ভয়
আটকে রেখেছিলাম আমি তোমার মায়ামৃগ
ওকে তোমার স্পর্ধা মনে করি।
ওকে যখন ছাড়াতে এলে আমার মনে হল
নৌকো থেকে নামছে আজ তরী।
ভেতরে এক পাগল বলে থাকতে পারছি না
কুয়াশা নামে তোমার গাঢ় ঠোঁটে
তোমার ঢেউ আছড়ে পড়ে তোমার খোলা চুলে
গরম ঢেউ নাভির থেকে ওঠে।
তখন আর কীকরে আমি দেখাব ভদ্রতা
কামড়ে দেব কালো খেজুর, কামড়ে দেব বোঁটা।
তোমার ঘরে কলসি আছে কলসি খালি করি
এ কলসিকে আগুন দিয়ে ভরি।
কামড়
আমি তোমার স্তনের কাছে মুখ এনেছি, প্রিয়
আমাকে তুমি সকাল এনে দিও।
হেমন্ত কি সবার হতে পারে?
আমার থেকে হেমন্তকে নিও।
কোনও ব্যথা চিরস্থায়ী হয় না কেন, প্রিয়?
ভালবাসাকে একটু ছেড়ে দিও।
ঘুরে বেড়াক, অশ্বপিঠে উড়ে বেড়াক, উড়ে
পুড়ছে পাতা, যাচ্ছি আমি পুড়ে।
সূর্য ডুবে গেলেও থাকে আলো
যেটুকু অবশিষ্ট আছে আমাকে তাই দিও।
আজ আমার হেমন্তকে চাই
আমি তোমার ঠোঁটের কাছে মুখ এনেছি প্রিয়।
ভাঙো উপোস
বাইরে আমি হুক খুলেছি, ভেতরে তুমি খোল
নাহলে আর কীসের প্রেম হল?
দড়িতে হাত দিয়েছি যেই, প্রতিধ্বনি বলে
আজকে নয়, আজ আমার উপোস
বাইরে থেকে খুলছি দড়ি ভেতরে তুমি খোল
কীসের আমি প্রেমিক আজ যদি না করি দোষ।
হেমন্তের বিষণ্ণতা—তাকেই বলে মদ
আমার পানপাত্রে ঢাল তোমার সম্পদ।
তরঙ্গকে আসতে দাও, তোল সমুদ্রকে
ভাঙো উপোস নাহলে আর কীসের প্রেম হল?
তোমার বিষ আসলে অমৃত
আমি তোমার বোতাম খুলি, আমাকে তুমি খোল।
দাসী
গরলে আমি ডুবতে চাই
মরীচিকাকে ধরতে চাই
ওই মেয়েকে বলতে চাই
তোমাকে ভালবাসি।
আমি তোমার দাসানুদাস
তুমি আমার দাসী।
খুন
হেমন্তকে খুন করেছ
আকাশ ভরা তারা
রাস্তা পার হচ্ছে কুয়াশারা
চিরুনিগুলো কোথায় রাখ শুনি?
হেমন্তকে খুন করেছ
তুমি আমার খুনি।
আজকে এত দেরি হল যে?
তরঙ্গিণী, তোমাকে আমি করিনি জিজ্ঞাসা
আজকে এত দেরি হল যে?
আজকে যারা দেখতে চায় বিরহ কালো জলে
আসলে তারা তরঙ্গকে খোঁজে।
আমার কাছে ভালবাসার অন্য মানে আছে
ভাগ্যে যদি এক মিনিট থাকে
সেটাকে দশ মিনিট করে বিস্তারিত হব
সহজ থেকে সহজে।
তরুণ কবি, এখনও আছ মজে?
সে কোন রসে হাঁড়ি পেতেছ, উনুনে নেই হাঁড়ি
নেশা যখন চড়ে মাথায়, নেশা মহত্তর
তরুণ কবি সবার চেয়ে বড়।
বড় হলেই হয় না, হও দু’কূলে বানভাসি
জুয়োতে দান ফেলার আগে তোমাকে ভালবাসি।
পাপ
‘দিস ইজ দ্য ফেস দ্যাট বারন্ট দ্য টপলেস টাওয়ার অব ইলিয়াম’
ড. ফস্টাস, মারলো
পাপ ও কিলোমটার
পাপ ও সেন্টিমিটার
পাপ ও প্যারামিটার
কোনও মিটার দিয়েই পাপ মাপা যায় না
পাপ যখন জন্মায় পলাশও তখন জন্মায়।
দ্রৌপদী বলেছিলেন
শরীরটা ভাল নেই, আমাকে রাজসভায় নিয়ে যেও না।
আমি বলেছিলাম দেখুন, রাজসভায় পাপ ও প্যারামিটার বলে কিছু নেই।
ফিফটি ফিফটি
মারি তো গণ্ডার লুটি তো ভাণ্ডার।
রাজসভা নেই, বলিউড আছে
কী না হয় সেখানে
একটা বুড়ো লোক
এই এখানে হাত দিচ্ছে ওই ওখানে ফুল ফুটছে
হাতটা ঠিক কোথায় রাখবে জানে না
মধু আর বিষ দুটোই যারা খায়
কামনায় যাদের কাঁকর বেশি থাকে, তারাই বলে
মেয়েরাই মধু, মেয়েরাই বিষ।
ঊরুভাঙা দুর্যোধন কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল
সবাই মিলে পাপ করলাম
ভূপৃষ্ঠে দাঁড়ানো সব মেয়ের শাড়ি খুললাম
শুধু ঊরু ভাঙা হল আমার?
যেন সবাই মিলে যে পাপ করি সে পাপ কারো একার নয়
সে পাপ নিয়ে হারিয়ে যায় বাতাস।
কুশ
কানে কামড় দিয়ে যেদিন মুচড়ে উঠেছিলে
আমি তোমার উপচে পড়া শস্যভূমি
আনত দেখেছিলাম
কিন্তু আমি তোমার সঙ্কেত
সহজ করে নিলাম।
কানে কামড় দিয়ে সেদিন মুচড়ে উঠেছিলে
কোমর ধরে শূন্যে তুলে দিলাম
ঠোঁটে কামড় বসিয়ে বলেছিলে
‘দস্যু হও, উদঘাটন করো’
শস্যে লাগা আগুন আমি কী করে আজ থামাই?
ফুটল পায়ে কুশ,
যদি না ভালবাসতে পারি কিসের আমি মানুষ?
কুঠার
কোমরে ছিল কুঠার, ছিল কুঠার লেলিহান
ফুরিয়ে আসে বেলা
লাস্য আর লাবণ্যের চাবুক মেরে খেলা
এখনও আছে বাকি
ইচ্ছে হয় জ্যোৎস্না পর্যন্ত আমি থাকি।
পতনে আমি ছিলাম অতি দৃঢ়।
যে উত্থানে পালিয়ে যায় বীরের মতো বীরও
ছলাত্ ছল ছলাত্ ছল বলে
বলতে পার সূর্য কেন ডোবে
মানুষ আর ডাহুক দুটো একটুখানি শোবে।
সারাটা দিন এরা দু’জন ছলনা করেছিল
আমাকে দেখে ঘরের খিল দিল।
জাগো কুঠার, ফুরিয়ে আসে বেলা
দেখি তোমার লাস্য জয় করার শেষ খেলা।
লুণ্ঠন
কুহকের আগে কুয়াশাকে ডেকে আনে
হত্য়ার আগে শুনেছ অট্টহাসি
এ কার দু’হাতে পরিয়েছ শৃঙ্খল
লুণ্ঠন করা মেয়েটিকে নিয়ে আসি।
আমরা সবাই বল্কল পরা লোক
আমরা সবাই সূর্যের সন্তান
একলা একটা মেয়েকে সামনে পেলে
লুণ্ঠন করে গাই সাম্যের গান।
লুণ্ঠন করে রাখতে পারি না ধরে
এই যে আমাকে বন্দি করেছে এরা
গাছের গুঁড়িতে আমাকে রেখেছে বেঁধে
আজ রাত্রেও হবে না বাড়িতে ফেরা
কী দোষ করেছি নারী লুণ্ঠন করে
যে দোষে তোমরা সবচেয়ে বেশি দোষী
লুণ্ঠিত হতে ভালবাসে সব নারী
আকাশের চাঁদ নিভে গিয়ে হল শশী?
মেয়েটিকে আমি পিঠে করে নিয়ে আসি
কত রাত তাকে বানিয়ে দিয়েছি রুটি
ঝোরা ঝর্নার জল এনে দিই তাকে
প্রেমিক হিসেবে পাবে না আমার ত্রুটি
গোষ্ঠীপ্রধান বলল, ও মেয়ে শোনো
পাহাড় পেরিয়ে এ তুমি কোথায় এলে
তোমার ওপর সব্বার অধিকার
কুহকের আগে কুয়াশা কী করে পেলে?
এ নারী আমার, কাউকে দেব না ভাগ
মারা গেছে আজ আকাশে রোহিণী তারা
লুণ্ঠন করে এনেছি আমার নারী
বিলিয়ে দেয় না লুণ্ঠন করে যারা।
কুহকের আগে কুয়াশাকে ডেকে আনি
এ মেয়ে আমার একে আমি ভালবাসি
আদিবাসী আমি আদি অক্ষর থেকে
পৃথিবীতে আমি বারবার ফিরে আসি।
জন্ম নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরে‚ ১৯৫৮ | ইংরাজি সাহিত্যের অধ্যাপক | পড়িয়েছেন আমেরিকার আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। 'দ্বৈপায়ন হ্রদের ধারে' এনে দিয়েছে সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার‚ ২০১৩ সালে| বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ কবিতা আকাদেমির সভাপতি। লিখেছেন পঁয়ত্রিশটি কাব্যগ্রন্থ যার মধ্যে রয়েছে একা নরকগামী (১৯৮৮), জেরুজালেম থেকে মেদিনীপুর (২০০১), মণিপুরের মা (২০০৫) ইত্যাদি। 'ভাষানগর' পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে সুবিদিত।
লেখা ও রেখা দুইই অনবদ্য। বোধ্য এবং সাহসের সঙ্গে সৎ।
উফ দুর্দান্ত লেখা। সেই অমোঘ স্টাইলাইজেশন। সুবোধ দার এই সব লেখা আমায় শিল্প ও কল্পনার শিখরে নিয়ে যেতে সহায়তা করে। মজে যাই, কবিতার নেশায় মজার মতো বিরল মুহূর্তের সম্মুখীন হই।
অসামান্য কবিতা সব। এই কলমটিকে ঈর্ষা হয়। এমন কলম হলে হয়তো লিখে ফেলতাম সমুদ্রকে চিঠি। অথবা ঝড়ের ঝুঁটি ধরে শিখিয়ে দিতাম যাবতীয় নীলের মহাশূন্যের গণিত।
অনিঃশেষ শুভেচ্ছা রইলো দাদা। শ্রদ্ধা!
এতো সুন্দর লাগলো বলে বোঝাতে পারব না। এক অসাধারণ অনুভূতি। খুব ইচ্ছা থাকল এটা রেকর্ড করবার যদি আপনার অনুমতি পাই। আপনি খুব ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন ।
সুবোধ দার লেখার আমিও একজন গুণমুগ্ধ পাঠক।
প্রতিটি লেখাই অসাধারণ লাগে । এখানে লেখা আর রেখার সুন্দর সহাবস্থান।
বছরের শুরুতেই দুর্দান্ত কিছু লেখা পড়ালেন সুবোধদা। “খুন” সবচেয়ে কাছের হয়ে রইল।