আজ তিনি নব্বই স্পর্শ করলেন। তিনি শ্রীশঙ্খ ঘোষ। আমাদের নতজানু প্রার্থনা, তিনি শতায়ু হোন। থাকুন সৃজনশীল ও সাবলীল। তাঁর আপসহীন প্রতিবাদী ভাষা প্রিয় অভিভাবকের মতোই বাঙালিকে রাখুক উজ্জীবিত, সটান মেরুদণ্ডবান।
আজ তিনি নব্বই ছুঁলেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি শতক দশকের হিসেব ছাপিয়ে গিয়েছেন অনেক আগেই, যখন একের পর এক লিখেছেন অবিস্মরণীয় পঙ্ক্তিসমূহ।
ডানায় রক্তের দাগ, উড়ে তুমি কোথা থেকে এলে
এই অশথের নীচে দুদণ্ড জিরোও, এর নীচে
কোনো ক্লান্তি ক্লান্তি নয়,কোনো ক্ষোভ নয় কোনো ক্ষোভ
তোমারও তো শেষ নেই, তুমি কেন ভাবো অপারগ?

কী নির্জন, অথচ কী দুর্বার ও শক্তিমান এই কাব্যভাষা। এখানেই তাঁকে একেবারে স্বতন্ত্র মনে হয় জীবনানন্দ দাশ পরবর্তী অগ্রগণ্য কবিকুলের মাঝে। তাঁর জীবনচর্যা যেমন এক সংযম-দৃষ্টান্ত দেয়, তেমনই তাঁর কবিতাগুলি। চিৎকার নেই, হুঙ্কার নেই, শুধু উপস্থিতির মধ্যেই প্রাবল্য। এমন নির্জন, নিরালাপ্রিয়, স্বল্পবাক কবিমানুষ , এমন সংযত ও সুচারু স্রষ্টা, অনায়াসে যখন এসে দাঁড়ান জনতার মাঝে, দৃপ্ত পদক্ষেপে হেঁটে যান, সেই উপস্থিতি, সেই শব্দের মধ্যে নৈঃশব্দ্য, সেই জনতার মধ্যে একক, সেই নিরুচ্চারের উচ্চারণ, ক্রমাগত সতর্ক করে দেয় অশুভকে। অকল্যাণ পরাভূত করার ব্রত করে বলীয়ান। এই মুহূর্তে, বলতে দ্বিধা নেই, তিনি বাঙালির নৈতিক অভিভাবক। কবি হিসেবে অনন্য। মানুষ হিসেবেও। একজন সৃজনশীল ব্যক্তিকে যে মনুষ্যত্ব ও বিবেক জলাঞ্জলি দিতে নেই, শঙ্খ ঘোষ নিরন্তর তা শিখিয়ে চলেছেন।
তাঁর কাব্যের ঋজুতা ও নমনীয়তার সহাবস্থান যেন সোনার জলের আখর। সেখানে কাব্য কেবল রহস্যাচ্ছন্ন হয়ে থাকে না। কাব্যিকতাও থাকে না কেবল আত্মপর আর্তি হয়ে। তাঁর নিজ হৃদয়, অপর হৃদয়ের বাণী হয়ে ওঠে। এত অনায়াস সেই সেতুবন্ধন, যে আলাদা করে চোখেও পড়ে না। যেমন করে উস্তাদ ও পণ্ডিত মঞ্চে অনায়াসে ফুটিয়ে তোলেন রাগরূপ, মুগ্ধ শ্রোতা সুরের আবেশে ভাবতেও ভুলে যান শিল্পীর অন্তরালের কঠিন সাধন কত সংগ্রামী, শঙ্খ ঘোষের কবিতাও তেমনই। তাঁর বিবেক জাগরূক রেখে চলার প্রক্রিয়াও তার বাইরে নয়। নিজ চর্যায় স্থিত থাকার চেয়ে বড় যুদ্ধ আর কিছুই নয়। এই বোধ থেকেই হয়তো তৈরি হয়েছিল কপিলাবস্তুর মহান দার্শনিক বুদ্ধদেব সম্পর্কিত সেই মিথ, সেই মারের কাহিনি। নানাবিধ ভয়, প্রলোভন, ত্রাস যেখানে ব্যর্থ হয়।
শঙ্খ ঘোষের কাব্য দেখিয়ে দেয়, বিদ্রোহ মানেই অশালীন দাহন নয়, প্রতিবাদ মানেই নিষ্ঠুর আক্রমণ নয়, প্রশ্ন তোলা মানেই নয় রুচিবোধবিবর্জিত মুষ্টিযুদ্ধ বা ধ্বংস। তাঁর বিদ্রোহ, প্রতিবাদ, প্রশ্ন জড়িয়ে থাকে ভালবাসা। এই ভালবাসা ব্যক্তিকে জগতের সঙ্গে যুক্ত করে। ব্যক্তি যে বিচ্ছিন্ন অস্তিত্ব নয়, এই অমোঘ সত্য সহজে ভুলে যাওয়া গোষ্ঠীর মধ্যে থেকে এই কবি কেবলই স্মরণ করিয়ে চলেছেন, তুমি আছ তাই আমি-র অস্তি অর্থময়। অণু যেমন বৃহৎ রূপে মহাবিশ্ব, তেমনি মানব তার ক্ষুদ্র সত্তা ছাপিয়ে ক্রমে পূর্ণ ও বৃহতের সন্ধান পায়, বাকি পৃথিবীর সঙ্গে আত্মচেতন যোগ করে। এখানেই প্রেম হয়ে ওঠে ভালবাসা। প্রেমের তুমি-আমি, প্রেমের আত্মপ্রতিকৃতি সকলের স্রোতে মিশে ভালবাসা আখ্যা পায়।
আবার ভালবাসার গভীরতার সন্ধান যে জানে, তার মতো প্রেমী আর কে? ব্যক্তিগত প্রেমেও তার সিদ্ধি। প্রেম ও ভালবাসা, মানুষের ইতিহাসে এর চেয়ে বেশি প্রয়োজন আর কোনও কিছুরই নেই। ভালবাসাই মানুষের অস্তিত্বের প্রথম ও শেষ শর্ত। বিপ্লব চেতনার অন্যতম মুখ চে গেভারা মানুষকে ভালবেসেছিলেন বলেই কিউবা বিপ্লব সফল হাওয়ার পর থেমে যাননি, মুক্তির স্বপ্ন নিয়ে ছুটে গেছেন দক্ষিণ আমেরিকার দেশে দেশে, আফ্রিকার দরিদ্র, নিপীড়িত মানুষের পাশে। কিংবা ধরা যাক দার্শনিক প্লেটোর কথা। জীবনসত্যের বিচিত্র উপলব্ধি থেকে তিনি পৌঁছেছিলেন সেই বাণীতে, সেই দর্শনে, “সত্যবাদীই সবচেয়ে বেশি অসম্মানিত হয়।”
এই অসম্মানিত শব্দটি প্রতিস্থাপিত করা যায় ঘৃণা দ্বারা, লাঞ্ছনা, অপমান, অবহেলা বা বঞ্চনা দ্বারা। কিন্তু প্লেটো সত্যভাষণ বন্ধ করেননি। যেমন করেননি গ্যালিলিও। তাঁরা সত্যপ্রিয় ছিলেন, সেই সত্য মানুষ। সেই সত্য মানুষের প্রতি ভালবাসা। শঙ্খ ঘোষের কবিতায় সেই সত্য। সেখানে মানুষ তার চেতনা নিয়ে উপস্থিত, সেই চেতনার রঙ ভালবাসার তুলি দিয়ে রাঙানো। কবি তো দার্শনিক হবেনই, আত্মমোহে অন্ধ হলে তিনি কেবল সেই উপস্তরীয়ে প্রেমে মশগুল থেকে যাবেন, যা দেহ অতিক্রম করে না। কিন্তু শঙ্খ ঘোষ চক্ষুষ্মান, তিনি দার্শনিক এবং তাঁর কবিহৃদয়ে বসবাস করেন এক দ্রোহী, ভালবাসা ও শৈল্পিক তরবারির মতো শব্দবন্ধে যিনি হয়ে ওঠেন শীতল আগুন।

যে কবিতার উল্লেখ ইতিপূর্বে করা হয়েছে, সেই নামহীন কবিতার শেষ চার পঙ্ক্তি উদ্ধার করা যাক এই মর্মে:
ডানার সীমানা নেই, নাশকের নিশানা পেরিয়ে
কোথায় তোমার বাড়ি কোথায় তোমার দেশগাঁও—
গ্রহতারকার নীচে পড়ে আছে সজল সময়
বুকে হাত দিয়ে বলো আজও তাকে কতখানি চাও।
কী অপরিসীম ভালবাসা এই শেষে। কী অমোঘ প্রশ্ন। এসো প্রেমিক, বলো প্রেমিকাকে, এসো মেয়ে, বোলো সেই পলায়নী পুরুষকে, এসো দেশ, বলো ক্ষমতাধর সেইসব প্রতিষ্ঠান বিধাতাদের, বলো, কতখানি চাও। কতদিন আগে লেখা এ কবিতা, তবু আজও কত প্রাসঙ্গিক। মনে হয়, এই কয়েকমাস আগে, তালাবন্ধ দেশে গৃহাভিমুখী শ্রমিকেরা শুয়ে আছে রেললাইনে মাথা ছিল। মাথা নেই। ছিন্নভিন্ন ঘুমন্ত দেহাংশ পড়ে আছে রক্তমাখা অকরুণ পাথরে পাথরে, তার দিকে তাকিয়ে যেন যন্ত্রণাকাতর কবি লিখছেন, ডানার সীমানা নেই, নাশকের নিশানা পেরিয়ে/ কোথায় তোমার বাড়ি কোথায় তোমার দেশগাঁও— বলছেন, ‘বুকে হাত দিয়ে বলো আজ তাকে কতখানি চাও।’
শঙ্খ ঘোষ প্রণম্য, প্রতিবাদী, নম্র বিপ্লবী, প্রেমিক ও সত্যবাদী। রোগক্লেশ সত্ত্বেও তিনি প্রতিবাদী পদক্ষেপে মানুষের সঙ্গে চলেছেন, মূঢ়ের লাঞ্ছনায় বিচলিত না হয়ে থেকেছেন নির্লিপ্ত, সন্ত্রাসের কবলিত না-হয়ে লিখে গিয়েছেন একের পর এক বৈপ্লবিক কবিতা, যা সচেতন বাঙালি মশালের মতো মিছিলের পুরোভাগে রেখে চলবে।

মনে পড়ে ‘অন্ধবিলাপ’ কবিতায় ধৃতরাষ্ট্রের উক্তি:
“সর্বনাশে সমুৎপন্নে অর্ধেক কি ছাড়তে হবে?
টুকরো টুকরো করব কি দেশ পিছিয়ে গিয়ে সগৌরবে?
যে যাই বলুক এটাই ধ্রুব—আমার দিকেই ভিড়ছে যুব”
মনে পড়ে ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’ কবিতায়,
“বিকিয়ে গেছে চোখের চাওয়া
তোমার সঙ্গে ওতপ্রোত
নিওন আলোয় পণ্য হলো
যা-কিছু আজ ব্যক্তিগত।”
মনে পড়ে আরও কত কবিতাই, মনে পড়িয়ে দেওয়াই তাঁর ক্ষমতা। যেমন এক অবিকল্প কলম তাঁর গদ্য রচনা করে।
এতটুকু প্রচারের পরোয়া না করে তিনি গদ্য লিখেছেন নিয়মিত। পুষ্টাকার কয়েক খণ্ড। খ্যাতির মুকুট স্বয়ং সরস্বতী এসে পরিয়েছেন তাঁর গদ্যকীর্তিকে। ‘জার্নাল’ বা ‘এ আমির আবরণ’ যেমন বিষয়ই হোক না কেন, তাঁর সম্বন্ধে এ কথার অবকাশ নেই, তাঁর কবিতা যেমন, গদ্য তেমন নয়। দু’টি দু’রকম শক্তি নিয়ে বাংলা সাহিত্যসম্ভার সমৃদ্ধ করেছে। এবং রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ও মুগ্ধতা এতটুকু গোপন না করে, বিপুল অহমিকায় রবীন্দ্রনাথকেই আপন প্রতিপক্ষ ঘোষণা না-করে তিনি থেকেছেন বিনম্র বিশ্লেষক হয়ে। তাতে তাঁর নিজের প্রাপ্তির আলোক ঠিকরে পড়েছে যে আলোচনায়, তা পাঠককে দেয় রবীন্দ্রদর্শন পাঠের দৃষ্টি ও আলোকবর্তিকা। ‘এ আমির আবরণ’ থেকে একটি অংশ দেওয়া গেল এ কথার সমর্থনে:
“উপরের এই আবরণ যখন ছেড়ে দেয় গান, যখন ‘সীমার মাঝে অসীম তুমি’ থেকে পৌঁছই ‘আজ যেমন করে গাইছে আকাশ তেমনি করে গাও’-এর দিকে, তখনই ওই দুই পর্যায় একজায়গায় এসে মেলে। বলা যায়, তখন পূজা আর প্রেম এই দুই শ্রেণীর বাইরে যেন কল্পনা করে নেওয়া যায় তৃতীয় আরেকটি শ্রেণী, যাকে বলি ভালোবাসার গান। আত্ম–আবরণ মোচনের প্রবল বেদনায় মথিত হয়ে উঠে এই গানগুলি দাবি করে আমাদের সমস্ত সত্তা, আর তখন মনে হয় এর চেয়ে বড়ো মন্থন, এর চেয়ে বড়ো প্যাশান বা বাসনার তাপ আর যেন নেই আমাদের অভিজ্ঞতায়। পুরুষ আর নারী পরস্পরকে নিয়েই এই তাপ; কিন্তু কেবলই পুরুষ আর নারী নয়। আমি আর আমার ভিতরে–বাইরে ব্যাপ্ত এক না–আমি, অর্থাৎ তুমি, এ–দুয়ের মধ্যে এক নিবিড় বেদনাসম্পর্ক জাগিয়ে তোলে গানের সেতু।
রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়তে গিয়ে যে তেইয়ার–দ্য–শার্দ্যাঁর কথা মনে পড়েছিল ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর, সেই শার্দ্যাঁ বলেছিলেন: নিজেকে যদি বিশ্বপরিধিতে বাড়িয়ে না নেয় মানুষ, তবে সে আলিঙ্গন করতে পারে না তার প্রিয়াকে। আর বিশ্ব তো কেবলই জায়মান, কেবলই সঞ্চরমাণ, অপূর্ণ কেবলই, তাই ভালোবাসার জন্য মানুষের সামনে পড়ে থাকে এক নিরন্তর আত্মনির্মাণ।… নারীর মধ্য দিয়েই পুরুষ তার ছিন্নতার গণ্ডি থেকে মুক্তি পায়, বলেছিলেন তিনি (ঠিক যেমন রবীন্দ্রনাথও বলেছিলেন তাঁর ‘পার্সোন্যালিটি’র প্রবন্ধগুলিতে), মুক্তি পায় বিশ্বের দিকে। রবীন্দ্রনাথ যেমন দেখতে চান
এ আমির আবরণ সহজে স্খলিত হয়ে যাক;
চৈতন্যের শুভ্র জ্যোতি
ভেদ করি কুহেলিকা
সত্যের অমৃতরূপ করুক প্রকাশ।
সর্বমানুষের মাঝে
এক চিরমানবের আনন্দকিরণ
চিত্তে মোর হোক বিকীরিত।
… রবীন্দ্রনাথের কাছে ভালোবাসা তিন শব্দের যোগ: তুমি আমি আর গান— তোমার আমার বিরহের অন্তরালে কেবলই তার সেতু বেঁধে যায় যে–গান, প্রেমের নয় শুধু, ভালোবাসার গান।”

শঙ্খ ঘোষ যেন এক একলব্য শিষ্য। নিজস্ব জ্ঞান ও পাণ্ডিত্যের গভীরতায় তিনি রবীন্দ্রনাথের জীবনসত্যগুলি পড়ে নিচ্ছেন মগ্ন হয়ে। রবীন্দ্ররচিত উপন্যাস, গান, গল্প, কাব্য, নাটক, প্রবন্ধ— এই সব নিয়ে তাঁর চলা। এতে শঙ্খ ঘোষের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য এতটুকু নিরালোক হয়নি। বরং তিনি যেমন রবীন্দ্রের পথ চিনিয়ে চলেছেন বাংলার পাঠককে, একালের পাঠক চলেছে রবীন্দ্রের সঙ্গে সঙ্গে তাঁকেও চিনতে চিনতে। আজ এই নব্বইয়ের সীমানায় তিনিও নিশ্চয় আশীর্বাদ করছেন তাঁর অগণিত অনুগামী ও ছাত্র ও ভক্তদের।
তিলােত্তমা মজুমদারের জন্ম উত্তরবঙ্গে। কালচিনি চা-বাগানে ইউনিয়ন একাডেমি স্কুল, আলিপুরদুয়ার কলেজ এবং স্কটিশ চার্চ কলেজে পড়াশোনা। ১৯৯৩ থেকে লিখছেন। সাহিত্য রচনার প্রথম অনুপ্রেরণা দাদা। ভালবাসেন গান ও ভ্রমণ| ‘বসুধারা' উপন্যাসের জন্য পেয়েছেন আনন্দ পুরস্কার এবং সেইসঙ্গে পেয়েছেন আরও অন্যান্য সাহিত্য পুরস্কার। ২০১৭-তে অংশ নিয়েছেন আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সাহিত্য কর্মশালায়।
শ্রদ্ধা এবং প্রণাম কবি কে। লেখাটি খুব ভালো।
খুব ভাল লাগল৷
Kobi Shankha Ghosh k amar pronam.. Apnar satayu kamona kori.
Lekhati khub sundor…
খুবই ভাল লাগল
খুব সুন্দর লেখা ৷
Valo laglo Tilottama. tomar songe sei 2004 sale alap Joy Goswamir Jadabpurer flat ay dinner ay. Chhilen Badal Bau, Anita agnihotri ebong aro keu keu. Valo thakbe.