এর আগে তানিয়া চক্রবর্তীর যে-গদ্যটি নিয়ে কথা বললাম, সেখানে একটি বাক্য আছে যা আগে জানিয়েছি, কিন্তু পুনরায় সেই বাক্য নিয়ে আসতেই হচ্ছে আমাকে– কারণ এবার যে কবির লেখার মধ্যে প্রবেশ করার চেষ্টা করব, তাঁর রচনার ক্ষেত্রে তানিয়ার উপলব্ধিসূত্রটি নিশ্চিতভাবে প্রয়োগ করা যায়। তানিয়া কী বলেছিলেন? বলেছিলেন: ‘কবিতা একটা লুকোচুরি… যেখানে বলাটাও বলা নয়, আবার না-বলাটাও বলা।’
আমি বেছে নিয়েছি, তানিয়ার চেয়ে দুই দশক আগে লিখতে শুরু করা জয়দীপ রাউতের কিছু কবিতা। পাঠককে ভেবে দেখতে অনুরোধ করব, কীভাবে ‘বলাটাও বলা নয়, আবার না-বলাটাও বলা’ এই বিশেষ সূত্র মেনে চলেছে তানিয়ার অগ্রজ এক কবির রচনা। জয়দীপ রাউতের সম্প্রতি প্রকাশিত দুটি শীর্ণকায় কবিতার বই আমার সামনে। একটি বইয়ের নাম ‘অপরূপকথাখানি’– অন্য বইটির নাম ‘আঁখিগুল্মলতা’।
‘অপরূপকথাখানি’ কাব্যগ্রন্থের একেবারে প্রবেশক হিসেবে, অথবা উৎসর্গ-কবিতার রূপ নিয়ে একটি সাদা পৃষ্ঠার নীচের দিকে বইয়ের আরম্ভেই স্থান নিয়েছে যে-কবিতা, সেই লেখাকেই আগে পাঠকের সামনে এনে দিচ্ছি। বলে রাখা ভালো, এই কবিতা-কণিকাটির কোনও নামকরণ করা হয়নি। এই কবিতাকে বইয়ের ভূমিকাও ভাবা যেতে পারে।
তুমি অপরূপ আলপনা
উঠোন পেরিয়ে আর
কোথাও যাব না।
হ্যাঁ, তিনটি মাত্র লাইন। সেখানে প্রথম লাইনের পর একটি স্পেসও আছে। এই কবিতা আমি যতবার পড়েছি, থেমে থেমে, ধীরগতিতে পড়েছি– কেননা, অত্যন্ত অল্প শব্দে, রচিত নীরব এই কবিতাটি বিলম্বিত লয়ই দাবি করছে। আরও একটি কবিতা তুলে দিই এবার।
মাধবী
মাধবীলতার নাম আমি আজ
মাধবীবিহ্বলতা রাখি
মাঝে মাঝে কেঁপে ওঠে ডাল
ডালে বসা বাতাসের পাখি

কবিতার আকার এইটুকুই মাত্র। আমার প্রশ্ন, ‘বাতাসের পাখি’ বলে কিছু হয় কি? জানি না। তবে, পাঠমাত্রই আমার মুখস্থ হয়ে গেছে ওই লেখা। এবং ‘বাতাসের পাখি’ কাকে বলে, স্পষ্ট করে না জানলেও এই কবিতাটি আমাকে এক মধুরতার স্পর্শ দিয়ে যাচ্ছে বারবার। প্রকৃত লিরিক কাব্য হয়তো একেই বলে। গাছের যে ডাল হাওয়া লেগে দুলছে, সেই ডালে যেন বাতাসের পাখিই বসল। তাই ওই দোলা। আরও একটি কবিতা এবার বলছি:
দিনান্তে
বাগানের বহু গাছে গাছে
ওড়ে অনায়াসগামী লতা
আমি তার অকৃতজ্ঞতা
ফুল হয়ে ফুটতে দেখেছি
চারটি মাত্র লাইন। প্রথম দুটি লাইনের পর একটি স্পেস আছে। যেন কবিতাটি ভেঙে যাচ্ছে দুটি খণ্ডে। প্রথম খণ্ডের দুটি লাইনে কেবল বাগানভরা অজস্র গাছ। সেখানে কী উড়ছে? উড়ছে ‘অনায়াসগামী লতা’! এই ‘অনায়াসগামী লতা’ শব্দদুটির মধ্যেও মাধুর্য সঞ্চারিত হচ্ছে, একদল তরুণীর হাস্যকলরোলময় চঞ্চলতা যেন ধরে রাখছে ওই শব্দদুটি– কিন্তু দ্বিতীয় খণ্ডে এসেই পাঠকের একটু ধাক্কা লাগে, কেননা, ‘আমি তার অকৃতজ্ঞতা/ ফুল হয়ে ফুটতে দেখেছি’। এখানে বেদনা এল, এল নারীর কাছে আঘাত পাওয়ার ইঙ্গিত। কিন্তু সেই ‘অকৃতজ্ঞতা’ আঘাত হয়েই রইল না, কবিতাটি তাকে ফুল হয়ে ফুটে উঠতে দেখল। বেদনা এল, পরক্ষণেই তাকে পুনরায় মধুরতা দিয়ে স্নিগ্ধ করে নেওয়া হল।

ঠিক এর আগে যে কবিতাটি বললাম, সেখানেও রয়েছে সহজ শব্দের দ্বারা মাধুর্যরহস্যের আগমন। ‘মাধবীলতার নাম আমি আজ/ মাধবীবিহ্বলতা রাখি’– ‘মাধবীবিহ্বলতা’ বলতে কী বোঝায়? সরাসরি অর্থ পাওয়া যায় কি? আমার মনে কবিতাটি ঢেউ দেয় এই সঙ্কেত নিয়ে, যেন ‘মাধবী’ নামের কোনও মেয়ে রয়ে গেছে এই কবিতা রচনার উৎসে। সেই নামটি থেকেই কি ‘মাধবীবিহ্বলতা’ কথাটি এল? কারণ মনে রাখতে হবে, মাত্র চারলাইনের এই কবিতার মধ্যে ‘নাম’ কথাটি কিন্তু ব্যবহৃত হয়েছে। শঙ্খ ঘোষ একবার একটি সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন:
‘যে-কবিতায় অল্প শব্দেরই ব্যবহার হচ্ছে, তার মধ্যেও কোনো-কোনো শব্দকে মনে হতে পারে বাহুল্যময়। বহুলতা এখানে নিষ্প্রয়োজনবোধক।’
আমি দ্বিধাহীনভাবে জানিয়ে দিতে চাই, অতি অল্প শব্দ ব্যবহার করে রচিত জয়দীপ রাউতের এইসব কবিতার মধ্যে এমন একটিও শব্দ খুঁজে পাওয়া যাবে না, যা ‘নিষ্প্রয়োজনবোধক।’ সেই সূত্রেই বলা যায় ‘মাধবী’ কবিতায় একবার মাত্র ব্যবহৃত হয়েই সরে যায় যে-শব্দ, ‘নাম’– সেই শব্দটিকে আমরা আবারও খুঁজে পেতে পারি ওই কবিতায়। প্রথমবার প্রয়োগের পরে নয়– আগে। আগে কেন? কবিতাটির নামকরণের দিকে তাকালেই ‘নাম’ শব্দটি প্রয়োগের উদ্দেশ্য ধরা দিতেও পারে। এ কবিতার নামই তো ‘মাধবী’! কবিতারচনার ক্ষেত্রে, কবিতালেখকের সামনে, কবিতাটি পুরো লিখিত হওয়ার পরেও লেখাটির মধ্যে অর্থ যোগ করার আরও একটি উপায় বা ‘স্কোপ’ থাকে। সেই ‘স্কোপ’ হল নামকরণ। নামকরণ দ্বারাই কবিতাটিকে তার অন্তর্বস্তু প্রকাশের দিকে আরও একটু এগিয়ে নিতে পারেন লেখক।
‘মাধবী’ একটি মেয়ের নাম হতে পারে, হওয়াই সম্ভব। সেইসঙ্গে কবিতার মধ্যে ‘নাম’ শব্দটি তো আছে– এও দেখা যায় কবি একটি নিজস্ব সম্বোধনে ‘মাধবীলতা’কে ডাকছেন, সেই বিবরণও উপস্থিত। কী সেই সম্বোধন? ‘মাধবীবিহ্বলতা’। অতএব এ কবিতা ‘দিনান্তে’ নামক কবিতার মতোই একটি নীরব প্রেমের কবিতা। নীরব কেন? কারণ এই ডাক তো আসলে ডাক নয়, একটি নাম রাখা-মাত্র। ‘মাধবীবিহ্বলতা’ বলে কোনও ডাক যে স্পষ্টভাবে উচ্চারিত হচ্ছে, এমন সংবাদ এ লেখা থেকে পাওয়া যায় না। কিন্তু এই ডাক শোনার ফলে কী কী প্রতিক্রিয়া দেখা যায়? দুটি প্রতিক্রিয়া– এক, ‘মাঝে মাঝে কেঁপে ওঠে ডাল’, আর দুই, ‘ডালে বসা বাতাসের পাখি’। অর্থাৎ গাছের ডাল কাঁপল। আর বাতাসের পাখিও কেঁপে উঠল। ভুলে যাব না, মাধবীলতা তো একটি গাছেরও নাম! অর্থাৎ, মাত্র চার লাইনের মধ্যেই কতগুলি খেলা ঘটে গেল– মন এক আশ্চর্য স্নিগ্ধতায় ভরে উঠল যেন!

যে-কাব্যগ্রন্থের কবিতা একের পর এক তুলে ধরছি এখন পাঠকের কাছে, আগেই বলেছি, তার নাম ‘অপরূপকথাখানি’। এই শীর্ণ বইটির উৎসর্গ-কবিতা বা প্রবেশক কবিতাটিও শেষ পর্যন্ত অতি অল্প শব্দ দিয়ে বলা একটি অনুপম প্রেমেরই কবিতা। সে কবিতা প্রথমেই তুলেছি। আবার সেই লেখার কাছে ফিরে আসব জয়দীপ রাউতের কবিতা নিয়ে আমার এই কথাবার্তার উপসংহারে পৌঁছলে। এখন অন্য একটি কবিতা বলি।
ঘাট
কী এমন ক্ষতি!
যদি তার চোখের দুপার
ঘেঁষে বসি আর
জল এসে ছুঁয়ে যায়
আমাদের সব সন্ধ্যারতি
পাঁচলাইনের কবিতা। প্রথম লাইনের পর একটি বিস্ময়চিহ্ন আছে। বাকি কবিতায় কোনও যতি ব্যবহৃত হয়নি। প্রথম লাইনের পর একটি স্পেস আছে। আর শেষ লাইনটির আগে রাখা হয়েছে আরও একটি স্পেস। স্পেস মানে কী? বিরতি। নীরবতা। অর্থাৎ পাঁচ লাইনের এই ক্ষুদ্রাকার কবিতার মধ্যে দু’বার বিরতি নেওয়ার ফলে এক নীরব অবসর জেগে উঠল। মনে রাখতে হবে, কবিতাটির নাম ‘ঘাট’। তাহলে, ঘাটের ধারে জলের পাশে বসে রয়েছে একটি যুগল। মেয়েটির চোখেও কি জল? কোনও অভিমানে কি? অথবা কোনও অসামান্য আনন্দে তার চোখ অশ্রুপূর্ণ? যে-চোখের কিনার ঘেঁষে কবিতার কথক বা কবি স্থির হয়ে আছেন?
কবিতার শেষ লাইন, ‘আমাদের সব সন্ধ্যারতি…’। আবারও বলি, কবিতার প্রথম লাইনের পর আর কোনও যতিচিহ্ন নেই লেখাটিতে। শেষ লাইনেও নেই। অর্থাৎ ‘আমাদের সব সন্ধ্যারতি…’ চিরায়ত… চলতেই থাকছে এই সন্ধ্যারতি– তার শেষ নেই। কবিতাটির নাম ‘ঘাট’। তাহলে ‘ঘাট’ দুটি অর্থসংকেত আনল। এক, যা সত্যিই কোনও নদীর ঘাট। দুই, মেয়েটির জলভরা চোখ যেন ঘাট। আচ্ছা, ঘাটের নিকটবর্তী মন্দির তো দেখা যায়? হয়তো দূরে কোনও মন্দিরে সন্ধ্যারতি হয় প্রত্যহ, ভেসে আসে ঘণ্টাধ্বনি– যখন সান্ধ্য অন্ধকারে এই প্রেমিক-প্রেমিকা এসে বসে। তাদের মধ্যে কি কোনও ঘনিষ্ঠতা হয়? চুম্বন ঘটে কি তাদের? ওই সাঁঝের আঁধার, জলধারা, দূর সন্ধ্যারতির শব্দ– এমন পরিবেশে তারা দু’জন কি কাছাকাছি আসে? বাগবাজারের ঘাটে, আউট্রাম ঘাটে যেসব তরুণ-তরুণী ঘন হয়ে বসে থাকে তারা তো পরস্পরের চুম্বনসান্নিধ্য পেতেই চায়! সেইটিই তো তাদের কাছে সন্ধ্যারতি।

‘সন্ধ্যারতি’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন কবি এক পবিত্রতায়, কিন্তু তার মধ্যে লুকিয়ে রেখেছেন ‘রতি’ কথাটিও। লিখতে তো পারতেন তিনি: আমাদের সন্ধ্যার আরতি? কিন্তু সে কথা না-লিখে ‘সন্ধ্যারতি’ কথাটির প্রয়োগ এই দৃশ্যের স্মৃতির দিকে নিয়ে যায়– গঙ্গার ঘাটের পাশে উপবিষ্ট প্রেমিক-প্রেমিকারা একে অন্যের নিকটস্থ হচ্ছে আরও, কাঁধে মাথা রাখছে, বিনিনয় করছে চুম্বন। এ-ই হল ‘আমাদের সব সন্ধ্যারতি’। এও এক পূজার্চনা। প্রেমিক-প্রেমিকা নিজেদের ঘনিষ্ঠভাবে কাছে পাচ্ছে, এর চেয়ে বড় পূজা কবির কাছে আর কী হতে পারে? তাই দূর থেকে ভেসে আসা মন্দিরের সন্ধ্যারতির ধ্বনি এক্ষেত্রে আর একরকম সন্ধ্যারতি হয়ে উঠল– শুধু ‘রতি’ শব্দটির গোপন ও অপূর্ব ব্যবহারের ফলে।
এছাড়া, আর একটি অর্থস্তর যুক্ত হল এই কবিতার শেষ লাইনে ‘সব’ কথাটি প্রয়োগের সঙ্গে সঙ্গে। ‘আমাদের সব সন্ধ্যারতি’– লাইনটির একটি অর্থ তো আসছে কবি ও তাঁর সঙ্গিনীর নির্জনে জলের ধারে ঘনিষ্ঠভাবে বসে থাকার মধ্যে। কিন্তু ‘সব সন্ধ্যারতি’ যখনই এল, তখনই আর মাত্রই দুজনের প্রসঙ্গই বলল না কবিতাটি, ‘আমাদের’ কথাটি প্রাথমিকভাবে তোমার-আর-আমার সন্ধ্যারতি এই লক্ষ্য নিয়ে আসছে যেমন– তেমনই জলের ধারে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে থাকা সকল প্রেমিক প্রেমিকার ‘সন্ধ্যারতি’ও হয়ে উঠছে এ কবিতা। অর্থস্তরের বিস্তার ঘটছে, ‘সব’ কথাটির প্রয়োগে।
আরও একটি কবিতা পাঠককে জানাব, যে-কবিতা রচনার জন্য দরকার হয়েছে মাত্র দুটি লাইনের। দুটি লাইন কিন্তু মাঝখানে একটি স্পেস:
দিগন্ত
সে এবার বহু দূরে যাবে
আকাশ মিশেছে এসে পাখির স্বভাবে
এইসব কবিতার কোনওটিই মঞ্চে দাঁড়িয়ে আবৃত্তি করা সম্ভব নয়। জয়দীপ রাউতের যেসব কবিতা আজ পাঠকের সামনে তুলে আনছি, সেসব লেখা একা ঘরে বসে, কোলাহলহীন অবস্থায় একাগ্রমনে পড়ে চলি আমি। তবেই এইসব কবিতার অন্তর্নিহিত রূপ খুলে যায়। এবার অন্য একটি কবিতার দিকে যাই।
দশমী
অতি ধীর চাঁদ ভেসে চলে
যেন দেবী তাঁর
কর্ণলতিকার
ফুল ফেলে গিয়েছেন জলে

এই কবিতার মধ্যেও কোনও যতিচিহ্ন নেই। কেবল শেষ লাইনটির আগে একটি স্পেস বা বিরতি প্রযুক্ত হয়েছে। আমি যখন রানাঘাটে থাকতাম, আমার বালকবয়সে, বিজয়া দশমীর দিন চূর্ণী নদীর ঘাটে বিসর্জন দেখতে যেতাম। মহাসমারোহে বিসর্জন দেওয়া হত একের পর এক প্রতিমা। তারপর আমার বয়স একটু বাড়ল। তখন আর ওই প্রবল ঢাকের বাজনা আর ক্লাবের ছেলেদের নৃত্যসমন্বিত বিসর্জন দেখতে যেতে ইচ্ছে করত না। সে সময় আমার কুড়ি-একুশ বছর বয়স। রাত সাড়ে দশটা নাগাদ চূর্ণী নদীর ধারে গিয়ে বসতাম বিসর্জনের পর। তখন দেখতাম নদীর স্রোতে ধীরে ধীরে ভেসে চলেছে প্রতিমাচ্যুত সাদা চাঁদমালা– ভেসে চলেছে দশমীর চাঁদও। রাতে সাড়ে এগারোটা বারোটা পর্যন্ত বসে থেকে ফিরে আসতাম বাড়ি। জয়দীপ রাউতের এই কবিতা পড়ে স্পষ্ট জেগে উঠল সেই স্মৃতি।
এই কবিতার মধ্যে অক্ষরবৃত্ত ছন্দের নির্ভুল ব্যবহার আছে, ব্যবহার আছে অন্ত্যমিলের। যেমন ‘সন্ধ্যারতি’ শব্দটি যে-কবিতায় ছিল, সেখানেও অন্ত্যমিল প্রয়োগ করা হয়েছে। আমি যেসব কবিতা আজ পড়তে দিচ্ছি পাঠকদের, জয়দীপ রাউত তার প্রায় সব কবিতার মধ্যেই অন্ত্যমিল এনেছেন। কিন্তু এনেছেন খুব গোপনভাবে, যার ফলে মিল যে ব্যবহার করা হয়েছে, তা চোখেই পড়ে না। কেবল শ্রুতির মধ্যে একটি অস্ফূট ধ্বনির অণুরণন যেন কাজ করে চলে। একমাত্র দ্বিতীয় সচেতন পাঠেই অন্ত্যমিলের প্রয়োগ ধরা যায়। চাঁদ, বিজয়া দশমীর গভীর রাত্রে, দেবীর কর্ণলতিকার ফুলমাত্র– স্রোতে ভাসমান ফুল– এইটুকুই এই কবিতার বার্তা। পৃথিবীর কাউকে এই কবিতা আকর্ষণ করতে চায় না– কেবল নিজের ভেতর থেকে উঠে আসা কয়েকটি নিরূপায় কথা কিছু শান্ত ছবি এসব কবিতায় আমরা বহমান অবস্থায় দেখি। আরও একটি কবিতা তুলে দিচ্ছি, মাত্র তিন লাইনের কবিতা– পাঠককে নিশ্চুপে অনুভব করতে হবে এই কবিতার অন্তর্বস্তু।

চন্দ্রাহত
জ্যোৎস্নায় পুড়ে যাচ্ছে ঘর
আজ
গৃহদেবতার জ্বর।
প্রথম লাইনের পর একটি স্পেস আছে। স্পেসের পর, দ্বিতীয় লাইনে, মাত্র একটি শব্দ। সেই শব্দটি হচ্ছে ‘আজ’। এবং শেষ লাইন হল ‘গৃহদেবতার জ্বর’। যতিযুক্ত। শেষলাইনে পূর্ণচ্ছেদ। যুক্ত। এখানে ছন্দ নিয়ে একটি লুকনো খেলা রাখা আছে। ‘আজ গৃহদেবতার জ্বর’ যদি এইভাবে পড়ি তবে অক্ষরবৃত্ত ছন্দে পুরো দশমাত্রা পাই। প্রথম লাইনে আছে ‘জ্যোৎস্নায় পুড়ে যাচ্ছে ঘর’। ‘জ্যোৎস্না’ শব্দটিকে বিশ্লিষ্ট করা হয়েছে, যা অক্ষরবৃত্ত ছন্দের নিয়ম লঙ্ঘন করে– তবু সেখানেও আমরা লঙ্ঘিত নিয়মেই দশমাত্রা পাচ্ছি। কিন্তু আশ্চর্য, কানে লাগছে না!
তাহলে কী দাঁড়াল? মূল কবিতাটি দুটিমাত্র বাক্য দিয়ে তৈরি– দুটি বাক্যই অক্ষরবৃত্তের দশ মাত্রা দ্বারা নির্মিত। কিন্তু প্রথম লাইনের পরেই স্পেস বা বিরতি এসে জ্যোৎস্নায় ঘরের পুড়ে যাওয়া বা জ্যোৎস্নাপ্লাবিত আবহাওয়াটিকে দীর্ঘক্ষণ ধরে রাখে। স্পেসের পর আসে আজ শব্দটি, যা আসলে একটি স্বতন্ত্র লাইন– তারপর ‘গৃহদেবতার জ্বর’ শব্দদুটি এসে আমাদের এক অর্থের সীমানাহারা অনুভবের দিকে নিয়ে যায়। আমরা, পাঠকরাও যেন জ্যোৎস্নায় পুড়ে যাওয়া ঘরটির ভেতরে বসে অলৌকিক কোনও গৃহদেবতার জ্বর স্পর্শ করতে পারি। ‘আজ’ কথাটি একলাইনে একটিই শব্দ, বললাম তো? আসলে ‘আজ’ শব্দটি ছন্দের টানে পরবর্তী লাইন ‘গৃহদেবতার জ্বর’-এ সংযুক্ত হয়। কিন্তু ‘আজ’ কথাটিকে একলা রাখায় একটি সাসপেন্স বা আগ্রহ তৈরি হয়ে উঠতে পারে পরের লাইনটির জন্য। অর্থাৎ ‘আজ’ কথাটিও দুরকমভাবে কাজ করছে– প্রথমতঃ ছন্দের টান রেখে পাঠককে শ্বাস ফেলতে না-দিয়ে পরবর্তী লাইনে পৌঁছতে বাধ্য করছে– দ্বিতীয়তঃ ‘আজ’ একটি লাইনের একমাত্র শব্দ হওয়ায় পাঠকের মনে মুহূর্তের জন্য জেগে উঠছে এই প্রশ্ন, আজ কী? আজ কেন? সঙ্গে সঙ্গে এসে পড়ছে ‘গৃহদেবতার জ্বর’ শব্দদুটির মধ্যে দিয়ে এক অসামান্য কল্পনাশক্তির প্রকাশ!
এই কবিতার মধ্যে অক্ষরবৃত্ত ছন্দের নির্ভুল ব্যবহার আছে, ব্যবহার আছে অন্ত্যমিলের। যেমন ‘সন্ধ্যারতি’ শব্দটি যে-কবিতায় ছিল, সেখানেও অন্ত্যমিল প্রয়োগ করা হয়েছে। আমি যেসব কবিতা আজ পড়তে দিচ্ছি পাঠকদের, জয়দীপ রাউত তার প্রায় সব কবিতার মধ্যেই অন্ত্যমিল এনেছেন। কিন্তু এনেছেন খুব গোপনভাবে, যার ফলে মিল যে ব্যবহার করা হয়েছে, তা চোখেই পড়ে না। কেবল শ্রুতির মধ্যে একটি অস্ফূট ধ্বনির অণুরণন যেন কাজ করে চলে। একমাত্র দ্বিতীয় সচেতন পাঠেই অন্ত্যমিলের প্রয়োগ ধরা যায়।
এই কবি, জয়দীপ রাউত, মাঝে মাঝে তাঁর দু’ একটি সত্য-উপলব্ধিকে প্রায় ছবিবিহীনভাবে ব্যবহার করেছেন। এখন তেমনই একটি লেখা বলব, যা বক্তব্যপ্রধান– জয়দীপের অন্য কবিতারা বক্তব্যপ্রধান নয়। মূলত সঙ্কেত ও চিত্রপ্রধান। কিন্তু এখানে দেখা যায় বক্তব্যপ্রধান হয়েও কেমন একটি সারসত্য উচ্চারণ করেছেন এই কবি। এ লেখাও তিন লাইনে সম্পূর্ণ হয়েছে।
সীমা
আমিও জীবন থেকে শিখতে পেরেছি অল্পকিছু
যতদূর উড়ে যাও পাখি
তবু তুমি আকাশের চেয়ে ঢের নিচু
এই কবিতার মধ্যেও কোনও যতিচিহ্ন নেই। এবং প্রথম লাইনের পর একটি স্পেসের প্রয়োগ আছে। কেন জয়দীপের অধিকাংশ কবিতায় যতিচিহ্ন থাকে না, আর কেনই বা জয়দীপ অত সংক্ষিপ্ত আকারের কবিতার মধ্যেও বারংবার স্পেস ব্যবহার করেন? এরও দুটি কারণ অনুমানে আসে। এক, জয়দীপ তাঁর কবিতার মধ্যে নীরবতাকে প্রবেশ করিয়ে দেন। দুই, কবিতাটিকে তিনি চিরসময়ের মধ্যে ভাসিয়ে দিতেও চান– অনেকক্ষেত্রেই জয়দীপ রাউত তাঁর কবিতাকে চলমান অবস্থায় ছেড়ে দিচ্ছেন, কোনও উপসংহার আনছেন না, এমন দেখতে পাওয়া যায়। এইরকমই একটি বক্তব্যপ্রধান কবিতা জয়দীপের ‘আঁখিগুল্মলতা’ বইতে দেখতে পাচ্ছি আবারও। এ কাব্যগ্রন্থটিও অত্যন্ত শীর্ণকায়। কিন্তু এ বইয়ের ভিতরেও এমন কিছু কবিতা আছে, আছে এমনকিছু ছবি, যা বহুক্ষণ ধরে আমার মনকে আবিষ্ট করে রাখে। প্রথমে বলি একটি চিত্রনির্ভর কবিতার কথা।
স্খলিত কানের দুল
…দেখি, আকুল চুলের মধ্যে তোমার ঘুমের মুখ
পাশ ফেরা
যেন, বাগানে ফুলের টব কাত হয়ে আছে।
দুটো ফুল শুধু
বাতাসের ষড়যন্ত্রে ছেঁড়া

যে পাঁচটি লাইন বললাম, তার মধ্যে দুটি স্পেস, এবং একটিই পূর্ণচ্ছেদ আসছে। ‘আকুল চুলের মধ্যে তোমার ঘুমের মুখ/ পাশ ফেরা/ যেন, বাগানে ফুলের টব কাত হয়ে আছে।’ একটি ঘুমন্ত মেয়ের মুখ উন্মুক্ত কেশরাশির ঢেউয়ে আধো ঢাকা, পাশ ফেরা– তার তুলনা হিসেবে এল ‘যেন, বাগানে ফুলের টব কাত হয়ে আছে।’ এমন অত্যাশ্চর্য উপমা আমি কোনও ঘুমন্ত মেয়ের মুখের উপমা হিসেবে বাংলা কবিতায় এর আগে কখনও পড়িনি। নিদ্রিতা নারীর রূপ বহু কবিতায় গল্পে উপন্যাসে এসেছে আমাদের বাংলা ভাষায়– কিন্তু ‘বাগানে ফুলের টব কাত হয়ে আছে।’ – এমন নতুন অভাবনীয় চিত্রসমতা তৈরি হচ্ছে এখানে যে, আমি এ জিনিস অন্তত আমার পাঠ-অভিজ্ঞতায় পাইনি কখনও। ‘যেন বাগানে ফুলের টব কাত হয়ে আছে’ বাক্যটির পরেই পূর্ণচ্ছেদ ব্যবহার করা হয়েছে।
শেষ দুটি লাইনে পাই: ‘দুটো ফুল শুধু/ বাতাসের ষড়যন্ত্রে ছেঁড়া’– ‘পাশ ফেরা’ শব্দটির সঙ্গে অন্ত্যমিল হিসেবে ‘বাতাসের ষড়যন্ত্রে ছেঁড়া’ এসেছে– কিন্তু প্রথম পাঠে চোখে পড়ছে না– শ্রবণের ভেতর একটি স্বরসাম্য তৈরি করে দিচ্ছে পাঠকের অজান্তেই– ‘আর বাতাসের ষড়যন্ত্রে ছেঁড়া’– এই লাইনটিও অতুলনীয়। শেষতম লাইনের পরেও কোনও যতিচিহ্ন নেই। অর্থাৎ এই কবি যে বারংবার স্পেস ব্যবহার করেন ও লাইনের শেষে যতিচিহ্ন প্রায় প্রয়োগই করেন না, তার বিশেষ কারণ আছে ধরে নেওয়া যায়। এই ধারণার একটি সূত্র আমি একটু পরেই উপস্থিত করব– কিন্তু তার আগে আরও কয়েকটি কবিতার সঙ্গে পাঠকের পরিচয় করিয়ে দিতে চাই।
একটু আগে বক্তব্যপ্রধান যে-কবিতাটির কথা তুলেছিলাম, সে কবিতাটি পাঠকের সামনে রাখি এবার। এ-কবিতার মধ্যেও তিনটি লাইন প্রয়োগ করে কবির উপলব্ধ একটি সত্যকে স্থাপন করা হয়েছে– জয়দীপ রাউতের কবিতার যা একটি প্রধান চরিত্র, চিত্রধর্ম, সেই ধর্মটি এ কবিতায় পাওয়া যাবে না। তবু এর মধ্যে উপস্থাপিত সত্যের ধারণাটি পাঠককে স্তব্ধ করে রাখবে। কবিতাটি বলি:
রূপ
মৃত্যু কিছু নয়
সে আমার অধুনা জন্মের
পূর্ব পরিচয়
কোনও যতিচিহ্ন নেই, কোনও স্পেস নেই কবিতায়– কেবল কবির জ্ঞানলব্ধ একটি সত্যবার্তা পাঠককে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই তিনটি লাইনের মধ্যে এসে পড়ে বুদ্ধ-কথিত জাতকের কাহিনিছায়া, ফলে জাতিস্মর স্মৃতিমালার অনুষঙ্গের দিকে পাঠকের মনকে নিয়ে যায় এ কবিতা। এইবার নিয়ে আসছি আরও এক কবিতা। চারটি পঙক্তি দ্বারা প্রস্তুত এই কবিতাও অক্ষরবৃত্তে চলেছে– কিন্তু, অন্তত দুটি লাইনে ছন্দের অপূর্ণপর্ব আসেনি– চার মাত্রা রেখে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে চার লাইনের কবিতার দুটি লাইনকেই। কেন, সেকথায় আসার আগে, পাঠক কবিতাটি পড়ে দেখুন একবার।
যম
দূরে তীর।
চন্দ্রাহত এক সমাধিসৌধের দিকে চেয়ে থেকে
জলে চোখ
ভরে গেছে যমুনাদিদির
এই কবিতারও শেষ লাইনের আগে একটি স্পেস প্রযুক্ত হয়েছে। প্রথম লাইনটিতে একটি পূর্ণচ্ছেদ ব্য়বহৃত। পরের তিন লাইনে কোনও যতিচিহ্নই নেই। আরও একটি কথা। ছন্দকৌশলে দ্বিতীয় লাইনটির সমাপ্তিও এমনভাবে করা হয়েছে, যার ফলে পাঠককে তৃতীয় লাইনটির দিকে শ্বাস ধরে রেখেই আসতে হয়, এবং লাইনটির শেষে একটি সাসপেন্সও থাকে। প্রথমেই পাচ্ছি ‘দূরে তীর’ এই দুটিমাত্র শব্দ। তারপর পূর্ণচ্ছেদ। এরফলে তীর যে অনেক দূরে দেখা যাচ্ছে, তা সঙ্কেতায়িত হল– এবং পরবর্তী লাইনটিতে আমরা যে দেখতে পাব একজন নির্নিমেষ চেয়ে আছে চন্দ্রালোকধৌত এক সমাধিসৌধের দিকে– তার পূর্বভূমিকাও প্রস্তুত হয়ে উঠল যেন। তৃতীয় লাইনও চার মাত্রা দিয়ে তৈরি। দুটিমাত্র শব্দ– ‘জলে চোখ’– আশ্চর্য এই যে, সেখানেও কোনও যতিচিহ্ন নেই। এমনকী লাইনটির পরে একটি স্পেসও প্রযুক্ত হয়েছে। এরফলে কী ঘটছে? ওই সাসপেন্স, কৌতূহল, আগ্রহ বেড়ে যাচ্ছে পাঠকের। অন্তত আমার তো বাড়ছেই।

কার চোখ? কে চেয়ে আছে? এইসব প্রশ্ন মনে আসে এবং মনের ভিতর ডুবে যায় ক্ষণবিদ্যুতের মতো। মোটেই এই সাসপেন্স, কৌতূহল, আগ্রহ স্থায়ী হয় না– কারণ ততক্ষণে এসে পড়ে কবিতার সমাপ্তিসূচক লাইনটি। আমরা জানতে পারছি ‘জলে চোখ/ ভরে গেছে যমুনাদিদির’। কবিতাটির মধ্যে আবারও একটি লুকনো খেলা আছে অনুচ্চকিত ছন্দের। উচ্চকিত ছন্দের খেলা অনেক দেখা যায়। কিন্তু খেলাকে লুকিয়ে রেখে পাঠককে তার মধ্যে প্রবিষ্ট করানো বড় শক্ত কাজ। ছন্দের প্রকৃতিকে তার কেন্দ্রস্থ অবস্থা থেকে না-জানলে এমন সূক্ষ্মকৃতি সম্ভব নয়।
এ কবিতায় আসলে দ্বিতীয় লাইন থেকে চতুর্থ বা শেষ লাইন পর্যন্ত পাঠক প্রায় একই টানে কবিতাটি পড়ে যেতে বাধ্য হন, যদিও দ্বিতীয় লাইনে– সামান্য শ্বাসবিরতি নেওয়ার জন্য– লাইনের প্রথমে ছয় মাত্রার একটি বাক্য রাখা হয়েছে। ইচ্ছে করেই প্রত্যাশিত দু’মাত্রা দিয়ে ছন্দের ওই ফাঁকা জায়গাটি পূরণ করা হয়নি। কারণ কবিতাটির শেষের দিকে আমরা পাব এই কথা, ‘জলে চোখ/ ভরে গেছে যমুনাদিদির’। সে তো এক শূন্যতারই কথা। তাই শেষ লাইনের আগে স্পেস রেখে কবিতাটির মাঝখানে দুটি চার মাত্রার লাইন রেখে– একটি লাইনের প্রথমে ছয় মাত্রা ব্যবহার করে কবিতার ফাঁকে ফাঁকে শূন্যতা ভরে দেওয়া হয়েছে।
কেন জয়দীপের অধিকাংশ কবিতায় যতিচিহ্ন থাকে না, আর কেনই বা জয়দীপ অত সংক্ষিপ্ত আকারের কবিতার মধ্যেও বারংবার স্পেস ব্যবহার করেন? এরও দুটি কারণ অনুমানে আসে। এক, জয়দীপ তাঁর কবিতার মধ্যে নীরবতাকে প্রবেশ করিয়ে দেন। দুই, কবিতাটিকে তিনি চিরসময়ের মধ্যে ভাসিয়ে দিতেও চান– অনেকক্ষেত্রেই জয়দীপ রাউত তাঁর কবিতাকে চলমান অবস্থায় ছেড়ে দিচ্ছেন, কোনও উপসংহার আনছেন না, এমন দেখতে পাওয়া যায়।
এই কবিতার নাম ‘যম’। কেন এই নামকরণ? আমি ধরতে পারিনি পুরোটা। হাল্কা আন্দাজ পেয়েছি মাত্র। ওই যে শঙ্খ ঘোষ একবার মনে করিয়ে দিয়েছিলেন আমাদের ১৯৭৮ সালে লেখা একটি প্রবন্ধে:
“গ্যয়েটে থেকে এলিয়ট পর্যন্ত অনেকেরই সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের মিল হবে এই ধারণায় যে ‘Art is perhaps most effective when imperfectly understood.’”
হ্যাঁ, রবীন্দ্রনাথেরই এই উক্তি। এখানে আমরা বুঝে নিতে পারি যে ‘যম’ নামকরণটি তার পুরো অর্থ পরিস্ফূট না-করলেও কবিতাটি তো আমাকে টেনে রাখছে! কেন? চন্দ্রালোকে দাঁড়িয়ে থাকা এক সমাধিসৌধ কী হতে পারে? তাজমহল কি? বেশ। তাই যদি হয়, তাহলে তো যমুনা সেই সমাধিসৌধের কাছাকাছিই থাকবে, বা আছে। তবে তো আর সংশয় রইল না। কিন্তু একেবারেই রইল না কি? ‘জলে চোখ/ ভরে গেছে যমুনাদিদির’– যেই যমুনা নদীর বদলে ‘যমুনাদিদির’ শব্দটি এল, সঙ্গে সঙ্গে সে একটি মেয়ে হয়ে গেল। এমনকী বলা যায় মধ্য তিরিশের একটি নারীতে রূপান্তরিত হল সে?
‘জলে চোখ’ কথাটির পরে কোনও যতিচিহ্ন নেই, বরং আছে স্পেস– প্রত্যেকটি স্পেস এক নৈঃশব্দ ঘন করে আনে জয়দীপ রাউতের কবিতায়। শেষ লাইনে ‘ভরে গেছে যমুনাদিদির’ কথাগুলি আমাদের দেখায় জ্যোৎস্নালোকিত রাত্রে একাকিনী এক নারীর দাঁড়িয়ে থাকা। আবছা ছায়াচিত্র যেন। রমণী এক মধ্য ত্রিশের যুবতী। কারণ ‘দিদি’ শব্দটি যুক্ত হয়েছে যে যমুনা কথাটির সঙ্গে। তৎক্ষণাৎ আমরা ফিরে যাই কবিতাটির প্রথম লাইনে– ‘দূরে তীর’। এইখানে পূর্ণচ্ছেদ। কারণ? কারণ এই দূরত্ব কখনও ঘুচবে না। অর্থাৎ কবিতাটি সমাপ্ত হওয়ার পর সে আবার আমাদের নিয়ে যায় তার সূচনার শব্দদুটিতে। দূরত্ব ঘুচবে না। কেন? কারণ এইখানে মৃত্যু পদার্পণ করেছিল কখনও। তাই ওই দূরত্ব এক চিরদূরত্ব। মৃত্যুর সঙ্গে কী জড়িত? যম। এইভাবে সঙ্কেত ও চিত্রময় এই কবিতা এক অসামান্যতায় পৌঁছে যায়।

অবশ্য এখানে খুব সঙ্গত একটি প্রশ্ন উঠতে পারে। তাজমহলই যদি হয়, তাহলে তো শোকাহত হয়েছিলেন এক পুরুষ– সম্রাট শাহজাহান। স্ত্রী মমতাজ মহলের মৃত্যুর কারণে। সেই সূত্রেই তো সমাধিসৌধের নির্মাণ। তাহলে এখানে মধ্য তিরিশের এক যুবতীর কথা মনে পড়ছে কেন আমার? ‘যমুনাদিদির’ শব্দটির কারণে? এবং সেই নারীর চোখ জলে ভরে যাওয়ায়? আমি কি ইতিহাস থেকে ভ্রষ্ট হচ্ছি না? হচ্ছি নিশ্চয়ই। তবে আমার যে ‘যমুনাদিদির’ শব্দটি পড়ে এক নারীর জ্যোৎস্নার মধ্যে একাকী দাঁড়িয়ে থাকার ছবি মনে এল– কী করব? এক্ষেত্রে আমি তো নিরূপায়! অন্যপক্ষে, একজন কবি তো অবিকল ইতিহাস-ই অনুসরণ করেন না– অনেকসময়ই ইতিহাসকে ভেঙে নিজের চিন্তাকল্পনা প্রবেশ করিয়ে দেন প্রচলিত কাহিনির মধ্যে। রবীন্দ্রনাথ যে তাঁর এক বিখ্যাত কবিতায় বারবার বলছেন, ‘ভুলি নাই ভুলি নাই ভুলি নাই প্রিয়া’– বলেছেন তো? বলতে বলতে একজায়গায় এই লাইনটি লিখে একটি স্পেস ব্যবহার করলেন।
স্পেসের পরেই গর্জে উঠলেন: ‘মিথ্যা কথা! কে বলে যে ভোল নাই?’ এই যে ‘মিথ্যা কথা!’ বলামাত্র রবীন্দ্রনাথ একটি নাট্যমুহূর্ত তথা এলিয়টের ‘ফোর কোয়ার্ট্রেটস’-এর কথাই যদি ধরি, তাহলে ‘কাউন্টার মুভমেন্ট’ তৈরি করলেন– সেও কি ইতিহাসকে একটু ভেঙে নিজের চিন্তাকল্পনার প্রবেশ ঘটানো নয়? একটা কথা বলে রাখা ভালো, রবীন্দ্রনাথ যখন এই দীর্ঘকবিতা রচনা করছেন, ‘ফোর কোয়ার্ট্রেটস’ এলিয়টের হাতে রচিত হবে তার অনেকটাই পরে। ফলে জয়দীপ রাউতের লেখা ‘যম’ নামক কবিতাটির ক্ষেত্রে আমার মন যদি ইতিহাসচ্যুত হয়ে থাকে, তাহলেও কবিতাটির আকর্ষণ ক্ষুণ্ণ হয় না। (চলবে)
দ্বিতীয় পর্ব প্রকাশিত হবে ১২ মার্চ
*ছবি সৌজন্য: Artmajeur, Femina, Shazam, Pixels, Pinterest, Artzolo
জয় গোস্বামীর জন্ম ১৯৫৪ সালে, কলকাতায়। শৈশব কৈশোর কেটেছে রানাঘাটে। দেশ পত্রিকাতে চাকরি করেছেন বহু বছর। আনন্দ পুরস্কার পেয়েছেন দু'বার - ১৯৯০ সালে 'ঘুমিয়েছ ঝাউপাতা?' কাব্যগ্রন্থের জন্য। ১৯৯৮ সালে 'যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিল' কাব্যোপন্যাসের জন্য। ১৯৯৭ সালে পেয়েছেন বাংলা আকাদেমি পুরস্কার। দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন কবিতার সাহচর্যে। ২০১৫ সালে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাম্মানিক ডি.লিট পেয়েছেন।