পিকু বরাবরই ওর ছোটমামা সন্তুর খুব ভক্ত। মামাবাড়িতে গেলে পিকু সারাক্ষণ সন্তুর সাথে আঠার মত সেঁটে থাকে। গল্প করা, একসঙ্গে ইস্টবেঙ্গলের খেলা দেখতে যাওয়া, সিনেমা নিয়ে আলোচনা করা, আরও কত কী! মামাবাড়ির পাড়ার মোড়ে শঙ্করের চায়ের দোকানের ভেজিটেবল চপ আর মাংসের ঘুগনি পিকুর দারুন পছন্দ। সন্তুও খেতে ভালোবাসে, ফলে পিকু এলে মাঝে মধ্যেই দুজনে মিলে নানারকম খাওয়া দাওয়া চলে। সন্তুর কাছে অন্যান্য ভাগ্নে ভাগ্নিদের তুলনায় পিকুর একটা বিশেষ জায়গা আছে – কারণ পিকুর বুদ্ধি। সন্তুর মতে পিকু ভীষন ইন্টেলিজেন্ট। সন্তু প্রেসিডেন্সিতে পলিটিক্যাল সায়েন্স পড়ার সময় একদিন পিকুকে কলেজস্ট্রিটে নিয়ে গিয়ে পুঁটিরামের কচুরি, দিলখুশার কবিরাজী আর প্যারামাউন্টের শরবত খাইয়েছিল। পিকু তখন ক্লাস এইটে পড়ে। সেই থেকে ক্লাসে পিকুর ইজ্জতই বেড়ে গেল। সাগ্নিক, অনির্বান, সাত্যকি, দেবশ্রীদের কাছে পিকুর ছোটমামা তখন থেকে সুপার হিরো। অনেকটা পাগলা দাশুর জগ্যিদাসের মামার মতন। 

গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করে, জে এন ইউ তে এম এ পড়তে যাওয়ার কারণে সন্তর সঙ্গে পিকুর দেখা সাক্ষাত মাঝে একটু কমে গিয়েছিল। সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা পাশ করে সন্তু এখন আই পি এস অফিসার। সি আই ডিতে আছে, ভবানী ভবনে পোস্টিং। পিকু এখন প্রেসিডেন্সিতে ফিজিক্স অনার্স পড়ে, থার্ড ইয়ার। পিকুর বেহালায় বাড়ি। বাড়ি ফেরার পথে মাঝে মধ্যেই পিকু ভবানী ভবন ঘুরে যায় – ছোটমামার সঙ্গে দেখাও হয়, আর খাওয়া দাওয়া তো লেগেই থাকে।

সন্তুর স্কুলের বন্ধু কৌশিক রায় পেশায় প্রাইভেট ডিটেকটিভ। দমদমে থাকে। খুব মজার ছেলে। পাত্রের ব্যাকগ্রাউন্ড ভেরিফিকেশন থেকে শুরু করে বউ-এর গোপন প্রেম বা বৃদ্ধ ডায়েবেটিক স্বামীর লুকিয়ে মিষ্টি খাওয়া – এই সবকিছুর খবর জোগাড় করাই কৌশিকের পেশা। মাঝে মধ্যেই কাজে অকাজে সে সন্তুর অফিসে চলে আসে। সেখানেই পিকুর সঙ্গে আলাপ। পিকুকে আবার কৌশিকেরও ভীষণ পছন্দ। কৌশিকের কথায় – পিকু যেমন বুদ্ধিমান তেমনই সুন্দর কথা বলে। দারুন ব্রাইট!  

সন্তু, কৌশিক আর পিকুর একটা কমন প্যাশন আছে– খাওয়া। সন্ধ্যেবেলা মাঝে মধ্যেই তিনজনে মিলে হাজরার মোড়ে ক্যাফেতে গিয়ে চিকেন কবিরাজী বা চিকেন স্টু আর পুডিং খেয়ে আসে। সেদিন বিকেলে প্রচণ্ড বৃষ্টি, বাইরে বেশ ভালই জল জমেছে। পিকু আর কৌশিক দুজনেই সন্তুর অফিসে আটকে গেছে, বেরোতে পারছে না। নানান রকম গল্পগুজব চলছিল, এরই মাঝে কৌশিক পিকুকে বলল “ভাগ্নে, তুমি তো ফিজিক্স পড়ছ, তা আমাদের একটু আইনস্টাইনের রিলেটিভিটি থিওরিটা বোঝাও না! শুনেছি রিলেটিভিটি থিওরি দিয়ে নাকি অতীত বা ভবিষ্যতে যাতায়াত করা যায়। ” 

রিলেটিভিটি পিকুর খুব প্রিয় বিষয়। প্রস্তাবটা শুনে পিকুরও খুব এক্সাইটিং লাগল। সোজা হয়ে চেয়ারে বসে পিকু শুরু করল। 

“আমি কতটা ভালো করে বোঝাতে পারব জানিনা, তবে ব্যাপারটা অনেকটা এইরকম। ধরা যাক, সোনারপুরে কোনও একটা ঘটনা ঘটছে আর বরানগরে দাঁড়িয়ে পল্টু বলে একজন সেটা দেখছে। ধরে নেওয়া যাক, সে দেখতে পাচ্ছে কারণ মাঝে কোনও বাধা নেই। সব ফাঁকা। এখন সোনারপুরের ঘটনাটার দুটো দিক আছে, একটা ফিজিক্যাল আর অন্যটা ভিসুয়াল। পল্টু যেটা এক্সপিরিয়েন্স করছে সেটা ভিসুয়াল। সিনেমার মত সোনারপুরের পুরো ঘটনার সময়টাকে যদি কতগুলো এক বা দুই সেকেন্ড ডিউরেশনের ফ্রেমে ভাগ করে ফেলা যায় তাহলে সিকোয়েন্সিয়ালি পর পর সবকটা ফ্রেমকে জুড়লে পুরো ঘটনাটাই দেখা যাবে। এখন পল্টুর কাছে সোনারপুর থেকে এই ফ্রেমগুলো আলোর গতিতে বরানগরে পৌঁছচ্ছে আর পল্টু পর পর সেগুলো সেই সিকোয়েন্সে দেখে ঘটনাটা চাক্ষুষ করতে পারছে। ধরা যাক সোনারপুরের ঘটনায় সব মিলিয়ে দশ হাজার ফ্রেম জেনারেটেড হ’য়েছে আর একটা ফ্রেমের আলোর গতিতে সোনারপুর থেকে বরানগর পৌঁছতে বারো সেকেন্ড সময় লাগছে। যদি একটা ফ্রেমের টাইম লেন্থ এক সেকেন্ড হয়, তাহলে হিসেব মতো যেকোনও সময়ে সোনারপুর আর বরানগরের মধ্যে বারোটা ফ্রেম থাকবে। অর্থাৎ পল্টু যখন এক নম্বর ফ্রেম দেখছে‌ সোনারপুরে তখন তেরো নম্বর ফ্রেমের ঘটনা ঘটছে। এইবারে পল্টু যদি ভুলুকে বরানগরে দাঁড় করিয়ে রেখে আলোর গতির চেয়েও বেশি গতিতে বরানগর থেকে সোনারপুরের দিকে যায় তাহলে যে ফ্রেমগুলো সোনারপুর থেকে বরানগরের দিকে যাচ্ছে তাদেরকে পল্টু বরানগরে ভুলু দেখার আগেই দেখে ফেলবে। তার মানে পল্টু বরানগরে ভুলুর তুলনায় এ ঘটনাগুলো আগেই দেখে ফেলছে অর্থাৎ ভুলুর রেস্পেক্টে পল্টু দেখতে পাচ্ছে ভবিষ্যত। আবার পল্টু যদি বরানগরের দিক থেকে ব্যারাকপুরের দিকে যায় তাহলে বরানগরে ভুলুর ইতিমধ্যেই দেখে ফেলা ফ্রেমগুলো সে দেখতে দেখতে যাবে। যতো সে ভুলুর থেকে দূরে যাবে তত সে আরও পুরোনো ফ্রেম দেখতে পাবে। তার মানে ভুলু যে মুহূর্তে তিন হাজারতম ফ্রেমটা দেখবে পল্টু ব্যারাকপুরে দাঁড়িয়ে সেই মুহুর্তে হয়তো দুহাজারতম ফ্রেমটা দেখবে। অর্থাৎ ভুলুর রেস্পেক্টে এবার সে দেখবে অতীত।“ একটানা এতগুলো কথা বলে পিকু হাঁপিয়ে পড়েছিল, একটু জল খেয়ে তবে আবার স্বাভাবিক হতে পারল। 

পিকুর এই লেকচার শুনে সন্তু আর কৌশিক দুজনেই তো থ! এত কঠিন একটা থিওরি কত সহজ করে বুঝিয়ে দিল ছেলেটা! পিকুর উপর দারুণ ইম্প্রেসড হলো দুজনেই। সন্তু বললো “দারুণ বুঝিয়েছিস। এক্সেলেন্ট!” 

কৌশিক তো পিকুর ফ্যানই  হয়ে গেলো। কিছুক্ষন অবাক হয়ে পিকুর দিকে তাকিয়ে থেকে বলেই ফেললো “কি ভাগ্নে সখের গোয়েন্দাগিরি করবে  নাকি আমার সাথে?” 

প্রথমে পিকু ভেবেছিল  কৌশিকমামা বুঝি ইয়ার্কি মারছে, কিন্তু যখন বুঝলো এটা ঠাট্টা নয়, সত্যিই তাকে গোয়েন্দাগিরি করার সুযোগ করে দিচ্ছে  কৌশিকমামা, তখন বাধ্য ছেলের মতো সে সন্তুর দিকে তাকিয়ে বললো   “মামা তুমিই বলো।”

সন্তু বললো “চেখে দেখতে দোষ কি? আমি হলে ঢুকে পড়তাম। আফটার অল এটা তো মানুষের চরিত্র বিশ্লেষণ করার একটা পেশা। লেগে পড়। গরমের ছুটি তো পড়েই গেছে, এখন থেকেই তা হলে লেগে পড়।” কৌশিক বলল “আর তাছাড়া এই মুহূর্তে আমার কাছে একটা টাটকা কেসও আছে! মনে হচ্ছে বেশ ইন্টারেস্টিংও হবে। ওটা দিয়েই শুরু করা যেতে পারে। কিন্তু খালি পেটে তো আর মাথা কাজ করবে না! কি বলো ভাগ্নে! চলো, তোমার মামা তো আর যাবে না আমরাই যাই, পেট পুজোও হবে আর কেসের ব্রিফও জানবে।”

সন্তুর অফিস থেকে বেরিয়ে, পাশেই পুলিশ কোর্টে প্রকাশের  চায়ের দোকানে বসে মোটা ক’রে মাখন দেওয়া কড়া চিনি টোস্ট, ডবল ডিমের অমলেট, ঘুঘনি আর শেষে গরম বোঁদে খেতে খেতে কৌশিক কেসটা পিকুকে ভালো করে বুঝিয়ে বলল।

“ঘটনাটা এরকম – সঞ্জয় সেন, বালিগঞ্জ সারকুলার রোডে একটা মালটিস্টোরিড বিল্ডিংয়ের পাঁচতলার উপরে এক ফ্ল্যাটের বাসিন্দা। দীর্ঘদিন ক্যানসারে  ভুগে তাঁর  স্ত্রী মারা গেছেন বছরখানেক আগে। একটিই ছেলে সুব্রত সেন, আমেরিকায় থাকেন, ওয়েস্ট কোস্টে বে অঞ্চলে। কলকাতায় এসেছেন একটা কনফারেন্স এ্যাটেন্ড করতে। মনে মনে ইচ্ছে এবারে কলকাতার বাড়ি বিক্রি করে বাবাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন আমেরিকায়। কিন্তু তিনদিন আগে একটা অঘটন ঘটে গেছ । গত সোমবার দুপুর তিনটে নাগাদ সঞ্জয় সেন হঠাৎ মারা গেছেন। সেই সময় বাড়িতে কেউ ছিল না। সুব্রত তখন কনফারেন্সে। “

এই পর্যন্ত শুনে পিকু কৌশিককে থামিয়ে  জিজ্ঞাসা করল “কিন্তু মৃত্যুর কারণটা কী?” কৌশিক বললো “হার্ট অ্যাটাক –  স্বাভাবিক মৃত্যু, কিন্তু আসল সমস্যাটা অন্য জায়গায়। মুশকিল হল বাড়ির  দলিলটা কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে সুব্রতর ফেরার দিন এগিয়ে আসছে। সঞ্জয় সেন কোথায় যে সব কাজ পত্র রেখে গেছেন, কেউ জানে না। বাড়ির দলিল আর তার সঙ্গে  ওদের পরিবারিক লক্ষ্মীমূর্তি – এই দুটো ইম্পর্টেন্ট জিনিস না পেলে সুব্রত কিছুতেই আমেরিকা ফিরতে পারছেন না।”

“লক্ষ্মীমূর্তি? সেটা আবার কী?” পিকু জিজ্ঞাসা করল। 

কৌশিক বলল “সঞ্জয় বাবুদের পূর্বপুরুষের একটা মহামুল্যবান সোনার লক্ষ্মী আছে। ইঞ্চি পাঁচেক লম্বা আর সারা গায়ে দামি পাথর বসানো। আজকের দিনে তার দাম অন্তত লাখ চল্লিশ তো হবেই।”

কৌশিক বলে চলল – ” সুব্রত ঠিকই করে এসেছিলেন এবারে বাড়ি বিক্রি করে দিয়ে বাবাকে সঙ্গে নিয়ে আমেরিকায় ফিরবেন। সেইমতো ওদের পাশের বাড়ির ভদ্রলোকের সঙ্গে ফ্ল্যাট বিক্রির কথা ফাইনালও হয়ে গিয়েছিল। কিছু টাকা অ্যাডভান্স নিয়ে একটা চুক্তি সইও করা হয়ে গেছে। কিন্তু বাড়ির দলিল আর লক্ষ্মী দুটোই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ বাড়িতে কোনও আলমারী বা লকার  কিছুই নেই যেখানে খুঁজে দেখা যেতে পারে। সুব্রত যতদুর জানেন ওঁর বাবার নামে কোনও ব্যাংকে লকারও নেওয়া নেই। এই অবস্থায় একরকম দিশাহারা হয়েই লোকাল থানার সঙ্গে যোগাযোগ করে আমাকে অ্যাপয়েন্ট করেছেন উনি।” কৌশিকের কথা মত পিকু সব কিছু নোট করে নিল। ছোটমামা একবার বলেছিল ওদের কাজে মেমরি এবং নোট করার ক্ষমতা ভীষণ ইম্পর্টেন্ট, কারণ কোথাও কোনো ইনকন্সিস্টেন্সি থাকলে পরে এই লেখা থেকে তা সহজেই ধরে ফেলা যায়। তাছাড়া লিখে না রাখলে অনেক ছোট ছোট ঘটনা অনেক সময় চোখ এড়িয়ে যায়। কথাবার্তার শেষে ঠিক হল পরেরদিন সকালে কৌশিক পিকুকে নিয়ে সেনেদের বাড়ি যাবে। 

ঠিক সকাল এগারোটায় কৌশিক পিকুকে হাজরা মোড় থেকে তুলে সোজা সেনেদের বাড়িতে পৌঁছে গেল। মোটর সাইকেল থেকে নেমে পিকু বাড়ির চারপাশটা আর লিফটের লবিটা ভালো করে দেখে নিল। কোনও সিসিটিভি লাগানো নেই। পাঁচতলায় লিফট  থেকে বেরলেই বাঁহাতে সঞ্জয় বাবুর ফ্ল্যাট। পাশের ফ্ল্যাটটা অনিন্দ্য বোসের, যিনি সঞ্জয় বাবুর ফ্ল্যাটটা কিনবেন বলে ঠিক করেছিলেন। বোঝা গেল প্রতি ফ্লোরে চারটে করে ফ্ল্যাট। লিফটের বাঁদিকে দুটো আর ডানদিকে দুটো। বেল বাজাতে সুব্রত সেন নিজেই দরজা খুলে ভেতরে আসতে বললেন। মধ্য বয়সী ভদ্রলোক, মাথায় চুল নেই বললেই চলে, হাল্কা সবুজ হাফপ্যান্ট আর কালো টি শার্ট পরা। ভদ্রলোকএকটু বেশি ইংরেজি বলেন বটে, তবে  এমনিতে বেশ অমায়িক ব্যবহার। কৌশিক পিকুর সঙ্গে সুব্রত’র আলাপ করিয়ে দিল নিজের ভাগ্নে বলেই। বলল “ওর খুব সখ এইসব মিস্ট্রী সলভ করে, তাই নিয়ে এসেছি! আপনাদের ফ্ল্যাটের ভেতরটা ও একটু দেখতে পারে? “নিশ্চয়ই!” – সুব্রত পিকুকে নিয়ে ভেতরে গেলেন, কৌশিকও সঙ্গে গেল। 

পিকু জিজ্ঞাসা করল

–“আপনার বাবার ঘর কোনটা?”

সুব্রত পিকুকে নিয়ে উপস্থিত হলেন তাঁর বাবার ঘরে। সঞ্জয় সেনের ঘরে পৌঁছে পিকু বলল

— “আমি একটু ঘুরে ফিরে সব দেখি, আপনারা বরং এই ফাঁকে কথাবার্তা সেরে নিন।”

সুব্রত আর কৌশিক চলে যাওয়ার পর পিকু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব দেখল, তারপর ফিরে এলো বসার ঘরে। ততক্ষণে চা আর বিস্কুট এসে গেছে। চা খেতে খেতে পিকু জানতে চাইল,

— “আপনার বাবা বুঝি খুব পড়শোনা করতেন! অনেক বই দেখলাম।”
–“হ্যাঁ বাবা যে শুধু বই পড়তেই ভালোবাসতেন তা নয়, সব ধরনের বই পড়তেন। ভীষণ উইটি ছিলেন আর খুব হেঁয়ালি করে কথা বলতে মজা পেতেন। খুব ‘মাই ডিয়র গোছের লোক ছিলেন। বাবাকে কখনও রাগতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। তবে মা চলে যাওয়ার পর থেকে একটু একা হয়ে পড়েছিলেন। নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকার চেষ্টা করতেন। মোটামুটি লেখাপড়া নিয়েই দিন কেটে যেত বাবার। ছড়া লিখতে খুব ভালেবাসতেন। ছন্দ ব্যাপারটা বাবার একটা প্যাশন ছিল।
বাবা বলতেন ‘যার জীবনে ছন্দ নেই তার সবই ছন্নছাড়া। সব কিছুর পেছনেই নাকি একটা ছন্দ কাজ করে। আর হ্যাঁ, বাবা প্রতিদিন নিয়ম করে ডাইরি লিখতেন, কখনও ভুলতেন না।” কথাগুলো এক নিশ্বাসে বলে থামলেন সুব্রত।

— “ওঁর ছড়ার খাতা আর ডাইরিগুলো কি একটু দেখতে পারি?” পিকু জানতে চাইল।

কৌশিক বলল ওগুলো ওর কাছেই আছে পরে দেখিয়ে দেবে।

— “তাহলে আজ এই পর্যন্ত। আপনি চিন্তা করবেন না মি. সেন ! আপনার বাড়ির দলিল আর লক্ষ্মী দুটোই আশা করি পাওয়া যাবে। আজ তাহলে আসি। সাবধানে থাকবেন আর নতুন কোনও কিছু মনে পড়লে অবশ্যই ফোন করবেন।”

এই বলে কৌশিক পিকুকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। 

বাড়ি না গিয়ে দুজনে হাজরায় ক্যাফেতেই এসে বসল আবার। দুটো চা অর্ডার করে কৌশিক পিকুকে জিজ্ঞাসা করলো

— “কি ভাগ্নে! কী বুঝছ?”
— “এখনও কিছুই বুঝতে পারছি না, একটু ভাবি। আচ্ছা সঞ্জয় সেনের ডাইরি আর ছড়ার খাতাটা একবার দেখতে পাওয়া যাবে কি?”

পিকু জিজ্ঞাসা করলো! কৌশিক বলল

— “শুধু দেখতে কেন, ওগুলো বাড়িও নিয়ে যেতে পার! তবে খুব সাবধানে! একটা পাতাও হারালে আমায় নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে।” 

সঙ্গের ব্যাগ থেকে বের করে তিনটে ডাইরি আর তিনটে ছড়ার খাতা কৌশিক পিকুর হাতে তুলে দিল, সেইসঙ্গে পাঁচশ টাকার একটা নোট দিয়ে সে বলল

— “ভাগ্নে এই মহামূল্যবান জিনিসগুলো নিয়ে আজ না হয় ট্যাক্সি করেই বাড়ি যাও।”

পিকু একটু দ্বিধা বোধ করাতে কৌশিক বুঝিয়ে বলল

— “তোমার তো এই কাজের জন্যে কিছু পারিশ্রমিকও পাওনা হবে! পরে অ্যাডজাস্ট করে নেব।”

বাড়ি পৌঁছেই পিকু মাকে জানিয়ে দিলো রাত্রে আর কিছু খাবে না, মামার অফিস থেকে খেয়ে এসেছে। এই বলেই সে সোজা দোতলায় নিজের ঘরে চলে গেল। ডাইরি আর ছড়ার খাতাগুলো খাটের উপরে  রেখে হাতমুখ ধুয়ে এসে বসল সেগুলো নিয়ে। কি রকম যেন রোমাঞ্চকর আর নার্ভাস লাগছে। সে প্রথমটা বুঝে উঠতে পারল না কোনটা দিয়ে শুরু করবে, – ডাইরি না ছড়ার খাতা! তারপর মনে হলো ডাইরিতেই বেশি ইনফরমেশন থাকবে। তাই ডাইরি খুলে পড়তে শুরু করলো সে। সঞ্জয় সেনের ডাইরি পড়তে পড়তে পিকু কেমন যেন সঞ্জয় বাবুর জগতে পৌঁছে গেলো। একজন সত্তর বছরের বৃদ্ধমানুষ, অথচ তার সামাজিক দৃ্টিভঙ্গি কত আধুনিক! জীবন সম্পর্কে কী ভীষণ পজিটিভ ছিলেন ভদ্রলোক! মানুষ দেখে তার চরিত্র বোঝার চেষ্টা করতেন। বেশ ভালো লিখতেনও ভদ্রলোক। প্রাঞ্জল লেখা, তার সঙ্গে বেশ রসিকও বটে। মারা যাওয়ার কদিন আগেই সঞ্জয় বাবু লিখেছেন ওঁর আমেরিকা যাওয়ার একেবারেই ইচ্ছে নেই। কী করবেন সেখানে গিয়ে! তবে বয়েস হয়েছে, একা থাকাটাও রিস্কের, তাই বহু কষ্টে নিজেকে মানিয়ে রাজি হয়েছেন। ওদের ওখানকার জীবনধারা ওঁর একেবারেই পছন্দ নয়। বড্ড ছন্নছাড়া জীবনযাপন। সাহেবদের জীবনে কোনও ছন্দ নেই। এই রকম নানা কথা লেখা রয়েছে ডাইরির পাতা জুড়ে।  

দেখতে দেখতে পিকুর সবকটা ডাইরিই পড়া শেষ হয়ে গেল। ভদ্রলোক সম্বন্ধে কিছুটা  জানা গেল বটে তবে কোনও মেজর ইনফরমেশন পাওয়া গেল না, যা পিকুকে রহস্য় সলভ করতে সাহায্য করবে। পিকু যেমন হতাশও হলো তেমনি একটু টেনশনও হতে লাগল। যদি কিছু না পায়! তাহলে তো প্রথমেই ফেল। যাইহোক, উঠে একটু নিচ থেকে ঘুরে এসে এবারে ছড়ার খাতা নিয়ে বসল পিকু। আশা করা যায় এখানে কিছু সূত্র থাকবে। প্রথম খাতার প্রথম পাতাতেই একটা ছড়া লেখা : 

 আমি ভূতো, ঘুরে ঘুরে দেখি লোক মজাদার
লম্বাটে রোগা, কেউ বেঁটে মোটা বোঝদার।
কেউ হাসে ভোরবেলা ধারে ব’সে ডোবাটার,
পাশে বসে শুনে নিই জীবনের কথা তার।
সমাজের নানা রং নানা দিক খুঁজতে
মানুষকে দেখি তার চরিত্র বুঝতে।
কেউ করে গুরুবাজী কেউ দেয় ধাপ্পা

বাঙ্গালীর হাবে ভাবে ইংরেজী ছাপ্পা।
তাদের এই চরিত্র নানা খোপে ফেলে তাই,
কল্পনা করি আর নিজে নিজে মজা পাই।
সেগুলোকে ছন্দেতে গেঁথে নিয়ে মাথাতে,
ছত্রে ছত্রে লিখি ছড়ার এই খাতাতে।।

 এটা পড়লেই ভদ্রলোকের রসবোধ বোঝা যায়। এইরকম নানান বিষয় নিয়ে নানান ছন্দের সব ছড়া। পড়তে পড়তে পিকু একেবারে মশগুল হয়ে পড়লো। কি মজার আর দারুন ছন্দের সব ছড়া ভাবাই যায় না! এখন বোঝা যাচ্ছে সঞ্জয় বাবু ছন্দের ব্যাপারে এত ক্রিটিক্যাল ছিলেন কেন। প্রথম খাতা পড়া শেষ। ইম্পর্টেন্ট কিছুই পাওয়া গেলনা। পিকুর তো টেনশন বাড়তে শুরু করলো। দ্বিতীয় খাতা পড়তে শুরু করলো সে।কয়েকটা পাতা পড়ার পর হঠাৎ একটা ছড়ায় পিকুর চোখ আটকে গেলো ! 

যতই খোঁজো উপন্যাসে
বই বা খাতায় কোনও!
সঠিক পাতায় পৌঁছোবে,
যদি পদ্মপুকুর চেনো।

 এর মানে কী? দুতিনবার পড়লো পিকু। বইএর পাতার সঙ্গে পদ্মপুকুরের কি সম্পর্ক? কি বলার চেষ্টা করছেন সঞ্জয় বাবু? পিকুর মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করে উঠল। বোঝা যাচ্ছে এটা একটা সূত্র। কিন্তু সঞ্জয়বাবু যে ঠিক কী বলার চেষ্টা করেছেন সেটা কিছুতেই বোঝা যাচ্ছে না।পিকু ভাবলো একটু বারান্দায় বেরিয়ে ফ্রেশ হাওয়া খাওয়া যাক যদি মাথাটা খোলে। বাইরে বেরিয়ে বুঝতে পারল রাত প্রায় আড়াইটে হবে, চারপাশ কিরকম নিশব্দ, অন্ধকার, টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। একটা ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব, বেশ রিফ্রেশিং। পাড়ার সব কুকুরগুলো এই বৃষ্টিতে উল্টোদিকের রেশন দোকানের বারান্দায় কুণ্ডলী পাকিয়ে বসে আছে। কুকুরগুলো দেখতে দেখতে হঠাৎ রেশন দোকানের সাইনবোর্ডটা চোখে পড়ল পিকুর। কিছুই পড়া যাচ্ছে না, শুধু নীচের দিকে রং উঠে যাওয়া ঠিকানার শেষটা পড়া যাচ্ছে। “বেহালা। কলিকাতা ৩৪!” হঠাৎ মাথাটা খুলে গেল! ‘আরে! এই তো পাওয়া গেছে!’  পিকু প্রায় চেঁচিয়ে উঠল। পদ্মপুকুর কলকাতা কত? তাড়াতাড়ি গুগল করে দেখল পদ্মপুকুর কলকাতা ২৫! তারমানে ২৫ নম্বর পাতা। দৌড়ে ঘরে এসে খাতা খুলে ২৫ নম্বর পাতায় গিয়ে দ্যাখে সেখানে দুটো ছড়া লেখা। 

প্রথম ছড়াটা হল –

ওপর থেকে নামতে নামতে
পাঁচতলাতে এসে,
টিপলে কলিং দেখবে ঘরে
আমিই আছি ব’সে।
আমার চাবি আমার ঘরেই
সেইখানেতে রাখা
মাথার উপর রোদ পড়লে
চেহারাটাই  ঢাকা।

তার মানে দুপুর বারোটা। হঠাৎ মনে পড়ে গেলো সঞ্জয় সেনের ঘরে বইএর তাকে দশ ইঞ্চি বাই বারো ইঞ্চির একটা কাঠের ঘড়ি দেখেছিল। ঘড়িটা বন্ধ ছিলো। সুব্রত বলেছিলেন ওই ঘড়িটা একমাত্র সঞ্জয় বাবুই চালাতে জানতেন। ওটা ম্যানুয়াল ঘড়ি আর কি করে দম দিতে হয় তা সঞ্জয় বাবু ছাড়া আর কেউই জানে না। কিন্তু এর সঙ্গে পাঁচতলা আর কলিং বেলের কী সম্পর্ক! ওনারা পাঁচতলাতেই থাকেন এটা ঠিক আর দরজার বাইরে কলিং বেলও আছে। আবার পাঁচতলার থেকে নামতেই বা বলছেন কেন! সব কিরকম গুলিয়ে যাচ্ছে। পিকু কনসেনট্রেট করে আবার ছড়াটা পড়ল। বুঝতে পারল লাইন দুটোতে কিছু একটা তথ্য লুকিয়ে আছে। কিন্তু যতক্ষণ না পিকু ওই ফ্ল্যাটে যাচ্ছে ততক্ষণ কিছুই ঠিক করে বলতে পারবে না সে। যাই হোক, যেটুকু বোঝা গেল পিকু সেটা নোটবুকে লিখে রাখল।

ওই পাতার দ্বিতীয় ছড়াটা হল –

ছটফট করি চিন্তায় মরি
তবুও তো কিছু পাই না!
পাই পাই করে হিসেব মেলাই
উত্তর খুঁজে পাই না।
কোথায় কি পাই, কখানা যে পাই
শুরু থেকে আজ শেষে,
ফোঁটা ছাড়া খেলে গোটা সন্দেশ
ভাগ্য দাঁড়ায় হেসে।

পিকু বুঝতে পারল এটা বেশ বেগ দেবে। সব একেবারে মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে। পিকু ছড়াটা ভেঙে ভেঙে পড়তে শুরু করলো। অনেকবার পড়ার পর ব্যাপারটা আস্তে আস্তে পরিষ্কার হল। একটু একটু করে একটা এক্সপ্লানেশন মাথায় এল। তাড়াতাড়ি মোবাইলে একটা হিসেব কষে বুঝল সংখ্যাটা বোধহয় 1884 হবে।

পিকু যদিও বুঝতে পারছিলো ওর ইন্টারপ্রিটেশন ঠিক নাও হতে পারে। কিন্তু এর বাইরে আর কিছু ভাবতেও পারছিলো না । মাথা আর কাজ করছে না। ভোর হয়ে আসছে আর চোখ ঘুমে লেগে আসছে। ওই অবস্থাতেই কখন যে ঘুমিয়ে পড়লো পিকু, কিছুই তার মনে নেই। 

 হঠাৎ মা’র ডাকে ঘুম ভেঙে গেল পিকুর।  মোবাইলে দ্যাখে এগারোটা বেজে গেছে। আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে তাড়াতাড়ি কৌশিককে ফোন করল পিকু।

— “হ্যালো কৌশিক মামা! গুড মর্নিং! মনে হচ্ছে একটু আলো দেখতে পাচ্ছি। আজ কি একবার সঞ্জয় সেনের বাড়ি যাওয়া যাবে?”
— “আলবৎ যাওয়া যাবে! কখন যাবি বল!” কৌশিক এক্সসাইটেড হয়ে বলে উঠল।
— “আমি স্নান করেই বেরিয়ে পড়ছি। তিনটেয় হাজরা মোড়?” পিকু উত্তর দিল।
— “দ্যাটস্ পারফেক্ট!” কৌশিক জানাল।

 তিনটে নাগাদ কৌশিক পিকুকে হাজরা মোড় থেকে পিক আপ করল। মোটর সাইকেলের পিছনে পিকু উঠলে কৌশিকের প্রথম প্রশ্ন “কি আমরা কি সোজা সঞ্জয় সেনের বাড়ি যাবো, নাকি কোথাও একটু বসে আলোচনা করে নেবো?” পিকু জানালো সে একটু তাড়াতাড়িই সঞ্জয় বাবুদের বাড়িতে যেতে চায়! এখনও তো কংক্রিট কিছু পায়নি , সবটাই তো এখনও চান্সের ব্যাপার। তাই ওই ঘরটায় গিয়ে একটু বুঝতে চায় ও যেটা ভাবছে সেটা ঠিক কিনা। 

কিছুক্ষণের মধ্যেই সেনেদের বাড়ি পৌঁছে গেল ওরা। সুব্রত যথারীতি খাতির করে বসালেন ওদের, জিজ্ঞাসা করলেন চা খাবে কিনা,  সাথে কোনো প্রগ্রেস হোয়েছে কিনা তাও জানতে চাইলেন। কৌশিক আর সুব্রত দলিল আর লক্ষ্মী কীভাবে পাওয়া যেতে পারে তা নিয়ে আলোচনা শুরু করে দিল,  এদিকে  পিকু কিন্তু অস্থির হয়ে পড়েছে সঞ্জয় সেনের ঘরে যাওয়ার জন্য। শেষে পিকু বলেই ফেলল,

— “আপনারা কথা বলুন, আমি একটু সঞ্জয় বাবুর ঘর থেকে ঘুরে আসি?”

কৌশিক আর সুব্রত দুজনেই খুব বিব্রত হয়ে একসঙ্গে বলে উঠল “নিশ্চয়ই”!

পিকু আর একটুও সময় নষ্ট না করে সোজা সঞ্জয় সেনের ঘরে উপস্থিত। কেমন যেন একটু ভয় ভয় করছে। যেমন ভেবেছে তেমনটি যদি  না হয়, তাহলে তো প্রেস্টিজ পুরো গেলো। মামার কাছেই বা মুখ দেখাবে কি করে। পকেট থেকে ছড়া কপি করা কাগজটা বের করে আরেকবার ভালো করে দেখে নিলো সঞ্জয় বাবু কি বলেছেন। তারপর সে আস্তে আস্তে সেই কাঠের ঘড়িটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ঘড়িটাতে তখন সাড়ে সাতটা বাজে। প্রথমেই মনে পড়লো দুপুর বারোটার কথা। পিকু ঘড়ির কাঁটা দুটোকে ঘুরিয়ে বারোটায় আনতে গিয়ে বুঝল দুটো কাঁটাই লক করা, কিছুতেই ঘোরানো যাচ্ছে না। ছড়ার কাগজটা আবার দেখতে দেখতে হঠাৎ প্রথম চারটে লাইনে চোখ আটকে গেল –

ওপর থেকে নামতে নামতে
পাঁচতলাতে এসে,
টিপলে কলিং দেখবে ঘরে
আমিই আছি ব’সে।

ব্যাপারটা এবার পরিস্কার হতে লাগল পিকুর কাছে। একহাতে ঘড়ির ঘণ্টার কাঁটাটাকে ধরে অন্য হাত দিয়ে আস্তে আস্তে ঘড়ির ডায়ালের ওপর হাত বোলাতে বোলাতে বারোর থেকে নীচের দিকে নামতে থাকল, পাঁচে এসেই থেমে যেই নম্বরটাকে টিপে ধরল অমনি বাঁ হাতে ধরা ঘণ্টার কাঁটাটা কেমন আলগা হয়ে গেল। নম্বরটা চেপে ধরে প্রথমে ঘণ্টার কাঁটা আর তারপরে মিনিটের কাঁটাটাকে ঘুরিয়ে বারোতে এনে পাঁচ নম্বরটা ছেড়ে দিতেই ঘড়ির সামনের কাঠের বায়ারের টপটা দরজার পাল্লার মত খুলে এল। যেন চিচিং ফাঁক! চমকে উঠল পিকু। ভিতরে উঁকি মেরে দ্যাখে সঞ্জয় সেনের ছবি সাঁটা একটা লকার। একটু ইতস্তত করে ছবিটা একটু প্রেস করতেই খুলে এল আর আড়াল থেকে বেরিয়ে পড়ল একটা নিউম্যারিক কি প্যাড। তাহলে তো সব কিছুই মিলে যাচ্ছে। এইবারে পিকু সত্যিই এক্সসাইটেড হয়ে পড়ল। 

পকেট থেকে হিসাবের কাগজটা বার করে আর একবার দেখে নিল সে। মোবাইলের ক্যালকুলেটরে কয়েক বার হিসেব কষে মিলিয়েও  নিল সংখ্যাটা সত্যিই 1884 কিনা। তারপর  ভয়ে ভয়ে যেই কি প্যাডে 1 8 8 4 প্রেস করল অমনি লকারের দরজাটা ঘটাং করে খুলে গেল। পিকু ছিটকে পিছনে চলে এলো। ভেতরে চকচক করছে একটা লক্ষ্মীমূর্তি। পাশেই রাখা বাড়ির দলিল।

কিছুক্ষণের জন্যে পিকু কেমন চুপ করে রইল! নিজেকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। সত্যিই কি ও পেরেছে, নাকি গোটাটাই স্বপ্ন। বুঝতে পারছে না কী করবে। আস্তে আস্তে নিজেকে একটু সামলে নিয়ে দুহাতে লক্ষ্মী আর দলিল নিয়ে বসার ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালো পিকু। প্রচণ্ড আনন্দ হচ্ছে কিন্তু তার সাথে কিরকম একটা ভয়ও করছে। 

কৌশিক আর সুব্রত হাঁ করে পিকুর হাতের দিকে তাকিয়ে! দুজনেই বাকরুদ্ধ। সুব্রতর চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে! মুখে কিরকম একটা বিস্ময় আর খুশি মেশানো ভাব। কৌশিকও কিরকম হা করে পিকুর দিকে তাকিয়ে আছে। ফিসফিস করে বলে উঠল

— “ভাগ্নে! তুমি তো কামাল করে দিয়েছো।” তারপর আনন্দে পিকুর হাতদুটো চেপে ধরে বলো – “কিভাবে করলে বলো তো? আমাদেরও একটু বুঝিয়ে দাও!” পিকু এবার কৌশিক আর সুব্রতকে  সঞ্জয় সেনের ঘরে নিয়ে গিয়ে ছড়াগুলো পড়ে পড়ে পুরো ব্যাপারটা এক্সপ্লেইন করলো। প্রথমে ভালো করে বুঝিয়ে বলল কীভাবে সে  ছড়ার খাতার ঠিক পাতা খুঁজে বার করেছে আর তার পরে কিভাবেই বা নিউম্যারিক কি প্যাড দেওয়া লকার পর্যন্ত পৌঁছেছে। 

 এরপর  পাসওয়ার্ড বার করার পর্ব – এ  ব্যাপারে  পিকুর যুক্তি হল পাসওয়ার্ডের সংখ্যাটা লুকিয়ে আছে এই কটা  লাইনে:

 কোথায় কি পাই কখানা যে পাই
শুরু থেকে আজ শেষে,
ফোঁটা ছাড়া খেলে গোটা সন্দেশ
ভাগ্য দাঁড়ায় হেসে।
           

প্রথম লাইনেই বলছে গোটা ছড়ায় কখানা ‘পাই’ আছে গুনতে।পিকুর মতে এখানে ‘পাই’  মানে হল ‘π’ ! 

সব মিলিয়ে গোটা ছড়াটাতে ছখানা π আছে। আমরা সবাই জানি ‘π’ এর এ্যাপ্রক্সিমেট হচ্ছে 3.14.

তাহলে ছয় কে 3.14 দিয়ে গুণ করলে গুণফল হয় 18.84. এরপরে শেষ লাইনটা, এই লাইনটাতে  সঞ্জয় বাবু মাস্টার স্ট্রোক দিয়েছেন। বলেছেন : “ফোঁটা ছাড়া খেলে গোটা সন্দেশ” – এখানে ফোঁটা মানে পয়েন্ট বা দশমিক আর সন্দেশ মানে মেসেজ। যদি 18.84 সংখ্যাটা একটা মেসেজ হয় তাহলে দশমিক বাদ দিয়ে গোটা মেসেজটা পড়লে সেটা দাঁড়ায় 1884. আর সেটাই হলো ফাইনাল পাসওয়ার্ড। 

 এসব শুনে  কৌশিক পিকুকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠল

— “ভাগ্নে! ইউ আর জাস্ট এ জিনিয়াস!! চলো মামাকে খবরটা দেওয়া যাক।”

সুব্রত বাবু তো এক্কেবারে চুপ। বুঝতেই পারছেন না কী বলবেন। এইটুকু ছেলের কি সাংঘাতিক বুদ্ধি! আর তার থেকেও অবাক লাগছে সঞ্জয় বাবুর ট্যালেন্টের কথা ভেবে। নিজের বাবার কথা ভেবে বেশ একটু গর্ব বোধই হলো সুব্রত বাবুর, বসার ঘরে ফিরে কাজের লোক নকুলকে বললেন ভাল মিষ্টি নিয়ে আসতে। তারপর পিকুর দিকে ফিরে বললেন

— “কী খেতে ভালোবাসো বলো।” পিকু একটু লজ্জাই পাচ্ছিল, কিন্তু সুব্রত ছাড়বেনই না। শেষে মোগলাই পরোটা, রসগোল্লা আর চা এল। সুব্রত বাবুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে কৌশিক আর পিকু সোজা ভবানী ভবন চলে এল। সব শুনে সন্তুতো দারুণ খুশি, উচ্ছ্বসিত হয়ে  বলে উঠল 

— “আমি জানতাম ও ঠিক পারবে!” তারপর কৌশিকের দিকে তাকিয়ে বললো
— “ কি কৌশিক! আমার ভাগ্নেকে তো কোনও পারিশ্রমিক দিলে না! অন্তত লাঞ্চ তো খাওয়াও!”
— “একশোবার! চলো যাওয়া যাক! কোথায় যাবে বলো  ভাগ্নে!” কৌশিক উত্তর দিল। 

পিকু বলল

— “পেট প্রচন্ড ভরা। আজ আর পারব না। তার থেকে অন্য একদিন যাবো।”

যাইহোক, লাঞ্চ না হলেও  চা আর সিঙাড়া খাওয়া হল। চা সিঙাড়া খেয়ে সন্তু বললো

— “চল তোকে আজকে আমি বাড়ি ড্রপ করে দেব। অনেকদিন দিদির সঙ্গে দেখাও হয়না। কি কৌশিক! আসবে নাকি?” কৌশিকও রাজি।

বাড়ি পৌঁছে পিকু মাকে খবরটা দিল, মামা এসেছে। ভাইকে দেখে দিদি তো দারুণ খুশি। ভাইয়ের মুখে পিকুর কর্মকান্ড শুনে মা বললেন–

— “আজকাল বুঝি এইসব করে বেড়ানো হচ্ছে! পড়শোনা তো করতেই দেখি না। তুই কিন্তু ওর মাথাটা খাচ্ছিস সন্তু।“  

এসব শুনে কৌশিক আর চুপ করে থাকতে না পেরে বলে উঠল

— “না দিদি! পিকু কিন্তু জাস্ট একটা জিনিয়াস।”

ঠাকুমা পাশে বসে সব শুনছিলেন । এবার তিনি বললেন

— “হইবেই তো! অর দাদু মানে আমার ভাসুর, হেয় ছিল গিয়া গেরামের পেরাইভেট ডিফেকটিভ!”
— “উফ্ ঠাম্মা তুমি পারোও বটে! ওটা ডিফেকটিভ না ডিটেকটিভ”। পিকু্র শোধরাবার চেষ্টা।
— “হ বুজঝি! দুইডাই সমান! তগো ডিটেকটিভরেই আমাগো দ্যাশে ডিফেকটিভ কয়!”  বুড়ি ফোকলা দাঁতে হাসতে হাসতে উত্তর দিলেন।

Aroop Dasgupta Author

পড়াশোনা করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেডিয়ো ফিজিক্স বিভাগে। পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন তথ্য প্রযুক্তিকে। প্রায় এগারো বছর নানা বহুজাতিক সংস্থার সাথে যুক্ত থাকার পর উনিশশো সাতানব্বইতে তৈরি করেন নিজের তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা। বর্তমানেও যুক্ত রয়েছেন সেই সংস্থার পরিচালনার দায়িত্বে। কাজের জগতের ব্যস্ততার ফাঁকে ভালবাসেন গান-বাজনা শুনতে এবং নানা বিষয়ে পড়াশোনা করতে। সুযোগ পেলেই বেড়াতে বেরিয়ে পড়েন আর সেই অভিজ্ঞতা ধরে রাখেন ক্যামেরায়।

3 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *