এই সব সারেগামা পেরিয়ে যখন তোমার কাছে দু’দণ্ড বসতে ইচ্ছে করে, তখন মনে পড়ে, এই শীতকালে তো তোমার রক্তে কে যেন ব্যাঙের রক্ত ঢুকিয়ে দেয় আর তুমি তিনমাস ঘুমিয়ে থাক। ঠিক তোমার মতো করে নয়, কিন্তু আমিও এই শীত এলেই, হয়তো তোমার চিলেকোঠার এক বিষণ্ণ বাসিন্দা হয়ে পড়ি, যে রাতে শুনতে পায় কোথা থেকে জল পড়ছে, কিন্তু দেখা যায় তা কারোর পেচ্ছাপ করার শব্দ।
শৈশব থেকে আমারও নদীর পাশেই বড় হয়ে ওঠা। কিন্তু তোমার নাগরিক বিষাদের সঙ্গে আমি একাত্ম হয়ে উঠতে পারিনি ততদিন, যতদিন আমি তোমাকে ভুল করে নাগরিক হিসেবেই দেখেছি। মনে হত, এই কবি কেন কখনও বেড়াতে যান না, হিমালয় বা সমুদ্র বা মরুভূমি বা কোথাও? তারপর মনে হত, কেনই বা যাবেন! বরং আপনি যান।

ভাস্কর চক্রবর্তী আসলে তীব্রভাবেই মানুষের ভিতরটা দেখতে পেতেন এই সময়ের সমস্ত হিংস্র স্মার্টনেস পেরিয়ে।এই দেখতে পাওয়ার মধ্যে যেহেতু একধরনের প্রজ্ঞাশাসিত মনন কাজ করত, তাই তার সঙ্গে মিশে যেত এক অনন্তকালীন নীরবতার ভাষা। ভাস্কর চক্রবর্তী তাঁর জীবনের মতোই, কখনও কবিতাতেও উচ্চ গলায় কথা বলেননি। যেন এক তীব্র অভিমান আর তার সঙ্গে মিশে আধুনিক পৃথিবীর সাদা ফ্যাকাশে ফ্যাটফ্যাটে মর্গের মতো বাস্তবতার দিকে মুচকি হেসে ওঠা, যে হেসে ওঠার মধ্যে রয়েছে এক শীতল উদাসীনতা। জীবনের মধ্যে থেকেই কবি জীবনের বাইরে চলে যেতেন। যেন মিছিলের বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে মিছিলটাকে দেখা। এই দেখার মধ্যে কি মিছিলে কিছুটা হেঁটে যাওয়াও নেই? রয়েছে।
আসলে এই হেঁটে যাওয়া এতটাই পিশাচের হাসির সামনে একজন শান্ত মানুষের দাঁড়িয়ে থাকার মতো, যে সেই রাজনীতিটিকে ভাল করে বুঝতে পারা যায় না। ভাস্কর চক্রবর্তীর কবিতা আমার কাছে তিয়েন আন মেন স্কোয়্যারে আগুয়ান ট্যাঙ্কের সামনে একা দাঁড়িয়ে থাকা সেই নিস্পৃহ লোকটির মতো, যে জানে, সে এক প্রবল রাজনৈতিক কাজ করছে, কিন্তু সে সেই কাজটি সম্পর্কেও খুব উচ্চকিত নয়। সে শুধু ট্যাঙ্কের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। একা। এটিই তাঁর রাজনীতি।
ভাস্কর চক্রবর্তী কলকাতার মফসসলে বসে সারা বিশ্ব ঘুরে বেড়াতে পারতেন। আসলে একজন কবি বা শিল্পীকে কখনওই খুব একটা বিশ্ব-পর্যটক হতে হয় না, যদি তিনি তপস্বী হেরোডোটাসের মতো রোদ পোহাতে পোহাতে স্বয়ং আলেকজান্ডারকেও বলতে পারেন, রোদ থেকে একটু সরে দাঁড়ানোই যথেষ্ট।

‘শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা’য় রাস্তা থেকে কুড়িয়ে নিয়ে যে ভাষায় কবিতা লিখতে শুরু করেছিলেন কবি ভাস্কর চক্রবর্তী, তাতে প্রেম, রাজনীতি, বিষাদ, সবকিছুই যেন জীবনানন্দ দাশের ‘সাতটি তারার তিমির’ কাব্যগ্রন্থের পরবর্তী পর্যায়ের অভিযান বলে মনে হত। ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়, এক্ষেত্রে জীবনানন্দ ছাড়াও প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ও তাঁর কবিতাকে সমৃদ্ধ করেছে। কিন্তু সেই সমৃদ্ধি, বহিরঙ্গের কিছু কিছু জায়গায়। হয়তো বাচনভঙ্গিতে। ছোট ছোট শৈলীতে। কিন্তু কিছুকালের মধ্যেই, ভাস্কর সম্পূর্ণ নিজস্ব এক কাব্যভাষায় যে কবিতা লিখতে শুরু করেছিলেন তার প্রমাণ আমরা পেয়ে যাই ‘স্বপ্ন দেখার মহড়া’, ‘আকাশ অংশত মেঘলা থাকবে’, ‘রাস্তায় আবার’, ‘দেবতার সঙ্গে’, ‘জিরাফের ভাষা’ ও ‘কীরকম আছ মানুষেরা’ কাব্যগ্রন্থগুলিতে।
এমন একটা নিরুপদ্রব পৃথিবীর স্বপ্ন দেখতেন কবি ভাস্কর চক্রবর্তী, যেখানে মানুষ মানুষকে সম্মান করবে, দু’টাকার কাগজের হিসেবে মানুষ মানুষকে বিচার করবে না। এই প্রজ্ঞা তাঁর ভিতরে জন্ম নিয়েছিল্, তাঁর ভিতরে মৃত্যুর এক গভীর ছায়া সবসময় কাজ করত বলেই। প্রতিটি কবিতায় মৃত্যুর অনিবার্য উপস্থিতি তাঁর কবিতাকে যে সময়ের নীরব শাসনে দীক্ষিত করেছে, এ বিষয়ে আর নতুন করে কিছু হয়তো বলার নেই। এমিলিও সুবিয়েলা পরিচালিত ‘দ্য ডার্ক সাইড অফ দ্য হার্ট’ ছবিতে যেমন একজন কবি রাস্তার মোড়ে গাড়ির জানলায় মুখ বাড়িয়ে কবিতা বলেন, এ ঠিক তেমন নয়। কিন্তু ভাস্কর চক্রবর্তীর কবিতা আমাদের জীবনের অন্তর্গত বিপন্নতাকে যেন টেনে টেনে বের করে আমাদের দেখায়, জীবনকে অশান্ত করে তোলে। মাঝেমাঝে মনে হয়, এই কবি তো না এলেই পারতেন! এত যন্ত্রণার মুখোমুখি কেন যে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছেন, অথচ পরমুহূর্তেই মনে হয়, সেই যন্ত্রণার সামনেই তো দাঁড় করিয়ে দিচ্ছেন, যাকে চেনার জন্য আমাদের কবিতা লেখা।
ভাস্কর চক্রবর্তীর কবিতা একজন সম্পূর্ণ আধুনিক মানুষের লেখা কবিতা, যিনি সময়ের কথা বলছেন সময়ের দিকে তাকিয়েই। একমাত্র তিনিই পারতেন একটা ওভারকোট পরে বারান্দা হয়ে অন্য একটা ঘরে চলে যেতে। ভাস্কর চক্রবর্তী আমাদের যেমন নিজস্ব বিপন্নতার মুখোমুখি দাঁড় করান, তেমনই আমাদের সঙ্গে পরিচয় ঘটান এক হিংস্র পৃথিবীর। যে হিংস্র পৃথিবীর স্মার্টনেস তাঁর জন্য নয়। যে পৃথিবীর বিষ তাঁর রক্তে মিশে আছে। শুধু কি তাঁরই রক্তে মিশে আছে? এই বিষ তো আমাদের সকলের রক্তে মিশে আছে। কবি শুধু সেই সত্যটিকে তুলে ধরছেন মাত্র। আর হয়ে উঠছেন আমাদের প্রতিনিধি।

ভাস্কর কোনও ভিন্ গ্রহের বা ভিন্ গোলার্ধের কবি ছিলেন না। তিনি ছিলেন আমাদের এই গোলার্ধের, এই শহরের, এই জীবনের কবি, যিনি দেখেছেন ‘তোমার চোখের জল যুক্তাক্ষরহীন’। এই প্রবল সংবেদনশীল দেখতে পাওয়ার ক্ষমতা ছিল বলেই, তিনি কবিতাকে জীবনের এক অন্যতম পরিবর্ধনের জায়গা থেকে দেখতে পারতেন। কোনও শব্দই তাঁর কাছে তাই ব্রাত্য ছিল না। শব্দকে তিনি নাচিয়েছেন, জুড়েছেন, ভেঙেছেন, আদর করেছেন, শাসন করেছেন, একটি শব্দের সঙ্গে আর একটি শব্দের বিদ্যুৎক্রিয়ায় আরও তীক্ষ্ণ করে তুলেছেন তাঁর কাব্যভাষাকে। কত সহজেই না তিনি লিখেছেন আশ্চর্য সব সত্য— “রক্তে বিষ মিশে আছে প্রিয়তমা,/ এখন জীবন যায়, আস্তে, চলে যায়।”
মনখারাপ করে আমার, তোমার এই সব কবিতা পড়লে। আমি তোমার চলে যাওয়ার অনেক পরে লিখতে এসেছি বাংলা কবিতা। কিন্তু যখন তোমার কবিতা পড়তাম, বিশ্বাস করতেই পারতাম না, তুমি নেই। ‘চলে যেতে হয় বলে চলে যাচ্ছি, না হলে তো আরেকটু থাকতাম’, তোমার এই অভিমানটুকু যে কতবড় সত্যি কথা, তা বুঝি।
আমাদের অনুভূতিমালার ধ্যানবিন্দুতে যে বিপন্ন সহজ অথচ গভীর নির্বিকার উদাসীনতা রয়েছে, তা সমস্ত জন্ম-মৃত্যুকে নিয়েই যেন অনন্তকালের সামনে বসে আছে। কিন্তু তুমি অনন্তের সামনে বসে খণ্ডকে অস্বীকার করার মতো কবি নয়। কারণ রাস্তা থেকে কুড়িয়ে পেয়েছ যে কাব্যভাষা, সেই কাব্যভাষায় তো তোমার আজীবন বেঁচে থাকাগুলোই লিখে রেখেছ কবিতায়। আর আমি যখন সেই সব কবিতা পড়ছি, তখন আমিও ঢুকে পড়ছি কবিতার অন্দরমহলে। দেখছি আমার না-দেখা বরানগরের গলি, দেখছি খানাখন্দে ভরা বিটি রোড, দেখছি কেমন সন্ধ্যা নামছে হাবুদার চায়ের দোকানে, দেখছি, সিঁথির মোড় দিয়ে হেঁটে যাওয়া আশ্চর্য সব সন্ধ্যার পাখিগুলি কেউ কারও সঙ্গে কথা বলছে না আর। দেখছি, এ পৃথিবীটা আর কারও প্রতিই তেমন সহানুভূতিশীল নয়।

‘জিরাফের ভাষা’ পড়তে পড়তে আমার জ্বর এসে গিয়েছিল। সত্যিই খুব কান্না পেয়েছিল আমার। খুব ভয় পেয়েছিলাম। আসলে তো, কবি বাইরের কোনও লোক ছিলেন না আমার কাছে। ‘জিরাফের ভাষা’ কাব্যগ্রন্থটিকে মানবসমাজের সামনে রেখে বলা যেতে পারে, এই এক নতুন ধর্মগ্রন্থ, এর কথা শোনও। শুনে নিজেদের একটু শান্ত করো। মঙ্গল হোক পৃথিবীর।
মাস্টারমশাই, আমরা তো এমন একটা পৃথিবীর স্বপ্ন দেখব বলেই এসেছিলাম। কিন্তু সেই পৃথিবী রক্তধারায় স্নান করতে করতে চলেছে। জানি না, এই মৃত্যুবিধ্বস্ত ব্যাধিবিধ্বস্ত পৃথিবীকে দেখলে কী লিখতেন ভাস্কর। কিন্তু এটুকু জানি, সুন্দর পৃথিবীর স্বপ্ন দেখা মানুষেরা অভিশাপগ্রস্ত হয়ে পড়েন। বিষাদ ও মৃত্যু তাঁদের তাড়া করে। বার্গম্যানের ছবির মতো কালো গাউন পরে দাবা খেলতে বসে। যেন জীবনের সঙ্গে তার এক ঘৃণা ও ভালবাসার সম্পর্ক। ভাস্কর চক্রবর্তী সব বুঝতে পারতেন। যে সুর তিনি বেঁধে দিয়েছিলেন তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থেই, তা বাজিয়েছেন শেষ কাব্যগ্রন্থ পর্যন্ত। হয়তো গান পালটেছে, দৃশ্য পালটেছে, কাব্যভাষাও। কিন্তু তিনি সরে আসেননি এই যন্ত্রণাবোধ থেকে।
ভাস্কর চক্রবর্তী এমন একজন কবি, যাঁকে দেশ-কাল-সীমা এবং দশকে বেঁধে রাখা যায় না। তিনি ছড়িয়ে পড়েন। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পরে, যখন এ পৃথিবী আরও অনেক বেশি নারকীয় হয়ে উঠবে, তখনও তিনি আবিষ্কৃত হবেন তাঁর কবিতার মধ্যে দিয়ে। আবিষ্কৃত হবেন মানুষের অন্তর্নিহিত বিপন্নতা যতদিন তার ভাষা খুঁজবে এই পৃথিবীতে।
*ছবি সৌজন্য Goodreads, poetrystate
বেবী সাউ মূলত কবিতা এবং প্রবন্ধ লেখেন। জন্ম পশ্চিমবঙ্গের ঝাড়গ্রাম জেলায়। বর্তমানে ঝাড়খণ্ডের জামশেদপুর শহরে থাকেন। জামশেদপুর আকাশবাণীতে কর্মরত। কবি বেবী সাউ-এর "কাঁদনাগীত: সংগ্রহ ও ইতিবৃত্ত" বইটি 'কৃত্তিবাস মাসিক পুরস্কার ২০১৯' এবং 'বাংলা একাদেমি তাপসী বসু স্মারক সম্মান ২০২০' পুরস্কারে পেয়েছে। তাঁর কবিতার বইগুলিও একাধিক সম্মান পেয়েছে। যেমন- রাঢ় বাংলা রোদ্দুর সম্মান, বইতরণী পুরস্কার, শব্দপথ যুব সম্মান এবং 'এখন শান্তিনিকেতন' পদ্য সম্মান।
লেখাটি পড়লাম। ভালো লাগল।
খুবই উন্নত মানের ভাল লেখা।