? হাতিয়ার দুটো। এক, নিজেকে ঘষেমেজে ঐ মেনস্ট্রিমের অন্তর্গত করার আপ্রাণ চেষ্টা। নইলে দুই, যতক্ষণ সেটা না পারছি ততক্ষণ কাউকে বুলি করে প্রমাণ করা, যে আমি ওদের মধ্যে পড়ি না। আমি অযোগ্য নই, অসুন্দর নই, অস্বাভাবিক নই। আমি বিজ্ঞাপনের সেই পারফেক্ট মানুষটি।  

আমাদের সন্তানদের সঙ্গে ঠিক এই ঘটনাটাই ঘটছে, খুব ছোটবেলা থেকে। 

এ বার এ ক্ষেত্রে আমাদের দায়িত্ব কী? আমাদের দায়িত্ব হলো ওদের ভেতরের শিশুসুলভ ঔৎসুক্যটাকে বাঁচিয়ে রাখা। ওদের বোঝানো, যে পৃথিবীটায় সবরকম রঙ, আকার, প্রকার আছে। সব রকম শেড আছে। ওই বাদামি প্যাস্টেলটার মত। তারা সবাই আলাদা। আর সেটাই আমাদের এই পৃথিবীটার সৌন্দর্য। এই বৈচিত্রই পৃথিবীকে সুন্দর করে। এই ভিন্নেরা কেউই কারোর থেকে খারাপ নয়, পিছিয়ে যাওয়া নয়, অপাংক্তেয়ও নয়। সকলেই এক আকাশের নিচে তাদের নিজস্বতা নিয়ে, স্বাতন্ত্র নিয়ে এক রামধনু রং আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে চতুর্দিকে।  

আর এটা মানতে বা জানতে না শিখলে পৃথিবীতে শেষ পর্যন্ত থেকে যাবে শুধু দু’টো দল। এক দল গুটিয়ে থাকবে, আরেক দল তার সুযোগ নিতে থাকবে। আর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হল, এই দুই দল অনবরত অদলবদল হতে থাকবে, যতদিন না সমস্ত মনুষ্যত্ব, চেতনা, বোধ ধূলিসাৎ হয়ে যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *